সাহিত্যিকা

আমার সেরা শিক্ষক (‘দাদু ‘ সারদাপ্রসাদ দে)

আমার সেরা শিক্ষক (‘দাদু ‘ সারদাপ্রসাদ দে)
অভিজিৎ রায়, ২০০২ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

প্রফেসার্স কোয়ার্টার্সের দিক থেকে সরু পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গীতে হেঁটে আসছেন একজন সত্তরোর্ধ ঋজু, ক্ষীণকায়, খর্বকায় মানুষ। পরণে ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী এবং মাথায় ছাতা নিয়ে ঢুকছেন স্কুল ক্যাম্পাসে। তিনিই ছিলেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন শিশু বিদ্যাবীথির প্রবীণতম শিক্ষক সবার আদরের ‘দাদু’ (পোষাকি নাম সারদাপ্রসাদ দে)

সে আজ থেকে প্রায় পঁয়তিরিশ বছর আগের কথা।
অকৃতদার, ছিপছিপে, নির্মেদ চেহারার এই মানুষটির কাছে স্কুল এবং ছাত্রছাত্রীরাই ছিল একমাত্র ধ্যান জ্ঞান। স্কুল ছুটির পরেও ঘুরে বেড়াতেন স্কুল ক্যাম্পাসে – কোথাও এক টুকরো নোংরা পড়ে থাকতে দেখলে তুলে ফেলে দিতেন ডাস্টবিনে.

পড়াতেন ইংরেজি, করাতেন ব্রতচারী, উদাত্ত গলায় গাইতেন –
‘পেটের খিদের জ্বালায়
খাব ক্ষীর আর মালাই’
অবলীলায় মিশে যেতেন ক্লাস ওয়ান-টু তে পড়া ছোটছোট কুঁড়িগুলোর সঙ্গে.

এই মানুষটিকে দেখে আমি অনুপ্রেরণা পেতাম।
উনি ছিলেন স্কুলের সকলের অভিভাবক। শিক্ষকদেরও। ঋজু টানটান নির্মেদ ছোটখাটো চেহারা। পরনে ধপধপে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী। পায়ে চকচক করা কালো নিউকাট। সে এক অন্য সময়। অন্য আভিজাত্য। এখনকার চটুল বিশৃঙ্খল সময় দিয়ে সেই গম্ভীর সুশৃঙ্খল আশ্রমিক পরিবৈশকে বোঝা যাবে না।

তখন আমার বয়স ৭ (সাত)। ক্লাস টু তে পড়ি। ওনার তখন হবে প্রায় ৭০ (সত্তর)। স্কুলে প্রধানশিক্ষক ছাড়া একমাত্র ওনারই একটা আলাদা কেবিন ছিল। সেই ঘরে ঢুকলে একটা স্বর্গীয় অনুভূতি হতো। একটু সুন্দর মিষ্টি গন্ধ ছেয়ে থাকতো ওনার সারা ঘর জুড়ে।

আমাকে খুব স্নেহ করতেন। সকালে প্রেয়ার শুরু হবার আগে আমাকে দিয়ে বেলের সুইচ টেপাতেন। বিরাট রেকগনিশন তখন আমার। দারুণ আনন্দ। ছোট্ট সেই আমি কতবার চলে গেছি ওনার ঘরে। ক্লাস শুরুর আগে। টিফিন পিরিয়ডে। বলতেন ‘আসো আসো।‘পুজোর পরে দেখা হলে বলতেন ‘এবার পুজোয় কটা ঠাকুর দেখলে?’

ওনার কঠোর পরিশ্রম আর নিয়মানুবর্তিতা এবং বিদ্যার প্রতি সততা আমাকে মুগ্ধ করতো।
ঐ রকম পরিচ্ছন্ন আদর্শবাদী হতে চেয়েছি সারা জীবন। কিন্তু পারলাম আর কই?
শিশু বয়সের সেই মিষ্টি স্মৃতি আজো আমার কাছে এক স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়া।
শৈশবের অমূল্য রত্নরাজির মধ্যে এও এক হীরে মাণিক। যাকে সযত্নে আঁকড়ে থাকতে চেয়েছি চিরকাল।

শিক্ষক দিবস স্মরণ করে আমার জীবনের এক আদর্শ শিক্ষাব্রতীর পরমপদকমলে অর্ঘ্যকুসুমের ডালি উজাড় করে দিলাম

– দাদু যেখানেই থাকো আশীর্বাদ করো.

******

Sahityika Admin

Add comment