হাওড়া ব্রিজ – The Gate Way of Kolkata
@নারায়ণ প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ১৯৬৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
লোকে বলে গেটওয়ে টু কলকাতা, আমি ব্যাতিক্রম। বলি গেটওয়ে টু হাওড়া।
কারণ আমি শুধু ৬২-৬৭ এই পাঁচ বছরেই কতবার যে বিই কলেজ যাওয়ার জন্য এই ব্রিজের উপর দিয়ে যাতায়াত করেছি, গুনে শেষ করতে পারবো না। আর অন্য আরও কারণ তো আছেই।
যদিও ১৯৬৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে এই ব্রিজের নামকরণ হয় রবীন্দ্র সেতু, তবু এক নস্টালজিক কারণে লোকজন এখনও এই ব্রিজকে হাওড়া ব্রিজই বলে। এই হাওড়া ব্রিজকে প্রথম দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো যখন আমি স্কুলে ক্লাস ফাইভ এ পড়ি। এক কাকার বিয়েতে নবদ্বীপ থেকে কাটোয়া লোকালে ফিরছিলাম। সঙ্গে ছিলেন মা আর বাবা। কাটোয়া লোকাল যখন হাওড়া স্টেশন এ ঢুকছে বাবা খোলা জানলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন – “ওই দেখো হাওড়া ব্রিজ।” অবাক বিস্ময়ে ওই বিশাল আকৃতির লোহার জাল টার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম।
পরবর্তী কালে যতদিন বিই কলেজের ছাত্র ছিলাম বাড়ি আর হোস্টেল যাতায়াত এর পথে বহুবার এই আশ্চর্য স্থাপত্য এর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকেছি।
শৈশব থেকেই হাওড়া ব্রিজ নিয়ে আমার কৌতুহল ছিল অপরিসীম। যেদিন ট্রেনের জানলা দিয়ে প্রথম হাওড়া ব্রিজ দেখলাম রবীন্দ্রনাথের লেখা কবিতার দুটো লাইন মনে এসেছিল ।
“হাওড়ার ব্রিজ চলে মস্ত সে বিছে
হ্যারিসন রোড চলে তার পিছে পিছে।”
বাবার মুখে শুনেছিলাম রবীন্দ্রনাথ এই কবিতা লিখেছিলেন পুরানো হাওড়া ব্রিজ নিয়ে যেটা পন্টুন ব্রিজ নামে খ্যাত ছিল।
তারপর বর্তমান হাওড়া ব্রিজ নিয়েও লেখকেরা লিখেছেন অনেক গল্প ও কবিতা। কবি শঙ্খ ঘোষ লিখে গেছেন
“চুড়োয় শূন্য তুলে ধরে হাওড়া ব্রিজ
পায়ের নীচে গড়িয়ে যায় আবহমান ।”
এই ব্রিজের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছে কত বিখ্যাত ছায়াছবি। আমার অল্প বয়সে দেখা অশোক কুমার মধুবালা অভিনীত ১৯৫৮ সালের একটি জনপ্রিয় ছবি হয়েছিলো ‘হাওড়া ব্রিজ’। সম্প্রতি ২০১৮ সালে এই নামেই একটি তেলেগু সিনেমাও তৈরি হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা বোমা মেরে এই ব্রিজকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। হাওড়া ব্রিজের কাহিনী সত্যিই রূপকথার গল্পের মতো।
ওমপ্রকাশজী গাইছেন শুনো জী ইয়ে কলকাত্তা হ্যায় (হাওড়া ব্রীজ, ১৯৫৮).
হাওড়া ব্রিজ নিয়ে লিখতে বসে আমার একটা পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। অনেক বছর আগে Bangalore এ একটা ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। বোর্ড এর চেয়ারম্যান আমার biodata দেখে বললেন-
“So, you are from the city of Howrah Bridge.
One famous industrialist of Bengal conceptualized this iconic structure and initiated its realisation.
Do you know his name?”
“Yes Sir. He is Sir Rajendranath Mukherjee.”
আমি যখন কর্ম সূত্রে মহারাষ্ট্র এবং দক্ষিণ ভারতে ছিলাম তখন আমার সহকর্মীরা মাঝে মাঝেই হাওড়া ব্রিজ নিয়ে নানা প্রশ্ন করতো। মাঝখানে কোনো সাপোর্ট নেই (আম জনতার ভাষায় পিলার নেই), অথচ এত লম্বা একটা ব্রীজ কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে? আপামর জনতার কাছে হাওড়া ব্রিজ ছিলো এক পরম বিস্ময়। এই আশ্চর্য্য শিল্প কীর্তি আমাদের গর্ব।
এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, সেই সময়ে কাকতালীয় ব্যাপার, অসিতদাই আমাকে ফোন করেছে। অসিত’দা মানে অসিত রঞ্জন ঘোষ ‘৬৬ সিভিল বিই কলেজ, IIT খড়গপুর থেকে MTech করেছেন। ভালোই হলো। অসিত’দা প্রফেশনালি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার আর স্ট্রাকচারাল আইকনস নিয়ে অনেক পড়াশুনা করেছে । ওনার কাছে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। ফোন ধরে বললাম “অসিত’দা ভালো আছেন তো? হাওড়া ব্রিজ নিয়ে আজ আপনাকে কয়েক টা প্রশ্ন করতে পারি?”
– ঠিক আছে। কি জানতে চাও বলো!
– হাওড়া ব্রিজ কে কেনো cantilever ব্রিজ বলা হয়, একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন?
– হাওড়া ব্রিজ আসলে suspension type balanced cantilever truss ব্রিজ। ব্রিজ কে তিনটে ভাগে ভাগ করলে দুই পাশে balanced cantilever end span মাঝখানে suspension central span। মাঝে Suspension ব্রিজ, দুই পাশে cantilever bridge এর সাপোর্ট নিয়ে বসে আছে একটা simply supported beam এর মতো। দুই দিকে দুটো লম্বা টাওয়ার এর সাহায্যে suspension ব্রিজ কে ground এ anchor করে bending moment কে balance করা হয়।
আমার কৌতুহলের শেষ নেই।
– আচ্ছা এই ব্রিজে truss এর কি ফাংশন?
– Truss এর ফাংশন হচ্ছে ব্রিজ এর ফোর্স শেয়ার করা। টোটাল ফোর্স প্রত্যেক ট্রাস এ compression এবং tension এ ভাগ হয়ে যায়।”
অসিত’দা কে বললাম “দাদা আজ এই পর্যন্ত থাক। সামনের সপ্তাহে আবার আলোচনা করা যাবে। এবার একটু অন্য গল্প করা যাক।”
আমরা অনেকেই জানি হাওড়া ব্রিজ এর আগে ছিলো একটি ভাসমান ব্রিজ যাকে বলা হতো পন্টুন ব্রিজ। এই ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৮৭৪ সালে। জলপথে যান চলাচলের জন্য এই ব্রিজটির মাঝখানের অংশ খুলে দেওয়া হতো। একসঙ্গে অনেক মানুষ ও ভারী যান চলাচলের জন্য এই ব্রিজটি উপযুক্ত ছিলো না। তাছাড়া বারবার খুলতে হতো এই ব্রিজটির মাঝের অংশটিকে জাহাজ স্টিমার ইত্যাদি চলাচলের জন্য। একবার একটি দুর্ঘটনার কারণে এই ব্রিজের প্রভূত ক্ষতি হয়েছিল।
১৯০৬ সালে তখনের পোর্ট কমিশনারের রিপোর্ট থেকে পাওয়া যায়, “Bullock carts formed the eight – thirteenths of the vehicular traffic (as observed on 27 August 1906, the heaviest day’s traffic observed in the port of Commissioners 16 days’ Census of the vehicular traffic across the existing bridge). সুতরাং তখনের পনটুন ব্রিজের ট্রাফিক সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
হাওড়া ব্রিজ ডিজাইন এবং কনস্ট্রাকসনে নিহিত আছে সিভিল, স্ট্রাকচার, metallurgy, materials handling, fabrication & erection এই সব বিষয়ে অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার এবং ওয়ার্কারদের জ্ঞান এবং প্রতিভার সংমিশ্রণ। তথ্য ঘেঁটে জানতে পেরেছি হাওড়া ব্রিজ তৈরী শুরু হয়েছিলো ১৯৩৬ সালে। এই কাজ সম্পূর্ণ হয় ১৯৪২ সালে। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি ট্রাম চালিয়ে এই ব্রিজে যান চলাচলের সূচনা হয়।
হুগলি নদীর পূর্ব তীরে কলকাতা এবং পশ্চিম পাড়ে হাওড়া। সারা দেশের সঙ্গে রেলপথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য ১৮৫৪ সালে স্থাপিত হয়েছিলো দেশের ব্যস্ততম হাওড়া স্টেশন। অন্য দিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ব্যবসা বানিজ্যের দৌলতে কলকাতা ক্রমে হয়ে উঠছিল তিলোত্তমা দুই শহরের মধ্যে মানুষ, পন্য ও যানবাহন যাতায়াতের উপযোগী একটি স্থায়ী ব্রিজের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। এটি এমন একটি ব্রিজ হবে যার ওপর দিয়ে সব সময় মানুষ এবং গাড়িঘোড়া চলতে পারবে, আবার ব্রিজের নিচেও জাহাজ স্টিমার চলার কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবেনা।
১৯০৬ সালে প্রস্তাব নেওয়া হয় যে নতুন ব্রীজ তৈরি হবে, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের কারণে এই কাজের বিশেষ কোনো অগ্রগতি হয় নি। এমন একটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন বিখ্যাত একজন বাঙালি শিবপুর বিই কলেজেরই প্রাক্তনী এবং কলেজ গভর্নিং বডির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট the doyen of industries of Bengal, স্যার রাজেন্দ্র নাথ মুখার্জি। ১৯২১ সালে Mukherjee Committee তৈরি হয়, স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি হলেন সেই কমিটির প্রধান। অন্য দুই সদস্যরা হলেন Sir Clement Hindley, কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, আর চিফ ইঞ্জিনিয়ার J. McGlashan
১৯২২ সালে মুখার্জি কমিটি নিউ হাওড়া ব্রিজ কমিশনে রিপোর্ট জমা দেন। ১৯২৬ সালে নিউ হাওড়া ব্রিজ এক্ট পাস হয়, ১৯৩০ সালে Goode Committee তৈরি হয়। কমিটিতে আর ছিলেন এস এন মল্লিক আর W.H. Thompson, “to investigate and report on the advisability of constructing a pier bridge between Calcutta and Howrah”. M/s. Rendel, Palmer and Tritton কোম্পানিকে একটি suspension bridge ডিজাইন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোম্পানির প্রধান ড্রাফটসম্যান Mr. Walton এই ডিজাইনের দায়িত্ব পান। এরপর গ্লোবাল টেন্ডারের ভিত্তিতে সবথকে উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য আবেদন জমা দেয় একটি জার্মান কোম্পানি, কিন্তু ১৯৩৫ সালে ব্রিটেন ও জার্মানীর মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদের কারণে অর্ডার পায় একটি ব্রিটিশ কোম্পানি M/s.Cleveland Bridge & Engineering Company. এদিকে দাবি ওঠে এই কাজের বরাত ভারতীয় কোম্পানিকে দিতে হবে। তখন তিনটি আলাদা কোম্পানি Braithwaite, Burn & Jessop (BBJ) সংযুক্ত হয়, আর এই হাওড়া ব্রিজের কাজের জন্যই ১৯৩৫ সালের ২৬শে জানুয়ারি এই কোম্পানি তৈরি হয়। প্রসঙ্গত, এই হাওড়া ব্রিজের আগে Braithwaite, Burn & Jessop Construction Co (BBJ) র কোন অস্তিত্বই ছিলো না। Cleveland Bridge & Engineering Company তখন ব্রিজের erection এর কাজ BBJ কে সাব-কন্ট্রাকট করে, আর fabrication এর কাজ নিজেরাই করবে ঠিক করে। এই fabrication এর কাজ যদিও Cleveland Bridge & Engineering Company র দায়িত্বে ছিলো, কিন্তু এই কাজের জন্য সকল স্কিলড ড্রাফটসম্যান, ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান BBJ র থেকেই নেওয়া হয়েছিলো। এরপর ১৯৩৬ সালে ব্রিজের প্ল্যানিং এর কাজ শুরু হয়। ১৯৩৯ সালে বিশ্বযুদ্ধর কারণে ব্রিজের কাজের গতি অনেকটাই কমে এসেছিলো। অবশেষে ১৯৪১ সালে ব্রিজ তৈরি হয়ে গেলে, একটি ট্রাম চালিয়ে এই ব্রিজের উদ্বোধন হয়েছিলো।
২১৫০ ফুট দৈর্ঘের এই ব্রিজে একটিও নাট বল্টু নেই, আগাগোড়া রিভেটিং। ২৬,০০০ টন স্টীলের দরকার হয়েছিলো, এর বরাত দেওয়া হয়েছিলো একটি ব্রিটিশ কোম্পানিকে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের কারণে (১৯৩৯-১৯৪৫) ব্রিটিশ সরকার ৩,০০০ টনের পর বাকি স্টীল পাঠাতে অস্বীকার করে। তখন টাটা স্টীল বাকী ২৩,০০০ টন স্টীল সাপ্লাই করে। (developed a high quality high-tensile alloy steel, known as Tiscrom)
এই হলো ছোট করে হাওড়া ব্রিজের ইতিকথা। এই প্রসঙ্গে পরবর্তীকালের আমাদের কলেজের দুই নামী ইঞ্জিনিয়ারেরর কথা অবশ্যই বলতে হয়। প্রথম জন অমিতাভ ঘোষাল, ১৯৫৭ সালের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাজুয়েট। অন্যজন হলেন অচ্যুত’দা, অচ্যুত ঘোষ, ১৯৬১ সালের মেকানিকাল গ্রাজুয়েট। রবীন্দ্র সেতু এবং বিদ্যাসাগর সেতু – এই দুটো সেতু নিয়ে এই দুজন মানুষের প্রচুর জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা। দুজনেই দেশে বিদেশে অবস্থিত বিভিন্ন ব্রিজের ডিজাইন এবং কনস্ট্রাকসন নিয়ে প্রচুর গবেষণা ও বিশ্লেষণ করেছেন। বিদ্যাসাগর সেতুর নির্মাণের টেন্ডার তৈরির সময় থেকে শেষ পর্যন্ত দুজনেই এই প্রজেক্টে ভীষণ ভাবে যুক্ত ছিলেন।
সিনেমার বিনোদনের দিক দিয়েও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই হাওড়া ব্রিজকে আউটডোর হিসেবে প্রচুর সিনেমা হয়েছে। শুধু বাংলা সিনেমা হয়, ইংলিশ, হিন্দী, তামিল, মালয়ালী, যেমন বিমল রায়ের দো বিঘা জমিন, সত্যজিৎ রায়ের পরশপাথর, ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি থেকে পালিয়ে, মৃণাল সেনের নীল আকাশের নীচে, কলকাতা ’৭১ ও পদাতিক, রিচার্ড এটেনবরো’র গান্ধী, রোনাল্ড জফের সিটি অফ জয়, গার্থ ডেভিসের দ্যা লায়ন, মীরা নায়ারের দ্যা নেমসেক, ফ্লোরিয়ান গ্যালেনবার্জের শ্যাডো অফ টাইম, নিকোলাস কোলজের দ্যা বেঙ্গলী নাইট, শক্তি সামন্তের অমর প্রেম, গৌতম ঘোষের পাড়, রাজ কাপুরের রাম তেরি গঙ্গা মইলি, মনি রত্নমের য়ুভা,প্রদীপ সরকারের পরিণীতা, সুজিত সরকারের পিকু, সুজয় ঘোষের কহানী, অনুরাগ বাসুর বরফি, এবং আরও অনেক। একটি যাত্রীবাহী ব্রিজকে কেন্দ্র করে এত সিনেমার শট ভারতবর্ষে আর দ্বিতীয় উদাহরণ নেই।
সব মিলিয়ে, হাওড়া ব্রিজ আমাদের কলকাতার এক ল্যান্ডমার্ক।
স্কেচ – ধীমান চক্রবর্তী
*******
Add comment