সাহিত্যিকা

কলেজ থেকে সাইকেলে মূর্শিদাবাদ

কলেজ থেকে সাইকেলে মূর্শিদাবাদ
@ঝঙ্কার বাসু, ১৯৬৯ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

অতীতের স্মৃতি থেকে গৌতম, শ্যামা, বিজয় ও আমি
কলেজের প্রথম দিন থেকে গুনতে শুরু করলে দেখতে পাই যে আমি ষাট-টি বছর পেরিয়ে এসেছি। কলেজের সেই পাঁচ বছরের বন্ধুদের সাথে হৈ চৈ করে কাটানোর দিনগুলোর কথা এখনও খুব মনে পড়ে।

“মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।
পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।“

শুরুতেই আমার জায়গা হলো ঐতিহ্য-পূর্ণ ডাউনিং হস্টেলে। আজ ৫১ বছর পরে সেই ডাউনিং হলের সকলের নামধাম আর মনে থাকে না, তবে অনেকেরই চেহারাগুলো আজও আমার মনে ভাসে। আমার প্রথম রুমমেট পেলাম গৌতম বসু ও জহরলাল বসু, পরে অজয় ব্যানার্জিও আমাদের ঘরে চলে আসে। আমি, গৌতম ও অজয় এই তিনজন ছিলাম মেকানিক্যালের, আর জহর ছিল সিভিলের। ডিপার্ট্মেন্ট ভিন্ন হলেও আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের সবার ক্লাস একসাথেই হতো।

পরের দিন থেকে বন্ধুর সংখ্যাও বাড়তে থাকল, আরম্ভ হল বন্ধুদের সাথে ড্রইং বোর্ড বয়ে ক্লাসে যাওয়া, কামারশালায় গরম লোহা পেটানো, কাঠের কাজ, সার্ভে করার জন্য কলেজের মাঠে ঘুরে বেড়ানো, জ্বলন্ত বয়লারের সামনে কাজ করা, হাইড্রোলিক ল্যাবে জলের ধর্ম বোঝার চেষ্টা করা, ইলেকট্রিক মোটরের কাজ শেখা, মেশিন শপে লোহা কাটা ইত্যাদি ও বিভিন্ন বিষয়ের ল্যাবের সাথে সাথে অবসর সময়ে হস্টেলে তাস, ক্যারম, টেনিস বা নিছক আড্ডা। বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘোরা, সিনেমা দেখতে যাওয়া, ছুটিতে একসাথে বেড়াতে যাওয়ার কথা এখনও মনে পড়ে।

এলো ১৯৬৯ সাল, এবার আমাদের নিজের নিজের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের দিকে যাত্রা শুরু হবে। কে কোথায় যাবে, কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা কেউ জানি না।

Goodbye to you my trusted friend
We’ve known each other since we were nine or ten
Together we climbed hills and trees
Learned of love and A B C’s
Skinned our hearts and skinned our knees.
We had joy we had fun
We had seasons in the sun
But the hills that we climbed were just seasons
Out of time ……
(Terry Jacks এর Seasons in the Sun গান থেকে আংশিক নেওয়া)

এরপর ২০২৪ সালে হলো আবার আমাদের পুনর্মিলন,
“হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়–
আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়॥
আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।“

সেই বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই আজ আমাদের মধ্যে নেই, কারও কারও সাথে সামান্য যোগাযোগ আছে বা হয়তো যোগাযোগই নেই। কিন্তু, তাদের সাথে কলেজ জীবন কাটানোর স্মৃতি এখনও অম্লান হয়ে আছে। গৌতমের সাথে প্রথম দিনই যে গাঁটছড়া বেধেছিলাম, কলেজ জীবনের পরের পাঁচ বছর নানান ভাবে, যেমন ল্যাব বা প্রজেক্ট বা এক্সিবিসনের মডেল তৈরি ইত্যাদির পার্টনার হয়েই কেটে গেল। কলেজ ছাড়ার পরে গৌতম নিজের ব্যবসা আরম্ভ করলো ও আমি চাকরির জন্য কোলকাতার বাইরে চলে গেলাম। এখনকার মতো মোবাইলের সুযোগ না থাকলেও যখনই সম্ভব যোগাযোগ হতো।

কলেজ জীবনে গৌতমের মধ্যে প্রাণশক্তি একটু বেশীই ছিল, একটু সুযোগ পেলেই হোস্টেল ছেড়ে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাবার প্রোগ্রাম তৈরি করে নিত। ২-৩ দিনের জন্য হলেও কোন আপত্তি নেই, নিজেদের তৈরি হওয়ার জন্য দিনের থেকে ঘণ্টার হিসাবই যথেষ্ট। সে সব প্রোগ্রাম, যেমন মেকানিকালের সুবীর বসুদের বাগান বাড়িতে পিকনিক বা অর্ধসমাপ্ত ভারত-ভ্রমণ (মোম্বাই থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল) বা ধানবাদে সন্দীপ বসুর দিদির বাড়ি (মাঝরাতে পৌঁছেছিলাম) বা মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ, সবই ছিল একেকটা ছোটখাটো অভিযান। তখন মোবাইল ক্যামেরার চল আরম্ভ হয়নি বলে ছবি বিশেষ তোলা না হলেও অজন্তার কেভের নীচে এক ঝর্ণায় স্নান বা দৌলতাবাগ ফোর্টের কথা এখনও চোখের সামনে ভাসে। অজন্তায় পরেও বেড়াতে গেছি, কিন্তু সেই ঝর্ণা আর দেখতেই পেলাম না, আর এখন অনেক কেভেই ঢোকা বারণ, দৌলতাবাগ দুর্গেও এবার বেশি উঁচুতে উঠতে দিল না।

ফোর্থ ইয়ারের ডিসেম্বরের শীতের ছুটিতে গৌতম হুজুগ তুললো, সাইকেলে মুর্শিদাবাদ যাওয়া হবে। কয়েক মাস আগের অসমাপ্ত ভারত ভ্রমণের কথা মনে করেই বোধহয়. উৎসাহ ও জেদ বেশি ছিল। ঠিক হয়ে গেল গৌতম, বিজয় ভৌমিক ও শ্যামাপদ ভট্টাচার্য যাবে, ওদের নিজেদের সাইকেল আছে, কিন্তু আমার সাইকেল ছিলনা, তার উপর অনেক দিন সাইকেল চালাইনি। আমার অসুবিধার কথা জানাতেই গৌতম নিজে বেতাইতলার এক সাইকেলের দোকান থেকে ভাড়া করা সাইকেলের ব্যবস্থা করে দিলে আমিও শেষপর্যন্ত দলের সাথে যোগ দিলাম। নিজেদেরকে বাইরের জগতে presentable করার জন্য কোথা থেকে যেন কালো চশমা নিয়ে এসেছিলাম। আমরা বলতাম গগলস। আমাদের সেই ৬৭-৬৮ সময়ে গগলস মানে চরম বিলাসিতা। পয়সা কোথায় পাবো? যাই হোক, এদিক ওদিক থেকে ম্যানেজ করেছিলাম।

কলেজের ছুটি হলে নির্দিষ্ট দিনে আমরা চারজন, গৌতম, বিজয়, শ্যামা ও আমি সকালে কলেজের বিখ্যাত সেন্টিনারি গেট থেকে অধ্যক্ষ অধ্যাপক দুর্গাদাস ব্যাণার্জি, প্রোক্টর ও কয়েকজন বন্ধুর শুভেচ্ছা নিয়ে সাইকেল যাত্রা শুরু করে দিলাম। সাথে প্রোক্টরের এক পরিচয় পত্র, রাস্তায় কাজে লাগতে পারে ভেবে সাথে নিয়েছিলাম। আমার তো নয়ই, অন্যদেরও সাইকেলে এত লম্বা ট্রিপ করার অভিজ্ঞতা ছিল না। সাইকেল না কি একবার শিখলে ভোলা যায় না, আমিও সেই প্রবাদ প্রমাণ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে থাকলাম। পথে দমদমে গৌতমের বাড়িতে কিছু খেয়ে আবার চলার শুরু হলো। ঠিক হলো, আমরা NH ৩৪ ধরে চলতে থাকবো, যেটা মুর্শিদাবাদ হয়ে উত্তরবঙ্গের সাথে যোগাযোগের রাস্তা। তখন রাস্তা বেশ ভালোই ছিল, কনক্রিটের তৈরি, সাইকেল চালাতে কোনও অসুবিধা নেই, তবে অনভ্যাসের জন্য পা ভারী হয়ে উঠল। মুখে চুয়িংগাম নিয়ে এগিয়ে চলেছি, একদিনে কতটা যাওয়া হবে, কোথায় থাকা হবে, কিছুই ঠিক নেই। প্রথমে ইয়ার্কি, ফাজলামি করে চলছিলাম, আস্তে আস্তে পা চলছে না, উৎসাহও কমছে। রাস্তায় একটা হাট দেখা গেল, কোনও প্রয়োজন নেই, তাও হাট দেখার জন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললাম, কিন্তু কারোরই সাইকেলে ওঠবার উৎসাহ নেই, হেঁটেই সাইকেল নিয়ে চলেছি। অন্ধকার হয়ে আসছে দেখে সাইকেলে উঠে কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়লাম রানাঘাট বাজারে। সামনেই একটা স্কুল, কাছেই থাকতেন স্কুলের হেডমাস্টারমশাই, ওনার কাছে গিয়ে প্রোক্টরের চিঠি দেখাতেই উনি দারোয়ানকে ডেকে স্কুলের এক ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে বললেন।

খানিক সময় কাটিয়ে ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। ঠিক হল, একবার বিশ্রাম নিলে হয়তো আর বেড়োতে ইচ্ছা করবে না, তাই রাতের খাওয়া শেষ করেই স্কুলে যাবো। রাতে রুটি, মাংস খাওয়ার চেষ্টা করলেও অনুভব করলাম যে সারাদিন চুয়িংগাম চিবানোর ফলে মুখের ভিতর ছাল উঠে গিয়ে সবই প্রচণ্ড ঝাল লাগছে। যাক, কোনরকমে খাওয়া শেষ করে, স্কুলে ফিরে এলাম। দারোয়ান একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে জানিয়ে দিল, আলো নেই তবে সে পরিষ্কার করে রেখেছে। কোনও খাট নেই, আমরা টর্চের সাহায্যে কোনও রকমে মাটিতে বিছানা পেতে নিলাম। দুটো পা’ই ভারী হয়ে গেছে, ব্যথাও আছে, শ্যামা জানালো ও পায়ে লাগাবার এক রকমের তেল নিয়ে এসেছে, যেটা নাকি রেসের ঘোড়ার পায়ে লাগানো হয়। আমাদের তখনকার অবস্থা রেসের ঘোড়ার থেকেও খারাপ। ঐ তেল ভালো করে পায়ে মাখিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, ঘরের পরিষ্কার জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে আমরা ময়লার দিকে শুয়ে আছি। অবশ্য, তখন আর কিছু করার নেই। উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আবার যাত্রা শুরু করা গেল, অনেকটাই সুস্থ লাগছে। প্রত্যেকেই কলকাতার ছেলে, গ্রাম বাংলার ব্যাপারে কারও অভিজ্ঞতা নেই। দুপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চললাম। মাঝে একেবার তাজা খেজুরের রস খেয়ে বেলা প্রায় এগারোটার সময় কৃষ্ণনগর এসে পৌছুলাম। ওখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য অবশ্যই কৃষ্ণনগরের চার্চ ও ঘূর্ণি অর্থাৎ কুমোরপাড়া। সেখানে দুপুরে খাওয়ার প্রধান উপকরণ ছিল কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সরভাজা ও রসমালাই। সাথে আর কী খেয়েছিলাম মনে নেই, কিন্তু এখন ডায়াবেটিসের রোগী হলেও বেশ মনে আছে, সেদিনের খাবারে ভাতের থেকে মিষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল।

ইতিমধ্যে কিছু ফটো তোলা হয়েছে। সাইকেল চালানোর সময় খালি চোখে, আর ফটো তোলার সময় কায়দা করে চোখে গগলস লাগিয়ে।
** প্রসঙ্গত বলি, সেদিনের সাদাকালো কিছু ছবি পাওয়া গেছে, শ্যামার ছেলে সৈকতের সৌজন্যে। এর জন্য ওকে অনেক ধন্যবাদ জানাই।

কৃষ্ণনগর থেকে বেড়িয়ে চলে এলাম পলাশী, রাস্তায় দেখলাম রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কষ্টিপাথরের মন্দির। নদিয়া জেলার নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর রাস্তার পাশে দে-পাড়ায় ঠাকুরতলা। সেখানে আছে একটি পুরনো মন্দির। মন্দিরে বিরাজ করছেন নৃসিংহ-দেব। একটি কষ্টিপাথরের মূর্তি, উচ্চতা প্রায় ৪ ফুট। পদতলে প্রহ্লাদ ও কোলে হিরণ্যকশিপু। বহু বছর ধরে বনে পড়ে থাকার জন্য মূর্তিটির কিছু কিছু জায়গা ভেঙে গিয়েছে। ২৫০ বছর আগে নৃসিংহদেবতলা ছিল গভীর জঙ্গলে আবৃত। হিংস্র জানোয়ারদের বিচরণক্ষেত্র। আশেপাশের গ্রামে যাতায়াতের জন্য যে বনপথটি ছিল দস্যু লুটেরাদের রাজত্ব। বহুবছর দেবতা জঙ্গলে ছিলেন। জানা যায়, গভীর জঙ্গলে একটা কষ্টি পাথরে নির্মিত দেবমূর্তি গ্রামের মানুষ উদ্ধার করেন। সেই সংবাদ নদিয়ার কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের কাছে পৌঁছায়। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর লোক লস্কর নিয়ে মূর্তিটি উদ্ধার করেন এবং সেখানে একটি মন্দির বানিয়ে দেন ও নরসিংহ দেবকে প্রতিষ্ঠা করেন। নিত্য পুজোর ব্যাবস্থাও তিনি করে দেন। পুরোহিত ছিলেন বিষ্ণপুর গ্রামের একজন ব্রাহ্মণ।

যদিও আমরা কেউ ইতিহাসের ছাত্র নয়, তাও ইতিহাস প্রসিদ্ধ পলাশীর মাঠ দেখার ইচ্ছায় সবাই নেমে পড়লাম। পলাশীর মাঠে, অবশ্য, তখন একটা পরিচিতি ফলক ও স্তম্ভ ছাড়া কিছুই দেখা গেল না। এখন শুনেছি, ওখানে একটা মিউজিয়াম হয়েছে।

পরবর্তী গন্তব্য বহরমপুর হয়ে মুর্শিদাবাদ। কাছেই ছিল তখনকার বিখ্যাত ব্যক্তি ও অ্যাডভোকেট শ্রী শঙ্করদাস ব্যানার্জির বাড়ি। ওনাকে পরিচয় পত্র দেখাতে উনি কাছেই এক কলেজে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। রাতটা ওখানে কাটিয়ে সকালে চলে এলাম বহরমপুর। রাস্তায় দেখলাম কাটরার বিখ্যাত মসজিদ, মুর্শিদাবাদ শহরের প্রতিষ্ঠাতা মূর্শিদকুলি খানের সমাধি এখানে আছে। এরপর বহরমপুর, বেশ বড় শহর, থাকার কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু, ভাগ্যচক্রে আমাদের স্থান হল বহরমপুরের বিখ্যাত জেলখানায়, তবে আসামী হিসাবে নয়। বহরমপুরের তখনকার জেলার-সাহেব কোনও এক সময় দমদমে ছিলেন, সেই সূত্রে ওনারা সবাই গৌতমকে চিনতেন। উনি রাস্তায় গৌতমকে দেখে ও আমাদের সাইকেল অভিযানের কথা শুনে সবাইকে ওনার কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন, সেই কোয়ার্টার জেলখানার ভিতরে। আমাদের বন্ধু চন্দন ও তরুণ (দুজনেই এখন আমাদের মধ্যে নেই) তখন বহরমপুরে ছিল, ওদের সাথে দেখা করে খাওয়া শেষ করে রাত্রি কাটাবার জন্য জেলখানায় চলে এলাম।

এখন যদিও রাত্রে ঠিকমতো ঘুম হয়না, সেদিন কিন্তু এক ঘুমেই সকাল। নতুন পরিবেশে উঠে দেখি, চারদিকে যারা ঘুরছে সবাই কয়েদি, ভাবতেই অস্বস্তি হচ্ছে। যাক, চা ও সামান্য কিছু খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম, উদ্দেশ্য এবার মুর্শিদাবাদ। হাজার-দুয়ারি এসে পৌঁছলাম প্রায় বেলা দশটায়। হাজার-দুয়ারি ছাড়াও আশে পাশে নবাবদের কীর্তি কলাপের নানা নিদর্শন ছড়িয়ে আছে, বেশীর ভাগ এখন মনেও নেই, সে সব বর্ণনার চেষ্টাও করছি না। ইতিমধ্যে এক সাপুড়ে এসে সাপের খেলা দেখিয়ে সাপ তাড়ানো ও নানা রোগ নিরাময়ের জন্য এক গাছের ছাল মূল (যেটা ওর মতে সামান্য মূল্যে) আমাদের গছাতে চাইল। ভাগ্যক্রমে আরেকটি ছেলে এসে শুনে আমাদের পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিল, ব্যাপারটা একেবারে জাল। সেই সাপুড়েও দেখলাম ছেলেটির কথা শুনে চলে গেছে।

এসব দেখতে দেখতেই অনেক বেলা হয়ে গেলো, কাছেই এক হোটেলে মেটের ঝোল ও ভাত খেলাম, মনে হল অমৃত, এত ভালো স্বাদ আগে কখনও পাইনি। খাওয়ার সাথে সাথে ঠিক হলো, জঙ্গীপুরের কাছে আমাদের ক্লাসের জ্ঞানরঞ্জন ব্যানার্জির বাড়িতে (জ্ঞান এখন লন্ডনের বাসিন্দা ও ড: রঞ্জন নামে বিখ্যাত), রাত কাটাবো। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে রাস্তার কথা জেনে নিলাম। কিন্তু, তখন কি জানতাম, সেই রাস্তায় সাইকেল চালানো আমাদের জন্য কত কঠিন? কিছুটা রাস্তা গরুর গাড়ি যাবার জন্য, তাও ধুলো আর গর্তে ভর্তি। সাইকেল চালাবার চেষ্টা করতেই এক একজন রাস্তায় উল্টে পড়ে যাচ্ছি। অগত্যা বেশ কিছুটা রাস্তা অতি কষ্টে হেঁটে হেঁটেই এগিয়ে গেলাম। রাস্তায় একটি স্থানীয় ছেলে আমাদের অবস্থা দেখে পরামর্শ দিল, রাস্তার দূরত্ব কম হলেও এরকম ভাবে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে, রাত্রি হয়ে যাবে, অন্ধকারে অচেনা রাস্তায় চলতে অসুবিধা হবে। যে কথাটা আগে কাউকে জানাইনি, সেটা আজকে জানাচ্ছি। ছেলেটিই বুদ্ধি দিল, একটি ট্রেন এখনই ওখান দিয়ে যাবে, একটা স্টেশনের পথ, ট্রেনে করে চলে গেলে কোনও অসুবিধা হবেনা। আমরা, অগত্যা, ট্রেনে চেপে বসলাম, দেখলাম টিকিট কাটার ব্যাপারই নেই। ট্রেনে গরু, ছাগল নিয়ে লোকে চলেছে, আমরাও সাইকেল নিয়ে উঠে পড়লাম। পরের স্টেশনে নেমে পড়লাম, জ্ঞানের গ্রামের নাম ছাড়া কিছুই জানা ছিলনা, লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে বাকী পথ সাইকেল চালিয়ে যখন জ্ঞানের বাড়ি পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।

জ্ঞান তো আমাদের দেখে অবাক, হৈ চৈ করে বাড়ির সব্বাইকে ডেকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। পরিচয় পর্ব মিটিয়ে হাত পা ধুয়ে ঘরে এসে বসতেই এসে গেল আমাদের জন্য চার ধামা মুড়ি ও তেলে ভাজা। পরিমাণ দেখে মনে হল, দেরি করে আসার জন্য রাত্রিটা হয়তো এই খেয়েই কাটাতে হবে। জ্ঞানকে জিজ্ঞাসা করতেই জানালো, এটা শুধুই জলখাবার, রাতের জন্য পুকুরে মাছ ধরা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত চার ধামা থেকে কমিয়ে এক ধামা মুড়ি দিয়ে চারজনে জলখাবার শেষ করে জ্ঞান ও ওর বন্ধুদের সাথে আমাদের সাইকেল অভিযানের অভিজ্ঞতা ও পরের প্রোগামের ব্যাপারে আলোচনা চলল। বোধহয়, জ্ঞানের বাড়ি একদিন থেকেছিলাম, সেদিন কতগুলো মাছ খেয়েছিলাম মনে নেই তবে জ্ঞানের যে হস্টেলের খাবারের ব্যাপারে খুব কষ্ট হয় সেটা সেদিন বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি।

একদিন পর সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম, সাথে জ্ঞান ও ওর কয়েকজন বন্ধুও এলো। এবার ওদের সাথে অন্য এক ভালো রাস্তা দিয়ে এলাম খোশবাগ যেখানে সিরাজউদ্দৌল্লা, আলিবর্দি খাঁ ও নবাবের বংশের কবর স্থান।

জায়গাটা বেশ পরিষ্কার, সেখানের দেখাশোনা করেন এমন একজন বয়স্ক লোক, আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন, সবকটি কবর দেখিয়ে দিলেন। ওখান থেকে বেড়িয়ে ফেরার পালা, জ্ঞান ও ওর বন্ধুরা আমাদের সাথে এল মুর্শিদাবাদ, ওখানকার বাকি দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো ঘুরিয়ে ওরা ফিরে গেল। আমরা ফেরার রাস্তা ধরে চলে এলাম কৃষ্ণনগর, যেখান থেকে বাড়ির কিছু বিশেষ কাজে জন্য বিজয় একাই ফিরে গেল।

আমরা গঙ্গা পেরিয়ে এলাম নবদ্বীপ-ধাম, শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মস্থান, সেখানে রাস্তার আনাচে কানাচে শ্রীচৈতন্যদেবের স্মৃতি ও মন্দির ছড়িয়ে আছে। সেখানে কিছু পুণ্য অর্জন করে খাওয়া দাওয়া শেষ করে এগিয়ে চললাম, গন্তব্য চুঁচুড়া, আরেক বন্ধু সন্দীপদের বাড়ি (যদিও এবারের অভিযানে বাড়ির বিশেষ কারণে সন্দীপ আমাদের সাথে যেতে পারেনি)। তাড়াতাড়ি চলতে হবে, অন্ধকার হলে সাইকেল চালাতে অসুবিধাহবে, কারণ সকলের সাইকেলে আলো নেই। অন্ধকারে একবার তো এক অর্ধসমাপ্ত ব্রিজে উঠে পড়েছিলাম, শেষে লোকজনের ডাকাডাকিতে নেমে এসে বেঁচে গেলাম।

চুঁচুড়া পৌঁছে গেলাম, কিন্তু সন্দীপের বাড়ি কে চেনাবে? সন্দীপের কাছে শোনা ওর কিছু বন্ধুর নাম ও জায়গাটার নামটাই শুধু মনে ছিল, সেইটুকু জ্ঞানের সাহায্যে শেষ পর্যন্ত সন্দীপের বাড়ি যখন পৌঁছলাম, তখন রাত হয়ে গেছে। সন্দীপও আমাদের দেখে অবাক। আমাদের সাইকেল অভিযানে না গেলেও ওর নিজের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কাণ্ড কারখানা বুঝতে পেরেছিল। সন্দীপের বাড়িতে খাওয়া শেষ করে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চলল। সকালের জলখাবার শেষ করে ফেরিতে গঙ্গা পেরিয়ে চুঁচুড়া থেকে নৈহাটি এলাম। নৈহাটি থেকে আবার সাইকেল চালিয়ে সকলে যে যার বাড়ি ফিরে গেল, আমি বেতাইতলার দোকানে আস্ত সাইকেল ফিরিয়ে দিয়ে ঘরের ছেলে বাড়ি ফিরে এলাম। বাকী কটা দিনের ছুটির পরে সাইকেল ভ্রমণের রেশটুকু ধরে রেখে মেশিন ডিজাইন (DOM), থিয়োরি অফ মেশিন (TOM) ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চর্চা করার জন্য আবার কলেজ জীবনে ফিরে এলাম।

আমরা বেড়ানোর আনন্দে বেড়িয়েছি, ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম না, কী দেখেছি, কোথায় কতদিন ছিলাম ঠিক মনে নেই, বয়সের জন্যও সব তালগোল পাকিয়ে আছে, কোনও ডায়েরিতে কিছু লিখে রাখা হয়নি, শুধু বেড়ানোর স্মৃতিটুকুই সম্বল। আজ গৌতম আমাদের মধ্যে নেই, শ্যামাও অনেক বছর শয্যাশায়ী, বিজয়ের স্মরণশক্তি ও আমার অবশিষ্ট স্মৃতি অবলম্বন করে লিখছি।

পরবর্তী জীবনে চাকরির সূত্রেই হোক, বেড়ানোর জন্যই হোক, দেশে বিদেশের অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে। কলেজ জীবনের সামান্য কিছু টাকা পকেটে নিয়ে মোবাইল বিহীন, বিনা জি.পি.এস.এর সাহায্য ছাড়া বন্ধুদের সাথে বেড়ানোতে যে আনন্দ পেয়েছি সেটা এখনো ভুলিনি। এখন যদিও আগে থেকে অ্যাপয়ন্টমেন্ট ছাড়া কারোও বাড়ি যাওয়া অমার্জনীয় অপরাধ ভাবা হয়, তখন যে কোনও সময় অচেনা জায়গায় কোনও বন্ধুর বাড়ি যেতে কোনও দ্বিধা হত না।

ঐ একই জায়গায় পরেও আবার বেড়াতে গিয়ে দেখেছি, অনেক বদল হয়েছে, অনেক সুযোগ সুবিধা বেড়েছে, কিন্তু সে আনন্দ পাইনি। একটাই শুধু অনুতাপ যে তখন ফটো তোলার বেশি সুযোগ না থাকায় সাদা কালোর যে কয়েকটা ছবি তোলা হয়েছিল তাও ঠিকমতো না রাখতে পারার জন্য অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে, যে কয়েকটা অবশিষ্ট আছে তাও কোথায় আছে বা কার কাছে আছে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল।

গৌতম আজ আমাদের মধ্যে নেই, ওর উৎসাহ, প্রাণশক্তি ও একসাথে বেড়ানোর নানা অভিযানের অভিজ্ঞতার কথা মনে করে এখনও ওর অভাব অনুভব করি। সম্প্রতি ২০শে মে, ২০২৫ সকালে আমাদের ট্রীপের আরেক বন্ধু শ্যামাপদও চলে গেলো। এখন আছি আমি ও বিজয়।

আমি সাহিত্যিক নই, বন্ধুদের সাথে সেই পাঁচ বছর কাটানোর কথা প্রকাশ করার মত সঠিক ভাষাও জানা নেই। যে বন্ধুরা আজ আমাদের মধ্যে নেই তারা যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক এই প্রার্থনা করে আমাদের সাইকেল ভ্রমণের স্মৃতিটুকু লিখলাম।

*******

বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও
মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও
ভুলো না তারে ডেকে নিতে তুমি।

খুশির খেয়ালে পাল তুলে যেও চিরদিন
হাসি আর গানে শোধ করে যেও যত ঋণ
স্মৃতির পটেতে যত ব্যথা আছে ভুলে যেও।
মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও

আলোর পরশে ভোর হয়ে যাবে এই রাত
কোন দিন ভুলে ছেড় নাক তুমি এই হাত
ভুল হারানো দিনে তাকে তুমি সাথে নিও।
ভুলো না তারে ডেকে নিতে তুমি।
বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও
মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও।

কথাঃ মুকুল দত্ত
কন্ঠঃ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

*******

Sahityika Admin

2 comments

Leave a Reply to C K Guha Cancel reply

  • বাঃ বেশ রোমাঞ্চকর ভ্রমণ হয়েছিল তো।আমরাও চার বন্ধুরা মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলাম তবে ট্রেনে করে।ট্রেনের ভাড়া আমাদের দিতে হয় নি,টিকিট পরিক্ষক মহাশয় দয়া করে শিয়ালদহ থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জারে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এক রাতে ট্রেন চড়ে ভোরে মুর্শিদাবাদ/বহরমপুর। সারাদিন রিক্সা চড়ে হাজারদূয়ারী দেখে হোটেলের খাবার খেয়ে বিকেলের ট্রেনে ফিরে ছিলাম। খরচ নাম মাত্র।বাড়ির কেউ জানতে পারে নি।ছাত্র অবস্থায় এমন ভ্রমণ খুবই নিষিদ্ধ আনন্দ দিয়েছিল।

    • কোন ব্যাচ, কবেকার কথা?
      এখন অনেক বদলে গেছে। আমাদের জঙ্গিপুর যাওয়াটা একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা ছিল।
      সেই জ্ঞান পরবর্তী জীবনে লন্ডনে ডঃ রঞ্জন নামে বিখ্যাত ছিল ও পৃথিবীর নানা দেশে বক্তৃতা দিতে যেত। অনেক দিন ওর খবর পাইনা। কেউ জানলে জানিও।