সাহিত্যিকা

পর্দানসীন যুগের নক্ষত্র (ধারাবাহিক) (প্রথম পর্ব)

পর্দানসীন যুগের নক্ষত্র (ধারাবাহিক) (প্রথম পর্ব)
@চন্দন গুহ, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

প্রথম পর্ব: প্রীতিলতা ওয়াহেদেদার
নারীদিবস উপলক্ষে কয়েকজন স্মরণীয়া মহিলার স্মৃতিচারণ করবো যারা তাঁদের অদম্য মনোবল ও ইচ্ছাশক্তির উপর ভরসা করে নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে নক্ষত্রের মতো জ্বল জ্বল করছেন।

প্রীতিলতা ওয়াহেদেদার
তাঁদের পরিবারের আদি পদবী ছিল দাশগুপ্ত। পরিবারের কোন এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে “ওয়াহেদেদার” উপাধি পেয়েছিলেন, এই ওয়াহেদেদার থেকে ওয়াদ্দেদার বা ওয়াদ্দার।

যে বয়সে একজন শিক্ষিতা যুবতী জীবনের রুপ রস গন্ধ উপভোগ করে আনন্দ লাভ করে, সেই বয়সে স্বাধীনতা বিপ্লবী প্রীতিলতা শাসকদের হাত থেকে গ্রেফতারী এড়াতে সায়নাইড খেয়ে মৃত্যু বরণ করেছিলেন, মাত্র একুশ বছর বয়সে।

প্রীতিলতার বাবা জগবন্ধু ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপালিটির করণিক, মা প্রতিভাময়ী দেবী ছিলেন গৃহবধু। পরিবারের চার বোন ও দু’ভাই এর মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। মধ্যবিত্ত সংসারে পিতা জগবন্ধু ছিলেন ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রতি খুবই যত্নশীল। ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামের ডঃ খাস্তগীর গভঃ হাই স্কুলে প্রীতিলতা তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। প্রতি ক্লাসের পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য তিনি ছিলেন শিক্ষকদের খুবই প্রিয়। তাঁদেরই একজন, ইতিহাসের ঊষাদি, সবার মনে দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্য ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই এর গল্প শোনাতেন। স্কুলে প্রীতিলতার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন এক ক্লাসের বড় কল্পনা দত্ত (পরবর্তীকালে বিপ্লবী)। ওঁরা একসাথে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। তাঁদের স্বপ্নের কথা লিখেছেন কল্পনা দত্ত: “কোন কোন সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময়ে ঝাঁসীর রানী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করলাম।” কল্পনা দত্ত “চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন” বইতে লিখেছিলেন, “স্কুলে আমাদের পরবর্তী জীবনের কোন লক্ষ ছিল না, ঊষাদির কাছে শোনা গল্পে আমরা উদ্দীপ্ত হয়ে সাহস সঞ্চয় করতাম”।

১৯২৩-এর ১৩ ডিসেম্বর সূর্য সেনের বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারী ১৭,০০০ টাকা ছিনতাই করে। এ ছিনতাইয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক চলাকালীন বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সাথে যুদ্ধের পর গ্রেফতার হন সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। তাদের বিরুদ্ধে রেলওয়ে ডাকাতি মামলা দায়ের করা হয়। এই ঘটনা কিশোরী প্রীতিলতার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এরপর ১৯২৪ সালে বেঙ্গল অর্ডিনান্স আইনে বিপ্লবীদের বিনাবিচারে আটক করা হয়। প্রীতিলতার নিকট-আত্মীয় পূর্নেন্দু দস্তিদার তখন বিপ্লবী দলের কর্মী। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রাখেন। প্রীতিলতা তখন দশম শ্রেনীর ছাত্রী। লুকিয়ে তিনি পড়েন “দেশের কথা”, “বাঘা যতীন”, “ক্ষুদিরাম” ও “কানাইলাল”। এগুলি পড়ে প্রীতিলতা দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছে বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত বিপ্লবীদলে মহিলা সদস্য গ্রহণ করা হতো না।

১৯২৬ সালে প্রীতিলতা সংস্কৃত পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। এবং ১৯২৮ সালে কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস সহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। অঙ্কের নম্বর কম ছিল বলে তিনি বৃত্তি পাননি। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বন্ধের সময় তিনি নাটক লেখেন এবং মেয়েরা চৌকি দিয়ে তৈরী মঞ্চে সে নাটক পরিবেশন করেন। এই সময়ে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু প্রীতিলতার প্রবল আপত্তির কারণে বিয়ের ব্যবস্থা তখনকার মতো স্থগিত হয়ে যায়। আই.এ. পড়ার জন্য তিনি ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। ১৯২৯/৩০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সকলের মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। এই ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পান এবং কলকাতার সেই সময়ের বিখ্যাত বেথুন কলেজ়ে বি এ স্নাতক বিভাগে ভর্তি হন। প্রীতিলতা দর্শনের পরীক্ষায় ক্লাসের সেরা ছাত্রী ছিলেন। এই বিষয়ে তিনি অনার্স করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিপ্লবের সাথে যুক্ত হবার কারণে অনার্স পরীক্ষা তাঁর আর দেয়া হয়নি। তবে ১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেন। দু’বছর পর তিনি পাশ করেন, কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী বৈপ্লবিক গতিবিধি সন্দেহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ওঁনাকে এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তকে ডিগ্রী থেকে বঞ্চিত করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘ আশি বছর পার হয়ে গিয়ে প্রীতিলতার স্মৃতি যখন জনমানসে মলিন হয়ে গিয়েছিল, তখন ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রীতিলতা ও বীনা দাশকে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করে নিজেদের লজ্জা ও গ্লানিমা মুক্ত করেন।

ঢাকায় যখন প্রীতিলতা পড়তে যান তখন “শ্রীসংঘ” নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন লাঠিখেলা, কুস্তি, ডনবৈঠক, মুষ্টিযুদ্ধ ইত্যাদি শিক্ষার জন্য বিভিন্ন ক্লাব তৈরী করেছিল। ঢাকায় শ্রীসংঘের “দীপালী সঙ্ঘ” নামে একটি মহিলা শাখা ছিল। লীলা নাগ (বিয়ের পর লীলা রায়) এর নেতৃত্বে এই সংগঠনটি নারীশিক্ষা প্রসার ও গোপনে মেয়েদের বিপ্লবী সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ করত। ইডেন কলেজের শিক্ষিকা নীলিমা’দির মাধ্যমে লীলা রায়ের সাথে প্রীতিলতার পরিচয় হয়। দীপালী সঙ্ঘে যোগ দিয়ে প্রীতিলতা লাঠিখেলা, ছোরাখেলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছিলেন “আই এ পড়ার জন্য ঢাকায় দু’বছর থাকার সময় আমি নিজেকে মহান মাস্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসাবে নিজেকে গডে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি”।

১৯২৯ সালের মে মাসে সূর্য সেন ও তার সহযোগী পূর্ণেন্দু দস্তিদারের উদ্যোগে চট্টগ্রামে নারী সম্মেলনের আয়োজন হয়। মহিলা কংগ্রেস নেত্রী লতিকা বোসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে প্রীতিলতা ঢাকা থেকে এবং তার বন্ধু ও সহযোদ্ধা কল্পনা দত্ত কলকাতা থেকে এসে যোগদান করেন।

১৯৩০ সালের ১৯ এপ্রিল আই এ পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। আগের দিন রাতেই চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের যুব বিদ্রোহ আক্রমণে ধ্বংস হয় অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, টেলিফোন অফিস এবং রেললাইন। বিপ্লবীমনস্কা প্রীতিলতা লিখেছিলেন “পরীক্ষার পর ঐ বছরেরই ১৯শে এপ্রিল সকালে বাড়ি ফিরে আমি আগের রাতে চট্টগ্রামের বীর যোদ্ধাদের মহান কার্যকলাপের সংবাদ পাই। ঐ সব বীরদের জন্য আমার হৃদয় গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত হল। কিন্তু ঐ বীরত্বপুর্ণ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে না পেরে এবং নাম শোনার পর থেকেই যে মাষ্টারদাকে গভীর শ্রদ্ধা করেছি তাঁকে একটু দেখতে না পেয়ে আমি বেদনাহত হলাম।”

চট্টগ্রামে সূর্য সেনের কাছে বোমা পৌঁছে দিয়ে কলকাতা ফেরত আসার একদিন পরেই ২৪ নভেম্বর মনোরঞ্জন রায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সে সময়ে বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ টি জে ক্রেগ চট্টগ্রাম সফরে আসেন। তাকে হত্যা করার জন্য রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালীপদ চক্রবর্তীকে নিয়োগ করা হয়। পরিকল্পনা অনু্যায়ী ১৯৩০ সালের ২রা ডিসেম্বর চাঁদপুর রেলস্টেশনে তাঁরা রিভলবার নিয়ে আক্রমণ চালায় কিন্তু ভুল করে মিঃ ক্রেগের পরিবর্তে তাঁরা চাঁদপুরের এস ডি ও তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করেন। সেদিনেই পুলিশ বোমা আর রিভলবার সহ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করে। এই হত্যা মামলার রায়ে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মৃত্যুদন্ড এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে নির্বাসন দন্ড দেয়া হয়। প্রীতিলতা তখন কলকাতায় বেথুন কলেজের ছাত্রী। রামকৃষ্ণ যখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী ছিলেন, তখন আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষের কাছে “অমিতা দাস” ছদ্মনামে “কাজিন” পরিচয় দিয়ে প্রীতিলতা দরখাস্ত করেন, ও জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতিতে অনেকবার রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন। এ সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন “তাঁর (রামকৃষ্ণ বিশ্বাস) গাম্ভীর্যপুর্ণ চাউনি, খোলামেলা কথাবার্তা, নিঃশঙ্ক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, ঈশ্বরের প্রতি অচলা ভক্তি, শিশুসুলভ সারল্য, দরদীমন এবং প্রগাঢ় উপলব্দিবোধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করল। আগের তুলনায় আমি দশগুন বেশি কর্মতৎপর হয়ে উঠলাম। আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত এই স্বদেশপ্রেমী যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ আমার জীবনের পরিপূর্ণতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল।” ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসী হয়। এই ঘটনা প্রীতিলতার জীবনে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। তার ভাষায় “রামকৃষ্ণদার ফাঁসীর পর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা আমার অনেক বেড়ে গেল।“

বি এ পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে বাড়ি এসে দেখেন তাঁর পিতার চাকরি নেই। সংসারের অর্থকষ্ট মেটানোর জন্য তখন তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে বিশিষ্ট দানশীল ব্যক্তি অপর্ণাচরণ দে’র সহযোগিতায় তিনি নন্দনকানন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের (বর্তমানে অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়) প্রধান শিক্ষিকা পদে নিযুক্ত হন। এখানেই তিনি মাস্টারদা’র দলের সাথে যুক্ত হন। পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবের উপর সসস্ত্র হামলার পরিকল্পনায় প্রীতিলতা তার নেতৃত্ব করেন। বিপ্লবীদলের সদস্যরা ছদ্মবেশ ধারন করে, চারটি দলে বিভক্ত হয়ে রাতে ক্লাব আক্রমণ করেন, আগুন লাগিয়ে দেন। সেই আক্রমণে একজন ইউরোপিয়ান মহিলা মারা যান, আর কিছু মহিলা ও পুরুষ আহত হয়েছিলেন। প্রীতিলতা পুলিশের ফাঁদে ধরা পড়ার আগেই সায়নাইড খেয়ে আত্মহুতি দেন।

দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আটাত্তরটি বছর হয়ে গেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বা বৈপ্লবিক ঘটনায় কত শত সহস্র মানুষ যে জীবনের বলিদান দিয়েছিলেন সেই কাহিনী আজ লোকে হয়ত ভুলে গেছেন, কিন্তু যে আদর্শ সামনে রেখে প্রীতিলতারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তার কখনও মৃত্যু হবে না, ওঁনারা অমর থাকবেন, উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো।

******

প্রীতিলতা লিখেছেন “১৯৩২ সালে বি এ পরীক্ষার পর মাষ্টারদার সাথে দেখা করবই এই প্রত্যয় নিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম”। মাষ্টারদা সূর্য সেনের সাথে সাক্ষাতের আগ্রহের কথা তিনি কল্পনা দত্তকে আগেই বলেছিলেন। ১৯৩১ সালে কল্পনা দত্তের সাথে গোপন সাক্ষাতের সময় মাষ্টারদা প্রীতিলতা সম্পর্কে জানতে চান। প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহেই কল্পনা দত্ত একদিন রাতে গ্রামের এক কুটিরে তাঁর সাথে নির্মল সেনের পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৩২ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে ঐ সাক্ষাতে নির্মল সেন প্রীতিলতাকে পরিবারের প্রতি কেমন টান আছে তা জানতে চাইলেন। জবাবে তিনি বলেন “টান আছে। কিন্তু duty to family-কে duty to country-র কাছে বলি দিতে পারব”। পরে প্রীতিলতার কথা মাষ্টারদা লিখেছেন “অল্প কয়েকদিন পরেই নির্মলবাবুর সঙ্গে আমার দেখা হতেই নির্মলবাবু আমায় বলল: আমি রাণীকে (প্রীতিলতার ডাক নাম) কথা দিয়েছি আপনার সঙ্গে দেখা করাব, সে এক সপ্তাহের জন্য যে কোন জায়গায় আসতে রাজ়ী আছে। রামকৃষ্ণের সঙ্গে সে ফাঁসীর আগে দেখা করেছে শুনেই তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা হয়েছিল। তার দেখা করার ব্যাকুলতা শুনে রাজী হলাম এবং কয়েকদিনের মধ্যে (মে মাসের শেষের দিকে) তাকে আনার ব্যবস্থা করলাম”। মাষ্টারদা এবং প্রীতিলতার প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনাতে মাষ্টারদা লিখেছেন “তার চোখেমুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম। এতদূর পথ হেঁটে এসেছে, তার জন্য তার চেহারায় ক্লান্তির কোন চিহ্নই লক্ষ্য করলাম না। যে আনন্দের আভা তার চোখে মুখে দেখলাম, তার মধ্যে আতিশয্য নেই, Fickleness নেই, Sincerity শ্রদ্ধার ভাব তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। একজন উচ্চশিক্ষিত cultured lady একটি পর্ণকুটিরের মধ্যে আমার সামনে এসে আমাকে প্রণাম করে উঠে বিনীতভাবে আমার দিকে দাঁড়িয়ে রইল, মাথায় হাত দিয়ে নীরবে তাকে আশীর্ব্বাদ করলাম…”। মাষ্টারদা আরো লিখেছেন “তার action করার আগ্রহ সে পরিষ্কার ভাবেই জানাল। বসে বসে যে মেয়েদের organise করা, organisation চালান প্রভৃতি কাজের দিকে তার প্রবৃত্তি নেই, ইচ্ছাও নেই বলে”। এরপর তিন দিন ধরে ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী দেবীর বাডিতে অবস্থানকালে আগ্নেয়াস্ত্র triggering এবং targeting এর উপর প্রীতিলতা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

১৯৩২ সাল–চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের দুই বছরের মধ্যে বিপ্লবীদের অনেকেই নিহত এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন। আক্রমণের নানা পরিকল্পনার পরেও বিপ্লবীরা নুতন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারে নি। মাষ্টারদা ও নির্মল সেন তখন গ্রাম থেকে গ্রামে বিভিন্ন আশ্রয়স্থলে ঘুরে ঘুরে সাংগঠনিক কাজ করছেন। এই আশ্রয়স্থলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর টিনের ছাউনি দেয়া মাটির দোতলা বাড়িটা। পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামটি ছিল বিপ্লবীদের অতি শক্তিশালী গোপন আস্তানা, নাম ছিল “আশ্রম”। বিধবা সাবিত্রী দেবী বিপ্লবীদের কাছে ছিলেন “সাবিত্রী মাসিমা”। অন্যদিকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ও জালালাবাদ যুদ্ধের পর থেকেই এই গ্রামে ছিলো মিলিটারি ক্যাম্প। সাবিত্রী দেবীর বাড়ি ছিল ঐ ক্যাম্প থেকে মাত্র দশ মিনিটের দূরত্বে। আর এই আশ্রমেই মাস্টারদা ও নির্মল সেন অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে সাক্ষাত করতেন।

বিপ্লবী দলের মহিলাদের পরিবারের প্রতি গোয়েন্দা বিভাগের পরামর্শ ছিল, “দ্য পেরেন্টস অর গার্ডিয়ানস অব দিজ় উইমেন শুড বি ওয়ার্নড দ্যাট দে উইল বি অ্যারেস্টড ইফ ফারদার রেভলিউশনারি অ্যাক্টিভিটি অন দেয়ার পার্ট(স) কামস টু লাইট, সো প্লিজ় টু বি আস্কড টু কিপ আ ওয়াচ ওভার দেম” (আইবি রিপোর্ট ফাইল নং ২২৩/১৯১৯)। সেই সময় ১৯৩২ সালের ১২ জুন তুমুল ঝড়বৃষ্টির রাতে মাষ্টারদার দূতের মাধ্যমে একজন প্রীতিলতাকে আশ্রমে নিয়ে আসেন। বাড়িতে প্রীতিলতা তাঁর মাকে সীতাকুন্ড যাবার কথা বলেন। মা-বাবা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি, কী উদ্দেশ্যে প্রীতিলতা ঘর ছেড়েছেন।

সেই রাতে মাষ্টারদা এবং নির্মল সেন ছাড়া ঐ বাড়িতে তখন ছিলেন ডিনামাইট ষড়যন্ত্র মামলার পলাতক তরুন বিপ্লবী অপূর্ব সেন (ভোলা)। ১৩ জুন সন্ধ্যায় সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে বিপ্লবীদের অবস্থানের কথা পটিয়া পুলিশ ক্যাম্প জানতে পারে, আর ক্যাম্পের অফিসার-ইন-চার্জ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন ঐ বাড়িতে অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পুরস্কার এবং পদোন্নতির আশায় ক্যাপ্টেন ক্যামেরন সদলে রাত প্রায় ৯টার দিকে ধলঘাটের ঐ বাড়িতে উপস্থিত হন। খানিক আগেই মাষ্টারদা এবং প্রীতিলতা দোতলা বাড়ির নীচতলার রান্নাঘরে ভাত খেতে বসেছিলেন। জ্বরের কারণে নির্মল সেন এবং ভোলা রাতের খাওয়া বাদ দিয়ে উপরের তলায় শুয়ে ছিলেন। এমন সময় মাষ্টারদা ঘরের ভিতরের মই বেয়ে দোতলায় উঠে জানিয়ে দেন যে পুলিশ এসেছে। মাষ্টারদা প্রীতিলতাকে নিচে নেমে এসে মেয়েদের সাথে থাকার নির্দেশ দেন। ততক্ষনে সিপাহী এবং কনষ্টেবলরা ঘর ঘিরে ফেলেছে। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এবং সাব-ইন্সপেক্টর মনোরঞ্জন বোস ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরের একতলায় থাকা সাবিত্রী দেবী ও তার ছেলেমেয়েকে দেখতে পান। এসময় ঘরের উপরের তলায় পায়ের আওয়াজের শব্দ শুনে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন রিভলবার হাতে সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতেই নির্মল সেনের গুলিতে মারা যায়। গুলির শব্দে ঘরের চারিদিকে থাকা সৈন্যরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। একটি গুলি নির্মল সেনের বুকে লাগে এবং প্রচুর রক্তক্ষরনে তাঁর মৃত্যু হয়। টাকাপয়সা এবং কাগজপত্র গুছিয়ে প্রীতিলতা এবং অপুর্ব সেনকে সঙ্গে নিয়ে মাষ্টারদা অন্ধকারে ঘরের বাইরে আসেন। আমের শুকনো পাতায় পায়ের শব্দ শুনে সিপাহীদের চালানো গুলিতে অপুর্ব সেন মারা যান। মাষ্টারদা আর প্রীতিলতা তখন রাতের অন্ধকারে কচুরিপানা ভরা পুকুরে সাঁতার দিয়ে ও কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে পটিয়ার কাশীয়াইশ গ্রামে দলের কর্মী সারোয়াতলী স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্র মনিলাল দত্তের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছান। মণিলাল দত্ত তাঁদের ধলঘাট থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে পাহাড়, জঙ্গল এবং নদীর কাছাকাছি গ্রাম জৈষ্ট্যপুরায় নিরাপদ কোন আশ্রয়ে নিয়ে যেতে মনস্থির করেন। পুলিশ যদি আসে তখন পাহাড় এবং জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা যাবে অথবা নদী পার হয়ে অন্য আশ্রয়ে যাওয়া যাবে। অনেক প্রতিকূল পথ অতিক্রমের পর তারা জৈষ্ট্যপুরা গ্রামে বিপ্লবীদের আরেকটা গোপন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছান। ঐ গুপ্ত আস্তানাটি বিপ্লবীদের কাছে “কুটির” নামে পরিচিত ছিল। ঐ কুটিরে তখন আত্মগোপনে ছিলেন সুশীল দে, কালীকিংকর দে এবং মহেন্দ্র চৌধুরী। সূর্য সেন পরের দিন প্রীতিলতাকে বাড়ি যাওয়ার নির্দেশ দেন। এর আগে সূর্য সেনের নির্দেশে মণিলাল প্রীতিলতার বাসায় পুলিশের নজরদারী আছে কিনা তা জানতে শহরে আসেন। সব কিছু ঠিক আছে জানার পর প্রীতিলতাকে বাড়ি গিয়ে স্কুল শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়।

“চট্টগ্রামে সৈন্য ও বিপ্লবীদের সংঘর্ষ” শিরোনামে ধলঘাট সংঘর্ষের খবরটা ১৫ জুন ১৯৩২ সালে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ঃ
“এইমাত্র সংবাদ আসিয়াছে যে, গতরাত্রে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার নিকটে বিপ্লবী ও সৈন্যদের এক সংঘর্ষ হইয়া গিয়াছে। ফলে গুর্খা বাহিনীর ক্যাপ্টেন ক্যামেরন ও দুইজন বিপ্লবী নিহত হইয়াছেন। বিপ্লবীদের নিকট দুইটি রিভলবার ও গুলি ইত্যাদি পাওয়া গিয়াছে। নিহত বিপ্লবীদের একজনকে নির্মল সেন বলিয়া শনাক্ত করা হইয়াছে।”

ধলঘাট সংঘর্ষে ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের মৃত্যুর পর পুলিশের এস. আই মনোরঞ্জন বোস পটিয়ার মিলিটারী ক্যাম্পে গিয়ে আরো ত্রিশজন সৈন্য এবং একটা লুইস গান নিয়ে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে ফিরে আসে। সকালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও সেনাধ্যক্ষ মেজর গর্ডন ঘটনাস্থলে আসে। সাবিত্রী দেবী এবং তার পুত্রকন্যাকে বিপ্লবীদের আশ্রয় দেবার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। কন্যা স্নেহলতার জবানবন্দিতে আরো তিন যুবক – দীনেশ দাশগুপ্ত, অজিত বিশ্বাস এবং মনীন্দ্র দাশকে আটক করা হয়। পরবর্তীকালে সাবিত্রী দেবী, তার পুত্র রামকৃষ্ণ, এবং এই তিন যুবককে বিপ্লবীদের আশ্রয় এবং সহায়তা করার দায়ে চার বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। ঘরের ভেতর চালানো তল্লাশীতে রিভলবার, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও প্রীতিলতার ছবি, কিছু চিঠি এবং দুটি বইয়ের পান্ডুলিপি পাওয়া যায়।

ছবি পাওয়ার পর ১৯ জুন পুলিশ প্রীতিলতার বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ২২ জুন এস.আই শৈলেন্দ্র সেনগুপ্তর নেতৃত্বে একটি দল ঐ বাড়িতে আরেক দফা তল্লাশি চালায়। আশেপাশের জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়। জঙ্গল এবং আশেপাশের পুকুরে তল্লাশীতে অনেক কাগজপত্র উদ্ধার হয়। তল্লাশি অভিযানে কাজিন পরিচয়ের অমিতা দাশের (প্রীতিলতার) আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসির প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে সাক্ষাতের হাতে লেখা একটা বিবরন পাওয়া যায়। ঐ হাতের লেখার সাথে মেলানোর জন্য ৩০ জুন প্রীতিলতার বাসা থেকে পুলিশ তার গানের একটা বই নিয়ে যায়। মাষ্টারদা তখন প্রীতিলতাকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন।


প্রীতিলতাকে ধরার জন্য বেঙ্গল পুলিশের সি আই ডি কর্তৃক প্রকাশিত ছবিসহ নোটিশ।
৫ জুলাই মনিলাল দত্ত এবং বীরেশ্বর রায়ের সাথে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে প্রীতিলতা আত্মগোপন করেন। ছাত্রী পড়ানোর কথা বলে তিনি বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর যোগেন গুপ্ত আরেক নারী বিপ্লবী কল্পনা দত্তের বাড়িতে যান। কল্পনা দত্ত ঐ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখেন “আমাদের বাসায় এসে গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর বলে: এত শান্তশিষ্ট নম্র মেয়ে ও, এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে, ভাবতেও পারি না তার ভিতর এত কিছু আছে! আমাদের খুব ফাঁকি দিয়ে সে পালিয়ে গেল।”

চট্টগ্রাম শহরের গোপন আস্তানায় কিছু দিন কাটিয়ে প্রীতিলতা পড়ৈকড়া গ্রামের রমণী চক্রবর্তীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। বিপ্লবীদের আরেক গোপন আস্তানা এই বাড়িটার সাংকেতিক নাম ছিল “কুন্তলা”। এই বাড়িতে তখন আত্মগোপনে ছিলেন মাষ্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদার। প্রীতিলতার আত্মগোপনের খবর ১৩ জুলাই ১৯৩২ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। “চট্টগ্রামের পলাতকা” শিরোনামের এই সংবাদে লেখা হয় “চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ধলঘাটের শ্রীমতী প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার গত ৫ই জুলাই, মঙ্গলবার চট্টগ্রাম শহর হইতে অন্তর্ধান করিয়াছেন। তাঁহার বয়স ১৯ বৎসর। পুলিশ তাঁহার সন্ধানের জন্য ব্যস্ত”। প্রীতিলতাকে ধরার জন্য বেঙ্গল পুলিশের সি আই ডি কর্তৃক প্রকাশিত ছবিসহ নোটিশটি ছিল নিম্নরূপঃ “Waddadar, whose photographs are published above. Photograph No 1 was taken 2 years ago when Miss Prithi was a student of the Dacca Eden Intermediate College and photograph No. 2 (sitting postures), which is a more recent one, was found at the time of search of one Apurba Sen alias Bhola (since deceased), in connection with Dhalghat shooting affray at Chittagong. A Special “look-out” should be kept for her and when traced, the I.B., C.I.D., Bengal, Calcutta, should be informed by wire. A close, though unobtrusive, surveillance should at the same time be kept on her movements.
Description—Miss Prithi Waddadar, daughter of Jagabandhu Waddadar (Baidya by caste), of Dhalghat, Patiya and Jamalkhana, Chittagong town: age 20/21 (looks younger than her age); dark; medium build; short; ugly in appearance.”

সেই সময়ের পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাবের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “ডগ এন্ড ইন্ডিয়ান প্রহিবিটেড”। আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা সেই ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা শুরু করেন। চট্টগ্রাম শহরের কাছে দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামে ঐ ক্লাবেরই একজন বেয়ারা যোগেশ মজুমদারের বাড়িতে বিপ্লবীরা আশ্রয় নেন। ১৯৩২ এর ১০ আগস্ট ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর প্রতিজ্ঞা ছিল ক্লাব আক্রমণের কাজ শেষ হবার পর নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার যদি সুযোগ থাকে তবুও তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর রাতে কাট্টলীর সমুদ্রসৈকতে তার মৃতদেহ সমাহিত করা হয়।

মাষ্টারদা ১৯৩২ এর সেপ্টেম্বর মাসে আবার ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি মনস্থির করেছিলেন যে এই আক্রমণের দায়িত্ব কোন একজন নারী বিপ্লবীদের উপর দেবেন। সাতদিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পরে গেলে আক্রমণে নেতৃত্বের ভার পড়ে একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার উপর।

২৩ সেপ্টেম্বর এর আক্রমণে প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা। ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোশাক পড়ানো হয়েছিল। আক্রমণে অংশ নেওয়া কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী পোশাক ছিল ধুতি আর শার্ট। লুঙ্গি আর শার্ট পরনে ছিলেন মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেন। বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার (বিপ্লবীদের দেয়া তার গোপন নাম ছিল জয়দ্রথ) ক্লাবের ভিতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ এ সংকেত দেখানোর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করে। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী। ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস। প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণের নির্দেশ দিতেই চতুর্দিক হতে গুলি ও বোমাবর্ষন শুরু হয়। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তারা পাল্টা আক্রমণ করল। একজন মিলিটারী অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতার বাঁ-পাশে গুলির আঘাত লাগে। প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে বিপ্লবী দলের সাথে তিনিও কিছুদূর এগিয়ে আসেন। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের এই আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয় এবং চারজন পুরুষ এবং সাত জন মহিলা আহত হয়। পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন। কালীকিংকর দে’র কাছে তিনি তাঁর রিভলবার জমা দিয়ে আরও পটাশিয়াম সায়ানাইড চাইলে, কালীকিংকর তা প্রীতিলতার মুখের মধ্যে ঢেলে দেন।

প্রীতিলতা ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে অংশ নেয়া অন্য বিপ্লবীদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করেন। পরদিন পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে মৃতদেহ দেখে প্রীতিলতাকে শনাক্ত করে। তাঁর মৃতদেহ তল্লাশীর পর বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা, রিভলবারের গুলি, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি এবং একটি হুইসেল পাওয়া যায়। ময়না তদন্তের পর জানা যায় গুলির আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না, তাঁর মৃত্যুর কারণ ছিল পটাশিয়াম সায়ানাইড।

পুলিশ তাঁর পকেটে একটি চিরকুট খুঁজে পায়: ‘লং লিভ রেভলিউশন’ নামে প্রীতিলতার মৃত্যু-পূর্ববর্তী বয়ান। তাতে যে প্রশ্নগুলো তিনি তুলেছিলেন তার উত্তর আজও মেলেনি। লিখেছিলেন, “আমি ভেবে বিস্মিত হই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী পুরুষের মধ্যে পার্থক্য থাকবে কেন? যদি দেশমাতৃকার জন্য ভাইয়েরা ভাবতে পারে এবং লড়াইয়ে সামিল হতে পারে তবে বোনেরা নয় কেন?”

বেঙ্গল চিফ সেক্রেটারী প্রীতিলতার মৃত্যুর পর লন্ডনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো একটা রিপোর্টে লেখেন:
“Pritilata had been closely associated with, if not actually the mistress of, the terrorist Biswas who was hanged for the murder of Inspector Tarini Mukherjee, and some reports indicate that she was the wife of Nirmal Sen who was killed while attempting to evade arrest of Dhalghat, where Captain Cameron fell.”

প্রীতিলতার মৃত্যুর পর কল্পনা দত্ত লিখেছেন: “প্রীতিলতার বাবা শোকে দুঃখে পাগলের মত হয়ে গেলেন, কিন্তু প্রীতিলতার মা গর্ব করে বলতেন, ‘আমার মেয়ে দেশের কাজে প্রাণ দিয়েছে’। তাঁদের দুঃখের পরিসীমা ছিল না, তবু তিনি সে দুঃখেকে দুঃখ মনে করেননি। ধাত্রীর কাজ নিয়ে তিনি সংসার চালিয়ে নিয়েছেন। প্রীতিলতার বাবা প্রীতিলতার দুঃখ ভুলতে পারেননি। আমাকে দেখলেই তাঁর প্রীতিলতার কথা মনে পড়ে যায়, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন।”

কল্পনা দত্ত ১৯৩০ সালে প্রীতিলতার বাড়িতে এক আলাপচারিতা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ “কথা হচ্ছিল, পাঁঠা কাটতে পারব কি না। আমি বলেছিলাম, ‘নিশ্চয় পারব, আমার মোটেই ভয় করে না’। প্রীতিলতা উত্তর দিয়েছিল ‘ভয়ের প্রশ্ন না, কিন্তু আমি পারব না নিরীহ একটা জীবকে হত্যা করতে’। একজন তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করল ‘কী, দেশের স্বাধীনতার জন্যও তুমি অহিংস উপায়ে সংগ্রাম করতে চাও?’ আমার মনে পড়ে প্রীতিলতার স্পষ্ট জবাব, ‘স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতেও পারব, প্রাণ নিতে মোটেই মায়া হবে না। কিন্তু নিরীহ জীব হত্যা করতে সত্যি মায়া হয়, পারব না।’”

তথ্যসুত্র:
** আনন্দবাজার পত্রিকা
** ডেইলি স্টার পত্রিকা
** উইকিপিডিয়া
** বাংলাপিডিয়া

Sahityika Admin

4 comments

  • এবারে অনেক লেখাই আমার ভালো লেগেছে।
    চট্টগ্রাম পাহাড়তলীর সশস্ত্র আক্রমণ ও বিপ্লবীদের নেতৃত্বে প্রতিলতা ওয়াদেদার এর কাহিনী স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই।

  • দারুন …. বিশেষ করে প্রীতিলতার ম্যাট্রিক পাশের সার্টিফিকেট ..

    একটা প্রশ্ন “পাহারতলির ইউরোপীয় ক্লাব” কোথায় ছিলো ? চট্টগ্রামের দিকে?

  • Thanks for the author and also for the magazine publishing group.
    The article is well written, with so much of history that was not known before.