সাহিত্যিকা

এ্যান্টারটিকা অভিযানে দুই বিক্কলেজিয়ান

এ্যান্টারটিকা অভিযানে দুই বিক্কলেজিয়ান
@দীপ্ত প্রতিম মল্লিক, ১৯৮০ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

দ্বিতীয় পর্ব
১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৩
যাত্রা হল শুরু (স্যান্তিয়াগো থেকে স্যান এন্টানিও হয়ে)
স্যান এন্টানিও বন্দর থেকে আজ আমাদের শিপ ছাড়বে। স্যান্তিয়াগো জায়গাটি সমুদ্রর ধারে নয়- ফলে বড় জাহাজ ছাড়ে হয় ভেপরেসো থেকে অথবা স্যান এন্টানিও থেকে। আমাদের জাহাজ আকারে বিরাট বড়ো, আড়াই হাজার প্যাসেঞ্জার, ক্রু মেম্বারই নাকি এক হাজার, ফলে এই সাড়ে তিন হাজার লোকের জাহাজটাই যেন এক বিশাল পাড়া। ঐ কলেবরের জাহাজ ভেপরেসোতে ঢুকতে পারে না, বড়ো জাহাজের জন্য তাই স্যান এন্টানিওতে তৈরি হয়েছে নতুন বন্দর, স্যান্তিয়াগো থেকে ১১০ কিলোমিটার দূর।

আমরা বহু আগেই গাড়ি বুক করে রেখেছিলাম, গতকাল সেই গাড়ির ড্রাইভার মেসেজ করেছে যে আজ সকাল দশটায় আসবে। সকাল দশটার আগে আমরা চেক আউট করে নীচে তৈরী। আর ড্রাইভার ঠিক দশটায় এসে হাজির। ছ সীটের বিরাট গাড়িতে মালপত্র পিছনে দিয়ে আমরা সামনের দুটো রো’তে বসলাম। ড্রাইভার অল্প সল্প ইংরাজি জানে। স্যান্তিয়াগোতে অনেকেই মোটামুটি ইংরাজি বুঝতে পারে ও অল্পসল্প বলতেও পারে। কিন্তু চিলিতে অন্য জায়গায় এই সুবিধা আমরা পাই নি। অনেকবারই ভেবেছি স্প্যানিশ শিখলে হয়, কিন্তু কুঁড়েমিতে আর তা হয়ে ওঠে নি।

দু ঘন্টার রাস্তা- পথে অজস্র পাহাড়, অধিকাংশই বলা যায় ন্যাড়া পাহাড়। এখানে শীতে প্রচুর বরফ পড়ে তাই গাছপালা কম। রাস্তা দারুণ- ১২০ কিমি স্পীডে গাড়ি চলেছে। মাঝে মাঝে এক একটা লেক পড়ছে। নিবিষ্ট মনে সৌন্দর্য দেখছিলাম, দূরে দেখা গেলো শহরের ঘরবাড়ি। খানিক বাদেই ড্রাইভার জানাল, স্যান এন্টানিও এসে গেছে। আরে? এইটুকু সময়ে এতটা রাস্তা চলে এলো? গুগল ম্যাপ দেখে, অনেক এদিক ওদিক করে যেখানে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে গিয়ে থামালো, সেটা পোর্ট এরিয়া বটে, কিন্তু এটা যে ক্রুজ পোর্ট নয়, সেটা একজন অন্ধ মানুষও বলে দেবে। ক্রুজ শিপের কলেবর বিরাট, বহু দূর থেকেই দেখা পাওয়ার কথা, কিন্তু তার টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। ড্রাইভার তো মালপত্র নামানোর উদ্যোগ নিচ্ছিলো, বললাম, ভাই এটা ক্রুজ পোর্ট নয়। ড্রাইভার সাহেব ভালো লোক, বলল, কোথায় যাবে? চলল জিজ্ঞাসাবাদের পালা। এখানকার লোকেরা ইংরাজি বোঝে না, ফলে কি চাইছি আর ও কি বলছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ড্রাইভারকে ক্রুজ বুকিং এর কাগজটি দিয়ে বললাম, তুমি যদি স্প্যানিশে জিজ্ঞাসা করো, আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। অনি আর দীপা বলছে আমরা কি ঠিক জায়গাতে এসেছি? ভেপরেসো যেতে হবে না তো? খানিক ঘুরে এসে ড্রাইভার জানালো, বুঝেছি কোথায় যেতে হবে- গাড়িতে বসো।

গাড়ি আবার চলল, মিনিট দশ চলার পর, পোর্ট এলাকার শুরুতে একটা টার্ন নিয়ে খানিকটা যেতেই দৃশ্যমান হল বিরাট ক্রুজ শিপের মাথা। বুঝলাম আমরা এবার ঠিক দিকে এসেছি। খানিক এগিয়ে ক্রুজ শিপ ঢোকার বিল্ডিং এর গেট পর্যন্ত গাড়ি এল, বললো, এসে গেছি। খুশি মনে ড্রাইভারকে কিছু বকশিস দিয়ে চেক ইন করার জন্য ঢুকলাম। আমাদের সুটকেশগুলো ওরাই চেয়ে নিলো। সুটকেশে আমাদের কেবিন নাম্বার ও নাম লেখা ট্যাগ লাগানো আছে, ওগুলো কেবিনে পৌছে যাবে।

ভিতরে ঢোকার পর আমাদের পাসপোর্টের ছবি তুলে একটা করে স্লিপ দিয়ে বলল, সিকিউরিটির পর জাহাজে উঠে মেডিলিয়ান পাস পাবে। এর আগেও মেডিলিয়ান পাস প্রিন্সেস এর ক্রুজে পেয়েছি। এটা হচ্ছে জাহাজে ঢোকার ও নামার প্রবেশ পত্র, শুধু জাহাজে নয়, ঘরে ঢোকা বেরুনো, এমনকি জাহাজে কেনাকাটা করলেও তার হিসাব কিতাবের জন্য এটা চাই-ই। এক কথায় এটা হলো জাহাজের ছাড়পত্র।

সিকিউরিটি করার সময় বললাম আমাদের সাথে দুখানা ওয়াইন বোতল আছে। এখানে প্রতি জনা একটি করে ওয়াইন বোতল ছাড়, কিন্তু কেবিনে বসে খেতে হবে। এ ছাড়া কোনো ইলেকট্রিক হীটার বা ওই জাতীয় জিনিষ, লম্বা ছুরি, বন্দুক এসব কিছুই আনা যাবে না। সিকিউরিটি চেক মানে এটাই। সিকিউরিটির পর ফটো তোলা। এই ফটো তুমি পরে কিনতেও পারো। এত কিছুর পরে দুপুর বারোটা ত্রিশে জাহাজে উঠলাম।

এই প্রসঙ্গে জাহাজের কথা কিছু লিখি। জাহাজের নাম “স্যাপিয়ার প্রিন্সেস”। বিরাট কলেবর। প্রায় হাজার ফুট লম্বা আর দুশো ফুট উঁচু। কুড়ি তলা বাড়ির উচ্চতায় আঠেরো খানা ডেক আছে। টনেজ হিসাবে এটা ১১৬ হাজার টনের জাহাজ। দু’হাজার সাতশো গেস্ট আর হাজার ক্রু নিতে পারে এই জাহাজ। কেবিনই আছে ১৩৩৭ খানা। আমরা জাহাজে ওঠার আগে নিজেদের কিরকম যেন অতি ক্ষুদ্র লাগছিলো জাহাজের পাশে। জাহাজ দেখে অনিবৌদি খুব খুশি- বলল, এই বিরাট জাহাজকে দোলাতে পারবে না ড্রেক প্যাসেজ, কি বল? আমিও সায় দিয়ে বললাম, নিশ্চয়, এত বিরাট জাহাজকে দোলায় কার সাধ্যি!

চারজনে জাহাজে ঢুকলাম, অনিবৌদি বলল, চলো আমাদের কেবিনগুলো দেখে আসি। আমাদের কেবিন ডেক ১০ এর পিছনের দিকে। জাহাজের মাঝখানে সেন্টার অফ গ্রাভিটির কাছে নেওয়া, যাতে দোলানি কম লাগে। ডেক ৫ থেকে ডেক ১৪ অধিকাংশই কেবিন। আমাদেরটা বলা যায় মাঝামাঝি উচ্চতায়। লিফট ধরলাম। জাহাজের লিফটগুলো দেখার মতো। তিন সারি লিফট আছে- সামনে, মাঝে আর পিছনে। আর প্রতি সারিতে খান ছয় লিফট, তার এক দিকটা কাঁচের। এছাড়া আরো সার্ভিস লিফট আছে, ক্রু-দের জন্য। আমরা জাহাজের মাঝে উঠেছি, তাই হেঁটে হেঁটে পিছনে এসে পিছনের লিফট ধরলাম। বাইরে বেরিয়ে সুদৃশ্য কারপেট মোড়া প্যাসেজ দিয়ে একটু এগুতেই আমাদের দুই কেবিন। দরজার সামনেই আমাদের সুটকেশ রাখা। ঘরের ভিতর ঢুকে টেবিলের ওপর একটা খামে সুন্দর করা রাখা আমাদের ছাড়পত্র মানে “মেডিলিয়ান পাস”। সুন্দর একটা বড়ো বোতামের মতো, লেনিয়ারডতে আটকানো। আমরা দুজনে যে যার গলায় পরে ফেললাম। ঘর দারুন, বিরাট বিছানা, জিনিষ রাখার আলাদা একটা জায়গা, টেবিল, বিরাট টিভি। দারুন ছিমছাম শাওয়ার রুম। আর আছে এক বিশাল প্রাইভেট ব্যালকনি। এই দশ নাম্বার ডেকের মজা এইটাই- যে এখানে সবচেয়ে বড়ো ব্যালকনি আছে। আছে দু’খানি ডেকচেয়ার ও টেবিল।

সুটকেশগুলো খুলে সব জায়গা মতো রাখা হল। ষোলোটা রাতের সংসার- তাকে ঠিকঠাক করে সাজানো, যেন এক জায়গায় নতুন করে সংসার পাতা। ঘরে কেবিন এটেন্ডেন্টের কার্ড রাখা ছিলো- নাম এ্যালান- তাকে ফোন করে বললাম, যদি একটা ইলেকট্রিক কেটিল পাওয়া যায়। আমাদের দারজিলিং চা খাওয়ার অভ্যাস- সেটা ছাড়তে পারি না। আয়ালান সাথে সাথে কেটল নিয়ে চলে এলো, বলল, পেয়ে গেছি- রেখে দাও। আর যখন যা লাগবে ফোন করো।

খানিক পর ঘন্টাদারা এলে একসাথে ওপরে খেতে গেলাম। এখানে সব খাবার ক্রুজের দামের সাথে ধরা আছে, অবশ্য কয়েকটি রেস্তোরাঁ বাদ দিয়ে। এই জাহাজে খান দশেক রেস্তোরাঁ, খান পাঁচেক বার আছে। আছে তিনটি সুইমিং পুল, একটি টেনিস কোর্ট, বাচ্চাদের খেলার জন্য পুরো একটা তলা জুড়ে আয়োজন। এ ছাড়া গলফ কোর্ট এমন কি পাহাড়ে চড়ার মাউন্টেনিং এর-ও ব্যাবস্থা আছে। আমরা ক্রুজ আগেও করেছি কিন্তু ঘন্টাদা ও অনিবৌদির এই প্রথম। ওরা অবাক হয়ে দেখছে আর ঘন্টাদা বারবার বলছে, কি নেই বলতো? অনিবৌদি বলল ধর্মীয় স্থান মানে মন্দির-চার্চ- মসজিদ ছাড়া সবই বোধ হয় আছে।

ডেক ১৪ এর ওয়ার্ল্ড ফুড এরিয়ায় বিরাট খাবারের আয়োজন। একসাথে প্রায় ৫০০ লোক খেতে পারে এমন ব্যাবস্থা। বিভিন্ন খাবার রাখা আছে, প্লেট বাটি সাজানো, যত পারো নাও আর খাও। ব্যাস, ঘন্টাদাকে আর পায় কে! থরে থরে সাজানো খাবার, রাশি রাশি ডেজার্ট, … অনি বৌদি বলল, নাঃ, তোমাদের ঘন্টাদাকে আর আটকানো গেলো না।

খাওয়ার পর্ব সেরে আবার নিচে গেলাম সেফটি ব্রিফ শুনতে। এটা ম্যান্ডেটরি, সবাই না শুনলে ও সই না করলে জাহাজ ছাড়বে না। জাহাজ বিপদে পড়লে কি করতে হবে, কোথা থেকে সেফটি স্যুট পরে কোথায় যেতে হবে এ সব প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দিলেন সেফটি অফিসাররা। তারপর সই করে সকলের মুক্তি।

ওপরে খোলা ডেকে তখন সুইমিং পুলের সামনে বিরাট নাচগান চলছে। খানিক সে সব দেখতে দেখতে জাহাজ ছাড়ার সময় হয়ে গেলো। বিরাট এক লম্বা ভেঁপু বাজিয়ে জাহাজ সান আন্টেনিও-র মায়া কাটালো ১৯ শে ডিসেম্বর ২০২৩ এর বিকাল ছ’টায়। তিন দিন টানা চলে পরবর্তী স্টপ হবে ২৩ ডিসেম্বর পুন্টা আরেনাস। মানে চিলির উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় পৃথিবীর শেষ স্থল্ভাগের কাছে গিয়ে আমরা থামব।

জাহাজ ছাড়লে নিজেদের ঘরে গেলাম, খানিক শীত শীত করছিলো, হালকা জ্যাকেট লাগাতে হল। ব্যালকনিতে বসে সমুদ্র দেখতে ভারী ভালো লাগছিল। ক্রমে পাড় থেকে খানিক গভীর সমুদ্রে এলাম। পাড় থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূর দিয়ে জাহাজ এগিয়ে চলেছে। ঢেউ সেরকম নেই। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, এই যে বিশাল প্রশান্ত মহাসাগর দিয়ে চলেছি, নাম সার্থক, সত্যিই এ যেন শান্ত সমুদ্র।

রোজ রাত আটটায় আমরা রাতের খাওয়া বুকিং করেছি মেন ডাইনীং রুমে। এখানে এই মেন ডাইনীং রুমই আছে তিন খানা, ডেক ৪ ও ৫ এ- প্রতিটায় ৫০০ র ওপর বসার জায়গা। এছাড়া ডেক ১৪ এ ওয়ার্ল্ড ফুডতেও খেতে পারো- তবে সেটা বুফে আর এখানে তিন কোর্স আর বসে খাওয়া। নিজেদের আলাদা টেবিল- সাদা ধপধপে ক্লথ পাতা। একজন ওয়েটার, খান দুই তাদের সহকারি নিয়ে এক একটা গ্রুপ- পাঁচ ছ খানা টেবিলের জন্য। এখানে কিচেন, রেস্টুরেন্ট বা সিকিউরিটিতে যারা কাজ করে- বেশির ভাগ ভারতীয় বা ফিলিপিনো। জমিয়ে খাওয়া হলো বটে। অনিবৌদি এখানে খুশি, কেননা এখানে খাবারের পরিমান ঠিকঠাক, ঘন্টাদাকে অন্তত একবেলা আটকানো যাবে।

খাওয়ার পর ডেক ফাইভে হাঁটতে গেলাম। এখানে জাহাজের চারপাশ দিয়ে হাঁটার ওয়াকিং ট্রাক আছে। একপাক মানে আধ মাইল। আমরা দু পাক হেঁটে ঘরে গেলাম, জাহাজের হালকা দোলানীতে আরামের নিদ্রা।

২০ থেকে ২২ ডিসেম্বর ২০২৩- এক অনন্ত সমুদ্রযাত্রা
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গল। চা বানিয়ে আমাদের প্রাইভেট ব্যালকনিতে বসলাম। দেখি গভীর সমুদ্র দিয়ে আমদের জাহাজ তরতর করে এগিয়ে চলেছে। আমাদের পোর্ট সাইডে কেবিন- সেদিকে দেখার কিছু নেই অনন্ত সমুদ্র ছাড়া। ভাবলাম উল্টোদিকে দেখি তো কিছু মন কাড়া সিনারি চলে যাচ্ছে কিনা? বাইরে বেরিয়ে সাততলার ডেকে দেখি, না, সেরকম কিছু নয়, শুধু দূরে চিলির তটরেখা দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম জাহাজ চিলির পশ্চিম দিকে দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে চলেছে। আগেই লিখেছি চিলি বিরাট লম্বা দেশ- ৪০০০ কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা। আর আমরা সেটা পার হবো তটরেখার সাথে সমান্তরাল ভাবে। আমাদের পরবর্তী স্টপ পুন্টারিনাস(Punta Arens), যা প্রায় তিন হাজার কিলোমিটারের পথ। এই পথ যেতে জাহাজ নেবে তিন দিন ও তিন রাত। লম্বা পথ- টলটলে নীল সমুদ্র- ঢেউ তেমন নেই। সেটা অবশ্য তটভূমির কাছ দিয়ে যাচ্ছি বলে। আর এই পথে সামুদ্রিক জীবজন্তু খুব একটা নেই। এক আধটা সীল মাছ বা তিমি মিললে সেটা ভাগ্যর কথা। কাজেই বিশ্রাম আর বিশ্রাম। শরীরটাকে সমুদ্রর বিশুদ্ধ হাওয়াতে তাজা করা আর জাহাজে ভালোমন্দ খাওয়া।

চা খেতে না খেতেই ঘন্টাদারা উঠে পড়লো। বউদি বলল, ব্রেকফার্স্ট এর লোভে দেখছ না, তোমাদের ঘন্টাদার জিব চকচক করছে? ঘন্টাদা বলল, তা নয়, ব্রেকফার্স্ট ঠিক সময়ে না খেলে লাঞ্চ খাবো কি করে?

চারজনে মিলে ওপরে ওয়ার্ল্ড ফুডে ব্রেকফার্স্ট খেলাম আর একটা বাজলে ওখানেই লাঞ্চ। বাকি সময় অলসভাবে কখনো বা গল্পের বই হাতে বসে থাকা,কখনও বা ওপরের ডেকে পায়চারি আবার কখনও বা নিছক লোক দেখা। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক এসেছে এই জাহাজে- তাদের চালচলন, খাওয়াদাওয়া, কথাবার্তা ও বিভিন্ন আচরণ দেখেই সময় কেটে যায়। আমেরিকা প্রবাসী চৈনিক নাগরিক অনেক আছেন। চীনারা দেখলাম সব বিরাট বিরাট গ্রুপ- আশি বছরের দাদু দিদা থেকে শুরু করে দু বছরের নাতি নাতনী পর্যন্ত আছে সেই সব গ্রুপে। কাজেই তাদের দেখে ভালোই সময় কাটে। আর আসর জমিয়ে দেওয়ার জন্য ঘন্টাদা তো আছেই। দেখলাম ঘন্টাদা খাওয়া দাওয়াতেও কিছুটা ব্রেক মেরেছে। “কি হলো ঘন্টাদা- খাওয়া কমে যাচ্ছে কেন?” “না রে বসে বসে আর কত অন্ন ধ্বংস করব, আউটপুট কোথায়?” অনিবৌদি বলল, যাক, চেতনা এসেছে তাহলে।

রাতের ডিনার খাওয়াটা বেশ আনন্দের। বিশাল ডাইনীং রুম, আমরা প্রথম সাতদিন প্যাসিফিক মুন ডাইনীং হলে বুক করেছি। রোজ রাত আটটায় আমাদের বুকিং। তিনদিন অন্তর খেতে যাওয়া জন্য ফর্মাল ড্রেস পরতে হয়, অন্যদিন সাধারণভাবে আসতে পারো, তবে হাফ প্যান্ট পরে আসা যাবে না। অন্যদেশের, বিশেষ করে আমেরিকান ও ইউরোপীয়ানদের ডিনার খাওয়ার জন্য সাজপোষাকের ঘটা দেখার মত। প্রতেকে সেজে গুজে আসেন ডিনার খেতে, বিশেষ করে বয়স্ক মহিলা, মানে সত্তর পঁচাত্তর বছর যাদের বয়স,তাঁরা দেখি মুখে রঙ মেখে, ঠোঁট লিপস্টিকে টুকটুকে লাল করে খেতে আসেন। আমাদের অনিবৌদি আর দীপাও কম যায়না। সেজেগুজে খেতে যাওয়াটা যেন এক অভিযান। ঘন্টাদা আর আমিও চেষ্টা করি বৌদিদের পাশে যাতে বেমানান না লাগে সেভাবে সাজ পোষাক রাখতে।

খাওয়ার টেবিলে আপ্যায়ন দেখার মত। সাদা ধপধপে টেবিল ক্লথ পাতা আলাদা আলাদা টেবিল। ছুরি, কাঁটা চামচ প্লেটের দুপাশে দু সারি সাজানো। ঝকঝকে গ্লাস তাতে বরফ মেশানো জল দিয়ে যাচ্ছে অথবা যদি ওয়াইন খেতে চাও তো ওয়াইন গ্লাসও আছে। আছে তিন চারটে টেবিলের জন্য একটা করে ওয়েটার ও দুজন করে সহকারী ওয়েটার বা ওয়েট্রেস। খাবার শুরুর আগে গরম গরম ব্রেড, মাখন দিয়ে যাচ্ছে ওয়েটার, সাথে বিরাট বিরাট মেনুকার্ড। তারপর অর্ডার গ্রহন। মেনুকার্ড থেকে তোমার পছন্দ মত স্টার্টার,মেন কোর্স ও ডেজার্ট বাছো। এক এক করে সব আসবে। একটা কোর্স খাওয়ার পর টেবিল আবার পরিষ্কার করে দেবে সহকারী ওয়েটার। কোনো খাবার ভালো না লাগলে বা অন্য কোনো মেনু পছন্দ হলে, তাও দিয়ে যাবে। দীপা প্রথম দিন কাঁচালংকা চেয়েছিলো বলে রোজ আমাদের জন্য ছোট এক বাটি কাঁচালঙ্কা সাজানো থাকত টেবিলে। মোদ্দা কথা এই রাজসিক খাতির ভাবা যায় না। ক্রুজের মজা এটাই। খাওয়া পর্বর সময় লাগে ঘন্টা দেড়েক। সে সময় তুমি রাজা।

জাহজে এতো রকম বিনোদনের উপকরণ থাকে- কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরব ভাবলে অনেক সময় ধাঁধাঁ লেগে যায়। সুইমিং পুল আছে খান পাঁচেক, জাকুজি খান সাতেক। জল ভালো লাগে না? তাহলে আছে বিভিন্ন খেলার উপকরণ, জিম, ওয়াকিং ট্র্যাক, মিনি গলফ, এমনকি মাউন্টেনিং শিখতে বা করতে পারো। আছে থরে থরে বই দিয়ে সাজানো লাইব্রেরী। অনবরত বিভিন্ন গেম বা কুইজ হচ্ছে। আছে ওপরের খোলা ডেকে বিরাট স্ক্রীনে সিনেমা, আছে হাজার আসন বিশিষ্ট হল প্রিন্সেস থিয়েটার- যেখানে নাচ, গান, বাজনার বিভিন্ন আয়োজন। অথবা জানার জন্য আছে অনেক ভালো ভালো সেমিনার। আমরা এই ক্রুজে থাকাকালীন অনেকগুলো ভালো ভালো প্রেজেন্টেশন দেখেছি- পেঙ্গুইনের ওপর, এ্যান্টারটিকার ওপর বা বিভিন্ন জায়গা বেড়ানোর ওপর। যেগুলো থেকে জেনেছি ও শিখেছি অনেক কিছু। অর্থাৎ নিছক আনন্দ বিতরণই নয়, অনেক জ্ঞানলাভও করেছি, যা বলা যায় বোনাস।

এছাড়া জাহাজের মাঝে চারতলার ডেকে রোজই কিছু না কিছু গান বা মিউজিক শুনেছি, পিয়ানো বা বাঁশি বা জাজের অন্যবদ্য অনুষ্ঠান শুনে মন ভরে গেছে। একদিন “কুছ কুছ হোতা হ্যায়” এই গানটির বাজনা শুনেছিলাম, তার অপূর্ব সুরের মূর্ছনা আজীবন মনে গাঁথা থাকবে।

মোদ্দা কথা – জাহাজের কটা দিন যেন এক রূপকথার জগৎ। যখন খুশি উঠছি, যখন যা মনে হচ্ছে খচ্ছি, প্রোগাম দেখছি, জ্ঞান লাভ করছি, বাজনার তালে তাল মেলাচ্ছি, আবার সাথে সাথে নিয়ম করে হাঁটা, ডেক ব্যালকনি থেকে সমুদ্রর সৌন্দর্য দেখা- সর্বোপরি ঘন্টাদাদের সাথে আড্ডা- এ যেন এক অন্য জগৎ।
ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে জাহাজ সাজিয়েছেও চমৎকার। কেক দিয়ে যে এরকম সাজানো যায়, ভাবা যায় না।

২৩ শে ডিসেম্বর ২০২৩
প্রথম স্টপ পুন্টারিনাস(Punta Arenas)
এই তিনদিন জাহাজ ক্রমাগত চলেছে – চিলির উত্তর প্রান্ত থেকে প্রায় দক্ষিণ প্রান্তে এসে গিয়েছি। চিলির তলার দিকটা হচ্ছে অজস্র জলরাশির চ্যানেল। এখানে পৃথিবীর মাটি যেন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, তার ফাঁকে ফাঁকে জল। আছে অজস্র ছোট ছোট দ্বীপ। আর যেখানেই জল, মাটি- সেখানেই রূপ তার খুলেছে। নীরস সমুদ্রর দৃশ্যশোভা পালটে গেছে – একের পর এক পটে আঁকা ছবি যেন চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে, মনে হয় পৃথিবী এত সুন্দর! ভাবতে গা কেমন ছমছম করে-যাচ্ছি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে স্ট্রেট অফ ম্যাগলান( Strait of Magellan) এর ওপর দক্ষিণের সবচেয়ে বড়ো শহর পুন্টারিনাস। পুন্টারিনাস থেকে অনেক অভিযান হয়েছে এবং এখনও হয়। পৃথিবীর দক্ষিণের সবচেয়ে বড়ো শহর হওয়াতে এখানে সব রকম সুখ সুবিধাই পাওয়া যায়। যতোদিন পানামা খাল ছিলো না, এই পুন্টারিনাস ছিলো দক্ষিণের সব চেয়ে বড়ো বন্দর। পানামা খালের আগে সব জাহাজকে এই দক্ষিণ আমেরিকা সম্পূর্ণ ঘুরে পুন্টারিনাসের পাশ দিয়ে যেতে হত। অর্থাৎ জাহাজ উত্তরে যেতে চাইলেও তাকে পৃথিবীর দক্ষিণ প্রান্তে এসে আবার ঘুরতে হত উত্তরের দিকে। আর এই সব কারণেই পুন্টারিনাস ছিলো তখনকার দিনে সবচেয়ে বড়ো বন্দর। তখন বিভিন্ন জাহাজ এখানে থামতো- জল, কয়লা, কাঠ, খাবার দাবার ইত্যাদি তুলতো পরবর্তী পথের রসদ হিসাবে। পরে পানামা খাল চালু হবার পর এখানে আসে মাত্র মুষ্টিমেয় জাহাজ, ফলে এই বন্দর তার কৌলিন্য হারিয়েছে। তবে এ্যান্টারটিকার যতো অভিযান, তার অধিকাংশই এখান থেকে হয়। এ ছাড়া আমাদের মতো যারা ক্রুজের যাত্রী, তাদেরও এটা নির্ধারিত স্টপ। একে বলা যায় চিলিয়ান পাটাগোনিয়ার গেটওয়ে।
পুন্টারিনাসতে জাহাজ থেকে বেশ কিছু কনডাকটেড ট্রিপ আছে। এগুলো দামের সাথে ধরা নয়, আলাদা করে বুক করতে হয়। তার মধ্যে কিছুটা জনপ্রিয় হচ্ছে ম্যাগেলানিক পেঙ্গুইনের (Magellanic Penguine) ট্রিপ, যেটা খানিক দূরের ম্যাগডিলিনা আইল্যান্ড (Magdilina Island) তে। এ ছাড়া শহর দেখার, আশেপাশে বাসে করে ঘোরার কিছু ট্রিপ আছে। কিন্তু আমরা যেহেতু এ্যান্টারটিকা যাচ্ছি, ওখানে পথে পাবো অজস্র পেঙ্গুইনের সাক্ষাৎ, তাই আর আলাদা করে পেঙ্গুইন ট্রিপের মানে নেই। ঘন্টাদাও সহমত ছিলো, ফলে ঠিক ছিলো আমরা নিজেদের মতো ঘুরবো।

বেলা নটায় জাহাজ হালকা চালে জলের মধ্যে এক জায়গায় এলো। ধীর লয়ে শেষটা এলো কেননা এখানে জল মাঝে মাঝে অগভীর। তাই বড়ো জাহাজকে সাবধানে যেতে হয়। এ সব ক্ষেত্রে একটি ছোট বোট নিয়ে লোক্যাল পাইলট আসেন। পাইলট যেহেতু লোক্যাল, এই জলপথ তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। আগে আগে পাইলট তাঁর বোট নিয়ে চলেন ও পিছনে জাহাজ নিয়ে আসেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। পুরো জিনিষটাই দেখার মতো। অতো বড়ো জাহাজ কিরকম ভাবে ঐ সরু জলের চ্যানেল দিয়ে যাচ্ছে, সে এক দেখার মতো দৃশ্য।

সোয়া নটায় জাহাজ তার যথাসাধ্য এগুলো, আর ওখানেই নোঙ্গর করলো। পাইলট বোট ফিরে গেল নিজের পথে। এখান থেকে পাড় এক কিলোমিটার। পাড়ে অজস্র ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। যেহেতু আমাদের জাহাজ বিরাট বড়ো, তাকে নোঙ্গর করার মতো ক্ষমতা এই পুন্টারিনাসের মতো ছোট বন্দরের নেই, তাই জলে নোঙ্গর। জাহাজের নিজস্ব বোট আছে খান ছয়েক- বোট বলছি বটে, কিন্তু প্রায় শ খানেক লোক ধরে, এ রকম শক্তিশালী মোটরবোট বা লঞ্চ। যেখানে জাহাজ বন্দরে ঢুকতে পারে না, সেখানে জাহাজ এরকমভাবে জলে নোঙ্গর ফেলে আর এই মোটর বোটগুলি অবিরাম চলাফেরা করে জাহাজ থেকে পাড়ে এবং উল্টোটাও। এর পোষাকী নাম হচ্ছে ওয়াটার শাটলিং বা টেন্ডারিং।

বেলা সাড়ে নটা থেকে ওয়াটার শাটলিং শুরু আর এর জন্য ডেক ফাইভ থেকে টিকিট ইসু করা হচ্ছে। টিকিট ফ্রি, কিন্তু লোকে যাতে সুষ্ঠভাবে যাতায়াত করতে পারে তাই শাটলের নাম্বার দেওয়া টিকিট। আমরা ব্রেকফাস্ট খেয়ে ধীরে সুস্থে গেলাম শাটলের টিকিট নিতে। তখন লাইন অনেক কমে গেছে। আমরা পেলাম সতেরো নাম্বার শাটলের টিকিট, তখন চলছে এগারো। ফলে মিনিট কুড়ির মধ্যে আমাদের শাটলের ডাক পড়লো। আমরা লাইন করে এলাম তিনতলার ডেকে। এখানে জাহাজের একটা দিকের দরজা খোলা আর সেখানে অপেক্ষা করছে আমাদের বোট। ধীর কদমে আমরা বোটে উঠলাম। এখানে সেফটি সবচেয়ে বড়ো কথা- প্রচুর সেফটি অফিসার দেখেছি জাহাজে আর তাঁরাই ভাগ হয়ে এক একটি বোটে। তাঁদের তীক্ষ্ণ নজর থাকে যাতে সবাই নিরাপদে বোটে থাকেন, বিশেষ করে ওঠানামার সময়। প্রায় একশো জন ঐ বোটে উঠল, প্রত্যেককেই বসতে হবে- দাঁড়ালে চলবে না- বোটের দুটি তলা মিলে প্রায় দেড়শো আসন। সবাই আসন গ্রহণ করার পর বোট ছাড়ল।

মিনিট পনেরোর পথ। বোট নিরাপদেই ওপারে এলো। এখানেও সেফটি অফিসার, তাঁরা সযত্নে বোট থেকে নামিয়ে দিচ্ছেন। বোট থেকে নামার পর কাষ্টমস চেক। চিলিতে কোনো রকম খাবার বা ফল নিয়ে আসা যাবে না। জাহাজে এটা বার বার বলা ও ঘরে ঘরে লিখিত নোটিশ দেওয়ার পরও বহু যাত্রী কিছু ফল বা খাবার এনেছেন। কিন্তু সব ধরা পড়ে যাচ্ছে এক্সরেতে, ফলে সব বাইরে রাখা ঝুড়িতে ফেলো। দেখি দুটো বিরাট ঝুড়ি ফল, কেক আর পেস্ট্রিতে উপছে পড়ছে। ঘন্টাদা বলল, এ তো পুরো জাহাজের খাবার উঠিয়ে এনেছে রে! অনিবৌদি বলল, ঐ জন্যই জাহাজে কলা পাই নি কোনোদিন, সবই দেখছি এরা আগে উঠিয়ে নেয়। তা বটে, কেননা দুটো ঝুড়ির অধিকাংশই কলা আর আপেলে ভর্তি।
কাস্টমস করে বাইরে এসে দেখি বিরাট এক পুরানো দিনের ঘড়ি। ঝটাঝট তার ছবি তুলছে সবাই, আমরাও তুললাম। পোর্টে ইনফরমেশন সেন্টার থেকে ম্যাপ নিয়ে চললাম এখানকার প্লাজা “মুনোস গ্যামেরোর” দিকে। চিলিতে স্পেন এককালে রাজত্ব করেছে, ৩০০ বছর ধরে এটা ছিলো স্প্যানিশ কলোনী তাই চিলির ভাষা স্প্যানিশ আর স্প্যানিশ স্থাপত্যর নিদর্শন চারিদিকে।

প্লাজার উল্টোদিকে দেখি আর এক ভিজিটার্স সেন্টার, এটা অনেক বড়ো। একবার ঢুঁ মারলাম। এক সুন্দরী মহিলা, নাম সোনিয়া, মিষ্টি হাসি হেসে সাদর আমন্ত্রণ জানালেন। কি কি দেখব জিজ্ঞসা করতে ম্যাপ খুলে সব প্রাঞ্জল করে বোঝালেন ও ম্যাপে দাগ দিয়ে দিলেন।

প্লাজা মুনোস গ্যামেরো (Munoz Gamero) তে ১৯২০ সালে ম্যাগেলানের ঐতিহাসিক অভিযানের ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তৎকালীন উল ব্যারন জোস মেনেন্ডিস (Jose Menendez) এই মনুমেন্ট স্থাপন করেন। আমরা মনুমেন্টের কাছে বসলাম। অজস্র জাহাজের যাত্রী ঘোরাফেরা করছে আশেপাশে, ফটো তুলছে। পুন্টারিনাসতে ঠান্ডা লাগবে ভেবে মোটা জ্যাকেট পরে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভারী চমৎকার রোদ্দুর উঠেছে, ফলে ঠান্ডা লাগছে না। সূর্যর তাপে শরীরের আরাম বোধ হচ্ছে।

প্লাজায় খানিক্ষণ বসে রোদের তাপ নিয়ে অনিবৌদির উৎসাহে চললাম উল্টোদিকের এক প্রাসাদে, নাম কাসা ব্রাউন মেনেন্ডিস (Casa Braun Menendiz)। এটা আগে ছিলো সারা ব্রাউনের প্রাসাদ, কিন্তু এখন এটা একধারে মিউজিয়াম, হোটেল ও ক্লাব। ভিতরে ঢোকার প্রবেশমূল্য দু ডলার করে। ভিতরের আর্কিটেকচার মন কাড়লো।

প্রাসাদ দেখার পর ঘন্টাদা বলল, কফি না খেয়ে আর এক পা-ও এগুনো যাবে না রে, চ কফি খাওয়া যাক। সামনেই ছিলো “লা চকোলেট” বলে এক কাফে। ওখানে ঢুকে খানিকক্ষণ বসে জমিয়ে কফি খাওয়া হল। অজস্র লোক যাতায়াত করছে, ছবি তুলছে- গলার মেডিলিয়ান মেডেল দেখে বুঝছি অধিকংশই জাহাজের লোক।

কফির পর পাশে এক ক্যাথিড্রাল ছিলো- সোনিয়া বলেছিলো অবশ্যই যেতে- তাই ঢুকলাম। ১৮৯২ সালে তৈরী এই ক্যাথিড্রাল আয়তনে বড়ো না হলেও বেশ মনোগ্রাহী।

এটা দেখার পর ট্যাঙ্গোস ট্যাঙ্গোস করে হাঁটা চালু করলাম মিউনিসিপ্যাল সিমেটারি যাবো বলে। সোনিয়ার ম্যাপ অনুযায়ী প্রায় আধ ঘন্টার হাঁটা। ঘন্টাদা বেগড়বাঁই করছিল, সিমেটারি কি দেখব, তার চেয়ে এখানে বসি। কিন্তু অনিবৌদি আর আমাদের সম্মিলিত অনুরোধে ঘন্টাদা যেতে রাজী। রাস্তা দিয়ে চলেছি। দু পাশে বিভিন্ন দোকান, মেয়েরা মাঝে মাঝে দোকানে ঢুঁ মারছে, এটা ওটা দেখছে- এই করে প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেলো ওখানে আসতে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গা, অজস্র কবর আর তাদের স্মৃতিফলক নিয়ে বেশ বড়ো এলাকা। অনেক কবরের মাঝে বিখ্যাত উল ব্যারন জোস মেনেন্ডিসের কবরও দেখলাম। অজস্র ফুল রাখা- লোকে এখনও মনে রেখেছে ওনাকে। এক চক্কর পুরোটা ঘুরে আবার বিভিন্ন দোকান দেখতে দেখতে ফিরে এলাম প্লাজায়। ভিজিটার্স সেন্টারের সোনিয়া বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল- আমাদের দেখে বলল, কি, সব দেখলে? বললাম, হ্যাঁ, যতটা পেরেছি দেখলাম। সোনিয়া বলল, এই কাছেই এক সিনিক ভিউ পয়েন্ট আছে, ওখানে যাবে না? না, সে তো যাইনি, কিভাবে যাবো? সোনিয়া আবার পথ নির্দেশ দিয়ে দিল। পথ জটিল নয়, কিন্তু শ খানেক সিঁড়ি উঠতে হবে। ঘন্টাদা সব শুনছিল, আমরা যাচ্ছি শুনে বলল, সিঁড়ি আর উঠছি না, তোরা যা। দীপাও বলল, আমি আর সিঁড়ি ভাঙ্গছি না, তোমরা ঘুরে এস। তাই আমি আর অনিবৌদি চললাম। রাস্তা খুব দূরের না, কিন্তু তারপর এক পাহাড়ে উঠতে হবে। পাহাড়ের গা বেয়ে সিঁড়ি করা আছে- শ খনেক স্টেপ হবে। আমি কিন্তু কিন্তু করছিলাম, কিন্তু বৌদি বলল, এত কষ্ট করে এলে আর ওপরে উঠবে না? বৌদির উৎসাহে ধীরে ধীরে ওপরে এলাম। নীচে সমুদ্রর নীল জল যেন মখমলের মত পড়ে আছে। দূরে আমাদের জাহাজ দাঁড়িয়ে। বন্দরে গোটা দুই ছোট জাহাজ। শন শন হাওয়া দিচ্ছে। খানিক ওখানের বিশুদ্ধ হাওয়া সেবন করে আর বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নেওয়ার পর আমরা উঠলাম।

আবার হাঁটা। তিন দিন অগাধ বিশ্রামের পর শরীর আর যেন চলছে না। প্লাজাতে এসে দেখলাম ঘন্টাদা বেঞ্চে বসে রোদ পোয়াচ্ছে। বলল, সামনে বারনাড হিগিনসের স্টাচু আছে, দেখে আয়। বারনাড হিগিনস ছিলেন চিলির নেতা, যিনি মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন চিলিকে স্প্যানিশ শাষণ থেকে মুক্ত করতে।

দীপা দেখলাম মেয়েকে ভিডিও কল করছে। আসলে চারদিন পর এখানে মোবাইল সিগন্যাল পাওয়া গেছে। জাহাজের ইন্টারনেট খুব ব্যয়সাধ্য তাই আর নেওয়া হয়ে ওঠে নি। চারদিন পর এখানে ফোর জি সিগন্যল পেয়ে চুটিয়ে সব আপডেট করা হল। ঘন্টাখানেক পর সবার সব ফোন বা ডাটা সংক্রান্ত কাজ হবার পর ফিরে এলাম।

সন্ধ্যা সাতটায় জাহাজ ছাড়ল। আজ আবার সারারাত চলে কাল সকালে জাহাজ আসবে আর্জেন্টিনার উসুইয়াতে। মানে, আজ রাতে আমরা চিলির ভৌগলিক সীমা ছাড়িয়ে ঢুকব আর্জেন্টিনার সীমানায়। কাল আমাদের ট্রিপ আছে সারাদিনের। আজ ঘুরেও বেশ ক্লান্ত তাই রাত আটটায় ডাইনীং হলে জমিয়ে থ্রি কোর্স ডিনার সেরে যে যার ঘরে শুতে গেলাম।

২৪শে ডিসেম্বর ২০২৩- ভয়াবহ ড্রেক প্যাসেজে যাত্রা
সকালে ঘুম ভাঙল। রোজ যেমন হয়, চোখ খুলেই পর্দা টেনে দেখি মনোগ্রাহী কিছু সিনারি চলে যচ্ছে কিনা। এই কদিন রোজই হতাশ হয়েছি, কেননা চোখে পড়েছে শুধু সমুদ্রর নীল জল। আজ কিন্তু পর্দা টানতেই দেখি আলিবাবার ম্যাজিক। আমরা চলেছি গাঢ় নীল জলে মোড়া এক চ্যানেলের মাঝ দিয়ে- যেন এক বিরাট চওড়া খাল। আর চ্যানেলের দু পাশে বিরাট উঁচু উঁচু পাহাড়- প্রতিটি পাহাড়ের মাথা ধপধপে সাদা বরফ দিয়ে মোড়া। সবে সূর্য উঠছে, তার আলো পড়ে চূড়োগুলোয় কমলা রঙ এর ছোপ ধরেছে। তড়িঘড়ি দু কাপ চা বনিয়ে বারান্দায় বসলাম। বাইরে তীব্র শীত- তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রী হবে। তাই আলমারী থেকে কম্বলটা বার করে গা-য় বেশ করে জড়িয়ে বসলাম। হাতের গরম চা-র কাপে চুমুক মারতে মারতে দেখছি একের পর এক বরফে মোড়া পাহাড় যাচ্ছে। আচমকা এসে পড়ল এক গ্লেসিয়ার। তার রূপ যেন ডানা মেলেছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছি আর ছবি তুলছি। জাহাজের লাউড স্পীকারে ঘোষণা হল আমরা বিগল চ্যানেল দিয়ে যাচ্ছি- আমাদের দুপাশে প্যাটাগোনিয়ার পর্বত শ্রেণী ও অজস্র গ্লেসিয়ার। পাশের বারান্দা থেকে ঘন্টাদা বলল, এটা কি হল বল তো? আমাদের তো উসুইয়ার (Ushuaia) দিকে যাওয়ার কথা কিন্তু এ তো দেখছি বিগল চ্যানেল দিয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো, আজ আমাদের উসুইয়া যাওয়ার কথা, কাল কেপ হর্ন আর তারপর ড্রেক প্যাসেজে যাওয়া। কিন্তু এটা তো আমাদের যাত্রা পথ নয়! কি ব্যাপার হল বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু তখন বোঝার বা ভাবার সময় না- প্রধান কাজ তখন পাশ দিয়ে যা যাচ্ছে তাকে মুগ্ধ নয়নে দেখা আর ক্যামেরা বন্দী করা। এরকম একের পর এক গ্লেসিয়ার ঘাড়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছে – এমন পরিস্থিতি কখনও পাইনি। কোনো কোনো পাহাড় যেন মনে হচ্ছে জাহাজকে চুম্বন করছে। বিগল চ্যানেলের চওড়া এখানে খুব বেশী নয়, ফলে জাহাজ ও পাড়ের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশী নয়। মুগ্ধ নয়নে দেখতে দেখতে সব ভুলে গিয়েছিলাম, সাড় মিলল পাশের বারান্দা থেকে অনিবৌদির ডাকে। বেলা প্রায় নটা বাজে- জলখাবার খাওয়ার ডাক।

চারজন মিলে ওয়ার্ল্ড ফুডে জলখাবার নিয়ে টেবিলে বসেছি, এমন সময় লাউড স্পীকারে ক্যাপ্টেনের ঘোষণা-প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়া ও তার প্রবল গতির জন্য আমরা উসুইয়া হয়ে যেতে পারছি না, ফলে উসুইয়া, কেপ হর্ন হয়ে এ্যান্টারটিকা যাওয়ার প্রোগাম বাতিল করতে হয়েছে নিরাপত্তার কারণে। কিন্তু তার সাথে বিরট সুখবর যে আমরা যে পথ নিয়েছি, এ্যান্টারটিকা যাওয়ার জন্য, সে পথে হাওয়া প্রায় নেই, ফলে ঢেউ কম ও অতি নিরাপদ। এই পথে আবহাওয়াও অতি সুন্দর, এ রকমটি নাকি পাওয়া যায় না। ফলে জাহাজ উসুইয়ার পথের বদলে বিগল চ্যানেল ধরেছে। সারাদিন ধরে বিগল চ্যানেল দিয়ে গিয়ে জাহাজ বিকালের দিকে ড্রেক প্যাসেজে ঢুকবে। ড্রেক প্যাসেজের নাম শুনলেই অনিবৌদির ভয় ভয় করে, বলল, এতে ড্রেক প্যাসেজের প্রতাপ কি কমবে? লোকে বলে শুনেছি ড্রেক প্যাসেজ মানে লেক অথবা শেক, আমাদের কি হবে? ঘন্টাদা বলল, শুনলে না, দারুণ ওয়েদার- আমাদের জন্য লেকই হবে।

জলখাবার খেয়ে রিসেপশনে বিস্তারিত খববের সন্ধানে গেলাম। আসলে আমাদের উসুইয়া থেকে জাহাজের কনডাক্টেড ট্রিপও ছিল- “এন্ড অফ দি ওয়ার্ল্ড” ট্রিপের। আমরা বিমর্ষ যে পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষিণের ভূমি স্পর্শ করা হল না বলে, আর কি কোনোদিন এদিকে আসতে পারব? রিসেপশন থেকে জানাল যেহেতু ঐ ট্রিপ আর হচ্ছে না, ঐ ট্রিপের টাকা রিফান্ড দেওয়া হবে। ঘন্টাদা বলল, এরকম রুট চেঞ্জ কি আগেও হয়েছে না এই প্রথম? ওরা জানাল এই পথে সবটাই অনিশ্চিত, কেননা ওয়েদার কখন পালটে যাবে আগে থেকে বলা যায় না। আবহাওয়া এখানে সদাই বিরূপ। তিন সাগরের মিলন হয়েছে আর তাদের তাপমাত্রার তফাতের জন্য সদাই বিরাট আয়তনের জল এদিক ওদিক হয়। অনেক সময় এরকমও হয়েছে, জাহাজ ড্রেক প্যাসেজ পেরিয়ে এ্যান্টারটিকায় ঢুকতেই পারে নি। হাওয়ার তেজ তীব্র হলে ঢেউ পঞ্চাশ ষাট ফুট পর্যন্ত ওঠে। এই তো কিছুদিন আগে ঢেউ ডেক সেভেন ছুঁয়েছিলো। এরকম পরিস্থিতিতে জাহাজ নিয়ে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। সে তুলনায় আমি বলব, তোমাদের ভাগ্য অতি ভালো, কেননা উসুইয়া বাদ হলেও যেটা মুখ্য- সেই এ্যান্টারটিকার আবহাওয়া দারুন আর ড্রেক প্যাসেজও এক্কেবারে শান্ত। শুনে অনিবৌদির মুখে একটা প্রশান্তির ছায়া নামল। আমরাও বাঁচলাম- যাক, আসল জায়গা তো হচ্ছ।

এ কথা তুমি ঠিকই বলেছ- ঘন্টাদা বলল, অতএব উসুইয়ার জন্য আক্ষেপ না করে- যে না চাইতেই আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে, সেই বিগল চ্যানেলের সৌন্দর্য দেখা যাক।

আমরা পাঁচতলার রিসেপশন থেকে সাততলার ডেকে উঠে চিয়ার টেনে বসলাম। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর জাহাজ দাঁড়িয়ে গেল। দূরে দেখছি একটা ছোট বোট প্রবল গতিতে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতে বুঝলাম এটা হচ্ছে চিলি বর্ডার কন্ট্রোলের বোট। আসলে আমাদের আর্জেন্টিনার জলপথ দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল আজ, তার বদলে চিলির জলপথ দিয়ে যাচ্ছি, তাই চিলি বর্ডার কন্ট্রোলের অনুমতি দরকার।

জাহাজ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। দেখলাম চিলি বর্ডার কন্ট্রোলের বোট তিনতলার ডেকের দরজায় এল, বুঝলাম ওখান থেকে ইমিগ্রেশন অফিসাররা বোটে উঠলেন।

ঘন্টা দুই জাহাজ এভাবে দাঁড়িয়ে আছে, আমরা মাঝে মাঝে চা কফি খাচ্ছি আর দেখছি। তারপর দেখি ঐ বোট আবার রওনা দিয়েছে জাহাজ ছেড়ে। ঘন্টাদা বলল, অফিসিয়াল কাজকর্ম তাহলে শেষ, পারমিশন হয়ে গেছে যাওয়ার, কেননা দেখ, জাহাজ ছাড়ার তোড়জোড় চলছে।

ঘন্টাদার ধারণা ঠিক- বেলা বারোটা নাগাদ জাহাজ ভেঁপু বাজিয়ে তার বিশাল কলেবর নিয়ে যাত্রা শুরু করল। আবার শুরু হল সুন্দরী বিগল চ্যানেলের বুক ঠেলে যাওয়া। ক্রমে দেখছি বিগল চ্যানেলের কলেবর বাড়ছে। প্রথম দিকে যা ছিল শীর্ণকায়, তা ক্রমে স্ফীত হচ্ছে। বুঝলাম, আমরা ক্রমে সমুদ্রর দিকে চলেছি তাই চওড়াও ক্রমে বাড়ছে। ঘন নীল রঙ খানিকটা ফিকে হয়েছে আর ঢেউ এর উচ্চতা ক্রমে বাড়ছে।

লাঞ্চ খেয়ে এসে সাততলার ডেকে বসেছি, তখন বিগল চ্যানেল বিরাট চওড়া। মাঝে মাঝে পাহাড়ি টিলা জলের মাঝে উঁকি মারছে। দূরে এখনও পাড় দেখতে পাচ্ছি- গাদা গাদা পাহাড়ে মোড়া। এমন সময় ক্যাপ্তেনের ঘোষণা, স্টার বোর্ডের দিকে একটা লাইট হাউস, তার সামনের টিলাটায় অনেক পেঙ্গুইন বসে। আমরা বসে ছিলাম পোর্ট সাইডে, মাঝের দরজা দিয়ে সাথে সাথে চলে এলাম স্টার বোর্ডের দিকে। দেখি অনেক চীনারা ভিড় করে দেখছে। সবারই চোখে বিরাট বিরাট জুম বা বাইনোকুলার। অনিবৌদি বলল, দেখেছ, ওরা কিরকম তৈরী হয়ে এসেছে? আর আমাদের ফোনের বা ক্যামেরার জুম ছাড়া কিছুই নেই। দেখে শেখো চীনাদের, কেমন তৈরি ওরা।

দীপা ইতিমধ্যে ভিডিও ক্রামেরার স্ক্রীনে জুম করে পেঙ্গুইনদের এনে ফেলেছে। দেখলাম খান দশেক পেঙ্গুইন। কেউ বসে, কেউ বা জলের দিকে যাচ্ছে, কেউ ঝাঁপাচ্ছে, এর সবাই হল ম্যাগলেনিক পেঙ্গুইন যাদের সম্বন্ধে পরে জেনেছি।

পেঙ্গুইন দেখে সবাই খুশী। ইতিমধ্যে বুঝতে পারছি বিগল চ্যনেল ক্রমেই সমুদ্রর রূপ নিচ্ছে। পাড় আর দেখা যায় না। ক্যাপ্টেন জানালেন আর এক ঘন্টার মধ্যে আমরা ড্রেক চ্যানেলে ঢুকবো। হাওয়ার তেজ সেরকম নেই, ফলে উথাল পাতাল ঢেউ আপাতত নেই, তবে রাতের দিকে বা ভোর থেকে ঢেউ এর প্রতাপ বাড়বে।
বিকাল চারটেয় আমরা এসে গেলাম ড্রেক চ্যানেল। সেই ভয়ংকর রাস্তা, যেখানে এককালে শ শ জাহাজডুবি হয়েছে। এখনকার দিনেও ছোট জাহাজকে নাকানি চোবানি খাওয়ায় আর বড় জাহাজও অতি সতর্কতার সাথে এই পথে পাড়ি দেয়। এখান থেকে, মানে পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষিণের স্থলভূমি থেকে এ্যান্টারটিকা ছ-শ মাইল আর এই ড্রেক চ্যানেল পেরুতে সময় লাগবে আটচল্লিশ ঘন্টা।

আমরা সাততলার ডেকেই থাকলাম। ঢেউ এর জোর বেড়েছে, এখন ঢেউ পনেরো থেকে কুড়ি ফুট উচু। জাহাজে এসে ঢেউ আছড়ে পড়ছে – তবে জল এখনও সাততলায় ছিটকে আসছে না। এখনও সেই তেজ হয়নি। খানিকক্ষণ অনিবৌদি দেখে ধাতস্থ হল, বলল, এরকম থাকলে ঠিক আছে। কোনো অসুবিধা নেই।

ডেকে বেশীক্ষন আর থাকা গেল না। প্রবল ঠান্ডা হাওয়া আসছে দক্ষিণের মেরু অঞ্চল থেকে। তাপমাত্রা জিরোর কাছে। আমরা ভিতরে চলে গেলাম।
রাত আটটায় সবাই মিলে ডাইনীং হল। ক্রিসমাস ডিনার, কাজেই জমিয়ে খাওয়া। খেতে খেতেই বুঝছি টেবিল সহ গোটা ফ্লোর দুলছে। অনিবৌদির মুখ শুকনো। তবে দোলানিটা প্রথম দিকে বোঝা গেলেও পরে এটা যেন এক ছন্দে চলে এল। আমরাও ওই দোলনিতে মানিয়ে নিলাম। খাচ্ছি, দুলছি সে এক দারুণ অনূভুতি। ওয়েটার বললেন আজ হাওয়ার তেজ নেই তাই রোলিং নেই। রোলিং কি? – বৌদি জিজ্ঞাসা করলো। ঘন্টাদা বলল, রোলিং হচ্ছে তিনটে প্লেনে দোলা, আমাদের সে সব হবে না, তোমার চিন্তা নেই।
খাওয়া সাঙ্গ, দারুণ ডেজার্ট খেয়ে মন খুশ। ঘন্টাদা আর আমি বললাম একবার সাততলায় ডেকে দেখে আসি কি অবস্থা। সবাই মিলে গেলাম। দরজাটা যেই খুলেছি, কি প্রচন্ড জোর হাওয়া! এই নাকি হাওয়ার তেজ নেই? তাহলে তেজ থাকলে কি হয়? ঢেউ দেখলাম ২০/২৫ ফুট হয়েছে। এক একটা আছড়ে পড়ছে জাহজের বুকে, যেন পুঞ্জিভূত রাগ নিয়ে আছড়ে পড়ে বলছে, দেখি কে বেশী শক্তিশালী। জলের ছিটে আসছে সাততলাতেও। আরো খানিক দেখার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু জাহাজের লোক এসে বলল, হাওয়ার তেজ বাড়ছে, তাই এই দরজাগুলো বন্ধ করব। দেখলাম সব ডেক চিয়ারগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে যাতে উড়ে না যায়। ঘন্টাদা বলল, এবারে তেজ বাড়বে, তার আগে চ শুয়ে পড়ি।

২৫শে ডিসেম্বর ২০২৩- ড্রেক প্যাসেজ দিয়ে চলেছি
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙ্গল, ঘড়িতে দেখি সকাল পাঁচটা। ইতিমধ্যে সূর্য অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। পৃথিবীর যত দক্ষিণে যাব, তত দিন বড়ো হবে। কেননা এখানে এখন গরমকাল। শীতে আবার উল্টো- চব্বিশ ঘন্টা রাত। পর্দা টেনে ঢেউ দেখলাম- না, সেই একই রকম- পনেরো কুড়ি ফুট উচ্চতার। কাল রাতে বেশ কিছু বড়ো ঢেউ ছিল কেননা জাহাজ ভালোই দুলছিল। অনিবৌদি দেখলাম ওনার ঘরের দরজা খুলে উঁকি মারলেন। বৌদি ঠিক আছ? বৌদি একগাল হেসে বলল, হ্যাঁ, এরকমভাবে যদি ড্রেক প্যাসেজ উতরে যেতে পারি, মন্দ কি? সি সিকনেসের ভয় আমার কেটে গেছে। এত বড়ো জাহাজের কাছে সমুদ্রও কাবু।

এই কথা বলার ফাঁকে হঠাৎ দূরে দেখি জলের ফোয়ারা। এখানে ফোয়ারা? তবে কি… তার দেখা মিলবে এবার? বৌদিকে খবরটা জানিয়ে ভিডিও ক্যামেরাটা নিয়ে এলাম। এর জুমটা অনেক শক্তিশালী। ওদিকে ক্যামেরা তাক করে বসে আছি, ইতিমধ্যে দীপা চা বানিয়ে এনেছে। পরবর্তী ফোয়ারাটা আরো কাছে। এবার জুম ছাড়াই দেখেছি- আরে এ তো সেই অভীষ্ট তিমি। এসো বন্ধু, তোমার জন্য কদিন ধরে অপেক্ষা করছি, ভালো করে দর্শন দাও বন্ধু। কাল জাহাজের যিনি ন্যাচরালিষ্ট আছেন, তিনি ঘোষণা করেছিলেন বটে ড্রেক প্যাসেজে তিমি দেখার বিরট সম্ভবনা আছে। এই সময়ে বিরাট সাইজের ব্লু হোয়েলরা দলে দলে ১০০০ মাইল পথ অতিক্রম করে এখানে, মানে এ্যান্টারটিকায় আসে বাচ্চা দিতে। আর সেই বাচ্চা খাওয়ার জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে কিলার হোয়েল বা অরকা আসে। বস্তুতঃ, পৃথিবীর ৭৫ ভাগ অরকা থাকে এখানে। সুতরাং ড্রেক প্যাসেজে ব্লু হোয়েল দেখার বিরাট সম্ভবনা। এ ছাড়া হাম্পব্যাক হোয়েলও বিভিন্ন দ্বীপের আশপাশে দেখা যাবে। আমরা যেটা দেখছি তার কলেবর দেখে মনে হচ্ছে এটা ব্লু হোয়েল। আমাদের তিমি ফোয়ারা তুলে ল্যাজ উল্টে আবার ডুব দিলেন। এবার আমিও চালাক হয়ে গেছি। একেবারে তাক করে রেখেছি ক্যামেরা- যখন পরের বার তিমি উঠবে তখন ছবি তুলব। আশেপাশের সব বারান্দাই দেখি ভর্তি।

ওখানে বসে খান তিনেক তিমি দেখলাম। সবগুলোই বিরাট, দেখার কোনো অসুবিধা নেই। ঠান্ডা এখন দু ডিগ্রীর মত, কিন্তু হাওয়া নেই বলে কালকের মত গায়ে লাগছে না।

দিনের অধিকাংশ সময় কাটল সাততলার ডেকে, হাতে গল্পর বই, বসে বসে উথাল পাতাল ঢেউ দেখা। ঢেউ এর প্রকোপ কিন্তু একই রকম, কেউ কুড়ি ফুটের বেশী নয়। যখন ঢেউ জাহাজের বুকে আছড়ে পড়ছে, সামান্য জলের ছিটে আসছে ডেকে। অলসভাবে দেখছি ঢেউ এর উল্লাস। ভাবছি প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায়, এত বিরাট জাহাজও দুলে উঠছে মাঝে মাঝে।

দুপুরে একটা প্রেজেন্টেশন দেখলাম প্রিন্সেস থিয়েটারে। প্রথমটি ছিলো পেঙ্গুইনের ওপর। জনলাম যে কত রকমের পেঙ্গুইন হয়। ক্রেস্টেড, ব্যান্ডেড, ব্রাস টেলড আর গ্রেট। এর মধ্যে ম্যাগেলেনিক (Magellenic), যেটা ব্যান্ডেড গ্রুপে, তাকে আগে দেখেছি। গ্রেট গ্রুপে কিং আর এম্পারার পেঙ্গুইন দেখব ফকল্যান্ডে (Falkland Islands)। আর সব রকমের পেঙ্গুইন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এ্যান্টারটিকায়, যা আমাদের দেখতে পাওয়ার বিরাট সম্ভবনা।

প্রেজেন্টেশনের পর সাততলার ডেকে বসে আছি, ক্যাপ্তেনের ঘোষণা হাওয়ার তেজ কম হবার ফলে জাহাজ ভালো গতিতে আসতে পেরেছে। তাই জাহাজ পূর্ব নির্ধারিত গতির থেকেও দ্রুত এসেছে। ফলে কাল বিকালের বদলে ভোরেই আমরা এ্যান্টারটিকা চলে আসব। প্রথম দর্শন হবে এলিফ্যান্ট আইল্যান্ড, দক্ষিণ শ্বেতল্যান্ডের এক দ্বীপ। সুতরাং কাল ভোর থেকে আমরা সব যেন তৈরি থাকি।

পরের প্রেজেন্টেশন এ্যান্টারটিকার ওপর বিকাল বেলায়। আমরা এই অঞ্চল সম্বদ্ধে সড়গড় হবার জন্য গেলাম। জানলাম এ্যান্টারটিকা হাওয়ার তেজ ও গতির জন্য বিশ্ব রেকর্ড করেছে ও সেটা সসম্মানে প্রতি বছর বজায় থাকছে- কমনওয়েলথ বে, পূর্ব এ্যান্টারটিকায় হাওয়ার গতি ২৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়।

এখানে যা বরফ আছে তা হল পৃথিবীর ৯০ শতাংশ ফ্রেশ ওয়াটার।

এবার প্রশ্ন – এলিফ্যান্ট আইল্যান্ড নাম কেন?
জানলাম, এই নাম নিয়ে দ্বিমত আছে। কেউ বলে দ্বীপের আকার অনেকটা বাচ্চা হাতির মাথার মত, তাই এই নাম। কিন্তু অন্য মত বলে, এককালে এই দ্বীপে অজস্র এলিফ্যান্ট সীল ছিল। তাদের শিকার করতে প্রাণ হাতে নিয়ে বহু জাহাজ আসত বা আসার চেষ্টা করত এখানে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এলিফ্যান্ট সীল মেরে তাদের চর্বি ও মাংস সংগ্রহ করা, কেননা বাজারে তার প্রচুর দাম। এদের মেরে মেরে প্রায় নির্বংশ করা হয়েছিল, আর সেই কারণের জন্য হয়ত বা এর নাম এলিফ্যান্ট আইল্যান্ড।

আমরা জানলাম যে ১৯১৬ সালে আরনেষ্ট স্যাকেলটন(Ernest Shackleton) ছিলেন এক অভিযানের নেতা। সেই অভিযানে জাহাজ পথ হারায় ও বরফে আটকা পড়ে। তখন সবাই মিলে লাইফ বোট নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে ঐ আটকে থাকা বরফের থেকে বেরুতে আর দীর্ঘ দিন ধরে প্রচেষ্টার পর ওরা এই এলিফ্যান্ট আইল্যান্ডে আসতে সক্ষম হয়। সেটা ১৯১৬ সালের এপ্রিল মাস। কদিন পর স্যাকেলটন স্থির করেন এখানে আটকে থাকলে তো হবে না তাই উনি পাঁচজন নাবিককে সাথে নিয়ে একটি লাইফবোট নিয়ে রওনা হন ৮০০ মাইল দূরের সাউথ জর্জিয়া, যাতে ওখান থেকে কোনো উদ্ধারকারি জাহাজ জোগাড় করে আনা যায়। বাকি নাবিকরা দিনের পর দিন অপেক্ষা করে স্যাকেলটনের জন্য। দীর্ঘ চারমাস ঐ ২২ জন নাবিক শুধু পেঙ্গুইন আর সীল মাছ খেয়ে ওই চরম ঠান্ডায় দিন কাটায়। যখন সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছে, মৃত্যুর মুখোমুখি সব, তখন স্যাকেলটন জাহাজ নিয়ে আসতে সক্ষম হন। সেই দিনটা ছিল ৩০ শে আগষ্ট ১৯১৬।

দক্ষিণ শ্বেতল্যান্ড হল এ্যান্টারটিক পেনিনসুলার এক দ্বীপপুঞ্জ। ৩২০ মাইল লম্বা আর ১৮০০ বর্গ মাইল জায়গা জুড়ে এই দ্বীপপুঞ্জ। এর উত্তরের প্রধান দ্বীপ হল এই এলিফ্যান্ট দ্বীপ। তারপর দক্ষিণের দিকে আছে কিং জর্জ আইল্যান্ড, যেখানে আটটা দেশের বেস ক্যাম্প আছে বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের। এছাড়া ক্রমে আরো দক্ষিণে আছে লিভিংস্টন আইল্যান্ড, ডিসেপশন আইল্যান্ড বা হাফ মুন আইল্যান্ড আর এই সব বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলির মাঝে মাঝে আছে দারুণ দারুণ বে, যেগুলো অপূর্ব সুন্দর।

১৮১৯ সালে মানুষ প্রথম এ্যান্টারটিকায় পা দিতে সক্ষম হয়। এর পর অনেক অভিযান হয়েছে। যে দেশ একটি অভিযান করে, সেই দাবী করতে থাকে এ্যান্টারটিকা তাদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তো জার্মানি জাহাজ পাঠায় নরওয়ের দখল আটকাতে। ক্রমে বহুদেশ দাবী করতে শুরু করল যে এ্যান্টারটিকা তাদের। প্রধান দাবীদার ছিল আমেরিকা,আর্জেন্টিনা, চিলি, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে ও ব্রিটেন। ফলে বিরোধ ওঠে তুঙ্গে। সবাই চায় এ্যান্টারটিকার দখল, কেননা সবাই ভাবছে এই জায়গা খনিজ পদার্থে মোড়া। কিন্তু ক্রমে দেখা দেল বৈজ্ঞানিক অভিযান ছাড়া এখানে কোনো কিছু থাকলেও তকে উদ্ধার করা এক অসম্ভব কাজ শুধু নয়, প্রবল ব্যায়বহুলও। এই সব ধারণা থেকে ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে ১৯৫৯ সালের এক মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর হয় বিভিন্ন দাবীদার দেশের মাঝে। এই চুক্তি অনুযায়ী এ্যান্টারটিকা কারুর একার সম্পত্তি নয়, সবার। এ ছাড়া ঠিক হয় বৈজ্ঞানিক এক্সপিডিশনে সবাই সবাইকে সহায়তা করবে।

দেড় ঘন্টার প্রেজেন্টেশনে অনেক জ্ঞান লাভ করলাম। আমরা এবার গেলাম পাঁচতলার ডেকে। ওখানে সন্ধ্যা থেকে ক্রিসমাসের গান, বাজনা, কেক খাওয়া ইত্যাদি চলল। ডিনারে আজ ছিল ক্রিসমাস ড্রেস, ফলে ক্রিসমাস টুপি, সোয়টার, লাল রঙ এর জামা কাপড়ে চারদিক ছয়লাপ।
রাত্রে তাড়াতাড়ি শোওয়া কালকের কথা ভেবে।

(চলবে)

**********

Sahityika Admin

Add comment