এ্যান্টারকটিকা অভিযানে দুই বিক্কলেজিয়ান
@দীপ্ত প্রতিম মল্লিক, ১৯৮০ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
প্রথম কিস্তি যাত্রার তোড়জোড়
ঘন্টা’দা আর আমি, এই দুই বিক্কলেজিয়ান মিলে প্রচুর বেড়াই। আমাদের অনেক দিনের শখ এ্যান্টারকটিকা যাওয়ার, কিন্তু এর জন্য দীর্ঘ ছুটির প্রয়োজন, টাকাপয়সার প্রয়োজন তো আছেই। তাই এতদিন হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ঘন্টাদা বলল, এবারে না গেলে আর কি কোনোদিন যাওয়া হবে? বয়স তো ক্রমেই বাড়ছে।
পাশ থেকে আমার সহধর্মিণী দীপা ফুট কাটল, “দাদা, গ্লোবাল ওয়ারমিং এর জন্য এরপর সব বরফই গলে জল হয়ে যাবে, তাই চলুন দাদা এবারেই যাই।“
সকলের কথা শুনে নিয়ে লাস্টে ঘন্টাদা বললো, ঠিকই বলেছো, চলো, সবাই মিলে মা দুগগা বলে ঝাঁপাই।
এ্যান্টারকটিকা পৃথিবীর একদম দক্ষিণে। একবারে কাছে আর্জেন্টিনা ও চিলি, বেশ খানিক দূরে নিউজিল্যান্ড আর আরো খানিক দূরে দক্ষিণ আফ্রিকা। বিভিন্ন কোম্পানী ক্রুজ চালায় নিউজিল্যান্ড, চিলি অথবা আর্জেন্টিনার থেকে। তবে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সব চেয়ে কাছে হওয়াতে এখান থেকে গেলে সময় ও অর্থ দুটই অপেক্ষাকৃত কম লাগে।
এ্যান্টারকটিকার জলপথ খোলা থাকে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী। বাকী সময় বরফ ও আইসবার্গ থাকায় জাহাজ যেতে পারে না। তাছাড়া ঐ সামারের তিন মাস ছাড়া বছরের অন্য সময় প্রবল ঠান্ডা থাকে- সে ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা বা শক্তি আমাদের নেই। যেহেতু ক্রিসমাসে আমাদের বেশ কদিন ছুটি থাকে আর কাজের চাপও কম থাকে, স্থির হল ডিসেম্বরেই যাওয়া যাবে।
সব বাছবিচার করে আমরা প্রিন্সেস ক্রুজে যাওয়াই স্থির করলাম। আমাদের পছন্দ মতো এ এফ টির সামনের দুটো ইন্টার কানেকটেড কেবিন বুক করা হল। উপরি পাওনা দুটোর সাথেই বিরাট ব্যালকনি। ক্রুজ শুরু হবে উনিশে ডিসেম্বর ২০২৩ চিলির স্যান্তিয়াগো থেকে আর শেষ হবে এ্যান্টারকটিকা ঘুরে আর্জেন্টিনার বুয়েনেস আইরিশে, মানে ১৬ রাতের ক্রজ। এছাড়া শুরুতে স্যান্তিয়াগো দেখা আর শেষে বুয়েনেস আইরিশ দেখা –সব মিলে দেখা গেল তেইশ দিনের ধাক্কা।
এলেম নতুন দেশে (স্যান্তিয়াগো, চিলি)
দীর্ঘ পথ, শুরু করেছি লন্ডন থেকে। প্রথমে আমেরিকার ফ্লোরিডাতে মিয়ামি – প্রায় সাড়ে ন ঘন্টার পথ। তারপর ঘন্টা তিনেক পর আবার দশ ঘন্টার জার্নি মিয়ামি থেকে স্যান্তিয়াগো। মিয়ামি এয়ারপোর্টে অদ্ভুত নিয়ম যে ইমিগ্রেশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আর সদাই ইমিগ্রেশনের বিশাল লাইন থাকে। ফলে এখানেই ঘন্টা দুই লেগে গেলো। পরের ফ্লাইট মিয়ামি থেকে স্যান্তিয়াগোর দীর্ঘ পথ- উড়ানের সময় দশ ঘন্টা। পর পর দুটো লম্বা জার্নি, তাই কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় পৌছালাম স্যান্তিয়াগো। এখানের ইমিগ্রেশনের তীক্ষ্ণ নজর সঙ্গে ড্রাগ আছে কিনা। কুকুর নিয়ে সব কিছু শুঁকে তবে ছাড়ল।
আমাদের গাড়ি বুক করা ছিলো। ড্রাইভার এক ফোঁটাও ইংরাজি জানে না। এখানের চলতি ভাষা স্প্যানিশ। ফলে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না কোথায় যাচ্ছি। ড্রাইভারের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বাইরেটা দেখায় মন দিলাম। ভালোই সাজানো গোছানো শহর- লোক সে রকম নেই, রাস্তাঘাট পরিষ্কার – অনেকটা ইউরোপের মতই। ঘন্টাখানেক বাদে হোটেলে পৌছে সোফায় বসে আরাম করা ছাড়া উপায় নেই কেননা ঘর বেলা বারোটার আগে পাব না। তা ছাড়া ঘন্টাদা আসছে অন্য ফ্লাইটে আমেরিকার অন্য শহর হয়ে।
বসে আছি, বেলা প্রায় বারোটা বাজে। রিসেপশন থেকে জানিয়েছে ঘর রেডি- আমরা চেক ইন করতে পারি কিন্তু ঘন্টাদার দেখা নেই। ফোন করলাম – উত্তর নেই। এমন সময় দেখি হাঁপাতে হাঁপাতে অনিবৌদি আসছে। হাতে সুটকেশ। কি হল বৌদি? তুমি হাঁপাচ্ছ কেন? দাদা কই?
– ঐ যে ও আসছে, কি কান্ড! ওকেই বলতে দাও।
দেখি ঘন্টাদা আসছে, মাথায় পানামা টুপি, হাতে ট্রলি সুটকেশ। সোফায় আমার পাশে বসে বলল – কি কান্ড মাইরি, খুব জোর বেঁচে গেছি।
– কি হয়েছে দাদা?
শোন তবে, ঘন্টাদা শুরু করল, “এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়ি থাকার কথা, কিন্তু নেই। একজন কোট টাই পরা, বুকে টুরিজিমের ব্যাচ আঁটা লোক অযাচিত ভাবে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, এনি প্রবলেম? গাড়ি আসেনি শুনে আমার থেকে গাড়ির কোম্পানির নাম্বার নিয়ে নিজের ফোন থেকে ফোন করল ড্রাইভ্রারকে। তারপর ফোনটা আমায় দিয়ে বলল, কথা বলে দেখো, আসে নি কেন? ড্রাইভারের সাথে কথা বলে জানলাম ওর গাড়ি খারাপ হয়ে মাঝ রাস্তায় আটকে আছে, ও আসতে পারবে না। সে বলল, তুমি অন্য ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাও, আমার অপেক্ষায় থেকো না। কি হবে তাহলে? ট্রাভেলের ঐ ভদ্রলোককে জানালাম। উনি বললেন, কোনো অসুবিধা নেই। উনিই একটি ট্যাক্সি জোগাড় করে দিলেন। ইয়ং ট্যাক্সি ড্রাইভার, বলল, পে কিভাবে করবে? ক্যাশ আছে? না হলে কার্ডে পে করতে পারো? মাত্র দু দিন চিলিতে থাকা, তাই চিলির মুদ্রা সঙ্গে নেই, প্ল্যান ছিলো কার্ডেই দুটো দিন চালিয়ে দেব। গাড়িতে উঠলাম। অদ্ভুত গাড়ি, ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে আর একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে। আধ ঘন্টার পর জানালো, গাড়ির কার্ড মেশিন চলছে না, কিন্তু ও প্রভাইডারের সাথে ইতিমধ্যে কথা বলেছে, সামনে একজন কার্ড মেশিন নিয়ে থাকবে, ওখানেই পেমেন্ট করে দিও।
খানিক পর গাড়ি দাঁড়ালো। এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে- হাতে কার্ড মেশিন। কার্ড মেশিনে চিলিয়ান পেসোতে লিখে আমায় দিল পিন নাম্বারের জন্য। দেখি স্ক্রীনে কিছু সংখ্যা তার পিছনে অজস্র শুন্য। চিলিয়ান পেসোর দাম অতি কম, ভাবলাম ৩০ ডলার মানে পেসোতে অনেক। তাই সরল মনে পিন নাম্বার লিখে দিলাম, কিন্তু পেমেন্ট ডিক্লাইন্ড হয়ে গেলো। প্রভাইডার আবার চেষ্টা করলো, এবারে কিন্তু অন্য সংখ্যা লেখা, আগের থেকে অনেক কম। সন্দেহ হল, কিন্তু ভাবলাম, দেখিই না- আমার কার্ডে তো লিমিট করা আছে, বেশি পেমেন্ট নিতে চাইলে হবে না। কিন্তু এবারেও ডিক্লাইনড।
অনি পাশ থেকে বলল, এখানে কিন্তু ইন্টারনেট পাওয়া যাচ্ছে, তুমি একবার ব্যাঙ্কের এ্যাপ খুলে দেখ তো? সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল এ্যাপ খুলে দেখি ঠিক যা ভেবেছি। প্রথম বারে চারহাজার পাউন্ড ও পরের বার আড়াই হাজার পাউন্ড তোলার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তুলবি কি করে? কার্ডের লিমিট তো বেঁধেছি পঞ্চাশ পাউন্ডে। বুঝলাম ফ্রড গ্রুপের পাল্লায় পড়েছি। চিলির খুব একটা সুনাম নেই, তাই সব বুঝেও না বোঝার ভান করে বললাম, কার্ডের গন্ডোগোল আছে মনে হচ্ছে, অনি তোমার কাছে কিছু ডলার আছে না? অনির কাছে সব সময় আলাদা কিছু ডলার রাখা থাকে। অনি তার থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে ত্রিশ ডলার পেল। আমি সেটা দিয়ে বললাম, ব্যাস হয়ে গেছে ভাই, এবার যাওয়া যাক।
এরাও বুঝেছে, ফ্রডের চেষ্টা ফেল করেছে, অতএব ভালোয় ভালোয় যা পাচ্ছে, নিয়ে কেটে পড়। টাকা নিয়ে প্রভাইডার চলে গেল। ড্রাইভার দেখল, মহা বিপদ, এরা ধরে ফেলেছে- ওকে যদি পুলিশে দিই! তাই দ্রুত গাড়ি চালিয়ে একটা গলিতে এসে বলল, আর গাড়ি যাবে না, এখান থেকে একটু হাঁটলেই হোটেল। অনি উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি থামালাম। গাড়ি ঝাঁ করে ঘুরিয়ে উল্টোদিকে চলে গেল। গুগল খুলে দেখি পাঁচ মিনিট হেঁটে গলিটার মোড় ঘুরলেই হোটেল – তাই মিনিট পাঁচ হেঁটে এই হোটেলে ঢুকছি।”
রিসেপশনিষ্ট এতোক্ষণ সব শুনছিলেন। বললেন, তোমরা কপাল জোরে বেঁচে গেছ। একটু আগে এক জার্মান দম্পতি চেক ইন করল, তাদের এভাবে চার হাজার ইউরো গেছে। প্রতি সপ্তাহে এখানে একটা না একটা এরকম ফ্রড কেস দেখছি। আসলে এরকম ফ্রড গ্রুপ এখানে অজস্র আছে আর এদের পাল্লায় পড়ে টুরিষ্টদের সর্বনাশ তো হচ্ছেই, আমাদেরও হচ্ছে বদনাম। এরকম হলে কে আর চিলি আসবে? পরে সত্যিকারের ড্রাইভারকে ফোন করে জেনেছিলাম সে ক মিনিট দেরীতে হলেও এসেছিল আর অনেকক্ষণ অপেক্ষাও করছিল। ও কোনো ফোন টোন পায় নি, মানে পুরোটাই সাজানো নাটক।
যাই হোক, চেক ইন করলে রিসেপশনিষ্ট মেয়েটি বলল, বাইরে বেরুলে পাসপোর্ট আর বাকি জিনিষ হোটেলে রেখে খালি হাতে যেও। মোবাইল ও ক্যামেরা থাকলে সাবধানে রেখো। এখানে পকেটমার প্রচুর। ঘন্টাদা বলল, ছিনতাই এর ভয় আছে? না, তা নেই, কিন্তু পকেটমারদের হাতের কাজ খুব সুক্ষ- একজনের প্যান্ট এমন কেটেছিল, প্যান্টের একটা পা নীচে পড়ে যাওয়ার পর সে বুঝছিল। শুনে ঘন্টাদা বলেছিল, আমাদের কলকাতাকেও হার মানায় রে!
ঘরে মালপত্র রেখে খেতে গেলাম। দশ মিনিটের রাস্তায় একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁ আছে দেখেছি গুগলে- নাম স্বাগত রেস্টুরেন্ট। ওখানেই যাব বলে বেরুলাম। হোটেলের বাইরে বিরাট বিরাট চওড়া সব রাস্তা, আর দু’পাশে সারি দিয়ে দোকান। কিন্তু সব বন্ধ, রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই। জানলাম এখানে শনি রবি ছুটির দিনে সব শুনশান, আবার সোম থেকে শুক্র অন্য রূপ- আসলে এটা অফিস অঞ্চল বলে আজ লোকজন নেই। রাস্তাগুলো শ’খানেক ফুট চওড়া। বেশ কিছু রাস্তা শুধু লোকেদের জন্য- গাড়ি ঢুকতে পারবে না- ব্যারিয়ার করা আছে। অজস্র দোকান দুপাশে- সবই প্রায় খাবারের দোকান, কিন্তু সব বন্ধ।
স্বাগততে একটু ভয়ে ভয়েই এলাম, কারণ রাস্তা ভীষণ খালি। সেখানে একটি পঞ্জাবি ছেলে সযত্নেই খাওয়ালো। খাবারের মানও খুবই ভালো। কথা বলে বুঝলাম ওর বাবা আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ফকল্যান্ড যুদ্ধর সময় এসেছিল আর সেই থেকে ওরা এখানের বাসিন্দা। এখানে ভারতীয় খাবারের চাহিদা আছে, সেটা পরে বুঝেছিলাম দোকানের ভিড় দেখে। রাস্তায় লোক নেই কিন্তু দোকান প্রায় ভরা।
হোটেল থেকে খেয়ে ফেরার পথে অনিবৌদি বল, চলো, সামনে একটা চার্চ আছে, দেখে আসি। এই সান ফ্রান্সিসকো চার্চটি সতেরো শতাব্দীতে তৈরি, আর এর ফ্রেসকোর কাজ অন্যবদ্য। বৌদি ইতিহাসের প্রফেসার, ফলে নিবিষ্ট মনে দেখছিলো কিন্তু ঘন্টাদা বিরাট কটা হাই তুলে বলল- এবার চলো, হোটেলে একটু গড়িয়ে নিই। সারারাত প্লেনে দু চোখের পাতা এক করতে পারিনি।
সবারই এক অবস্থা, এক তো ঘুম নেই, তায় প্রায় পুরো এক দিনের প্লেন জার্নি, শরীর রেষ্ট চায়। চলে এলাম হোটেলে। হোটেলের নরম বিছানায় শুয়ে যখন ঘুম ভাঙ্গল দেখি রাত আটটা বাজে, কিন্তু চোখ আর খুলতে ইচ্ছা করছে না। আসলে লন্ডনের তখন মধ্যরাত।
দীপা বলল, চলো বেরুই, কিছু খেয়ে আবার শোওয়া যাবে।
দুজনে তৈরি হয়ে ঘন্টাদাদের সাথে বেরুলাম। শনিবারের রাত, চারদিক শুনশান। একটু ভয় ভয় লাগছিলো বটে কিন্তু চারজন আছি, সঙ্গে অল্প কিছু টাকা ছাড়া কিছুই নেই, আর ঘন্টাদা গুন গুন করে মান্না দের গান ধরেছে “কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়…” সব মিলে ভয়টা তাড়ানোর চেষ্টা। আবার এলাম সকালের সেই ভারতীয় রেস্তোরাঁয়। আর জমিয়ে খাওয়া ও আরামের নিদ্রা।
পরদিনের সকাল- রবিবার, জানালা দিয়ে নিচে চেয়ে দেখলাম খালি খালি রাস্তা- মানুষ জন নেই, যেন এক ঘুমন্ত নগরী। তৈরী হয়ে ঘন্টাদাদের সাথে ব্রেকফাস্টে নীচে গেলাম। ব্রেকফার্স্ট হোটেলের দামের মধ্যে ধরা- ভেবেছিলাম বিজাতীয় কি জানি কি দেবে- কিন্তু দেখা গেল অজস্র খাবার ও বিভিন্ন রকমের চয়েস আছে। ঘন্টাদা তো প্লেটে পাহাড় করে প্যান কেক, প্যাস্ট্রি আর ক্রশো নিল। খাবারের ব্যাপারে ঘন্টাদাকে সামলানো মুশকিল, বিশেষ করে যদি মিষ্টি জাতীয় খাবার হয়।
খাওয়ার পর আমরা প্রথমে চললাম হোটেল থেকে দশ মিনিট হাঁটা পথে সান্তা লুসিয়া হিল। এটা একটা ছোট পাহাড়- কয়েকশো ফুট উঁচু। ওপরে বিরাট বাগান ও শহরের ভিউ দেখার জন্য অন্যবদ্য এক ভিউস্পট। লিফট আছে ওপরে ওঠার। সবাই মিলে ওপরে উঠলাম। ওপরে সামনে যে বেঞ্চটা ছিল, ঘন্টাদা ধপাস করে তাতে বসে বলল, তোরা ঘুরে আয়, আমি একটু রেষ্ট নিই। “আরে? এই তো সবে ঘুমিয়ে রেষ্ট নিয়ে এলে, আবার রেষ্ট?” অনিবৌদি বলল, “ঠিক আছে, তাহলে আমরাই চারদিকটা একটু দেখে আসি।“
আমরা তিনজন টেরেস বাগানে খানিক ঘুরলাম। আহামরি কিছু নয়- বাহারি গাছ গাছড়া আর ফুলের বাগান আছে। স্যান্তিয়াগো শহর নীচে দেখা যায়। দূরে বেশ কিছু বরফের চূড়োওলা পাহাড়। কদিন পরেই তো বরফের রাজ্যে পা দেব, ফলে কেউ আর আমরা উৎসাহ দেখালাম না। খানিকক্ষণ ওখানে বসে আর ঠান্ডা হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে আবার নীচে নামলাম।
এবারের গন্তব্যস্থল প্লাজা দ্য আরমাস। দীর্ঘদিন চিলি ছিলো স্প্যানিশদের অধিকারে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা চিলি ইউরোপিয়ানদের নজরে আসে ষোলো শতাব্দীর প্রথমে। স্পেন প্রথম একে দখল করে নেয় ১৫৪০ সালে। সেই থেকে স্পেন এখানে রাজত্ব করেছে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত। তারপর চিলি স্বাধীনতা অর্জন করে। ফলে স্যান্তিয়াগো স্প্যানিস ধাঁচে গড়ে উঠেছে। এদের ভাষা এখন স্প্যানিশ, অরিজিনাল চিলির ভাষা কোথায় হারিয়ে গেছে।
চিলি দৈর্ঘে বিরাট লম্বা এক দেশ- আড়াই হাজার মাইল লম্বা আর চওড়া মাত্র সাড়ে চারশো মাইল। কিন্তু প্রাকৃতিক বৈচিত্রর অভাব নেই। এখানে আছে অজস্র বরফে ঢাকা পাহাড়, আছে সমুদ্র, আছে মরুভূমি। আর চিলির পাটাগোনিয়ার সৌন্দর্য তো দেখার মতো। স্যান্তিয়াগো এর রাজধানী, আজ নয়, বহু যুগ আগে থেকে, তাই স্প্যানিশ ছোঁয়া স্যান্তিয়াগোর সর্বত্র।
স্পেন যেখানেই রাজ করেছে, সেখানেই এরকম প্লাজা দ্য আরমাস বা বাঁধানো পার্ক ও চত্তর গড়ে উঠেছে। তৈরি হয়েছে অগুনতি চার্চ । এ জিনিষ দেখেছি পৃথিবীর সর্বত্র – পেরু, পানামা, মেক্সিকো সব জায়গাতেই এক গল্প।
প্লাজাতে যখন এলাম, সকাল এগারোটা বাজে। বিরাট অঞ্চল জুড়ে বসার জন্য অজস্র বেঞ্চ যার অধিকাংশই দখল করে আছে ভবঘুরেরা। প্লাজার একদিকে বিরাট এক ক্যাথিড্রাল, পাশে বহু পুরানো বাড়ি কংগ্রেস বিল্ডিং। ঘন্টাদা ও আমি সেলফি তুলছি, কোথা থেকে এক সুন্দরী মেয়ে এসে বলে, আমি তুলে দিচ্ছি, তোমাদের ছবি। ঘন্টাদা মোবাইলটা প্রায় বাড়িয়ে দিয়েছিলো আর কি, সঙ্গে সঙ্গে অনিবৌদি ছুটে এসে মোবাইলটা দাদার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল, না, না আমি তুলে দিচ্ছি। মেয়েটি চলে যেতেই অনিবৌদি প্রবল বকা দিল- তোমার শিক্ষা হয় নি এখনও! ও নির্ঘাত তোমার মোবাইলটা নিয়ে পালিয়ে যেত- ওদের একটা দল থাকে। পরে মনে হয়েছিল এটা ঠিকই, কেননা ওই মেয়েটিকে সারাদিনই ওখানে দেখেছি। কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে কেউ এরকম করে?
প্লাজাতে খানিক বসে এলাম উল্টোদিকের মেট্রোপলিয়ান ক্যাথিড্রালে। বিরাট জায়গা জুড়ে এই ক্যাথিড্রাল – ১৫৪১ সালের অগ্নিকান্ডে ও পরে ভূমিকম্পে পুরানো ক্যাথিড্রালটির ধ্বংসস্তূপের ওপর এটি পরে গড়ে উঠেছে। বিরাট হল- এখানেও ফ্রেস্কো ও মোজেকের কাজ দেখার মতো।
আজ রবিবার, ফলে রাস্তায় লোকজন খুবই কম, যা আছে সবই টুরিষ্ট। শুধু এক কাপ কফি খাওয়ার জন্যই দোকান খুঁজতে পুরো এলাকাটা চষে ফেললাম, কিন্তু সব দোকানই বন্ধ, এমনকি একটা বিরাট স্টারবাকস ছিলো, সেটাও বন্ধ। কোনরকমে একটা ট্যাকোবেলতে লাঞ্চ হলো, অতি জঘন্য খাবারের প্রিপারেশন। ট্যাকোবেল আমেরিকার সাথে এখানের আকাশ পাতাল তফাত। খাওয়ার পর আরো কিছুক্ষণ ওখানে ঘুরলাম, সেন্ট আগস্টাইন নামের একটি চার্চ, আর প্রেসিডেন্ট প্যালেস দেখে যখন আর পারছি না, ফিরে এলাম হোটেলে। বোঝা গেল স্যান্তিয়াগোতে কাছাকাছির মধ্যে আর কিছু নেই, তার চেয়ে হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়াই ভালো।
রাতে আবার স্বাগতে যাওয়া হল, কিন্তু আজ রবিবার বন্ধ। কাছেই একটি “ইয়ো সোহো” বলে চীনা রেস্তোরাঁ ছিলো সেটাও বন্ধ। অনিবৌদি বলল, ধুস, এরা রবিবারে কিছুই খোলা রাখে না, তার চেয়ে চলো, হোটেলেই যা পাই খেয়ে নেওয়া যাক।
পরদিন হোটেলে ব্রেকফার্স্ট চু্রোস পাওয়া গেল- ঘন্টাদাকে আর পায় কে! সব ছেড়ে আবার পাহাড়ের মত করে চুরোস নিয়ে এল। বৌদি বলল, এটা কি তুমি সবার জন্য এনেছ?
– আরে না, না, এটা শুধু আমার, তোমরা নিয়ে এসো – অনেক আছে।
কিছু খাবারের ওপর দাদার দুর্বলতা দেখার মতো।
আজ বাইরে বেরিয়ে দেখি স্যান্তিয়াগোর চেহারাই পালটে গেছে। রাস্তায় থিক থিক করছে লোক, দোকান বাজার সব খুলেছে, যেগুলো গত দু দিন ধরে বন্ধ দেখেছিলাম, সেগুলো যেন প্রাণ পেয়েছে। অফিস যাত্রীতে ব্যাস্ত শহর। আমরা বিভিন্ন দোকানে ঢুঁ মারছি, এটা ওটা দেখছি। ভালো কফির দোকানে বসে কফি ও পেস্ট্রি খাওয়া হল। এ যেন এক যাদু কাঠির ছোঁয়াতে শহর জেগে উঠেছে। আবার প্রেসিডেন্ট প্যালেস এলাকায় গেলাম। ওখানে গার্ড চেঞ্জের প্যারেড দেখলাম। অজস্র পুলিশ সেখানে কুকুর নিয়ে টহল দিচ্ছে।
স্যান্তিয়াগোতে গত দু দিন ধরে দেখছিলাম “ওয়ার্ক কাফে” বলে বিরাট বিরাট দোকান, দু দিন বন্ধ ছিলো বলে কি জিনিষ বুঝিনি। ঘন্টাদা বলল, চ তো দেখে আসি, এর মানে কি?
সামনে দেখলাম “স্যানটান্ডার ওয়ার্ক কাফে” বলে বিরাট বাড়ি, অনেক লোকে ঢুকছে, পিছু পিছু আমরাও ঢুকলাম। স্যানটান্ডার স্পেনের এক বিরাট ব্যাঙ্ক, গোটা পৃথিবীতেই এদের শাখা আছে। আমরা বললাম, ঘন্টাদা এটা পাবলিকের জন্য নিশ্চয় নয়। “আরে আয় তো, ঢুকে তো দেখি।“
ঘন্টাদা ঢুকে গেলো আর পিছু পিছু আমরাও ঢুকলাম। দেখি বিরাট কাফে, আছে অগুনতি বসার জায়গা, সোফাসেট, টেবিল আর প্লাগ পয়েন্ট। লোকেরা কফি নিয়ে কাজে বসে যাচ্ছে । প্রথমে ভাবছিলাম, এটা হয়ত স্যানটান্ডার ব্যাঙ্কের লোকেদের কাজের জায়গা, বাইরের লোকেরাও বসতে পারে। কিন্তু কফি দেওয়ার কাউন্টারে ঘন্টাদা জিজ্ঞাসা করতেই ভুল ভাঙ্গল। উনি জানালেন, এখানে বহু লোক আসে, ইন্টারনেট ফ্রি, তাই বাড়িতে কাজ না করে এখানে বসে কাজ করে আর কফি খায়, খাবারও খায় এখানে। এটাই এখানকার প্রচলিত রীতি। আমরা যেমন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করি, তার বদলে এরা করে “ওয়ার্ক ফ্রম কাফে”।
ওখানে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে আর ইন্টারনেট করে আমরা আবার বেরুলাম। দুপুরের খাওয়া হল এক ইটালিয়ান রেস্তোরাঁয়, পিজার স্বাদ ছিলো দারুণ। এছাড়া বিভিন্ন জুস।
বিকাল হলে আমরা আবার হোটেলে। কাল হোটেল ছেড়ে দিতে হবে, সকালে গাড়ি বলা আছে স্যান এন্টানিও যাওয়ার।
*******
Add comment