সাহিত্যিকা

অধ্যক্ষ ‘অতুল চন্দ্র রায়’ স্মরণে

অধ্যক্ষ ‘অতুল চন্দ্র রায়’ স্মরণে
** বিমলেন্দু সোম, ১৯৬১ – ১৯৬৭ স্থাপত্য বিভাগ
** নারায়ণ প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ১৯৬৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

মানুষ গড়ার কারিগর
বিমলেন্দু সোম, ১৯৬১ – ১৯৬৭ স্থাপত্য বিভাগ

৫-ই সেপ্টেম্বর ২০২৫ সালের ‘শিক্ষক দিবস’ উপলক্ষ্যে ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ পর্যায়ের শিক্ষাগুরুকে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করতে গিয়ে মনে পড়ছে বি ই কলেজের প্রবাদপ্রতিম, অধ্যক্ষ ‘অতুল চন্দ্র রায়’ অতুলনীয়-কে! যতদূর মনে পড়ে তিনি পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধ থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বি ই কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন!

বি ই কলেজের স্বর্ণালি দিনগুলো আমার জীবনের এক অনুপলব্ধ প্রাপ্তি! আমি ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি বি ই কলেজের স্থাপত্য বিভাগে অ্যাডমিশন নিয়েছিলাম। আমাদের ব্যাচ থেকে স্থাপত্য পাঠ্যক্রমের ব্যাপ্তি ছিল ছয় বছরের! আমার ছাত্রাবস্থার সিংহভাগ কেটেছে ‘বজ্রাদপি কঠোরানি, মৃদুনি কুসুমাদপি’ এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী, প্রশাসক প্রোফেসর এ সি রায় অধ্যক্ষ থাকাকালীন। কলেজে অ্যাডমিশন ইন্টারভিউয়ের সময়ই আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল! পরবর্তীকালে শিক্ষক হিসেবে উনাকে না পেলেও, ক্লাসের বাইরে আমাদের গুরু-শিষ্য মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছিল বার তিনেকের মত! প্রতিটি ঘটনা আমার বি ই কলেজ জীবনে জন্ম দিয়েছে অম্লমধুর কিছু মুহুর্তের অভিজ্ঞতা! এতোগুলো বছর পেরিয়ে এলেও সেই মুহুর্তগুলো আমার স্মৃতির মণিকোঠায় আজও অম্লান! বি ই কলেজের প্রবাদপ্রতিম অধ্যক্ষ এ সি রায় আমার কাছে আদর্শ শিক্ষক, ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ ! নিচে বর্ণিত কয়েকটি স্মৃতিচারণের মাধ্যমে ‘শিক্ষক দিবস ২০২৫’ উপলক্ষ্যে স্যারকে আমার প্রণাম এবং শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করছি!

*প্রথম: আমার উপস্থিত বুদ্ধির পরীক্ষা!
শুরুটা করা যাক ১৯৬১ সালের মে- জুন মাসের কোন একটা দিন থেকে। বি ই কলেজে সেদিন ছিল আমার ভাগ্য পরীক্ষার সবচেয়ে কঠিন ধাপ – মৌখিক পরীক্ষা। তার জন্য আমি খুবই মানসিক চাপে ছিলাম, তবে আমার মেজদার (বি ই কলেজ প্রাক্তনী ১৯৫৭) টিপস অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সেদিনের ইন্টারভিউতে আমি বাজিমাত করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম! মেজদার প্রথম টিপস ছিল: উনার অফিসে ঢুকে বসবার অনুমতি পাওয়ার পর নিঃশব্দে চেয়ারটা টেনে সোজা হয়ে বসবি! চেয়ারের আওয়াজ যেন না হয়। আর টেবিলের নিচে দুই হাঁটুর কাঁপুনি, কিংবা দাঁত দিয়ে নখ কাটা – এগুলো তোর নার্ভাস হওয়ার লক্ষণ! এসব যেন না হয়।
এরপরের টিপস: ‘প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এ সি রায় স্বয়ং হয়তো থাকবেন ইন্টারভিউ বোর্ডের মধ্যমণি হয়ে। আর তাঁর দুই পাশের চেয়ারগুলোতে থাকবেন কয়েকজন বিভাগীয় প্রধান। প্রোফেসর এ সি রায়ের প্রখর উজ্জ্বল দু’টি চোখের সামনে আমাকে নার্ভাস হ’তে মানা করে মেজদার উপদেশ: উনাকে সমীহ করে নির্ভয়ে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিবি। একদম ফাম্বলিং না করে, সত্যি হোক কিংবা মিথ্যে, স্মার্টলি জবাবগুলো দিতে হবে।

মুখ্যত মেজদার টিপস আর আমার উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োগ করে আমার উদ্দেশ্যে প্রশ্নবাণগুলির সঠিক জবাবে ইন্টারভিউ হল-এর গুরুগম্ভীর পরিবেশ কিছুটা হালকা করে দিতে পেরেছিলাম! সেদিনের প্রিন্সিপাল এ সি রায় সহ অন্যান্য বোর্ড মেম্বারদের IQ প্রশ্নবাণের অল্প কয়েকটি উদাহরণ দেয়ার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না:
(যদিও পুরো ইন্টারভিউ হয়েছিল ইংরেজিতে, আমি তার বাংলা তর্জমা করে দিলাম)
– তুমি শালিমার থার্ড গেট পেরিয়ে এসেছ, ওখানে কতগুলো রেল লাইন বলতে পারবে কি?
– আচ্ছা বিমলেন্দু, কলেজ ফার্স্ট গেট থেকে পোর্টিকো পর্যন্ত পৌঁছোতে তোমার কতগুলো স্টেপ লেগেছে’?
আমার উদ্দেশ্যে আরেকটি প্রশ্ন ছিল: ‘অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী মেলবোর্ণ না সিডনি’ ? …ইত্যাদি ইত্যাদি!
সবশেষে প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে সুখবরটা দিলেন: ‘বিমলেন্দু, আজ তোমার সেকেন্ড প্রেফারেন্স মেকানিক্যাল ইন্জিনীয়ারিং ডিসিপ্লিনে ভর্তির জন্য তুমি সিলেক্টেড হয়েছ! আগামী পরশু তোমার ফার্স্ট প্রেফারেন্স আর্কিটেকচার এর ইন্টারভিউ আছে। কোন অজুহাতেই তোমার অনুপস্থিত থাকা চলবে না! সেই ইন্টারভিউয়ে যদি সিলেক্টেড না হও, তাহলেই সেকেন্ড প্রেফারেন্স ডিসিপ্লিন-এ তুমি ভর্তি হ’তে পারবে!’
আমাকে বিশেশভাবে প্রশ্ন করলেন, বিমলেন্দু, ইজ ইট ক্লিয়ার টু ইউ’?
‘ইয়েস স্যার’: আমি সম্মতি জানিয়েছিলাম!
‘ওকে দেন, ইওর ইন্টারভিউ ইজ ওভার টুডে! গো ব্যাক অ্যান্ড এনজয়’!
উনি আমাকে বোর্ড রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এক সাঙ্কেতিক নির্দেশ দিলেন, আর আমি ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার’! ধন্যবাদ জানিয়ে একরাশ খুশির আমেজ নিয়ে বোর্ড রুম থেকে বেরিয়ে এলাম!

*দ্বিতীয়: কর্তব্যচ্যুতির শাস্তি, নাকি ক্ষমা!
১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, ১৩ নম্বর হোস্টেলে থাকি। কোন এক রবিবার, আমার ও সুবীরের মেস ডিউটি ছিল। সকালবেলা আমাদের দু’জনের উপস্থিতিতে স্টোর থেকে লাঞ্চের রেশন তুলে নেওয়ার পর, এগারোটা নাগাদ সুবীর বলল: ‘বিমল, জংলি সিনেমাটা দেখিস নি তো ? চল তা’হলে, দেখে আসি! দারুণ হিট হয়েছে, গত এক বছর ধরে সোসাইটিতে হাউস ফুল চলছে সিনেমাটা’।
সিনেমা দেখে ফিরতে আমাদের রাত হয়ে গেলো প্রায় সাড়ে সাতটা! হোস্টেলের খানিক দূর থেকেই আভাস পেয়ে যাই যে কিছু একটা গোলমাল ঘটে গেছে। হোস্টেল-মেটরা সপ্তাহ শেষের ছুটির পর ফিরে এসেছে। তারা আমাদের দু’জনকে দেখে চুটিয়ে গালিগালাজ শুরু করে দিলো। কারণ, আমাদের অনুপস্থিতিতে স্টোর থেকে বিকেলের রেশন বের করতে পারে নি। এই বিপদে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ১২ নম্বর হোস্টেল! স্টোরের চাবি কাউকে দিয়ে যাওয়ার কথা আমাদের দু’জনের একবারও মনে পড়েনি।

দাবানলের মত এই খবরটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে! প্রোক্টর স্যারও নাকি এসে দেখে গেছেন। নির্দেশ দিয়ে গেছেন যে হোস্টেলে ফেরা মাত্রই আমরা দু’জন যেন উনার সঙ্গে দেখা করি! অতএব আমি ও সুবীর ছুটে গেলাম প্রোক্টর স্যারের কোয়ার্টারে! উনার কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়ে কোন লাভ হ’ল না। তীব্র বিরক্তি সহকারে বললেন: ‘প্রিন্সিপাল সাহেবের নির্দেশ কাল সকাল এগারোটায় উনার চেম্বারে গিয়ে দেখা করতে হবে তোমাদের’! বোঝা গেল যে আমাদের কপালে দুঃখ আছে। হোস্টেল ফিরে বন্ধুদের টিটকারি শুনতে হলো: আর আফসোস করে কী লাভ? এখন বারো নম্বর হোস্টেলের দেওয়া তোমাদের ফেয়ারওয়েল ডিনারটা খেয়ে নাও! ডিনার শেষে রুমে ফিরে এলাম, কিন্তু চিরকালের জন্য বাড়ি ফিরে যাওয়ার অপমান আর দুশ্চিন্তায় সেই রাতে একেবারেই ঘুমোতে পারিনি।

পরদিন ঠিক এগারোটার সময় প্রিন্সিপাল স্যারের অনুমতি নিয়ে আমি এবং সুবীর তাঁর চেম্বারে ঢুকি। আমাদের দিকে তাকালেন, চোখ দু’টো যেন আগুনের গোলা! শিরদাঁড়া দিয়ে রক্তের হিমস্রোত বয়ে যাওয়ার অনুভূতি টের পেলাম। প্রথমে সুবীরের পালা, ওর কাছে জানতে চাইলেন: ‘নাম কি, বাড়ি কোথায়, যাতায়াত কিভাবে করে, ট্যাক্সি ভাড়া নিয়ে কত টাকা লাগে, ইত্যাদি ইত্যাদি’। আমি প্রমাদ গুনছি, আমার তো আর সুবীরের মত দিল্লিতে বাড়ি নয়! দমদম নাগেরবাজার, বড়জোর দশ বারো টাকা লাগবে! মুহূর্তে প্ল্যান ‘বি’ ভেবে নিলাম, সত্যি কথা বলা চলবে না! মেজদার পোস্টিং শহর কোচবিহার হবে আমার ঠিকানা!

সুবীরকে জেরার পর এবার আমার টার্ণ। প্রশ্নবাণের ঠ্যালায় বলতে হ’ল কোচবিহারের জন্য সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ নেই, ফোকার ফ্রেন্ডসিপ ফ্লাইটে যাতায়াত করতে হয়। ভাড়া ইত্যাদি শোনার পর নির্দেশ দেন: ‘হুঁম্, ঠিক আছে, অফিসের বড়বাবুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাও, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। আর শোন, আজকেই তোমাদের হোস্টেল খালি করে দিতে হবে’!

লজ্জায় আমার মাথা ঝুঁকে পড়েছে, বাড়িতে ফিরে কী করে বলব? কলেজ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে! প্রিন্সিপাল স্যারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে অফিসে বড়বাবুর সাথে দেখা করি। গম্ভীর মুখে তিনি জ্ঞান বিতরণ করে গেলেও, টাকার ব্যাপারে এক্কেবারে মুখে কুলুপ আঁটা। বিরক্তি প্রকাশ করার উপায় নেই, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। অবশেষে একসময় বলেন: ‘প্রিন্সিপাল সাহেবের নির্দেশে তোমাদের এই জ্ঞানগর্ভ কথাগুলো বলতে হয়েছে। আরও বলেছেন যে অফিস থেকে টাকা দেওয়ার অসুবিধা আছে, তাই তোমাদের দু’জনের আপাতত আর হোস্টেল ছাড়ার প্রয়োজন নেই! এবারের মত তোমাদের কর্তব্যচ্যুতি উনি ক্ষমা করে দিয়েছেন, তবে এটাও বলেছেন ভবিষ্যতে এই জাতীয় অপরাধ তিনি আর ক্ষমা করবেন না’ !

*তৃতীয়: ডিসিপ্লিন ভঙ্গের পরিণাম!
১৯৬২ সালের শেষের দিকের ঘটনা! আমি তখন কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে, স্লেটার হলে থাকি। পুজোর ছুটির শেষে বিকেলের মধ্যেই হোস্টেলে ফিরে এসেছি। জনা ছয়েক বন্ধু মিলে হঠাৎ সিনেমা যাওয়া ঠিক করলাম! শিবপুর ট্রাম ডিপো অঞ্চলে অলকা সিনেমা হল-এ উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত ‘সূর্যশিখা’ চলছে। আমাদের কারো দেখা হয়নি, ঠিক হ’ল ইভনিং শো দেখব! হাতে সময় কম, তাই আমরা ছয় বন্ধু সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লাম। ভাগ্য ক্রমে টিকিট পেতে কোন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ফেরার পথে পঞ্চান্ন নম্বর বাসে তিলধারণের জায়গা নেই! প্রথম বাসটি ছেড়ে দিলাম কলেজগামী পরের বাস ধরব বলে! ফলস্বরূপ হোস্টেল ফিরতে আমাদের বেশ দেরি হয়ে গেল। ন’টা বেজে গেছে অনেকক্ষণ, আমরা ছয় বন্ধু ছাড়াও আরো কয়েকজন ছিল। আমরা বিরাট দল এক সঙ্গে কলেজ সেকেন্ড গেটের ‘টার্ণ স্টাইল’ পেরিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে খানিকটা এগিয়ে দেখি যে দূরে রাস্তার বাঁ দিকে দেবদারু গাছের নিচে অন্ধকারে একটা কালো গাড়িতে হেলান দিয়ে দুই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন! তখনও আমরা ভাবতে পারিনি যে আমাদের জন্য এক বিপদ অপেক্ষা করছে! ‘সূর্যশিখা’ সিনেমার ‘হট সিন’ নিয়ে নিজেরা এতোটাই আলোচনায় মগ্ন ছিলাম যে, ভদ্রলোক দু’জনের দিকে ফিরেও তাকালাম না। আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে, শুধুমাত্র ক্লাচ দাবিয়ে গাড়িটি উতরাই রাস্তায় নিঃশব্দে এসে আমাদের দলটাকে দু’ভাগে ভাগ করে দাঁড়িয়ে পড়লো। ডান দিকে সোমেশ বিশ্বাস, প্রীতি কুমার নায়েক আর আমি। সুবীর সাহা, অনুপ মিত্র, শুভেশ মজুমদার ছাড়া অচেনা চারজন রাস্তার ওপারে। গাড়ির সামনের ডান দিকের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন প্রিন্সিপাল স্যার এবং বাঁ দিক থেকে উনার এক সহযোগী। আর পেছনের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন দু’জন লেঠেল সিকিউরিটি। প্রিন্সিপাল স্যার সিংহ বিক্রমে তিন অসহায় মেষ-শাবকের কাছে ডিসিপ্লিন ভঙ্গের জবাবদিহি চাইলেন। জবাব গ্রহণযোগ্য মনে না হওয়ায় এলোপাতাড়ি থাপ্পড়-বৃষ্টি প্রীতি, সোমেশ আর আমার সর্বাঙ্গে! ডানদিকের তিনজনকে শাস্তি দেবার পর, রাস্তা পেরিয়ে ওপারে গেলেন। শুরু হলো দুই হাতে এলোপাতাড়ি চড়,থাপ্পড়! সিকিউরিটি দু’জন ততক্ষণে সবাইকে আটকে রেখেছে। স্যারের সহযোগী ভদ্রলোক একটা ডায়েরি খুলে সবার নাম ও হোস্টেল নম্বর নোট করে চলেছেন। চপেটাঘাতের হাত থেকে কেউই রেহাই পেল না। অতঃপর ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে প্রিন্সিপাল স্যার গাড়ি স্টার্ট করে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যান বাঁ-হাতি রাস্তা ধরে। পরবর্তী ডেস্টিনেশন খুব সম্ভবত ছিল ‘অপারেশন’ সিনিয়র হোস্টেল, ওখান থেকেও হুল্লোড়ে মত্ত থাকার শব্দ স্পষ্ট ভেসে আসছিল!

*চতুর্থ: এক স্নেহশীল অভিভাবক!
তখন উনিশশো তেষট্টির এপ্রিলের শেষ কিংবা মে মাসের শুরু। এক শনিবারে আমাদের সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা। শুক্রবার বিকেলের দিকে উর্দি পরিহিত এক পত্রবাহক এসে আমাদের খোঁজাখুঁজি করে একটি চিঠি ধরিয়ে দিলেন, এনভেলাপের ওপরে লেখা ছিল ঠিকানা: স্লেটার ‘হল’। পত্রবাহক জানালেন: ‘প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছ থেকে আসছি। আগামীকাল সন্ধে ছ’টার সময় আপনাদেরকে সাহেবের বাংলোতে চা খেতে ডেকেছেন’ ! খাম খুলে দেখলাম সত্যিই তাই, আমাদের সেই ছয়জনের নাম লেখা আছে যারা পুজোর ছুটির শেষে হোস্টেলে ফিরে সেই রাতে ‘সূর্যশিখা’ সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম! আর ফেরার সময় প্রিন্সিপাল স্যার ডিসিপ্লিন ভঙ্গের কারণে আমাদের মেরেছিলেন। আমন্ত্রণ পেয়ে আমরা সবাই অবাক হয়ে ভাবছি – দোর্দন্ডপ্রতাপ প্রিন্সিপাল স্যারের এই স্নেহশীল দিকটার কথা তো একেবারেই জানা ছিল না! সুবীরকে সেই রাতের ট্রেনেই দিল্লি রওয়ানা হতে হবে, তাই স্যারের টি ইনভাইটেশন অ্যাটেন্ড করা সম্ভব হবে না।

শনিবার সন্ধ্যায় আমরা বাকি পাঁচ বন্ধু যতটুকু সম্ভব ভদ্রলোকের মত পোশাক পরে প্রিন্সিপাল স্যারের বাংলো পৌঁছে গেলাম। সাদা উর্দি পরা আর্দালি আমাদের সবাইকে প্রশস্ত বারান্দায় টিপটপ সাজিয়ে রাখা চেয়ারে বসতে বলে ভেতরে চলে গেলেন। মিনিট কয়েকের মধ্যেই স্যার এসে হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানান! তাঁর পরণে ধোপদুরস্ত সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। এই ঘরোয়া পোশাকে স্যারের ব্যক্তিত্ব যেন অন্যরকম মাত্রা পেয়েছে! ইনি যেন অন্য এক ব্যাক্তিত্ব। আমরা একে একে চেয়ার ছেড়ে উঠে স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করি। উনিও সবাইকে আশীর্বাদ করেন! আমরা সেদিনের ডিসিপ্লিন ভঙ্গের ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি।

স্যারের কণ্ঠস্বরে আবেগের ছোঁয়া, বলতে শুরু করেন: ‘সবাই আমাকে অত্যন্ত কঠোর প্রশাসক বলেই জানে। হয়ত সেটাই সত্যি, দায়িত্বভার আমাকে কালক্রমে কঠোর প্রকৃতির করে তুলেছে। বি ই কলেজের হাজার দেড়েক ছাত্রদের রক্ত সম্পর্কের অভিভাবকরা তাঁদের ছেলে-মেয়েকে আমার দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে বাড়িতেই নিশ্চিন্তে থাকেন। তাঁদের শুধু একটাই স্বপ্ন: ছেলে হোক কিংবা মেয়ে, সে যেন ভবিষ্যতে খুব নাম করা ইন্জিনীয়ার হয়ে ঘরে ফেরে! বাড়িতে যদি একজন ছাত্র/ছাত্রীর অভিভাবক তার বাবা/মা হয়ে থাকেন, তাহলে বি ই কলেজের প্রায় দেড় হাজার ছাত্রের অভিভাবক একজন প্রিন্সিপাল। ছাত্রদের প্রত্যেকেই যে নামকরা ইন্জিনীয়ার হয়ে বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে, তা হয়ত সম্ভব নয়! কিন্তু আমি চাই, আমার ছাত্ররা যেন সবাই সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠে! বি ই কলেজের ছাত্রদের ভবিষ্যত যেন আমার ভুলের জন্য অন্ধকার না হয়ে যায়! তোমাদের গায়ে হাত তোলার মত কঠোর কাজে তোমরাই শুধু কষ্ট পাওনি, আমিও সমানভাবেই মনঃকষ্টে ভুগেছি। তাই আজ মন খুলে কিছু বলতে পেরে অনেক হালকা বোধ করছি। আমি ভেবেছিলাম সবাই আসবে, কিন্তু তা’ তো হ’ল না, শুনলাম অন্যেরা বাড়ি চলে গেছে’।
সেই প্রথমবার স্যার বাংলায় কথা বললেন। তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের বাঙ্গাল, এবং কথায় পূর্ববঙ্গের বেশ টান ছিল।

আর্দালি প্লেট ভর্তি মিষ্টি, নোনতা, স্ন্যাক্স নিয়ে এসে টি-টেবিলে সাজিয়ে রাখেন। কিছুক্ষণের পরেই গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ সাজিয়ে দিয়ে গেছেন আর্দালি। স্যার আবেগ মন্দ্রিত আলোচনায় ইতি টেনে সবাইকে বলেন: ‘কী হ’ল? নাও, নাও, খাওয়া শুরু কর – চা ঠান্ডা হয়ে যাবে যে’ !
এর পর বিদায় নেয়ার পালা। স্যারকে প্রণাম করে এক সুন্দর অনুভূতি নিয়ে আমরা পাঁচ বন্ধু হোস্টেলের দিকে পা বাড়াই।

I cannot teach anybody anything;
I can only make them think.
– Socrates

*******

অধ্যক্ষ A.C. Roy স্মরণে
নারায়ণ প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ১৯৬৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

১৯৬২ সালের এক বৃষ্টি ভেজা দুপুরে ছাত্র হিসেবে আমার বি ই কলেজে প্রবেশ। স্থান হলো ব্রিটিশ স্থাপত্যের প্রাচীন নিদর্শন ডাউনিং হস্টেলে। শুরু হলো জীবনের এক নতুন অধ্যায় – ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা। ডাউনিং সাহেব (S.F.Downing) ছিলেন বি ই কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল। তাঁর নামেই নামকরণ হয়েছিল এই হস্টেলের।

সেই ইংরেজ সময়ের কথা বলতে পারবো না। আমি বলতে পারি অন্য একজন অধ্যক্ষের কথা যাকে আমি নিজের চোখের সামনে দেখেছি, যার নাম আজও তাঁর ছাত্রদের হৃদয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ হয়। তিনি অতুল রায়, আমরা সংক্ষেপে জানি প্রফেসর এ সি রায়। বাঙালি হয়েও আদব কায়দায় কথাবার্তায় তিনি ছিলেন পুরোপুরি সাহেব। আমরা ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত মাত্র তিন বছরের জন্য ওনাকে অধ্যক্ষ রূপে পেয়েছিলাম। তারপরে উনি North Bengal University তে উপাচার্যর দায়িত্ব নিয়ে চলে যান।

এক সিনিয়র দাদা সমীর পাল, আমার থেকে দুই বছর সিনিয়র। নবদ্বীপে একই পাড়াতে আমরা থাকতাম। সমীরদা হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অর্জন করেছিল। কলেজে ঢোকার আগেই সেই দাদার কাছে প্রফেসর রায়-এর সম্পর্কে কিছুটা জেনেছিলাম। সমীরদা আগেই জানিয়ে রেখেছিল যে উনি একজন দক্ষ এবং কড়া প্রশাসক। রাশভারী ব্যক্তিত্ব। শিক্ষক ছাত্র সকলেই ওনাকে যেমন সমীহ করে, তেমনই সন্মান করে। আরও বলেছিল ওনাকে Black Jewel of Glasgow বলা হয়। Black Jewel কেন বলা হয় জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেন উনি Glasgow-র একজন কৃতী ছাত্র, ইঞ্জিনিয়ার। গায়ের রং একেবারে কয়লার মতো কালো বলে Black Jewel বলা হয়।

প্রথম আমি ওনাকে দেখলাম কলেজের ওভালে। সেদিন ছিলো কলেজের বাৎসরিক স্পোর্টস-এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। সঙ্গে ছিলেন ওনার মেমসাহেব স্ত্রী, অতীব সুন্দরী । সেদিন ওনার সেই ইংরেজি বক্তৃতা আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। কখনো এত ভাল ইংরেজি বক্তৃতা শুনেছি বলে আমার মনে পড়ে না।

সেই সময় ভারতের বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় প্রেমজিত লাল বিই কলেজের টেনিস কোর্টে প্রাকটিস করতে আসতেন, আর সেই সূত্রে স্যারের বাড়িতে প্রেমজিতের ভালোই যাতায়াত ছিল। একদিন কৌতুহলের বশে আমরা কয়েকজন অধ্যক্ষ স্যার এর বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছি, এদিক ওদিক উঁকি মারছি। উদ্দেশ্য প্রেমজিতলালকে সামনে থেকে একটিবার মাত্র দেখা। হঠাৎ দেখি অধ্যক্ষ আসছেন। সঙ্গে মেমসাহেব স্ত্রী এবং মেয়ে জর্জিনা। সেই দেখে আমাদের তো হাত পা ঠান্ডা হবার জোগাড়। পড়িমরি করে ছুটে পালিয়ে সেদিন কোনোরকমে আত্মরক্ষা করেছিলাম। ভাগ্যিস উনি আমাদের দেখেন নি। তাহলে আমাদের ভাগ্যে কী ছিল কে জানে।

আমার যখন সেকেন্ড ইয়ার কি থার্ড ইয়ার, এত বছর বাদে সঠিক মনে নেই, বাতাইতলার সঙ্গে আমাদের কিছু গণ্ডগোল হয়েছিলো। আমরা হস্টেল থেকে মশারির রড নিয়ে মারপিট করতে বেরিয়ে এসেছিলাম। স্যার খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ আমাদের মধ্যে ছুটে এসেছিলেন। সেইদিন দেখেছিলাম কিভাবে শক্ত হাতে সেই অশান্ত অবস্থা উনি সামলে ছিলেন। “Boys go back to your hostel. Move fast.” এই আদেশ সেদিন এতোটাই কঠোর ছিলো যে সেটা অমান্য করার সাহস আমাদের হয়নি।

আপাত দৃষ্টিতে উনি গম্ভীর হলেও মানুষটি কিন্তু অত্যন্ত রসিক ছিলেন। আমাদের তখন বোধ হয় ফোর্থ ইয়ার। প্রফেসর অমিতাভ ঘোষ আমাদের Theory of Machines এর ক্লাস নিতেন। একদিন আমরা স্যারের জন্য ক্লাসে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দেখি ক্লাসে ঢুকেছেন অধ্যক্ষ স্যার। ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন “What is the subject in this period? Who is the teacher?
আমরা উত্তর দিলাম। তারপরেই প্রশ্ন “What topic he is teaching now?”
আমরা বললাম “Flywheel”।
তারপরেই প্রশ্ন “Why a Flywheel is so named?”
আগের ক্লাসেই প্রফেসর ঘোষ Flywheel সম্পর্কে ভুমিকা বলে দিয়েছেন কিন্তু Flywheel এর নামকরণের কোন ব্যাখ্যা তো দেননি! আমরা সকলেই চুপ করে আছি । আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় অশোক মল্লিক উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু সে এতটাই নার্ভাস ছিলো যে ও কি বলল আমরা কেউ বুঝতে পারলাম না। উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন – Is it because the wheel flies in the air or because a fly sits on the wheel?
ওনার এই কৌতুকের মধ্যেই যে উত্তর লুকিয়ে ছিলো সেটা প্রথমে বুঝি নি। তিনি তারপর বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে Fly Press আর গভর্নর এর fly balls থেকে Fly কথাটার উৎপত্তি হলো। যাই হোক তার পরেপরেই প্রফেসর ঘোষ ক্লাসে ঢুকলেন এবং আমরাও যেন স্বস্তি ফিরে পেলাম।

আমার অবচেতন মনে তাঁর ব্যক্তিত্বর প্রভাব এতটাই ছিলো যে প্রবীণ বয়সেও মাঝে মাঝেই আমি ওনাকে স্বপ্নে দেখেছি। প্রতিবারই যেন উনি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। পাশেই কখনও বসে আছেন প্রফেসর দুর্গাদাস ব্যানার্জি, কখনও বা প্রফেসর শঙ্কর সেন, আবার কখনও বা ডঃ বড়াল। আর অধ্যক্ষ স্যার আমাকে কখনও প্রশ্ন করছেন কলেজের ক্লক টাওয়ার নিয়ে, কখনো হাওড়া ব্রিজ নিয়ে কখনো বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর পরী নিয়ে।

এক বন্ধুর কাছে শুনেছি উনি ছিলেন বরিশালের বাঙাল। ঘরোয়া পরিবেশে অনায়াসে বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন।

আমার দীর্ঘ পাঁচ বছরের ছাত্রজীবন ও তারপর চল্লিশ বছরের কর্মজীবনে উনার মতন এমন অসাধারণ জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব এবং প্রশাসনিক দক্ষতা আমি খুঁজে পাইনি।
ছাত্রজগতেও এমন প্রশাসক আজ সত্যিই বিরল।

A leader … is like a shepherd.
He stays behind the flock,
letting the most nimble go out ahead,
whereupon the others follow,
not realizing that all along they are being directed from behind.
-Nelson Mandela

******

Sahityika Admin

Add comment