সাহিত্যিকা

সেই হলুদ রাস্তাটা – গল্পগুলো আমাদেরই

সেই হলুদ রাস্তাটা – গল্পগুলো আমাদেরই
@তৃণাংকুর সাহা, ১৯৮৫ ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং

সেদিন সকাল থেকেই মনটা বেশ খারাপ। সকালে মুন্নু বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে চেয়ারটায় কিছুক্ষণ বসেছিলো। একটু পরেই বাড়ির বাইরে রাস্তায় গিয়ে একবার বাড়িটার দিকে তাকালো, হয়ত একরাশ দুঃখ, অভিমান বুকে নিয়ে। তারপর হাঁটতে শুরু করলো বাঁ দিকে বড় রাস্তার দিকে। গলির মুখে গিয়ে দাঁড়ালো, শুধু একবার পিছন দিকে ঘুরে দেখলো, কেউ ডাকছে কিনা। কেউ ডাকলো না, ফিরিয়েও আনলো না। ডানদিকের রাস্তায় না গিয়ে বাঁ দিকের রাস্তায় এগোতে লাগলো, যে রাস্তাটা দিয়ে গঙ্গায় যাওয়া যায়, পাশেই শ্মশান। মুন্নু হয়ত মহাপ্রস্থানের পথেই চললো।

মুন্নু হলো আমাদের আদরের সাদা বিড়াল। জন্মের পর থেকে চুন্নু আর মুন্নু, দুই যমজ ভাই আমাদের কাছেই বড় হচ্ছিলো। প্রায় এক বছর বয়স হলো। ভালোই চলছিলো, কিন্তু আজকে কী যে হলো … একটু বকাবকি করতেই, যেন সব সম্পর্ক শেষ করে মুন্নু চলে গেলো।

মুন্নুর এই হঠাৎ করে চলে যাওয়া নিয়ে ভাবতে ভাবতে একটা কঠিন সত্য মনকে আঁকড়ে ধরলো, মুন্নু না হয় আজ অভিমান করে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। কিন্তু আমি যেদিন সত্যিই চলে যাবো, বাড়ি থেকে বার করার পর পেছন থেকে ডেকে কি কেউ ফিরিয়ে আনতে পারবে? একবার পিছন ফিরে নিজের বাড়িটাকেও তো দেখতে আর পারবো না। আপনজন, সাজানো সংসার, কত স্মৃতি … সবকিছুই পড়ে থাকবে, শুধু আমি থাকবো না। যাওয়ার আগে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততায় হয়ত অনেক কিছুই মনের মধ্যে এলোমেলো হয়ে যাবে, ভিতরটা উথাল পাথাল করবে, অনেক না বলা কথা মনেই থেকে যাবে, অনেক কাজ অসমাপ্তই থেকে যাবে, কেউ আর জানতেও পারবে না কোনোদিন।

আজকাল মাঝে মাঝেই একটা হলুদ মাটির রাস্তা মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে। কোনো এক মন উদাস করা বিকেলে আমি একা একা হেঁটে চলেছি ঐ হলুদ রাস্তা দিয়ে, দু ধারে সবুজ ধান ক্ষেত, রাস্তার ধারে একটা বড় বাবলা গাছ, দূরে তাল গাছের সারি, তারপরেই যেন লাল দিগন্ত মাটিতে মিশেছে। আলো কমে আসছে, মাথার উপর দিয়ে সার বেঁধে পাখীরা ঘরে ফিরছে, নাম না জানা কোনো বুনো ফুলের গন্ধ বাতাসে ভেসে আসছে, ঝিঁ ঝিঁ পোকারা ডাকছে। ছোটোবেলায় আবিষ্কার করা দামোদরের বাঁধের ধারের সেই পিটুলী গাছটা আজ আর খুঁজে পাই না, জোনাকীর আলোয় হলুদ রাস্তাটা কোন দিকে গেছে, আজ আর বোঝাই যাচ্ছে না।

চাইলেই সব কিছু ভোলা যায় না, জীবনের জলছবিটা একবার আঁকা হয়ে গেলে আর মোছা যায় না, সেটা রঙীন কিংবা সাদাকালো যাই হোক না কেন। ছাত্র জীবন, কর্মজীবন, সংসার …… কত আর পুরোনো? মনে হয় এই তো সেদিন! একটু মনে করার চেষ্টা করলেই তো দেখতে পাই প্রাইমারী স্কুলে যাওয়ার পায়ে হাঁটা আঁকাবাঁকা সেই পথ …… বাঁশবন পেরিয়ে, বড় তেঁতুল গাছটার তলা দিয়ে, পুকুরগুলোয় হাঁসেদের সাঁতার কাঁটা দেখতে দেখতে যাওয়া। স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যে বড় কুলগাছটা, একটা বাতাবি লেবু গাছ …… সেই আটচালা, আর তার লাগোয়া বিশাল নিম গাছের তলায় মৃদু মন্দ হাওয়া …… হয়ত ভুলবো না কোনোদিন।

রোজই ভাবি, পঁচিশ তিরিশ বছর আগেকার ফটোগুলো খুঁজে বার করবো, কানহা জঙ্গলে জিপসীর একদম সামনে থেকে তোলা বাঘের ফটোটা দেখবো, কিন্তু হয়ে আর উঠছে না। এরকম অনেক কিছুই আর হয়ে উঠছে না। যেমন, পুরোনো চিঠিগুলো, অনেক আগের লেখা ডাইরী … কিছুই খুঁজে বার করে পড়া হচ্ছে না। এরকম কত সংগ্রহ, কত ইতিহাস, সবই অনাদরে অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব রাখতে পারছি কোথায়! কিন্তু সময় তো আর থেমে থাকছে না। অজস্র স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকি আমরা। মনে হয়, জীবনটাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিই, ফিরে যাই ছোটোবেলার সেই দিনগুলোয় …… কল্পনা করতে আমরা ভালোবাসি। যদিও অনেক ভুলের মধ্য দিয়েই অনেক কিছু শেখা, অনেক অভিজ্ঞতা এই জীবনে চলার পথে, তবুও মনে হয় — “প্রশ্ন করি নিজের কাছে কে আমি, কোথায় ছিলাম, কোথায় যাবো এই আমি। ….. ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা,”— মনে হয় এটাই জীবনের অমোঘ সত্য, হয়ত অনেকের ক্ষেত্রেই।

অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যায় জীবনে। মাঝে মাঝে ভাবি, গল্প লিখবো। কত অভিজ্ঞতা, আলাপ পরিচয় এই জীবনে। অনেক স্মৃতির বাসা মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কী যে ভালো লাগে বাংলাদেশের টেলি-নাটকগুলো! যদি ঐ রকম কোনো এক প্রেমের কাহিনী লিখতে পারতাম, যেখানে শৈশবে মাকে হারিয়ে বাবার স্নেহ ভালোবাসা ও কঠোর শাসনে বেড়ে ওঠা এক সাধারণ মেয়ে তার কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ অফিসার বাবার চোখে চোখ রেখে বলতে পারছে – “তোমার কিসের এত শাসন, কেন এত বারণ, আমি বুঝি না …… ওর প্রতি তোমার এত অবজ্ঞা, এত লাঞ্ছনার পরেও আমি হার মেনেছি ওর পাগলামির কাছে। এত প্রতিকূলতার মাঝেও আমি পারিনি ওকে ভালো না বেসে থাকতে।“

অনেক কিছুই হারিয়ে যায় আমাদের জীবন থেকে। চাইলেই কি সেই ঘাসের বনে ফড়িং ধরার দিন – আর ফিরে পাওয়া যায়? আমার সারা বিকেল জুড়ে শুধু তুমিই …… কোথায় হারিয়ে গেছে সেই খামখেয়ালী দস্যিপনা, হঠাৎ বৃষ্টিতে এলোমেলো হওয়ার দিন। খুব ইচ্ছা থাকলেও সেই হলুদ রাস্তা ধরে যেতে যেতে শৈশবের প্রাণের বন্ধু হরিসাধনের দেখা পাবো কিনা জানি না। কিংবা আরেক প্রিয় বন্ধু সাহাবুদ্দিনের?

ফিরে আসি মুন্নুর প্রসঙ্গে। অভিমান করে চলে যাওয়ার পরের দিনই মুন্নু ফিরে এসেছিল। কিন্তু তার কদিন পরেই হঠাৎ করে চুন্নু বেপাত্তা। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পাওয়া গেলো না আমার বড় আদরের চুন্নুর। ভুলতে পারি না, ধবধবে সাদা চুন্নুর উজ্জ্বল কালো দুটি চোখ, নাকের নীচে কালো গোঁফ। বুঝতে পারি, এখন মুন্নুর খুব মন খারাপ, আমাদের তো অবশ্যই। কঠিন মায়ার এই জগতে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়, মেনে নেওয়ার জন্য মনকে তৈরী রাখতে হয়। জীবন বয়ে চলেছে তার নিজের খেয়ালে, হয়ত কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করেই। এগিয়ে চলেছি ঐ হলুদ রাস্তাটা ধরেই। মানুষ চলে যায়, গল্পটা থেকে যায় – গল্পগুলো আমাদেরই।

*******

Sahityika Admin

Add comment