সাহিত্যিকা

প্রিয় বন্ধু মৃত্যুঞ্জয় মৈত্র’র স্মৃতিচারণে

প্রিয় বন্ধু মৃত্যুঞ্জয় মৈত্র’র স্মৃতিচারণে
অজয় দেবনাথ, ১৯৭০ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সুদীপ রায়, ১৯৭০ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

মনটা খুব খারাপ, খুবই খারাপ। ক’দিন আগেই আমার আট বছরের ছোট ভাই চলে গেছে; সেই কষ্ট যেতে না যেতেই খবর পেলাম প্রিয় বন্ধু মৃত্যুঞ্জয় মৈত্র (১৯৭০ মেকানিক্যাল) মৃত্যুর সাথে অনেক লড়াই করে শেষে বীরের মতই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে।

অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে। ফার্ষ্ট ইয়ারে ডাউনিং সেন্ট্রাল ইস্টের একতলায় সবচেয়ে কোনার দুটো পাশাপাশি ঘরে আমরা থাকতাম। মাঝে একটা দরজা ছিল যেটা দু’দিক দিয়েই খোলা বন্ধ করা যেত। সেই দরজা খুলে কল্যাণ দেবের দুস্টুমীতে সামিল হয়ে ওকে ভুতের ভয় দেখানো হয়েছিল।

কিছুদিন পরে শীতকাল এল …কলেজে বার্ষিক স্পোর্টস হবে। আমি তখন জিম নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু যেহেতু স্কুলে ছোটাছুটি করে কিছু প্রাইজ পেয়েছিলাম তাই ভাবলাম আমিও যোগ দেবো। দিন সাতেক আগে ওভালে প্র্যাকটিস করতে গিয়ে তো চক্ষু চড়ক গাছ। মৃত্যুঞ্জয় রানিং শু পায়ে প্র্যাকটিস শুরু করে দিয়েছে … যার মানে ও দৌড়তে অভ্যস্থ।। যাই হোক, ফ্রেশার গ্ৰুপে ১০০ মিটারে ফার্ষ্ট হল প্রাকটিস না করা তপন ঘোষ (বিএসসি), সেকেন্ড হলো মৃত্যুঞ্জয়, আর থার্ড হলাম আমি। এবার কিছুক্ষন পরে শুরু হল ফ্রেশার গ্ৰুপের ২০০ মিটার প্রতিযোগিতা। অবাক হয়ে দেখলাম যে শেষের দড়ি ছোঁয়ার সময় আমার ধারে কাছে কেউ নেই; পিছু ফিরে দেখলাম পাঁচ ছ মিটার দূরে মৃত্যুঞ্জয় মাঠে বসে পড়ে বমি করছে। খুবই কষ্ট হয়েছিল সেদিন; বেচারা কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে এই পরপর দৌড়নোর ধকল নিতে পারেনি। এরপর কলেজ থেকে পাশ করার পর দেখা হয়েছিল সেই বিই কলেজ ক্লাব CK ১৪- র GT তে। চট করে চিনতে পারিনি; মাথায় চুল কমে গেছে, থুতনিতে দাড়ি। আমার অবস্থা দেখে ও বলেছিল ‘কিরে চিনতে পারছিস না, আমি মৃত্যুঞ্জয়’। ওকে তখনই জড়িয়ে ধরেছিলাম কিন্তু লজ্জাও পেয়েছিলাম চিনতে পারিনি বলে।

শেষ দু বছর মৃত্যুঞ্জয় হুইল চেয়ারে করে আমাদের GTতে এসে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে কতখানি ওর মনের জোর আর বন্ধুদের প্রতি ওর ভালবাসা। তপন ঘোষ (বিএসসি) তো অনেক আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এবার মৃত্যুঞ্জয় ও আমাদের ছেড়ে চলে গেল। কলেজ ফ্রেশার গ্ৰুপে ১০০ মিটার দৌড়োনো ফার্ষ্ট আর সেকেন্ড হওয়া দুজনই থার্ড হওয়া আমাকে মাঠ ছেড়ে দিল; আমার আর ফার্ষ্ট হওয়ার… নেই… মানা।

মৃত্যুঞ্জয় তাঁর পিতামাতার দেওয়া নামের সন্মান রেখে গেলো।

********

‘দেখা হবে’ – সুদীপ রায়

মন ভালো নেই। ক’দিন আগে কলেজের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসের সহপাঠী মৃত্যৃঞ্জয় মৈত্র কিছুদিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে চলে গেল না ফেরার দেশে। খুবই কাছের বন্ধু ছিল মৃত্যুঞ্জয় যাকে আমরা ‘মতি’ নামে ডাকতাম। আমাদের মতি ছিলো অসম্ভব আমুদে। স্প্রিন্টে চ্যাম্পিয়ন, ওভালের চেনা মুখ। আশ্চর্য, প্রাণ শক্তিতে ভরা অমন বন্ধু আমার আজ আর পাশে নেই।

এই তো জীবন!
লং ডিস্টেন্স রানে … শেষ পাকে ছুটছি এখন।
আশেপাশে বিদায়ের বিষণ্ণ মিছিল,
কেউ চেনা তাতে, কেউ বা অচেনা।
কোথা যায় তারা ? বলা মুশকিল!
তবু মনে দাগ কেটে যায়।
হায়, যারা চলে গেল, তারা কি নিঃশেষ হল ?
নাকি তারা কোনো এক অনন্ত জীবনে হয়েছে সামিল ?
বলা মুশকিল।
চিরন্তন রহস্যে মোড়া জীবনের প্রশ্ন সে বেশ।
উত্তর অজানা তার, শেষ হয়ে হয় না তবুও সে যে শেষ।

বুঝে গেছি এভাবেই কাটবে সময়!
এভাবেই কাটাকুটি হয়ে কেউ ছেড়ে চলে যাবে আগে, কেউ পরে।
এটাই সত্য ধ্রুব, আসুক প্রলয়,
এ সত্য সত্য তবু রবে বিশ্বচরাচরে।
নিদারুণ, তবু এ বিচ্ছেদ মেনে নিতে হবে।
দুঃখ শোক আর কেন তবে ?
কেন এই প্রচ্ছন্ন বিলাপ ?
প্রিয়জন ছেড়ে চলে গেলে আর নয় বৃথা সন্তাপ।
যাও বন্ধু যাও তুমি নব জীবনের রথে,
পূর্ণ সেই মহা জীবনের পথে,
দেখা হবে ফের, যদিও জানি না কোথায়।
তবে দেখা হবে জানি পরে,
অদেখা আলোকসাগরে,
দিগন্তে … কোনো এক দূর মোহনায়।

*******

Sahityika Admin

Add comment