সাহিত্যিকা

আমার হযবরল

আমার হযবরল
@শান্তনু দে, ১৯৮৯ মেটালার্জিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং

১ নম্বর (প্রথম দিন ও তারও আগে)
জয়েন্টের রেজাল্ট দেখে, বাড়ি ফিরে বলতেই বাবা বাক্যিহারা, শকড। মা শুধু বললেন, “আমি জানতাম। “কী ভাবে জানতেন এরকম একটা অভাবনীয়, অকল্পনীয় ব্যাপার, তা অবশ্য কোনদিন ভেঙে বলেন নি। যাই হোক দিন দুয়েক পরে, শকের প্রভাব একটু কমলে, বাবা হাতে কড়কড়ে পাঁচটা একশো টাকার নোট দিয়ে বললেন, “যা, ভাল কিছু জামা কাপড় কিনে নে। কলেজে তো লাগবে।”

অনেক দিন ধরে একটা জিন্সের প্যান্ট আর এক জোড়া স্নিকার্স-খুব ইচ্ছে। কিন্তু সেই যুগে লেভাইস, লী, পেপে, গেস, ডিজেল বা কেলভিন ক্লেইন তো পাওয়া যেত না, এমন কী দেশের প্রথম ব্র্যান্ডেড জিন্স প্যান্টালুন্সের ‘বেয়ার’ আসতেও বছর কয়েক দেরী আর স্নিকার্স বলতে বাটা কোম্পানীর নর্থ স্টার। কানাঘুষোয় শুনেছিলাম, নিউমার্কেটে নাকি গরুর দুধ-ও পাওয়া যায়। তা, জিন্স কিনতে নিউ মার্কেটেই পৌঁছে গেলাম। আভিস বলে একটা দোকান ছিল, বেশ ভাল ভাল জিন্স পাওয়া যেত…কলকাতায় বোধ হয় একটাই।

জিন্স, সাদা টি শার্ট আর সাদা নর্থ স্টার জুতোয় সেজেগুজে যথা সময়ে বিক্কলেজে তো পৌঁছে যাওয়া গেল। আট নম্বর হোস্টেলের ৩০৩ নম্বর ঘরে, জিনিস পত্র রেখে বাইরে এসে একটা সিগারেট সবে ধরিয়েছি। একটা রোগা মত, ঢোলা পায়জামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত ছেলে এসে জিজ্ঞেস করলো,”এই তুই কে বে?”
আমি, একটু বিরক্ত হয়ে, “শান্তনু দে, ফার্স্ট ইয়ার মেটালার্জি। তুই কে বে?”
শুনে ছেলেটার চোখ ছানা বড়া হয়ে গেল, এক থাপ্পড়ে সিগারেট ফেলে দিয়ে, চেঁচিয়ে উঠলো, “ফ্রেশার ফ্রেশার।” তারপর একটা ধাক্কা মেরে বললো, “তোর সাহস তো কম নয়, ফ্রেশার হয়ে সিগারেট খাচ্ছিস। শালা, কী মাঞ্জা দিয়ে এসেছিস! লজ্জা করে না? মেটালার্জি পেয়েছিস, তাও আবার এত ড্রেস মেরে এসেছিস? তোর মাথার থেকে তো জামা কাপড়ের দাম বেশী। পাশ করে তো ফ্যা ফ্যা করে ঘুরবি, চাগরি বাকরি পাবি না। আবার সেইন্ট মেখে এসেছে। গেঁয়ো ভূত কোথাকার।
বল, (আমার বুকের দিকে আঙ্গুল তুলে) বুকে ও দুটো কি?”
এটা কমন ছিল। কোন শারীরবৃত্তীয় উত্তর দিলে সে দিন রাম ক্যালানি ভাগ্যে ছিল।
ভয়ে ভয়ে বললাম,”ভাওয়েল”
– “বাঃ, জানিস দেখছি। চল রসগোল্লা খাই।”

ওয়েল কাম টু বিক্কলেজে।

২ নম্বর (রিপোস্টিত)
অঞ্জন আর ভিভেক
হোস্টেল আটে, আমাদেরই ফ্লোরে, ঠিক পাশের রুম…মানে ৩০৪ এ এসে জুটলো অঞ্জন ব্যানার্জি আর ভিভেক ঘুটঘুটিয়া, দুজনেই আমার মত জয়েন্টের rank-লিস্টে জাস্ট ঢুকে মেটালার্জি পেয়েছে। অঞ্জনের বেশ পেশীবহুল চেহারা, কিন্তু কি ভাবে যেন ওর নিকনেম হয়ে গেল সখী। কলেজে প্রত্যেক ব্যাচেই এক বা একাধিক সখী, ড্যাড, বাবা এই ধরনের নামধারী দেখতে পাওয়া যেত। আর ভিভেক? ঘুটঘুটিয়া থেকে ঘুঁটে! অঞ্জন ছিল কিশোর কুমারের ব্যাপক ফ্যান। ওর লাইফের একমাত্র গোল ছিল কিশোরের সব গান সংগ্রহ করা। মোটামুটি করেও ফেলেছিল। রবীন্দ্রসদন মেট্রো স্টেশনের উল্টো দিকে সুরলহরী বলে একটা রেকর্ড/ক্যাসেটের দোকান ছিল। ওদের ছিল বীভৎস রেকর্ডের কালেকশন। অঞ্জন একটা ডায়েরিতে নতুন শোনা কিশোরের গান নোট করতো, আর মাসে একবার সুরলহরী-তে গিয়ে সেই গান গুলো রেকর্ড থেকে ক্যাসেটে ট্রান্সফার করে নিয়ে আসতো। ভিভেক সারা দিন পাবলিকের সাথে ‘মুরগী আগে না ডিম আগে ‘এই সব দার্শনিক ব্যাপারে ভাট মারতো। ভাট শেষ হতো, যখন ভিভেক বলতো, “হামি কুছু জানি না, ডিম আগে ব্যাস।” ভিভেকের ছিল নাটকের শখ। কলেজের নাটকের দলে, লম্পট জমিদার, দৈত্য, অসুর বা কিছু না হলে মড়া সৈনিক বা ভাঙা ল্যাম্পপোস্টের রোল পাক্কা। পরে ঊষা গাঙ্গুলীর নাটকের দলে অভিনয়-ও করেছে, এমনকি প্রসেনজিতের সাথে একটা ফিল্মেও। সেই ফিল্মে ওর একটা মাত্র ডায়লগ ছিল। কিন্তু ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ গল্পের পটলবাবুর মতোই সেই ডায়লগ খুব নিষ্ঠার সাথে ভিভেক বলেছিল। সেই সিনেমাটা আমি ভিসিআর-এ দেখেছি। ভিভেকের নিষ্ঠা দেখে আমার চোখ প্রায় ছলছল হয়ে উঠেছিল।

অঞ্জন আর ভিভেক আমাদের কলেজের আন্তাকসরী টিমের মেম্বার ছিল। অঞ্জনের গানের গলা বেশ ছিল, ভিভেকের ততধিক বাজে। কিন্তু ভিভেক ফটাফট গান বানাতে পারতো, স্টেজেই। গান শেষ হলে বলতো,” রাজকুমারী, সায়গল,1947 বা দিল দিয়া তুঝে মেরি সনম, উমা দেবী 1965″…কোনদিন অবশ্য ধরা পড়তে দেখি নি।

যাই হোক আমরা তিনজন গ্রূপে স্টাডি করতাম। মানে অঞ্জন ওর লেখা নোটস পড়তো প্রিন্স হেনরি টানতে টানতে, আমি শুয়ে শুয়ে শুনতাম, ওই প্রিন্স হেনরি টানতে টানতেই, কাউন্টার। কোন ডায়াগ্রাম থাকলে অঞ্জন বলতো,”পাগলা, ওঠ… ডায়াগ্রাম আছে।” আমি টুক করে উঠে দেখে আবার শুয়ে পড়তাম। এই যে পাশ-টাশ করে চাকরি করে খেয়ে পরে আছি, ফেসবুকে আবোল তাবোল ভাট লিখছি তার পুরো কৃতিত্ব অঞ্জনের। ভিভেক ভুরু টুরু কুঁচকে এক দৃষ্টিতে নোটস-এর দিকে তাকিয়ে থাকত আর মাঝে মাঝে বলতো,”হামি তো কুচ্ছু বুঝতে পারছিনা।”
আমি ওই শুয়ে শুয়েই, আর ভিভেক কিছু না বুঝেই যথা সময়ে মেটালার্জি পঠন-পাঠন শেষ করেছিলাম, সেটাই যা রক্ষে।

৩ নম্বর
কলেজে গিয়ে বেশ অনেক নতুন প্রতিশব্দ /বাগধারা শিখেছিলাম। তার একটা হলো ল্যাদ মানে আলসেমি …খুব সম্ভবতঃ lethargy থেকে উৎপন্ন। lethargy থেকে লেথ হওয়া উচি, ল্যাদ কেন? বোধ হয় লেথখোরকে লাথখোর শোনাতে পার, তাই লেথ হয়েছে ল্যাদ। আমরা কলেজে টু ডাইমেনশনাল মাছের টুকরো, জামদানি শাড়ির মতো পাতলা ফিনফিনে ডাল, সস্তা সিগারেটের সঙ্গে এটাও খুব খেতাম। রাতের শেষ সিগারেটটা বিছানায় হেলান দিয়ে খেতে খেতে ঘুমচোখে, মাঝে মাঝে হাত থেকে খসে মেঝেতে পড়ে যেত। ওটা আর তুলতাম না। এটা এক ধরনের সঞ্চয়ও ছিল। সিগারেট দুর্ভিক্ষের সময় খাটের তলা খুঁজলে বিস্তর আধ-ফোঁকা সিগারেট পাওয়া যেত। খাটের তলা ছিল আমাদের সিগারেটের সেভিংস ব্যাংক একাউন্ট।আমি ফোর্থ ইয়ারে রিচার্ডসন হলে থাকতাম। একবার ঘরের বাল্ব কেটে যাওয়ায় প্রায় তিন মাস লাগাই নি। টেবিল লাম্প দিয়েই ম্যানেজ করতাম। তারপর সেটাও কেটে গেলে ,বাধ্য হয়েই দুটো বাল্ব কিনতে হয়েছিল।

এখনো ল্যাদ খেতে খুব ইচ্ছে করে, বিশেষত সপ্তাহান্তে। সারা সপ্তাহ দৌড়ঝাঁপ করে শরীর আর দেয় না। ইচ্ছে করে চুপচাপ সোফায় তাকিয়া -টাকিয়া সহযোগে বসে থাকি আর ঢুলি। তবে ভুক্তভোগী মানেই জানেন রবিবার কাজ কিছু কম থাকে না। বাজার করো রে ,ফ্যান-এ সি পরিষ্কার করো রে, হ্যান করো, ত্যান করো। তা এতসব কাজ করার একটা ম্যান ফ্রাই ডে পেয়েছি। পাওয়াটাও বেশ কাকতলীয়। আমাদের একটা উঁচু কাঠের টুল ছিল। বাল্ব চেঞ্জ করতে,ফ্যান পরিষ্কার করতে কাজে লাগতো। একবার ওটা ভেঙ্গে গেলে দু তিনমাস সারানোর কোনো উদ্যোগ নিই নি। যদি এইভাবে কিছু দিন ল্যাদ খাওয়া যায়। এই সময়ে এলো মোহাম্মদ আলি ,ইলেকট্রিশিয়ান, কোনো একটা অন্য কাজে। যে হেতু এর উচ্চতা বেশ বেশী, প্রায় সাড়ে ছ ফুট…একে দিয়েই বাল্ব চেন্জ আর ফ্যান পরিষ্কার করিয়ে নেওয়া গেল, কোনো রকম টুল ছাড়াই। তেলুগু ছেলে তবে হিন্দিও ভালো বোঝে। হাতের কাজও বেশ পরিষ্কার। তা গত রবিবার কী একটা কাজে ফোন করেছিলাম… ওর মেয়ে ফোন তুলে বললো ,” বাবা ব্যস্ত আছে…রেকর্ডিং করছে।” শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বৌ কে বলতে, শুনলাম আমার নাকি কানটাও গেছে। কী শুনতে কী শুনেছি। যাই হোক ঘন্টা খানেক পরে আলি-সাহেব সশরীরে হাজির। জানা গেল, আমাদের মোহাম্মদ আলি নাকি একজন গায়ক। স্টার মেকার না কী একটা বস্তু আছে ,সেখানেই গানের রেকর্ডিং করছিল। ইউ টিউবে ও আর ওর ভাই-এর প্রায় ছ হাজার ভিডিও আছে। সোফায় ঠ্যাং-এর উপর ঠ্যাং তুলে বসে চা -জল খাবার খেতে খেতে ওর নজর পড়লো আমার সদ্য কেনা ব্লু টুথ স্পিকারের দিকে। নিজেরই গান ভালো করে, প্রায় ঘন্টা খানেক সেটায় শুনে আলি সাহেব সার্টিফিকেট দিলেন, জিনিসটা খাসা। তার পর যা হলো তার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। বললো “স্যার ,এটা আমায় দিয়ে দিন। আপনি তো শুধু শোনেন, গাইতে পারেন না। বুঝতেই পারছেন আপনার থেকে আমার দরকার অনেক বেশী। আর আপনার বিস্তর সিডি আছে, ভালো সিডি প্লেয়ার আছে…আপনার মতো সমঝদারের এই ব্লু টুথ স্পিকার মানায় না। “কী করে বোঝাই যে সিডির দাম বিস্তর বেড়ে গেছে ,পাওয়াও যায় না। সি ডি কিনতে গেলে অনাহারে না হলেও অর্ধাহারে থাকতে হতে পারে। তারপরও অনেক লজিক টজিক দিলো। কিন্তু আমি একদম ঠিক করে রেখেছিলাম মনটাকে নরম হতে দেব না…রাহুল দ্রাবিড়ের মতো একদম দেওয়াল হয়ে থাকবো। পরের সপ্তাহে পেরেছি। আজ আবার রবিবার…খুব টেনশনে আছি। কী হয় ,কী হয়।

৪ নম্বর
ঠাকুর্দা, আমার নাম রেখেছিলেন জ্ঞানদারঞ্জন। মা, কাকীমা এদের সে নাম পছন্দ ছিল না, নাকি বড্ড সেকেলে। তা ছাড়া ভয় ও ছিল এই জ্ঞানদা নাম নিয়ে মাধ্যমিকে দু বার গাড্ডা খেলে বা সামান্য ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস না করতে পারলে? ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ এফেক্ট আসতে পারে। তাদের আশঙ্কা পুরো অমূলক না হলেও খুব একটা ভুল ছিল না। কিন্তু নামট যেটা রাখলেন সেটা এতই ছোট, যে শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। এই না হওয়া নাম ,মানে জ্ঞানদারঞ্জন নিয়ে আমার মনে বেশ দুঃখ ছিল মনে আছে। ছোট বেলা থেকেই বড় নাম নিয়ে আমার ফ্যাসিনেশন…পেলের আসল নাম ছিল এডসন আরান্তেস দি নাসিমেন্টো। কী মিষ্টিই না লাগতো নামটা…আহা কবিতার লাইন যেন একটা। কর্ম জীবন কাটছে এমন জায়গায় সেখানে নাম শুরু হলে আর শেষ হয় না। আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নাম , পামুলাপার্থী ভেঙ্কটা নরসিমহা রাও। এখানকার হিসেবে বেশ ছোট। তেলুগুদের এত বড় বড় নাম হয় যে সংক্ষেপে A to Z বলে ডাকার চল আছে। আমার ফোনে A to Z Murthy, A to Z Srinivas এই সব নাম সেভ করা আছে। সব থেকে হাইট হলো, এখানকার একটা স্টেশন আছে,তার নাম ভেঙ্কটানরসিমহারাজুভারিপেটা। যাই হোক আমাদের বংশে এক নতুন অতিথির আগমন হয়েছে। ফ্যামিলি হোয়াটসএপ গ্রূপে (যেখানে সবাই সকালে গুচ্ছ গুচ্ছ গুড মর্নিং আর রাতে গুড নাইট সম্বলিত বাণী দেয়) নাম রাখা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বাবা ,মা দুজনেরই নাম ‘র’ দিয়ে শুরু, সুতরাং তাদের ইচ্ছে বাচ্চার নামও তাই হোক। আমি কতগুলো নাম সাজেস্ট করলাম… রামকানাই (ঠিক আছে এটা না হয় বাদ দিলাম, স্বয়ং রবি ঠাকুর নামটাকে একটু কালিমালিপ্ত করে গেছেন), রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, রমণীমোহন (ছোকরা বেশ হ্যান্ডসাম হয়েছে), রামকৃষ্ণ, রবাহূত (এটার মানে খুব একটা সুবিধের নয়,কিন্তু এদের জেনারেশনে কেই বা এই সব শব্দের মানে জানবে), রাসপুটিন (পুটিনের থেকে খারাপ নয় মোটেও) থেকে শুরু করে রবিন উইলিয়ামস, রবার্ট ডাউনি জুনিয়র, রেইন এন্ড মার্টিন। কিন্তু এদের এসব নাম পছন্দ হলো না। যাক হে যাক, যা ইচ্ছে নাম রাখুক,আমার কী?

৫ নম্বর
এই বিই কলেজ ফেসবুক গ্রূপটা খুবই শান্ত…কোনো রকম ঝুট ঝামেলা, ঝগড়া ঝাঁটি, ব্যান, ব্লক এইসব নেই। একটু অশান্তির আগুন লাগানো যাক।

সারা জীবন অপারেশন-এ কাজ করেছি। স্টিল প্ল্যান্টে এঁদের প্রধান কাজই হলো, মেইনটেনেন্স টিমকে অনুরোধ করে, পায়ে পড়ে ,হুমকি দিয়ে ,গালাগালি দিয়ে (মানে যে ভাবেই হোক না কেন ) যন্ত্রপাতির প্রবলেম সল্ভ করানো। তা ইলেক্ট্রিকাল হলো প্রায় বুদ্ধিজীবী ক্লাস… এদের বেশী ঘাটানো উচিত হবে না। রেগে গেলেই বলবে পি এল সি লজিক করাপ্ট হয়ে গেছে, আবার প্রথম থেকে করতে হবে। লজিক শুনলেই বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে। তাই এদের বিশেষ ঘাটাই না। তবে কোনো রকম মডিফিকেশন না করার জন্য স্ট্রিক্ট ইন্সট্রাকশন দিয়ে রেখেছি। দু’একবার খুব খারাপ অভিজ্ঞতা আছে। মেক্যানিকাল আবার দু রকম। একদল প্রবলেম শুনে বলবে এ ভারী কঠিন কাজ, হওয়া মুস্কিল… এই স্পেয়ার লাগবে, হ্যান চাই ত্যান চাই। তাই এদেরও কিছু বলি না। আর একদল অতি উৎসাহী আছে তারা বলবে ঘন্টাখানেকের মধ্যে হয়ে যাবে। দু ঘন্টা পরে বলবে আরো আধ ঘন্টা …সেই আধ ঘন্টা অবশেষে আট ঘণ্টায় দাঁড়াবে। তারপর ও শুনতে হতে পারে…”হলো না স্যার। পুরনো টা লাগিয়ে দি?”
-“কত সময় লাগবে? ”
-” এই ঘন্টা খানেক।”
তাই এদের আমি কোনো কাজ শুরু করার আগে ভাবা প্র্যাকটিস করার ইন্সট্রাকশন দিয়েছি। লাভের মধ্যে কাজ আজকাল আরো দু ঘন্টা পরে হচ্ছে।
” বাহ, ভাবতে সময় লাগবে না!”

৬ নম্বর
সত্তর আশির দশকে জীবন খুবই আন-কমপ্লিকেটেড ছিল। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান (চার বছর পরে পরে বিশ্ব কাপ ফুটবল), উত্তম -সৌমিত্র, হেমন্ত-মান্না, কংগ্রেস-সিপিএম …মানে বলতে চাইছি, চয়েজ অনেক কম ছিল। বাথরুমেও তার প্রতিফলন দেখা যেত… চৌকো মত লাক্স বা লাইফবয় সাবান (শীতকালে অবিশ্যি ওভাল শেপের গ্লিসারিন সাবান ), আর লম্বা মতন ক্লিনিক শ্যাম্পু। ঝামেলা শুরু হলো সি কে প্রহ্লাদ বাবু ‘Fortune at the bottom of Pyramid’…লিখে ফেলায়। চেন্নাই-এর চিক শ্যাম্পু bottom of the pyramid এ ঢুকতে গিয়ে আম-জনতার জন্যে , ট্র্যাডিশনাল বোতল ছেড়ে সস্তায় শ্যাশেতে শ্যাম্পু বিক্রি করা শুরু করে। পরে অবশ্য অন্যান্য এফ এম সি জি কোম্পানিও একই পথে হাঁটা শুরু করে। সেই শ্যাশেতে একটা খাঁজ কাটা। উদ্দেশ্য -ওখানে টান মারলে ওটি খুলবেন। কিন্তু সাক্সেস রেট ছিল খুবই কম। আমি একবারই ট্রাই করেছি…মিনিট পনেরো ধস্তাধস্তি করে হাত থেকে স্লিপ করে কমোডে পড়ে তার সলিল সমাধি (টেকনিকালি হয়তো ভুল শব্দ) হয়। হয়তো একটু অফ দ্য ট্রাক। তাও বলে রাখি এই সব হাল আমলের প্যাকেট খোলায় আমি খুব একটা পারদর্শী নই । একবার গ্লোবে কী একটা সিনেমা দেখতে গিয়ে ইন্টারভ্যালে এক প্যাকেট লে’জ নিয়ে ঢুকেছি। মিনিট পনেরো টানা হ্যাঁচড়া করে পাশের দাদাকে (অচেনা অবশ্য) বললাম,”দাদা একটু খুলে দিন না “…এমন কটমট করে তাকালো যে রক্ত হিম হয়ে গেল। মিনিট দশেক পরে অন্য পাশের বৌদি কে সেই একই অনুরোধ জানালাম। “পাগল না কী !” বলে দু চারটে সিট ছেড়ে বসলেন। সেই প্যাকেট হাতে করে বাড়ি নিয়ে গিয়ে কাঁচি দিয়ে কেটে খেয়েছিলাম, সেটা মনে আছে।

যাই হোক,আসল টপিকে ফিরে আসি…আজকাল চয়েজ বেড়ে গিয়ে, বাথরুমে ঢুকে দেখা যায় থরে থরে শিশি-বোতল। শাওয়ার জেল, হেয়ারজেল, শ্যাম্পু, ময়েসচেরাইজার…সবই বোতলে। তবে সুবিধে হলো, সিলভার লাইনিং ও বলা যায় জিনিষগুলোর ইন্টার-চেঞ্জেবিলিটি খুবই ভালো। ধরুন আপনি শাওয়ার জেল ভেবে একটু ময়েসচেরাইজার গায়ে মেখে নিলেন। বা শ্যাম্পু ভেবে মাথায় শাওয়ার জেল মেখে নিলেন…কিছুই ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। তবে এই রবিবার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। হাত থেকে শ্যাম্পুর বোতলটা পড়ে গেল। আমিও হাতড়ে হাতড়ে বাথরুমের মেঝে থেকে একটা বোতল তুলে মাথায় মাখলাম। গন্ধটা একটু অদ্ভুত লাগলো। নতুন কোনো ব্র্যান্ড ভেবে ইগনোর করলাম। স্নান করে বেরোতেই গিন্নি মাথাটা একটু শুঁকে মড়া কান্না জুড়লেন, “ওরে ডিলান (আমার ছেলে), তোর বাবা মাথায় ফিনাইল দিয়ে চান করে এসেছে”…ইত্যাদি প্রভৃতি।”

৭ নম্বর
৮৯ সালে যখন চাকরি নিয়ে ভাইজ্যাগে এলাম, মাস ছয়েক পরে পরেই বেশ হোমসিক ফিল করতাম। বাড়ি আসার প্রিপারেশন ছিল বেশ লম্বা। মাস দুয়েক আগে এজেন্টকে দিয়ে ট্রেনের টিকিট কাটানো, ছুটির দরখাস্ত করা। দুটোই খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। তখন ভাইজ্যাগ-কলকাতা রুটে ফ্লাইট চালু হতে বেশ কয়েক বছর বাকি। থাকলেও হয়তো এফোর্ড করতে পারতাম না। তাই আমার প্রিয় ট্রেন ছিল করোমন্ডল এক্সপ্রেস। একটু আগে সিটি গিয়ে একটা বিয়ার আর চাইনিজ খেয়ে ট্রেনে উঠতাম। সঙ্গে থাকতো স্টেশন থেকে কেনা দেশ বা আনন্দমেলা আর দু প্যাকেট সিগারেট। এরকম এক ট্রেন সফরেই প্রথম সুমন চট্টোপাধ্যায়ের কথা পড়ি। তখনো তোমাকে চাই গানের আলব্যামটা বেরোয় নি। তবে সেবার রবীন্দ্র সদনে ওঁর দ্বিতীয় লাইভ কনসার্ট শোনার সুযোগ হয়েছিল।

তখন ট্রেনে সিগারেট না খাওয়ার এত কড়াকড়ি ছিল না। রাতের অন্ধকার কেটে ট্রেন ছুটে চলতো, দূরে কাছে ছোট বড় জনপদ। মাঝে মাঝে কোথাও একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়তো সিগন্যাল না পেয়ে। পূর্ণিমার কাছাকাছি সময় হলে ,সে এক অপার্থিব সৌন্দর্য্য। সকালবেলার অনেকটা সময় যেত উড়িষ্যা /বাংলার ধানখেত, পুকুর, এইসব দেখে। খড়গপুর পৌঁছলে স্টেশনের ট্রেডমার্ক লুচি আর আলুর তরকারি খেতাম। হাওড়া পৌঁছনোর কয়েকশো মিটার আগে হাওড়া ব্রিজ কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা যেত, দেখলেই বুকটা খুশিতে ভরে উঠতো। হাওড়ার প্রিপেড ট্যাক্সির লাইনে ঘন্টা খানেক দাঁড়িয়ে, বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সেই বিকেল চারটে। বেশ কষ্টকর জার্নি ছিল বলেই হয়তো বাড়ি যেতে এত ভালো লাগতো। এখন ফ্লাইট চালু হতে ,আসা অনেক সহজসাধ্য। তাই হয়তো সেই আবেগ আর নেই।

৮ নম্বর
ডেনমার্কে বরফ পড়ছে। যুবরাজ হ্যামলেট রোববার ঘুম থেকে উঠে ভাবলেন,”To bath or not to bath, that is the question.” ও দিকে শেক্সপিয়ার শুনলেনও তাই, কিন্তু লেখার সময় অস্তিত্ববাদী হয়ে লিখে ফেললেন,” to be or not to be…”. হবে না? শেক্সপিয়ার গিন্নি তখন চিল-চিৎকার জুড়েছেন, “বললাম, আলু আর আদা, আনলে পেঁয়াজ আর রসুন! তুমি জানো না মাংসে আলু না দিলে আমি খেতে পারি না?”

সে যাই হোক, হ্যামলেটই প্রথম নয়…”to bath or not to bath ” যুগে যুগে মুনি ঋষিদের চিন্তার বিষয়।বেদ, বেদান্ত, পুরাণ, ওল্ড টেস্টামেন্ট, কোরান, ঝেন্ড আভেস্তা সবেতেই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে ওঁরা লিখেছেন এই সন্দেহের কথা।কী বললেন? জানতেন না! ভাল করে মন দিয়ে আবার পড়ে দেখুন।ঋক বেদ দিয়ে শুরু করুন।

আমাদের চামড়ার সব থেকে বাইরের স্তর হচ্ছে এপিডার্মিস। বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রতি আঠাশ দিনে সব পুরনো এপিডার্মিস কোষ মরে গিয়ে নতুন কোষের জন্ম নেয়, তাই প্রতি মাসে একদম নতুন আপনি। পুরীতে জগন্নাথদেব যেমন প্রতি বারো বছরে নবকলেবর ধারণ করেন, সে রকম আপনিও প্রতি মাসে একদম ব্র্যান্ড নিউ নব কলেবর। তা এই নতুন চামড়া পেয়ে আপনি কী করছেন? না চান করছেন …করে যত রকমের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া শরীরে ঢোকাতে চাইছেন। ভাগ্যিস এপিডার্মিস লেয়ারটা ওয়াটারপ্রুফ নয়তো এক সপ্তাহেই আপনি…

ধরুন আপনি সারা দিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জায়গায় থাকেন, আই টি কর্মী, বা শপিং মলের সেলস ম্যান…দিনের মধ্যে দুবার তিন বার স্নান করারই বা কী দরকার।সরকারের উচিত আধার, প্যান এসবের মত বাথ কার্ড চালু করা।

সেখানে ভৌগলিক অবস্থান, পেশা এ সবের উপর স্নান করার অধিকার নির্ভর করবে। কাশ্মীরে পনের দিনে একবার স্নান করলেই হবে কিন্তু চেন্নাইতে দিনে একবার। কাশ্মিরীরা মাসে দুটো বাথ কোটা পাবে কিন্তু তামিলরা মাসে তিরিশটা ।কাশ্মীর থেকেই শুরু করা যাক …ওদের এখন ইন্টারনেট নেই…এই ব্যাপারে ফেসবুকে হুজ্জুত করতে পারবে না। সেরকম চাষীভাইরা বা শ্রমিকভাইরা মাসে তিরিশটা বাথ কোটা পাবেন, কিন্তু আই টি শ্রমিকরা মাসে দুটো।

অক্ষয়কুমারকে দিয়ে কয়েকটা প্রোপাগান্ডা ফিল্ম বানাতে হবে,”নাহানা মানা হ্যায়” এই টাইপের টাইটেল দিয়ে, স্বরা ভাস্কর নায়িকা। গল্প এরকম হবে, শুরুতে দেখানো হবে অক্ষয় কুমার প্রকৃত দেশ ভক্ত, মাসে দু দিন স্নান করেন। বাকিটা ডিও দিয়ে ম্যানেজ করেন। স্বরা ভাস্কর বিরক্ত হয়ে ওঁকে ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু ছবির শেষে, উনি ভুল বুঝতে পারবেন ও ফিরে এসে নিজেই মাসে একবার স্নানের থিওরি দেবেন।

টেকনোলজিস্ট স্যারদের অনুরোধ করবো, এমন কিছু যন্ত্র বানান, টেকনোলজি আনুন যাতে জল খরচ হবে না, কিন্তু বেশ একটা স্নান স্নান ফিলিং আসবে। এ আই, এম এল, ব্লক চেইন যা ইচ্ছে লাগান। কিন্তু তাড়াতাড়ি করুন। ওষুধের কোম্পানিগুলোকে এমন কিছু আবিষ্কারের জন্য অনুরোধ করছি, যা সেবন করলে বেশ একটা স্নান করেছি টাইপের অনুভূতি আসবে। পারবেন, ঠিক পারবেন… চেষ্টা করলে কী না হয়।

Sahityika Admin

2 comments

Leave a Reply to Asok Kumar Ghosh Cancel reply

  • Santanu, as usual in his best form, de la grandi mefistofilis ….
    Another few greats from Santi, cheers.

  • Bhaijag khub taratari sesh hoe gelo.1989 theke katodin tao bojha gelo na. hathat Denmark keno chale elo ? Bhaijag ar Denmarker samay sarani die dile porte subidha hoto. Lekhata khub bhalo hoeche. Anek Subhechha roilo.

    Asok Kumar Ghosh 1965 Mining