সাহিত্যিকা

প্রফেসর জয়ন্ত কুমার সেন – উডল্যান্ডসের আনন্দঘন বিষণ্ণ সন্ধ্যা

প্রফেসর জয়ন্ত কুমার সেন – উডল্যান্ডসের আনন্দঘন বিষণ্ণ সন্ধ্যা
রঞ্জিত গাঙ্গুলী, ১৯৮১, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

সেদিন কলকাতার ভয়ঙ্করতম বৃষ্টি হয়ে গেলো আর তার সাথে রাস্তার জল জমার রেকর্ড। পরের দিন মানে মা’কে নিয়ে উডল্যান্ডস হাসপাতালে যেতে হয়েছিলোI রিসেপশন এরিয়াতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে একবার কফি খেতে ইচ্ছে হয়, আর সেই কফির কাপ হাতে নিয়ে বেরোতে গিয়েই দেখি প্রবলভাবে চেনা সেই বিশিষ্ট ব্যক্তি বসে আছেন! পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন – আরে, আরে, তুমি কি আমাকে চিনো ?
– স্যার, আপনি আমাদের ইলেক্ট্রিক্যাল-এর হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট ছিলেন, আপনাকে চিনবো না?
পরম স্নেহে পাশে বসালেনI এখানে আসার কারণসমূহ বিনিময় করা হলোI
– এই, তোমার নাম কি? কুন ব্যাচ ?
আমার নাম বললাম, আর এও বললামম যে আমি আপনার অগণিত ছাত্রদের মধ্যে একজনI
– তাই হবে, তুমায় ঠিক চিনতে পারলাম নাI
– স্যার, আপনি কিন্তু একই রকম রয়ে গেছেন।
দেখলাম স্যারের সেই চওড়া কপালটাও অবিকৃতই রয়ে গেছে।

– আচ্ছা, আমি তুমাদের কি পড়াতাম বলো তো? আসলে কি জানো, একাশি বছর বয়স হইলোI মূত্রনালীতে হালকা কর্কট রোগ নিয়ে বেঁচে আছি I তবে সুগার, প্রেসার কিস্সু নাই, বুঝলা কিনা?? হাঃ হাঃ হাঃ ( স্যারের সেই অনাবিল হাসি )I আরো কি জানো?? আমার আগের প্রায় অনেকেই চলে গেছেন, সাত আটজন বাদে ..
– সাত আটজন মানে, তাঁরা কারা স্যার?
– কেন? ড: শঙ্কর সেন, ৮৯ বচ্ছর বাচলেন, তারপর ড: রজত চক্রবর্তী, ৯০। আরও আছে ড: ধ্রুব রায় ৮৪ ; ড: চিরঞ্জীব সরকার ৮৬; তুমাদের ড: অমিতাভ মুস্তাফি 83; আর অংকের মাস্টারমশাই ড: সুশীল দাশগুপ্ত ৮৬। তবে সর্বজ্যেষ্ঠ হইলেন কামদাবাবু, ১০২ ব্যাটিং! হাঃ হাঃ হাঃ ….
– কি বললে? দীপ্তেন? ড: দীপ্তেন দাশগুপ্ত? সে আমার থেকে ছয় বছরের ছুট, ভালো আছেন .. চিত্তকে তুমার মনে আছে? আরে, চিত্তরঞ্জন মাহাতো গো ! এখন উনার ৭৭, হ্যাঁ, তিনিও ভাল আছেন I আমার ছোটদের মধ্যে তুমরা যাকে “গাভাস্কার” বলতে, সেই দেবাশীষ ঘোষ কিন্তু নাই .. প্রদীপ, শোভেন সক্কলে আমার ছোট , কিন্তু নাই , চলে গেছে!! নাঃ , ড: আনন্দমোহন ঘোষ ভাল আছেন I

খানিক পরে আবার শুধোলেন – নামটা যেন কি কইলে? ছবি তুলো, ছবি তুলো।
সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে ছবি তোলা হলো।
– দেখাও, দেখাও, ছবিটা দেখাও।
ছবি দেখালামI
– আমাকে ইমেইল করে দিও কিন্তু !!

মনের মধ্যে একরাশ আনন্দ নিয়ে স্যারের পাশে চুপ করে বসে আছি … কত স্মৃতি মনের মাঝে উঁকি মারছে…. আমাদের কলেজ জীবনে স্যার কলকাতা থেকেই যাতায়াত করতেন। তখনও “বিদ্যাসাগর সেতু” হয়নি. বহু সময় লাগতো কলকাতা থেকে হাওড়া এসে বাস পাল্টিয়ে কলেজে পৌঁছতে। ওঁনার এক সহযাত্রী আমাদের এক সতীর্থর কাছে শোনা:- ” বিগার্ডেন – হাওড়া” মিনি বাস ব্যাতাইতলায় এসেই দাঁড়িয়ে যেত, নড়তো নাI কন্ডাকটর ক্রমাগত হাওড়া হাওড়া চিৎকার করে কান ঝালাপালা করে দিতোI এ ছিল নিত্যচিত্র। একদিন স্যার নাকি আর থাকতে না পেরে শিক্ষকসুলভ ধমকের সুরে কন্ডাক্টরকে বলেন – “এতো চিৎকার করার কি আছে হে?? বাসের গায়ে তো বড় বড় অক্ষরে ল্যাখাই আছে যে এটা কোথায় যাবে।” ফিচকে কন্ডাকটর মিচকে হেসে দার্শনিক ভঙ্গিমায় স্যারকে বলে বসে – সব প্যায়েনজার্ তো আপনার মতুন এম এ, বি এ পাস্ নয় কাকু, যে তারা পড়তে পারে… আমাদের তাই চেল্লাতেই হবে বাস বোঝাই করতে… !!

হুঁশ ফিরলো স্যারের পরিচিত কণ্ঠস্বরে …
– কিস্সু মনে রাখতে পারিনা!! নামটা যেন কি বললে ??
চোখে জল এসে গেলো. টকটকে ফর্সা, উচ্চারণে সামান্য পূর্ববঙ্গের টান, আমাদের সেই মাস্টারমশাই ড: জয়ন্ত কুমার সেন বইয়ের পাতার পর পাতা মনে রাখতেন, আর আজ এখন সামান্য হলেই ভুলোমনা হয়ে যান।

– এই, আমাকে একটু টয়লেটে নিয়ে চলো. শোনো ইখানেই দাঁড়াও, কোত্থাও যেওনা কিন্তু! কেউ যদি বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়?
– স্যার , আমি দাঁড়াচ্ছি , আপনি নিশ্চিন্তে যানI
দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করার কোনও উপায়-ই নেই.. পরম নির্ভরতা সঙ্গী করে স্যার টয়লেট-এ গেলেন, পিতাসমান মাস্টারমশাইকে আগলে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলুম …

শিশুর মতো সহজ সরল মানুষটি নিজে এসে মায়ের সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন.. ১৯৩৫ এ জন্ম. ক্লাস এইট পর্যন্ত ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে-এ পড়াশোনা। ১৯৫০ সালে মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। আমি আগ্রহী হয়ে স্যারের একাডেমিক এক্সেলেন্স এর বিশদ জানতে চাইলাম। বর্তমানের কিছু কিছু মনে রাখতে সামান্য অসুবিধে হলেও আগেকার কথা স্যার গড়গড় করে বলে গেলেন.. ১৯৫২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে আই এস সি পাশ করে তারপর ১৯৫৪ সালে বি এস সি পাশ করেন ফিজিক্স-এ অনার্স নিয়ে। ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্বাবিদ্যালয় থেকেই এম এস সি (টেক) (রেডিও ফিজিক্স এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স) এ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। ১৯৬৫ সালে ডি ফিল করেন ওই একই বিষয়ে। তারপর ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ইউ এস এর ইলিনয়েস ইউনিভার্সিটি থেকে পি এইচ ডি করেন।

আমি অবাক হয়ে শুনছি আর মনে মনে চাপা গর্ব অনুভব করছি আমাদের সহজ সরল মাস্টারমশাই এর অসাধারণ এক একাডেমিক সাফল্যের কথা ভেবে।

হুঁশ ফিরলো স্যারের কথায় — এই দেখো, কলকাতা পুলিশ থেকে আমাকে সুরক্ষা কার্ড দিয়েছে যার নাম “প্রণাম”। আর ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়েছিলো ৭০ বছর অব্দি। পরে আর রিনিউ করে নাই।

– কি বললে? পেনশন? হ্যাঁ , পাইতো! হাঃ হাঃ হাঃ, মজার কথা কি জানো – যখন অবসর নিই, বেতন ছিল মাসে পনেরো হাজার টাকাI আর এখন বর্তমানে পেনশন পাই তার প্রায় চারগুণ …. হাঃ হাঃ হাঃ … আমার সমস্ত সঞ্চয় তো অবসর জীবনেই অর্জিত .. যার মধ্যে সিউড়ি আর কোলাঘাট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে-এ আমন্ত্রণমূলক অধ্যাপনাও আছে.. তবে জানো তো, আমার এখনের এই চিকিৎসাটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল!! ওই রোগটাকে কাবু রাখতে একেকবারে ত্রিশ হাজার টাকার ইনজেকশন নিতে হয়..

মা-এর দিকে ফিরে স্যার বলে চলেন; জানেন তো, আমাকে অতটা কাবু করতে না পারলেও চারিপাশটা দেখে আমার মনে হয় যে বার্ধক্য, জীবনের একাকিত্ব এইসব ক্রমশ: যেন মানুষকে গ্রাস করছে। বিদেশে চাকুরীরত ছেলেমেয়েরা টাকা পাঠিয়ে তাদের কর্তব্য, হয়তো বা অপরাধবোধ কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাড়িটা যে খাঁ খাঁ করে। সেখানে কোনও হৈচৈ নাই, শিশুর হাসি কান্না নাই, আধো আধো কথা নাই। নাই কুনও দাম্পত্য খুনসুটি, কপট কলহ। বিরাজ করে শ্মশানের নিস্তব্ধতা।

বলতে বলতে কি স্যারের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। জানিনা, স্যারের চোখের কোলদুটি অশ্রুসিক্ত হলো কি? কি জানি! একরাশ দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে এই লেখা।

পুনশ্চ; স্যার আমাদের কাঁদিয়ে চলে গেলেন ১৫ই জুলাই,.২০২০

******

Sahityika Admin

Add comment