সাহিত্যিকা

মায়াবতী মেঘ

মায়াবতী মেঘ
তৃণাংকুর সাহা, ১৯৮৫, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

আমরা জানি, অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। অপূর্বসুন্দর কিন্তু ডাক্তার হতে চেয়েছিল।

অপূর্বসুন্দরের বোন, তিশা খুব ছোটোবেলায় একবার ম্যালেরিয়ায় বেশ কয়েকদিন ভুগেছিল। অপূর্ব তখন গ্রামের হরিসভা প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস টু’তে পড়ে। আর তিশা শিশুশ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে, বেশীরভাগ দিন দাদার সঙ্গেই যাতায়াত করে। ওদের গ্রামেরই ডাক্তার চন্দ্রশেখর ধাড়া তিশা’র চিকিৎসা করেছিলেন। ছোটো বোনের অসুস্থতা, ডাক্তারের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠা, …… সব নিজের চোখের সামনে দেখে সম্ভবত তখনই সেই শিশু অপূর্বর মনে ডাক্তার সম্পর্কে একটা অন্যরকম ধারণা তৈরী করেছিল। মনে মনে ঠিক করেছিল, বড় হয়ে ডাক্তার হবে, মানুষের অসুখ ভালো করবে (তার নিজের ধারণায় এখনকার অনেক অর্থপিশাচ ডাক্তারের মতো নিশ্চয় নয়)। অপূর্বদের গ্রামে আরেকজন ডাক্তার ছিলেন, ডাঃ সূর্যশেখর ভৌমিক। অনেকে রসিকতা করে বলতেন, ‘চন্দ্র, সূর্য দুইই আমাদের গ্রামে, ভয় কীসের’?

অপূর্ব যখন ক্লাস নাইনে, এক রবিবারের সকালে স্কুলের মাঠের ধারে খেলার সময় ভাঙা কাঁচের গ্লাসের টুকরোয় ওদের এক বন্ধু সজলের পা কেটে যায়। সবাই মিলে সজলকে সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে যায় ডাঃ ভৌমিকের কাছে। সজলের পায়ে তিনটে সেলাই দিতে হয়েছিল। সেলাই করার সময় সজলের কান্নাকাটি আর চিৎকারে ডাক্তারখানার মধ্যেই অপূর্ব অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। সেদিনই বোধ হয় ও মনে মনে বুঝতে পেরেছিলো, ডাক্তার হওয়ার মতো নার্ভের জোর ওর নেই। বিশ্বাস করেছিলো, জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষকের কথাই হয়ত সত্যি, “যে ছেলে পাঁঠা কাটার রক্ত দেখতে পারে না, সে কিন্তু কোনোদিন ডাক্তার হতে পারবে না”।

পারেও নি। ডাক্তার হতে পারে নি অপূর্বসুন্দর, হয়েছিল ইঞ্জিনীয়ার। কিন্তু ডাক্তার হতে না পারার সেই অব্যক্ত দুঃখকে প্রকাশ করার জন্য ঠিক করেছিল চাকরির সাথে সাথে গল্প লিখবে, গল্পের মধ্যেই নিজেকে ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। সেই কলেজজীবনের বাংলা সিনেমা, ‘সূর্যশিখা’র উত্তমকুমার কিংবা ‘মাল্যদান’-এর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্র গভীর দাগ কেটেছিল অপূর্বর মনে। বেশ কিছু গল্প লিখেছে অপূর্ব গত কুড়ি বছরে। অনেক গল্পই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, কয়েকটা বইও বেরিয়েছে। বহু কাহিনীরই প্রধান চরিত্র কোনো একজন ডাক্তার। এরকমই এক গল্প নিয়ে পরিচালক অলোকেন্দু বসু একটা বাংলা সিনেমা তৈরী করলেন ‘মায়াবতী মেঘ’। গল্পটা পছন্দ হওয়ার পর অলোকেন্দুবাবু যেদিন ফোন করেছিলেন, খুব আনন্দ হয়েছিল অপূর্বর। এরকমই তো স্বপ্ন দেখতো ও। ঐ ছবির শ্যুটিংও দেখতে গিয়েছিলো কয়েকদিন। আগের মাসেই ছবিটা মুক্তি পেয়েছে, বেশ ভালোই চলছে।

ডাঃ ত্রিদিবেশ সান্যাল বিলেৎ থেকে এফআরসিএস পাশ করে এসে কলকাতার এক বড় হাসপাতালে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। মাসে দু একবার হুগলীর সোনাপুরে গ্রামের বাড়ীতে মা’বাবার কাছে চলে আসে। ত্রিদিবেশ ওরফে ঋভু, বাড়ীর একমাত্র সন্তান। বাবা এখনও গ্রামের স্কুলেই শিক্ষকতা করছেন, অবসর নিতে আরও কয়েক বছর বাকি। কলকাতা, লন্ডনে পড়াশোনা করলেও গ্রামের স্কুলের কয়েকজন বন্ধুর সাথে ত্রিদিবেশের এখনও যোগাযোগ আছে, বেশ কয়েক বছর পরে

অনেকের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎও হয়েছে। ছুটিতে গ্রামে এলে মাঝে মধ্যে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। অনেক সময় কোনো বন্ধুর বাড়ীতে গিয়ে ছিপ নিয়ে পুকুরপাড়ে মাছ ধরতে বসে পড়ে। কিংবা কোনো বন্ধুর আমবাগানে আম পাড়তে চলে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প আড্ডা ভালোই হয়। অন্যদিকে এই গ্রামেই পঞ্চাশ বেডের সরকারী সদর হাসপাতাল তৈরীর কাজ জোরকদমে চলছে। হয়ত এক বছরের মধ্যেই চালু হয়ে যাবে। গ্রামের লোকজন, বন্ধুবান্ধবরা সকলেই চাইছে, ডাক্তার ত্রিদিবেশ যেন এই হাসপাতালের দায়িত্ব নেয়।

কুহেলী সোনাপুর গ্রামেরই এমবিবিএস ডাক্তার বিশ্বনাথ মজুমদারের একমাত্র মেয়ে। সান্যালবাড়ির সাথে এঁদের খুবই সখ্যতা ছিলো এবং এখনও আছে। কুহেলীরা থাকতো ঋভুদের বাড়ির কাছাকাছিই, একই পাড়ায়। কুহেলী ওর থেকে প্রায় বছর চারেক ছোটো, পড়তো গার্লস স্কুলে। ছোটোবেলা থেকেই কুহেলীকে ঋভুর ভালো লাগতো। দেখতে বেশ ভালোই, একটু লাজুক প্রকৃতির। কুহেলী কিন্তু বড় হওয়ার পর কোনোদিন সে কথা বলতে পারে নি কাউকেই, না কুহেলীকে, না নিজের মাকে। কেন বলতে পারে নি, এর কোনো ব্যাখ্যা ওর কাছে নেই, আর থাকলেও ও সেটা বোঝাতে পারবে না। ঋভু কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে যাওয়ার পর দুজনের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ কম হতো সত্যি, তাই বলে কুহেলীর প্রতি ওর দুর্বলতা কোনোদিন এতটুকু কমে নি। এটাও ঠিক, কুহেলীর মনের ঠিকানা পাওয়ার চেষ্টাও তো ঋভু কখনো করে নি। নিজের মনে রবীন্দ্রনাথকেই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করতো, ‘পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী’। শেষ পর্যন্ত সুদূর বিলেতে বসে ঠিক করেছিল, দেশে ফিরে কুহেলীকে জানাবে ওর ভালোবাসার কথা। কিন্তু ওর দুর্ভাগ্য, সেই সুযোগ আর পায় নি। ইংল্যান্ড থেকে ফেরার কিছুদিন আগেই মায়ের ফোনে ঋভু জানতে পেরেছিল কুহেলীর বিয়ের খবর। পাত্র স্টেট ব্যাংকে চাকরি করে।

প্রায় তেরো চোদ্দ বছর পর ত্রিদিবেশের সঙ্গে দেখা ওর স্কুলের বন্ধু সাহাবুদ্দিনের। কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে এক রবিবারের সকালে ওদের বাড়ীতে এসে হাজির। প্রাইমারী স্কুল থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত দু’জনে একসাথে পড়াশোনা, খেলাধুলো করেছে। একসঙ্গে স্কুলের ফুটবল টীমেও খেলতো। তারপর সময়ের চাপে ধীরে ধীরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল দুজনের মধ্যে। এখন সাহাবুদ্দিনের একটা মোটর সাইকেলের শো’রুম আছে পাশের গ্রামে।

আজ ও এসেছে অনেকটা নিজের প্রয়োজনেই। ওর বউ-এর পেটে কিছুদিন ধরেই ব্যথা হচ্ছে। এখানকার কোনো ডাক্তারের ওষুধেই কাজ হচ্ছে না, তাই ডাক্তারবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছে। সাহাবুদ্দিনের যমজ কন্যাসন্তান, দু’বছর বয়স। এরপর ওদের আর সন্তান হবে না, ‘ছোটো পরিবারই সুখী পরিবার’, সাহাবুদ্দিনের কথা শুনে খুব ভালো লাগলো ত্রিদিবেশের। বন্ধুর মোটরবাইকে চেপে ডাঃ ত্রিদিবেশ চললো ওদের বাড়ি রুগী দেখতে।

শেষ পর্যন্ত এখানকার এমএলএ-র আন্তরিক প্রচেষ্টায় গ্রামের নতুন হাসপাতালের ডেপুটি সুপারের দায়িত্ব পেলো ডাঃ ত্রিদিবেশ। ওর মা, বাবাও চেয়েছিলেন ছেলে এই হাসপাতালেই যোগ দিক, গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করুক। আপাততঃ তিরিশ বেড নিয়ে হাসপাতাল চালু হয়েছে। ত্রিদিবেশের অক্লান্ত চেষ্টায় হাসপাতাল ভালোই চলছে। আউটডোরে রোজই অনেক পেশেন্ট। এখন অনেক চিকিৎসা কিংবা অস্ত্রোপচারের জন্যও এই মহকুমার লোকজনকে সাধারনত বাইরে যেতে হয় না। এলাকার মানুষ খুব খুশী।

দেখতে দেখতে এই হাসপাতালে ত্রিদিবেশের দু’বছর চাকরিও হয়ে গেলো। বয়স তিরিশ পেরিয়ে গেছে আগেই, কিন্তু বিয়ে করা হয়ে ওঠে নি। হঠাৎ একদিন ত্রিদিবেশ জানতে পারলো, কুহেলীর হাজব্যাণ্ড অনুরাগ খুব অসুস্থ। দেরী না করে কুহেলীর বাবার সঙ্গে দেখা করে পরের দিনই গেলো কুহেলীদের শ্রীরামপুরের বাড়ীতে। ইংল্যান্ডে পড়তে যাওয়ার পর কুহেলীর সঙ্গে এত বছরে মাত্র একবারই দেখা হয়েছিল ঋভুর। এবারে দেখা হলো পাঁচ ছয় বছর পর। কুহেলী এখন দু বছরের ছেলের মা, প্রথমটায় সহজ হতে একটু সময় লেগেছিল। ত্রিদিবেশের ব্যবস্থাপনায় কলকাতার এক বড় হাসপাতালে অনুরাগ ভর্তি হলো। দুরারোগ্য অসুখ, লিভার ক্যান্সার, ছয় মাসের বেশী আর বাঁচানো গেলো না।

এখন কুহেলীর বাবাও খুবই অসুস্থ। ওনার দেখাশোনা ও চিকিৎসার জন্য ত্রিদিবেশকেই মাঝে মাঝে যেতে হচ্ছে ঐ বাড়ীতে। কুহেলীও মাঝে মাঝে ছেলেকে নিয়ে এসে থাকছে ওর মা বাবার কাছে। ত্রিদিবেশ তো আগেই জেনেছিলো, অনুরাগের ছোটো ভাই অনুভব এখনও বিয়ে করে নি, রেলে ভালো চাকরি করে। এবারে জানতে পারলো, কুহেলীর শ্বশুর শাশুড়ী চাইছে, অনুভবের সঙ্গে কুহেলীর বিয়ে দিতে। মনে হয়, অনুভবেরও এতে মত আছে।

সাহাবুদ্দিন মাঝে মাঝে আসে বন্ধু ত্রিদিবেশের সঙ্গে দেখা করতে। ওর বউ এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ওদের গ্রাম থেকে রোজ অনেক মানুষ আসে এই হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে। সাহাবুদ্দিন আর ওর বন্ধুরা বুঝেছে, আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা হলো ‘বিপুল লোকসংখ্যা’ এবং ‘অশিক্ষা’। ওরা কিন্তু ডাঃ ত্রিদিবেশের পরামর্শ মতো ওদের গ্রামে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষার প্রসারের জন্য খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে। গ্রামের অনেক গরীব মানুষ ত্রিদিবেশের থেকে নানান ভাবেই উপকৃত হয়। ক্রমশঃ এই হাসপাতালের খ্যাতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনেক দূর থেকে লোকজন আসছে চিকিৎসার জন্য। আর কয়েক মাসের মধ্যেই হাসপাতাল বিল্ডিং-এর দোতলাটা চালু হয়ে যাবে, বেডের সংখ্যাও বেড়ে পঞ্চাশ হবে।

অনুরাগের মৃত্যু এক গভীর ছায়া ফেলেছে ত্রিদিবেশ ওরফে ঋভুর জীবনে। কুহেলীর ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে সে খুবই বিচলিত। অনেক ভেবে দেখলো, কুহেলীকে ওর ভালোবাসার কথা কোনোদিন জানাতে পারেনি, এটা যেমন সত্যি, তেমনি সেই ভলোবাসার মৃত্যুও তো হয় নি। সেই ভালোবাসা ধীরে ধীরে এখন ওর মনের ভিতরে জেগে উঠছে। কিন্তু কুহেলীর মনের নাগালও তো পাওয়া দরকার। সেই কিশোরী কুহেলীর সঙ্গে আজকের কুহেলীর অনেক তফাৎ, এটাই স্বাভাবিক। কুহেলীর সঙ্গে কয়েকবার কথা বলে ঋভু বুঝতে পারলো, অনুভবকে বিয়ে করার ইচ্ছে ওর একদমই নেই। কুহেলীর বাবার শরীর একটু ভালো হলেও এখনও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ঋভু শেষ পর্যন্ত মনস্থির করলো, কুহেলী ও কুহেলীর সন্তানের দায়িত্ব সেই নেবে, কুহেলীকে বিয়ে করে। আর অন্য কারোর হাতে পড়তে দেবে না কুহেলীকে।

ছবির শেষ দৃশ্য ……… কুহেলী ওর ঋভুদাকে বলছে, ‘ছোটোবেলা থেকে আমিও তোমার কথা ভাবতাম। মনে মনে তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু তুমি যেমন কোনোদিন আমাকে জানাওনি তোমার মনের কথা, আমিও সাহস করে মুখ ফুটে বলতে পারি নি। আমি ভাবতাম, আমি হয়ত তোমার উপযুক্ত নই। তুমি বিদেশে চলে যাওয়ার পরে অনেক রাত আমি ঘুমোতে পারি নি, মনে মনে অনেক কেঁদেছি। আমি জানি, এখন তুমি আমাকে করুণা করছো। এখন আর তা হয় না। আমার অদৃষ্ট আমাকেই মেনে নিতে হবে’। এর উত্তরে ঋভু যখন বলে, ‘আমি কিন্তু আজও তোকে সেরকমই ভালোবাসি, শুধু সময়মতো প্রকাশ করতে পারিনি। কেন পারি নি, এর কোনো সদুত্তর হয়ত আমার কাছে নেই। মাঝের কয়েকটা বছর কোথা দিয়ে যে কেটে গেলো! অতীতকে ভুলে গিয়ে নতুন করে বাঁচবো আমরা ….. এটা বুঝেছি, মায়াবতী মেঘের তন্দ্রায় জীবন আজও সত্যিই মোহময়’, ……

কুহেলীর চোখের চাউনি বুঝিয়ে দেয় ওর ঋভুদা, ডাক্তার ত্রিদিবেশের ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করার সাধ্য ওর নেই। এই কুহেলীই তো অপূর্বর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, হয়ত অন্য কোনো নামে, অন্য কোনো রূপে। আর, ত্রিদিবেশের চরিত্রের মধ্যেই যেন নিজেকে কল্পলোকে খুঁজে পায় অপূর্বসুন্দর।

******

 

Sahityika Admin

Add comment