সাহিত্যিকা

কুলপুকুরের মাঠ

কুলপুকুরের মাঠ
@হিমাংশু পাল, ১৯৯০ কম্প্যুটার সায়েন্স

“যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি”

প্রথম অংশ
বেশ গা-ছমছম করত; এতটা নির্জন মেঠোপথ! দু-আড়াই মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে লোকবসতির চিহ্নমাত্র নেই। কিছুটা দূরে দূরে একেকটা করে পুকুর, – সদুচ্চক, মদুঞ্চক, শ্যাওড়াগেড়ে, দারুনগেড়ে, লোচুরগেড়ে, বড়গেড়ে, – তাদেরকে ঘিরে কয়েকটা ঝোপঝাড় সঙ্গে নিয়ে দু-একটা গাছ মাঠের নিশানা নির্দেশ করছে। দিনের আলো কমে আসার সাথে সাথে মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে দিকবলয়ের অপরূপ সৌন্দর্য আমরা উপভোগ করতাম। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেরা আরো কয়েকটা রাখালছেলের সঙ্গে সারাদিন খেলাধুলা সেরে সন্ধ্যা নামার আগেই গরুর পাল নিয়ে ঘরে ফেরার উদ্যোগ করে, আর তখনই কুলপুকুরের মাঠে গোধূলির আস্তরণ অন্ধকারের সঙ্গে মিলিয়ে যায়! সুয্যিমামা ধীরে ধীরে অস্ত যান।

কুলপুকুরের মাঠ থেকে বিষ্টু কুণ্ডুদের বাড়ি পরিষ্কার দেখা যেত। দিনের আলোয় রুপোর মত ঝকঝক করত। বুঝতে পারতাম ওটাই আমাদের গ্রাম। গ্রামের বাড়ির সেই মটকার রং সিঁদুর-ছড়ানো লাল হওয়ার একটু পরেই অদৃশ্য হয়ে যেত। কিন্তু সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সেই নির্জন মাঠের সৌন্দর্য যেন এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে! কুলপুকুরকে ঘিরে বিস্তীর্ণ মাঠ অন্ধকারের চাদরে মুখ লুকোয়। তখন মনে পড়ে যায় এক অল্পবয়সী প্রেমিক-প্রেমিকার জোড়া মৃতদেহ। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে গ্রামের এক সদ্যযুবক তার পাশের গ্রামের এক স্কুলছাত্রীর সঙ্গে একসঙ্গে আত্মহত্যা করে, এই কুলপুকুরের মাঠেই। ছেলেটি টিউশনি পড়াত, এভাবেই ভাব-ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্কুল থেকে সবাই এসেছিলাম প্রেমিক-প্রেমিকার আত্মবলিদান দেখতে। সেই কথা মনে-পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যেত।রাম-লক্ষণ সহ সমস্ত দেবতার নাম নিতাম, যখন যেটা কাজে লাগে!

দিদিবাড়ি যাওয়ার আরো একটা রাস্তা ছিল। বাসে চড়ে তিন মাইল যাওয়ার পর মনসাতলা স্টপেজে নেমে, আরো তিন-চার মাইল হেঁটে বৃন্দাবনপুর, বাসুদেবপুর পেরিয়ে তবে রঞ্জিত রায়ের দীঘি। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে, দীঘির পার হয়ে ডিহি বায়রা, বাগডহর গ্রাম পেরোলেই দেখতে পাওয়া যেত হাতিশাল হাই স্কুল। আরো কিছুটা গ্রামের মধ্যে হাঁটতে-হাঁটতে প্রায় দু-তিন ঘন্টা লেগে যেত দিদিবাড়ি পৌঁছতে। একটা বাস ফেল করলে এক ঘন্টারও বেশি অপেক্ষা করতে হত পরের বাসের জন্যে। তাছাড়া বাসের ভাড়াই বা দেবে কে? তাই অগতির গতি সেই মেঠো পথই! রাস্তাটাও খুব সোজাসাপ্টা। বর্ষায় চাষের সময় জমির আল ঘুরে-ঘুরে যেতে হলেও, ফসল ওঠার পর জমির মাঝ দিয়েই বেমালুম চলে যাওয়া যায়। লোক-চলাচলের ফলে স্বাভাবিকভাবেই মাঠ চিরে একটা পায়ে-চলা রাস্তা তৈরি হয়ে যায় কোলেপুকুর থেকে কুলপুকুর পর্যন্ত। আমাদের বাড়ি থেকে বাসরাস্তাটা পেরোলেই পুবদিকে আমাদের মাঠ শুরু হয়। একটু হেঁটে গেলে প্রথমেই জোড়াগেড়ে, তার কিছুটা পর সদুচ্চক, আরো একমাইল হাঁটলে কুলপুকুরের মাঠ। কুলপুকুর থেকে পুবদিকে আরো মাইল-দেড়েক হাঁটলেই পঞ্চবটী বন। তখন ধড়ে যেন প্রাণ পাই। কানপুকুর গ্রামের সীমানায় পৌঁছে গেছি।

কুলপুকুরের মাঠ পেরিয়ে কতবার যে দিদিবাড়ি গিয়েছি তার হিসেব নেই। বেশিরভাগ সময় দিদি-দাদাবাবুদের সঙ্গে, কখনো ঘরের পিসির সঙ্গে, আবার কখনো-কখনো একা একাই! কিন্তু আমার মত জন্মভীতু ছেলে কীভাবে একা-একা কুলপুকুরের মাঠ পেরিয়ে দিদিবাড়ি যেতাম সেটাও এক অবাক বিস্ময়!

কুলপুকুরের সঙ্গে গোষ্ঠ ভবনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। শুধু গোষ্ঠ ভবন কেন? রামনগর, মোবারকপুর ও আশপাশের আরো বেশ কয়েকটি কৃষিজীবি গ্রামের কাছে কুলপুকুরের গুরুত্ব অপরিসীম। গোষ্ঠ ভবনের ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা আর পাঁচটা কথা শেখার আগেই কুলপুকুর কথাটা শিখে ফেলে! কতবার শোনে, শুনতে-শুনতেই নিজের অজান্তেই বলে জ্যাঠামশাই ‘কুলপুকুর’ গেছে। আমাদের চাষের জমির প্রায় সবটাই কুলপুকুর ও তার কাছাকাছি মাঠেই। গোষ্ঠ ভবনের সারা বছরের খোরাকি ও সংসারের সব খরচ কুলপুকুরের মাঠ থেকে উঠে আসে। এমনকি পুকুরের ভাগিদার পালপাড়ার অনেক পরিবার হলেও গোষ্ঠ ভবনের অংশ সবচেয়ে বেশি, অনেক বেশি। পাঁচ আনা, মানে তিন ভাগের এক ভাগের মতো। সেইমতো পুকুরের জলও গোষ্ঠ ভবন বেশি পায় দরকার মতো সেচের কাজে লাগাতে। পুকুরটা প্রায় দুই একর আটষষ্টি শতকের মতো।

দ্বিতীয় অংশ
আবার অত বড় পুকুরে যত মাছ ধরা হত তার সিংহভাগই আসত গোষ্ঠ ভবনে। বর্ষাকালে কই-মাগুর-শিঙি ও অন্যান্য জীয়ন মাছ এত বেশি পরিমাণে আসত যে ঘরের মধ্যেই ছোটখাটো একটা পুকুর খুঁড়তে হত। আমরা বলতাম মাছের কুয়া। বারো ফুট বাই দশ ফুট মতন একটা বিশাল গর্ত। ছ’ ফুট গভীর হলেও কুয়োতে চার-সাড়ে চার ফুটের বেশি জল রাখা হত না। কুয়াটা খোঁড়া হত মুড়িভাজা চালা ও দক্ষিণ দুয়ারের মাঝে, তুলসীতলার আমগাছের নীচে সদর ঘরের কাছে। তালকাঠের কাড়ি ও বড় বড় তালপাতা দিয়ে ঢাকা থাকত যাতে কেউ অসাবধানে পড়ে না যায়। কুয়াতে জিয়ানো মাছ ধরে ধরে গোষ্ঠ ভবনের প্রায় দু-আড়াই মাস চলে যেত।

গ্রীষ্মকালের শেষের দিকে ও বর্ষার আরম্ভে গোষ্ঠ ভবনের দু’জোড়া বলদ সঙ্গে নিয়ে দু-তিনজন মুনিষ (আজকের দিনে বলে “লেবার”) প্রত্যেক দিন ভোরে দুটো লাঙল ও জোয়াল কাঁধে নিয়ে চাষের সময় মাঠে যেত। মেজ জ্যাঠামশাইকেও সঙ্গে যেতে হত। তিনি প্রধানত তদারকিই করতেন। কখনো-সখনো গরুর কাঁধে লাঙল জুড়ে নিজেও জমি চাষ করতেন। উপযুক্ত সময়ে বৃষ্টির জল পরিমাণ মতো জমলে রোয়ার (রোপণ) কাজ শুরু হত। আট -দশ জন লেবার সারি দিয়ে ধানগাছের চারা-বীজ সমান সমান দূরত্বে পুঁতে পুরো জমি রোপণ করত। কখনো গান গেয়ে, কখনো নিজেদের মধ্যে গাল গপ্পো করতে করতে নারীপুরুষের চাষির দল মনিবের জমি চাষ করত। দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে ধান রোয়ার কাজ সারা হয়ে যেত। সারা মাঠ জুড়ে যেন অপূর্ব সুন্দর এক নৈসর্গিক দৃশ্যের সূচনা করত। সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা হয়ে উঠত জোড়াগেড়ে, সদুচ্চক, দারুনগেড়ে ও কুলপুকুরের মাঠ। শুধুমাত্র পাশাপাশি কয়েকটা গ্রাম নয়, মহকুমা – জেলা সদর ছাড়িয়ে দূরবর্তী কলকাতা শহর এমনকি অন্য রাজ্যের মানুষের খাদ্যের সংস্থান হত।

আমাদের ছোটদের কাছে কুলপুকুরের মাঠের পরিচিতি একটু অন্যরকম ছিল। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে সারা মাঠ ও গ্রাম যখন ঝলসে যেত, ঘরের মধ্যে বন্দী থেকে কখন বিকেল হবে তার অপেক্ষায় থাকতাম। তখন দল বেঁধে বেরিয়ে পড়তাম কাছাকাছি কোনো মাঠে। চাষের মাঠ হয়ে যেত খেলার মাঠ! আবার অনেক সময় কোনো সমবয়সীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মাঠের মধ্যে চলে যেতাম অনেকদূর, প্রায় কুলপুকুরের কাছে। গা-জুড়ানো দক্ষিণের শীতল বাতাসে মন প্রাণ জুড়িয়ে যেত! নির্মল কলুষমুক্ত হাওয়া, বুক ভরে অক্সিজেন টেনে নিতাম। কোনো কলকারখানা বা রাইস মিল ছিল না কাছেপিঠে। ধোঁয়া বলতে শুধুমাত্র ছিল কাঠ ও কয়লার রান্নার ধোঁয়া। কালেভদ্রে পিচের রাস্তা মেরামতের জন্য বাস-লরির টায়ার পোড়ানো হত। ওসব ধোঁয়া কুলপুকুরের মাঠে পৌঁছত না। আবার কখনো-সখনো হঠাৎই কালবোশেখির দেখা মিলত; দে দৌড়! মন খুশিতে ভরপুর হয়ে যেত। প্রাণের আনন্দ উপচে গিয়ে মনের আনন্দে লয় হত। বিপদেরও ঝুঁকি থাকত। প্রবল ধুলোঝড়ের সঙ্গে আর অল্প বৃষ্টির সঙ্গে প্রচন্ড বজ্রপাত। আবার কখনো-কখনো নুড়িপাথরের মতো শিলাবৃষ্টি।

গ্রীষ্মের বিকেলের মতো উপভোগ্য ছিল গ্রীষ্মের ভোরবেলাও। আমাদের ছোটবেলায় খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস ছিল। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে-সঙ্গে প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়ে পড়তাম। বিকেলের মত ভোরেও মাঠের পরিবেশ হতো নির্জন ও মনোরম। সারা বিশ্বচরাচর যেন প্রশান্তিতে ভরে থাকত। বর্ষায় চাষের সময় সকাল-বিকাল মাঠে বেড়ানো যেত না। তবে দুপুরের ঠিক আগে মাঠে ভাত নিয়ে যেতে হত। মেজ জ্যাঠামশাই,অজা দুলে, শেতলা দুলে ও অন্য অনেক মুনিষ মাঠেই দুপুরের খাবার খেত। ছোট কাকিমা একটা ঝোড়ার মধ্যে ডাল-ভাত-তরকারি-জল আর থালা-গেলাস সাজিয়ে বুঁচকির মতো কাপড় দিয়ে বেঁধে দিত। তারপর আমাদের মাথার উপর বসিয়ে দিত, তার আগে তালপাতার তৈরি বড় পেখে পরিয়ে দিত – যাতে বৃষ্টিতে ভিজে না যাই। মাঠের মধ্যে পেখে পরে খাবার নিয়ে যেতে যখন ঝমঝমিয়ে মাথার উপর বৃষ্টি পড়ত তখন অদ্ভুত শব্দের অনুরণন সৃষ্টি হত। বর্ষার জলে ছোট ছোট ধানের চারাগুলো আস্তে আস্তে দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে বাড়তে থাকে। কুলপুকুর জুড়ে বিশাল ধানের ক্ষেত আরো ঘন, আরো সবুজ হয়। হাওয়ায় দোল খায় চঞ্চলা এক কিশোরীর মতো।

এক শরতের ভোরে পেটরোগা ছেলেটা তার বন্ধু মিনের সাথে মাঠ দেখতে বেরিয়ে পড়ে। মিনেদের বেশিরভাগ জমি দারুনগেড়ের চার পাশেই। চাষ সম্পর্কে মিনের জ্ঞান অনেক বেশি। লেবারদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে কাজ করতে পারে। বলতে থাকে, “বুঝলি হিমাং, আজকালকার লেবাররা খুব ফাঁকিবাজ। বাবাতে-আমাতে এক বিঘের বেশি ধান কেটে ফেলতে পারি। লেবার লাগা, তো বলবে তিনজন লাগবে। এবার দারুনগেড়েতে বিশাল ফলন হবে। তোদের কুলপুকুরেও এবার ভালো হবে। তোর মেজজ্যাঠার বয়েস হচ্ছে। একলা সবকিছু দেখে উঠতে পারছে না। সুকোদা – বুদোদার এবার মাঠে লাগা দরকার। গদাইজ্যাঠাকে হেল্প না করলে তোদের যৌথপরিবারকে আর ধরে রাখতে পারবে না”।

এটা-সেটা কথা বলতে বলতে হঠাৎ একটা ধানের শীষ আমাদের নজরে আসে। তারপর একটু ভালো করে এদিক-ওদিকের বেড়ে-ওঠা ধানগাছগুলো লক্ষ্য করতে করতে এগিয়ে চলি। ওইদিনই জীবনে প্রথমবার গজিয়ে-ওঠা সবুজ নরম ধানের শীষ আবিষ্কার করি! তারপর বেশ কয়েকদিন নতুন-গজিয়ে-ওঠা ধানের শীষ দেখতে দেখতে ভেজা ভেজা পায়ে ঠান্ডা জলের মতো পরশ অনুভব করি। ভালো করে কাছে গিয়ে দেখি যে জমির আলের ধার-বরাবর ছোট ছোট ঘাসগুলো যেন শিশিরে স্নান করেছে। “মিনে দ্যাখ, এই মিনে দ্যাখ, ধানের শীষের উপর মুক্তোর মতো ছোট ছোট শিশিরের ফোঁটাগুলো কেমন আটকে আছে, কী সুন্দর লাগছে!” হালকা সোনালি ধানগাছেরা সদ্যযুবতীর মত দিনে দিনে অপরূপা হয়ে উঠছে। নিজেরা সাজসজ্জা করতে পারে না। তাই বোধ হয় প্রকৃতি নিজের হাতে সাজিয়েছে। মিনে অভিজ্ঞ, চাষির ছেলে। শিশির, কুয়াশা, মেঘ ও বৃষ্টির ব্যাখ্যা তার কাছে অন্যরকম। আমাকে বোঝাতে থাকে,- “যত শিশির খাবে, ধানের শীষগুলো তত পুরুষ্টু হবে – তত ভালো ধান ফলবে। পোকামাকড় কাছে ঘেঁষতে পারবে না। এখন শরৎকাল, বৃষ্টিবাদল থেমে গেছে। এই দ্যাখ গাছের গোড়ায় আর জল দাঁড়িয়ে নেই, যদিও মাটিটা একটু নরম, ভেজা ভেজা। এইসময় ভোরের শিশিরটা খুবই দরকারি। শুধুমাত্র ধানের শীষের জন্য নয়, পুরো গাছটারই শিশিরের জলে চান (স্নান) করা দরকার। তাহলেই গাছটা তেজি থাকবে আর ফলন ভালো হবে”।

তৃতীয় অংশ
হেমন্তের শেষের দিকে ধান কাটা শুরু হয়। রাশি রাশি কাটা-ধান আঁটি বেঁধে জাঙ্গি দেওয়া হয়। একটা বিশেষ পদ্ধতিতে কায়দা করে পুরো গোছাটা ধরে ঘুরিয়ে মজবুত করে বেঁধে দেওয়া হয়। একে চলতি কথায় ‘এটোনা’ বলা হয়। এটোনার সময় অনেক ধানের শীষ ঝরে যায়। আবার বাঁধা-আঁটিগুলো যখন একসঙ্গে জাঙ্গিতে জড়ো করা হয় তখনও প্রচুর কাটা কাটা শীষ ঝরতে থাকে। ওই সব কাটা-ধান কুড়োনোর জন্য আমরা ছোটরা পেতে, ঝোড়া ও থলে নিয়ে মাঠে যেতাম। ঘরের বিধবা পিসিও আমাদের সঙ্গে যেতেন।

ধান কাটার সময়ের কিছু আগেই আমাদের স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা সারা হয়ে যেত। তারপর প্রায় একমাস ধরে কুলপুকুরের মাঠ। শীতের সকালে একটু রোদ ওঠার পরপরই মোটা জামা পরে চাদর জড়িয়ে শুরু হত ‘মিশন কুলপুকুর’। সঙ্গে থাকতো মুড়ির থলি, একটা বড় পেঁয়াজ ও এক টুকরো শক্ত ভেলি গুড়। আর বেশিরভাগ সময়ই খালি পা। শিশির ও ধুলো মিলেমিশে পায়ে একটা আস্তরণ পড়ত। তারপর কয়েকঘন্টা হুড়োহুড়ি ছোটাছুটি করে কুটো ধানের শীষ কুড়োতাম। পুকুরের চার পাড় ঘুরে ঘুরে কুল তুলতাম। ছোট-বড় কত সব কুলের গাছ! তাছাড়া ছিল সেকুল, আর ভেমুচও তুলতাম। সেকুল তোলা যদিও এতটা সোজা ছিল না। প্রচুর কাঁটা, একটা ছাড়ালে আরো পাঁচটা জড়িয়ে ধরে। একটু খিদে পেলে সকলে মিলে মুড়ি খেতাম। তেষ্টা পেলে কুলপুকুরের জল, পানা সরিয়ে, দুই হাতে আঁচলা করে। কখনো মনে হয়নি অসুস্থ হতে পারি! যদিও এখনকার কুলপুকুরের জল আর কেউ খায় না। চারদিকে এখন মিনি। সারা বছরচাষের জন্য মিনি ডিপ-টিউবওয়েল সারা মাঠে এখন ছেয়ে গেছে। আমাদের ছোটবেলায় মাঠে একবারই চাষ হত। আর মেঠো পুকুরের জলই সকলে পান করতাম।

ধান কুড়োনোর পাশাপাশি জ্যাঠামশায়ের তত্ত্বাবধানে কিছু কিছু চাষের কাজ শিখেছিলাম। যেমন ধানের চারটে আঁটি বাঁ হাতে আর চারটে ডান হাতে করে তুলে নিয়ে টেনে টেনে নিয়ে গিয়ে জাঙ্গি দেওয়া, গাড়ি বোঝাই করতে সাহায্য করা ইত্যাদি। সুকুমারদা, বুদোদা ও সিতাংদা-রা অনেক অ্যাডভান্স ছিল। লাঙল দেওয়া, ধান কাটা, এটোনা, গাড়ি বোঝাই করা, ধানের গাদা দেওয়া, ধান ঝাড়া, ধানের গোলা ভর্তি করা, – সব কাজ শিখে নিয়েছিল। ধান এটোনার কাজটা শেখার খুব উৎসাহ ছিল, কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করার পর ডান হাতের বুড়ো আঙুলে ইয়া বড় একটা ফোস্কা পড়তেই ক্ষান্তি দিই।

গ্রামবাংলার শীতকালে আর একটা মনোরম শোভাযাত্রা দেখতাম – সারি সারি ধান-বোঝাই গরুর গাড়ি। কোলেপুকুর থেকে কুলপুকুর পর্যন্ত গরুর গাড়িই ছিল পাকা ধান পরিবহণের একমাত্র উপায়। অনবরত গাড়ি-চলাচলের ফলে দুই চাকার সমদূরত্বে সরু সরু দুটো সমান্তরাল রাস্তা তৈরি হত। চলতি কথায় ‘গাড়ির লিক’ বলা হয়। একই লিক বরাবর অনেক গাড়ি অনেকবার যাতায়াত করলে লিকটাও একটু মোটা হয়ে যায়। আর গরুরাও লিক-বরাবর গাড়ি টেনে নিয়ে যায়। কারো হেলে তেজি, লেজ মুলে গাড়ি ছুটিয়ে সামনের গাড়িকে ওভারটেক করত। গরুর খুরে খুরে ধুলোর মেঘ উড়ে বেড়াত। কোথাও কোথাও ফাঁকা জায়গায় হাওয়ার ঘূর্ণি ছোট ছোট মানুষের মতো ধুলোর টর্নেডো তৈরি করত। ছোটবেলায় ওই ধুলোর ঘূর্ণিগুলোকে ভূত ভাবতাম। ধান-বোঝাই গাড়ির মটকায় চড়ে আমরা বাড়ি ফিরতাম।

সেই দিনগুলির স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করছে। সেইসব ধান-বোঝাই গরুর গাড়ি, লাঙল, জোয়াল, চাষের মই, জলসেচের ডোঙা, মাছ ধরার ঘুনি, বার, ফলুই, খালুই, চাটুনি জাল, গাঁতি জাল ক্রমশ এখন বিলুপ্তির পথে। কিন্তু আমার সেই ছোটবেলার গোষ্ঠভবনের স্মৃতির মিউজিয়ামে সবকিছুই সুরক্ষিত হয়ে আছে।

*******

Sahityika Admin

7 comments

Leave a Reply to শংকর কুমার চন্দ্র Cancel reply

  • ছেলেবেলার মাটির গন্ধ অনেকদিন বাদে পেলাম। আমার বাল্যকাল আর লেখকের বাল্যকাল মোটামুটি একই রকম ছিল, আমরা একই ধারায় শৈশব কাটিয়েছি।
    লেখাটা খুব ভালো লাগলো।

    • প্রিয় শংকর-বাবু, কুলপুকুরের মাঠের স্মৃতিচারণা যে আপনার বাল্যকালের স্মৃতির পটে গেঁথে থাকা গ্রামীণ জীবন এবং সংলগ্ন মেঠো জীবনের গন্ধে ভরপুর থাকা চিত্ত বৃত্তির অঙ্কুরোদগম করেছে, জানতে পেরে গর্ব বোধ করছি। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার চিন্তা ভাবনা শেয়ার করার জন্য।

  • কুলপুকুরের মাঠ গল্পে কিশোর বয়সের গ্রাম বাংলায় বেড়ে ওঠার সেই সময়ের চিত্রটা খুব ভালো তুলে ধরা হয়েছে। আমিও গ্রাম বাংলার ছেলে, আমার ছেলেবেলার দিনগুলি, আমার বন্ধুদের কথা মনে পড়লো। কলেজ পেরিয়ে কর্মজীবনে ঢুকে আর গ্রামে ফেরা হলো না। এখন মাঝে মাঝে যাই, ধ্বংস দেখে আসি। এই ধ্বংসের জন্য আমিও দায়ী।

    • প্রিয় প্রশান্ত বাবু, আমিও একইরকম কষ্ট পাই, যদিও কুলপুকুরের মাঠ এখনও এতটা ধ্বংস হয় নি। ধান তোলা আর ঝাড়াই মাড়াইয়ের পর খড়ের বোঝাগুলো মাঠেই পুড়িয়ে ফেলা হয়। সারা মাঠ এরকম জ্বলতে দেখে কষ্ট হয়। কিছু করার নেই, পরিবর্তন মেনে নেওয়া ছাড়া। ভালো থাকবেন।

  • অসাধারণ সুন্দর, জ্বলজ্যান্ত মন ভাল করা এক ছবি…..

    • কুলপুকুরের মাঠ আপনার মনে দাগ কেটেছে জেনে, নিজের অজান্তেই চোখে জল এসে গেলো। তিলকবাবু, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটা পড়ার জন্য আর এইরকম আবেগপূর্ণ কমেন্ট করার জন্য। ভালো থাকবেন।