খেজুরের রস
@প্রণব কুমার মজুমদার, ১৯৭১ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
সাহেবের হঠাৎ শখ হলো একটু খেজুরের রস খাওয়ার। বয়সটা বাড়ছে বলে আজকাল ছোটবেলার প্রাপ্তিগুলো যেন আরও বেশি বেশি করেই স্মৃতির মধ্যে থেকে এই ফাঁক ঐ ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে থাকে। ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে গিয়ে মাঠের পাশের খেজুর গাছে হাঁড়ি ঝুলতে দেখলে দলবদ্ধভাবে জুটে যেতো হাঁড়ি নামিয়ে রসের সন্ধান করতে। কিন্তু খেলা হতো বিকালে আর খেজুর গাছ থেকে রস বেরোনো শুরু হতো সন্ধ্যা হলে, ঠাণ্ডা পড়লে। ভোর রাত পর্যন্ত হাঁড়িতে রস জমা হতো, তারপর তাকে নামাতো গাছি বা শিউলি। সমস্যা হচ্ছে যে এই রস বেশিক্ষণ হাওয়ায় থাকলে গেঁজিয়ে যাবে। হাঁড়িতে জমা এই রস সরাসরি খাওয়া যেতে পারে, তেমনি এই রস মিশিয়ে বিবিধ মিষ্টান্ন তৈরি করা হয়। আর এই রসকে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় পাটালী গুড়, নলেন গুড়।
একদিন কথায় কথায় সাহেব নিজের শ্বশুর বাড়িতে তার এই ইচ্ছার কথাটা ব্যক্ত করলো। সেরকম কোনও দাবি হিসাবে ইচ্ছাটা পেশ করেনি সে। সান্ধ্যকালীন চায়ের আসরে বসে শীত সম্পর্কে বিভিন্ন কথাবার্তার ফাঁকে একেবারে আলটপকা নিজের ইচ্ছার কথাটা বলে দেয়, আর ওনার শাশুড়ি ঠাকরুণ কথাটা কানে নেন। কিন্তু এটাও জানিয়ে দেন যে কোলকাতায় আজকাল মোটামুটি চলনসই পাটালী গুড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বড় জোর স্টেশন চত্বরের সংলগ্ন এলাকা থেকে তাড়িও হয়তো পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু গ্রামের দিক ছাড়া খেজুরের রস জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। এরপর ঐ সন্ধ্যায় খেজুর রস প্রকল্প আর বিশেষ এগোয়নি।
জামাই চলে যাওয়ার পরে শাশুড়ি মায়ের সর্বক্ষণের কাজের বৌ তথা রান্নার মাসি মায়া পরের দিন ঐ খেজুরের রসের প্রসঙ্গ গিন্নীমার কাছে আবার উত্থাপন করলো। তাঁর বাড়ি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার লক্ষ্মীকান্তপুরে। এই বাড়িতে কাজের জন্য থাকে। গতকাল জামাইয়ের খেজুরের রস খাওয়ার আবদার শুনতে পেয়ে রাতেই নিজের স্বামী এবং জামাই দু’জনকেই মোবাইল ফোনে খেজুরের রস জোগাড় করতে বলে। কিন্তু তারা উভয়েই জানায় যে এখন খেজুরের রসের হাঁড়িতে কি সব ওষুধ মেশায় যাতে চট করে গেঁজে না গিয়ে অনেকক্ষণ থাকে, কিন্তু খেজুরের রসের গুণ এবং অনেকাংশে স্বাদ এতে করে নষ্ট হয়ে যায়। মায়া বলে যে তাঁরা যেন ওষুধ ছাড়া আসল খেজুরের রস জোগাড় করার চেষ্টা করে, সে ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়ে ঐ রস নিয়ে আসবে। তাঁর কাজের বাড়ির জামাই সাধ করে খেতে চেয়েছে বলে কথা।
পরের সপ্তাহে মায়ার কাছে তার জামাইয়ের ফোন এলো যে রবিবার ভোরে আসল টাটকা খেজুরের রস একজন দিয়ে যাবে। জামাইয়ের কথা মতো মায়া একটা কাজের অজুহাত দিয়ে তার কাজের বাড়ি থেকে শনিবার ছুটি নিয়ে লক্ষ্মীকান্তপুরে নিজের বাড়িতে চলে গেলো, আর বলে গেলো যে রবিবার ভোরেই ফেরৎ চলে আসবে। তবে খেজুরের রস নিয়ে আসার কথা বলে গেলো না, যদি কোনও কারণে না পাওয়া যায় রস তবে আশাভঙ্গ হবে।
রবিবার সকাল সাতটায় মায়া এসে হাজির লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে। এসে এত্তেলা দিলো যে এক্কেবারে টাটকা খেজুরের রস নিয়ে এসেছে সে। বোতলে আছে। জামাইকে খবর পাঠানো হোক যে তার ইচ্ছাপূরণ প্রস্তুত। আচমকা এমন টাটকা খেজুরের রসের আগমনে জামাইয়ের সাধপূরণের সম্ভাবনার থেকেও শাশুড়ির উদ্বেলিত আনন্দ যেন সারা বাড়িকে মাথায় তুলে ফেললো। আরে? মেয়েজামাইকে তো এক্ষুনি খবর পাঠাতে হয়। এখান থেকে মেয়ের বাড়ি রস পৌঁছে দেওয়ার লোকের যেমন অভাব, তেমনি জামাই এখানে এসে খেয়ে গেলে সবার সাথে একটু দেখাসাক্ষাতও হবে আর খেজুর রসের টাটকা স্বাদটাও অনেক বেশি থাকবে – এই উভয় যুক্তিতে জামাইকে আমন্ত্রণ বার্তা জানিয়ে মেয়ের কাছে মায়ের ফোন গেলো।
কিন্তু মেয়ের উত্তরটা খুব একটা সুখকর হলো না। রবিবার ছুটির দিনে মেয়ে-জামাই নাতিকে নিয়ে মা-বাবার সাথে দেখা করতে আসবে বলে মনস্থ করেছিলো। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে জামাই বাবাজীবন টের পান যে শরীরটায় কেমন একটা জ্বর জ্বর ভাব, একটু হাল্কা সর্দি-কাশির ভাবও যেন আছে। ব্যস। মনের ইচ্ছেটা গুটিয়ে গিয়ে মনেই থেকে গেলো। গত দুই-আড়াই বছর ধরে সারা পৃথিবী জুড়ে যা চলছে তাতে মনের সব ইচ্ছেগুলো যেন একটাই সুতো দিয়ে বাধা হয়ে গেছে – করোনা ভাইরাস। তার সাথে ইদানীং জুটেছে ডেঙ্গু। এই সুতোতেই সবার আগে টান পড়ে। মেয়ে মাকে জানালো যে তাদের জামাইকে এখন বাড়িতে আটক থেকে কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। আটচল্লিশ ঘন্টার আগে জানা যাবে না যে তিনি পরীক্ষায় পাশ করলেন না ফেল। পাশ করলেই শরীর চার দেয়ালে বন্দী। আর ফেল করলে মনের আনন্দে উড়ে বেড়াও, ঘুরে বেড়াও। তাই যতক্ষণ না পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হচ্ছে, সাহেবের অত কাঙ্খিত খেজুরের রস মাত্র পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরত্বে উপলব্ধ থাকা স্বত্বেও এ যাত্রায় সেই মায়া তাকে কাটিয়ে ফেলতে হবে। এমনটাই সিদ্ধান্ত নিলো মেয়ে।
ফোনে মেয়ের থেকে এই সংবাদ পেয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা শুরু হলো, বিশেষ করে চোখের সামনে জামাইকে দেখতে না পেয়ে। দুশ্চিন্তা শুধু তো জামাইকে নিয়ে নয়, এই করোনা ভাইরাসের সুতোয় যে তার মেয়ে আর নাতিও বাঁধা পড়ে যেতে পারে।
ইতিমধ্যে গিন্নীমা কাজের বৌ মায়ার থেকে খেজুর রসের ইতিবৃত্ত শুনে নিয়েছেন। মায়া আজ ভোরে সাড়ে চারটার সময় মেয়ের বাড়ি চলে আসে, মায়ার ছেলে নিজের অটো করে মাকে এনে দিদির বাড়ি পৌঁছে দেয়। বেশি না, দু’তিন কিলোমিটার দূরত্ব। মায়ার জামাইয়ের কাছে চারটের সময় এক প্লাস্টিকের বোতল ভর্তি টাটকা খেজুরের রস এসে পৌঁছয়। বোতল হস্তান্তরিত হলো মায়ার হাতে। ইতিমধ্যে ছেলে তার অটোর সওয়ারী পেয়ে গেছে। কিন্তু ছেলের ইচ্ছা নয় মাকে হেঁটে স্টেশন পর্যন্ত যেতে দেয়। এদিকে সওয়ারীও পেয়ে গেছে। সওয়ারীদের অনুরোধ করলো পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা করতে, মাকে স্টেশনে ছেড়ে দিয়েই ফেরত আসবে। ছেলে মায়াকে লক্ষ্মীকান্তপুর স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে এলে সে নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন পেয়ে সকাল সাতটার মধ্যেই তার কাজের বাড়িতে এসে হাজির যেন অঙ্কে এক্কেবারে দশে দশ।
গিন্নী শুনলেন, খানিক চুপ থেকে মায়াকে তাঁর জামাইয়ের অসুস্থতার কথা বললেন। এত ঝামেলা করে আজ রস নিয়ে এসে বাড়ির জামাইয়ের অসুস্থতার কথা শুনে মায়ার মনটা খুবই দমে গেলো কিন্তু তার মাথায় ঘুরছে খেজুরের রসের চিন্তা। আজকাল ভালো খেজুরের রস পাওয়াই দুষ্কর, সেখানে এত টাটকা রস এত ঝামেলা করে এনে সাধের খানেওয়ালার মুখে তুলে দেওয়া যাচ্ছে না? মায়া এটা মেনে নিতে পারছে না। গিন্নীমাকে প্রস্তাব দিলো তাহলে কত্তাবাবুকেই খেজুর রস দেওয়া হোক। শুনেই উনি হাঁ হাঁ করে তেড়ে উঠলেন, “বলিস কিরে? তোর কত্তাবাবুর সুগার, আর তাকে তুই খেজুরের রস খাওয়াতে চাইছিস? কি আক্কেল তোর?”
বাড়ির জামাইয়ের সাধ মেটাতে এমন চমক দিতে গিয়ে এখন এই রস যেন মায়ার গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে রইলো। না পারছে কাউকে খাওয়াতে, না পারছে ফেলে দিতে। একবার ভাবে পাড়ার বাজারে চেনা জানা কাউকে দিয়ে দেয়, কিন্তু মনটা সায় দিলো না। আবার ভাবে কাজ শেষ করে বিকেলে বাড়ি ফিরে গিয়ে ছেলে বা জামাই কাউকে খাইয়ে দেবে। কিন্তু বিকেল পর্যন্ত কি আর ঐ রস ভালো থাকবে? এভাবে কষ্ট করে জোগার করা টাটকা জিনিষ নষ্ট হলে নিজের জামাই খুবই দুঃখ পাবে। মায়া দেখেছে গিন্নীমা সব্জি, ফল বা রান্না করা খাবার ফ্রিজে রেখে দেন। রসটাকেও ফ্রিজে রাখার কথা গিন্নীমাকে বলতেই রাজি হয়ে গেলেন। টাটকা খেজুরের রস নষ্ট হওয়ার আগে ফ্রিজস্থ হলো।
মায়া এই গিন্নীমার বাড়িতে কাজ করার ফাঁকে কাছাকাছি আরও এক বাড়িতে ঠিকের কাজ করে আসে। ঐ বাড়ির বৌদিকে গিয়ে সংক্ষেপে খেজুরের রসের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে অনুরোধ করলো দাদাবাবুকে যদি বৌদি রসটা খেতে দেন তাহলে রসটার একটা সদগতি হয়। প্রস্তাব শুনেই বৌদি দু’কথা তেরচাভাবে শুনিয়ে দিলেন – “আচ্ছা, ও বাড়ির জামাই একটু রস খাওয়ার সাধ করেছে তাই তুই ছুটে ছুটে এনে দিলি, আর এখন বাড়তি হচ্ছে বলে দাদাবাবুকে দেওয়ার কথা মনে পড়লো? কেন, নিজের গরজেও তো দাদাবাবুকে খাওয়ানোর জন্য একটু এনে দিতে পারতিস।”
এই কথা শুনে মায়া সিদ্ধান্তই নিয়ে নিলো যে বৌদি এরপর যেচে খেজুরের রস চাইলেও সেটা আর তাকে দেবে না।
দুপুর পর্যন্ত মুখটা থমথমে করে দুই বাড়ির কাজ সারলো মায়া। দুপুরে কর্তাবাবু আর গিন্নীমার ভাত খাওয়া হয়ে গেলে নিজেও খেয়ে নিলো। তারপর ভাবলো যদিও খেজুরের রসটা সাময়িক ভাবে নষ্ট হতে পারছে না ফ্রিজে আছে বলে, কিন্তু তারপর তাকে নিয়ে সে কি করবে? একবার ভাবলো কাউকে খাওয়ানো না গেলে বরং সে নিজেই খেয়ে নেয়। কিন্তু শহরে কাজ করতে এলেও গ্রাম্যজীবনের সংস্কার এখনও জলাঞ্জলি দিয়ে উঠতে পারেনি। গিন্নীমার জামাইয়ের নামে আনা রস নিজে খেয়ে নিলে যদি তার পাপ লেগে যায়? তাই গিন্নীমা দুপুরে একটু বিশ্রাম নিতে যেতেই চুপিচুপি খেজুরের রস ভর্তি বোতলটা ফ্রিজ থেকে বের করে এনে হাত ধোওয়ার বেসিনে নিয়ে গিয়ে সবটা রস ঢেলে দিলো বেসিনটায়। তারপর জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে দিলো বেসিনটা। বোতলটাও জলে ধুয়ে মিউনিসিপ্যালিটির ময়লা ফেলার বালতিতে ফেলে দিলো, নাহলে আবার পিঁপড়ে ধরতে পারে বোতলটায়। তারপর দুহাতে বেসিনটা ধরে মায়া চোখ বুজে নিজেকে ধাতস্ত করার জন্য খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।
বেসিনের নল দিয়ে খেজুরের রস গড়িয়ে যাওয়াটা তার কল্পনার চোখে ধরা পড়লো যেন গিন্নীমার জামাইয়ের খাদ্যনালী দিয়ে রসটা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। যাক বাবা, খেজুরের রসের যেন সদগতি।
******
খুব ভালো
খুব ভালো