স্বাবলম্বী
@অর্ণব চ্যাটার্জী, ১৯৮৩ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
শীতটা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে আজ। গ্রামের দিকে ঠাণ্ডা এক্টু বেশিই থাকে। তার উপর পুরনো দিনের খোলামেলা বাড়ি। কালের স্রোতে জানলা দরজাগুলোর জায়গায় জায়গায় চিড়ও ধরেছে।
ঠাণ্ডার কবল থেকে বাঁচতে আজ আনিকেত নেশার মাত্রাটা বোধহয় খানিকটা বেশিই চডিয়ে ফেলেছে। রাস্তায় গাড়িটা বিকল হয়েই যত বিপত্তি … সারাদিন শরীরের উপর দিয়ে প্রচণ্ড ধকল গেছে। আর এখন ক্লান্ত লাগছে, খুবই ক্লান্ত — প্রায় মধ্য রাত। শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতে পারলে ভালো হয়।
সাধারণত প্রতি সপ্তাহ শেষে আনিকেত কোলকাতার বাড়ি থেকে এসে গ্রামের এই পৈতৃক ভিটেতে একটা রাত কাটিয়ে যায়। এই কয়েকটি ঘণ্টা তাঁর একান্তই নিজের — বাবার সাথে একান্তে খানিকটা সময় কাটাবার এক পরম তৃপ্তির আস্বাদ পায় এখানে। তাঁর মনে হয় বাবা যেন তারই জন্য সারাটি সপ্তাহ অপেক্ষা করে বসে থাকে। বাড়ির প্রতিটা আনাচে কানাচে বাবার শারীরিক উপস্থিতি সে অনুভব করে।
সেই মাঝরাতে দরজায় হাল্কা একটা টোকার শব্দ। “ভেতরে এসো দিনুদা”, আনিকেত ডাকলো, “আজ তো তোমার খুব হয়রানি গেছে। এতো রাত পর্যন্ত জেগে বসে আছো।“
গত মাসে দিনুদা এ বাড়ির কেয়ার টেকার নিযুক্ত হয়েছেন। সে আনিকেতের হাতে একটা মুখবন্ধ খাম ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আজকালকার দিনে হাতে লেখা চিঠি? আনিকেত একটু অবাকই হলো। কে দিয়ে গেছে খাম্টা? বলেও গেল না দিনুদা। পাশের গ্রামের বিশুকাকা হতে পারে। বার কয়েক মোটা টাকা ধার নেওয়ার পর বোধহয় নিজের মুখে আবার ধার চাইতে লজ্জা পাচ্ছেন, তাই হয়ত চিঠি লিখেই টাকার প্রয়োজন জানিয়েছেন। এই বিশুকাকার মাথার উপর সংসারের বিরাট দায়িত্ব। তিনটি অবিবাহিত মেয়ে। কোন রোজগারও করে না। ধার শুধবে না জেনেও অনিকেত কয়েকবার বিশুকাকাকে ধার দিয়েছে। তবে শুধু বিশুকাকাই নয়, গ্রামের অনেকেই অনিকেতের কাছে অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে।
নেশায় একে মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার উপর ড্রপ ভোলটেজ, আর মাথার উপর আলোটাও টিমটিম করে জ্বলছে। একবার ভাবল কালকে পড়বে। কিন্তু অজানা এক রহস্যের টানে খামের মুখ খুলে চিঠিটা সামনে মেলে ধরে আনিকেত। পড়তে আরম্ভ করলো
স্নেহের বাপি, “গতকাল টিভিতে সরকারের ডাকা বাণিজ্য সন্মেলনের প্রথম সারিতে তোকে দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেলো। আজ তুই একজন কৃতি ও সফল ব্যাবসায়ী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিস। সমাজ সেবামুলক কাজেও নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিস শুনে ভালো লাগলো। ছোট বেলায় তোর হাত ধরে যখন রাস্তায় বের হতাম তুই আমার থেকে পয়সা চেয়ে নিয়ে রাস্তার ভিখারিদের দিতিস মনে আছে?”
অনিকেত থমকে দাঁড়ায় … কার লেখা এ চিঠি!! নেশার মাঝে অনিকেতের সবকিছু যেন ওলট পালট হয়ে যায়। পড়ে চলে অনিকেত …… “তখনই বুঝেছিলাম তোর মধ্যে একটা ভালো মানুষ ঘুমিয়ে আছে। তুই একদিন সমাজের প্রান্তিক মানুষদের সেবা করবি, আর এ কেবলশুধুই সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু কেবল একজন ভালো মানুষ হয়েই তো এই কঠিন সংসারে বেঁচে থাকা যায় না। সংসারে বেঁচে থাকতে হলে অর্থেরও প্রয়োজন হয়। আর অর্থ উপার্জনের জন্য দরকার কিছু শিক্ষাগত যোগ্যতা, আর কঠিন লড়াই আর নানা ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করার ক্ষমতা।“
আনিকেত আবার একবার পড়া থামিয়ে ভাবতে শুরু করে।
“ভালোভাবেই তুই বি কম পাশ করলি। দেখতে দেখতে তোর বয়স ২৫ বছর হয়ে গেলো। কিন্তু এই বয়সেও তুই আমাকে আঁকড়ে ধরে থাকলি। সার্বিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কোন চেষ্টাই আমি তোর মধ্যে দেখলাম না। মাঝে মাঝে মনে হতো আমিই বোধহয় তোকে একটু বেশি মাত্রায় পরনির্ভর করে দিয়েছি। সামান্য ব্যাংক পোষ্ট, বা অফিসের কাজ করতেও তুই ভয় পেতিস। আত্মবিশ্বাসের বড়ই অভাব ছিল তোর মধ্যে। ভয় পেলাম, কোন মানসিক সমস্যা নয় তো? কলকাতার ডাক্তার দেখালাম, তিনি কোনো ওষুধ দিলেন না শুধু বলেছিলেন, ওকে জলে ফেলুন — ও আপনি আপ সাঁতার শিখবে।“
“আমি ব্যাংক, বাজার্, পোষ্ট অফিসে যাওয়া বন্ধ করলাম। তুই প্রথম প্রথম খুব ঘাবড়ে গেলি। টাকা তোলার জন্য তুই চেকবই চাইলি। সই করে দিলাম। তুই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে আনলি। আস্তে আস্তে বাড়ির কাজের কিছু কিছু দায়িত্ব নিতে শুরু করলি। কিন্তু নিজের রোজগার করার কোন চেষ্টাই ছিল না তোর মধ্যে।“
এরপর আর আমি সই করতে পারতাম না। জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট না থাকার ফলে টাকা তোলা বন্ধ হয়ে সংসারে আর্থিক সংকট তৈরি হলো। ব্যাংক পোষ্টঅফিসের বই কোথায় আছে মনে করতে পারলাম না। তোর কাছে আমি তখন হয়ে গেছি মানসিক ভারসাম্য হারনো এক মানুষ। রূঢ় বাস্তবটা এবার তুই কিছুটা হলেও উপলব্ধি করলি। চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরা শুরু হলো তোর। ভগবান সহায় ছিলেন, তোর একটা চাকরীও জুটে গেলো। আমাকে নিয়ে তোর উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না। মাঝে মাঝেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতিস।“
“আমাকে মানসিক হাসপাতালের বাইরে বেঞ্চে বসিয়ে তুই আবার ডাক্তারের কাছে গেলি কিছু জিজ্ঞেস করতে। বলে গেলি, একটু অপেক্ষা করো—আমি আসছি। দেখে ভালো লাগলো যে তুই আস্তে আস্তে দায়িত্ব নিতে শিখছিস। সেই দিনই মানসিক হাসপাতালে তোর আর আমার ছাড়াছাড়ি হলো।“
“তারপর দীর্ঘ ১৫টা বছর কেটে গেছে। সেদিনের কথা আমার খুব মনে পড়ে। তুই ডাক্তারের ঘরে ঢোকার পর সুযোগ বুঝে আমি হাসপাতাল থেকে একলাই বেরিয়ে পড়লাম। অনেকটা পথ হেঁটে স্টেশনে এসে বসলাম। মনটা ছিল ভারাক্রান্ত। বার বার তোর কথা মনে হচ্ছিলো …. যখন ফিরে এসে দেখবি আমি নেই নিশ্চয় পাগলের মতো এদিক ওদিক হন্যে হয়ে খুঁজবি আমাকে – দিশেহারা হয়ে পড়বি হঠাৎ করে আমাকে হারিয়ে।“
“একবার মনে হলো ফিরে যাই। আবার মনে হলো যদি ফিরেই যাবো তাহলে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলাম কেন? মনকে শক্ত করলাম। যে ট্রেনটা পেল্ম, উঠে বসলাম – কোথায় যাব জানি না। কেবলই মনে হচ্ছিল আমি কি ঠিক কাজ করেছি তোকে এভাবে অথৈ জলে ফেলে এসে? তোকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য মানসিক ভার সাম্যহীন মানুষের অভিনয় করে সংসার থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কি ঠিক করেছিলাম?”
“আজ মনে হয় ঠিকই করেছিলাম। সেদিন তোকে অথৈ জলে ফেলে চলে না আসলে তুই আমার মুখাপেক্ষী হয়েই সারাজীবন কাটাতিস। আজকের এই সাফল্য অধরা থেকে যেত। আমার বিশ্বাস ছিল যে তুই ঠিকই সাঁতরে ডাঙায় এসে উঠবি। অফিসের রিক্রিয়েশন ক্লাব এ নাটক করার অভিজ্ঞতা বাস্তবে এভাবে কাজে লাগবে ভাবতে পারিনি।“
“জীবনে আরও উন্নতি কর। গরীবের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখিস।
প্রান ভরা ভালবাসা রইলো।
তোর বাপি ”
আনিকেতের সম্বিত ফিরে এলো। ঘর থেকে বেরিয়ে দিনুদাকে ঘুম থেকে ওঠালো সে।
“কে দিয়ে গেলো এই খাম? তুমি নাম জিজ্ঞেস করলে না? কেমন দেখতে তাঁকে? কোথায় থাকেন কিছু বোলে যান নি ?” এমনি অনেক প্রশ্ন করে চলে আনিকেত।
“আপনার মতই লম্বা, আর মুখে দাড়ি আছে। নাম বললেন না। কেবল বললেন একদিন আপানার সাথে দেখা কববেন”, দিনুদার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
********
Add comment