মা ও মেয়ে, সব সংলাপ কাল্পনিক
@ বন্দনা মিত্র, ১৯৮৬ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
মা – কি রে? এটা কি মেসেজ পাঠিয়েছিস, সক্কাল সক্কাল? “ লাইফ আপডেট, স্টিল অ্যালাইভ”। ফাজলামি হচ্ছে?
মেয়ে- কি আর করা? সেদিন ভিডিও কল করতে একটু দেরি হয়েছিল, আর তুমি কি টেনশনটাই না করতে বসে গেলে। কতবার বলেছি, চিন্তা কোরো না, চিন্তা কোরো না, মরে গেলে কেউ না কেউ ঠিক তোমায় খবর পাঠাবে, সব আমার সেট করা আছে।
মা- নেহাত ভিডিও কল, আর ওখানে যেতে ভিসা লাগে। নয়তো এখুনি গিয়ে একটা ঠাটিয়ে চড় মেরে আসতাম। কি করিস সারাদিন যে বাড়িতে একটা ফোন করার সময় হয় না?
মেয়ে- মা, তুমি বুঝবে? যদি বলি কাল সারাদিন লাইব্রেরিতে প্রোজেক্টের পাইলট স্টাডি রিপোর্ট বানিয়েছি, লাইব্রেরিতে ফোন সুইচ অফ রাখতে হয়। তারপর ক্যান্টিনে দুটো স্যান্ডুইচ তুলে সটান শো রুমে, কাল আমাদের নতুন স্টক এসেছিল, আমার আট ঘন্টা শিফট ছিল, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। কাজ থেকে ফিরেছি রাত দশটায়।
– শো রুম মানে? কোথায় আবার কাজ নিয়েছিস? বলিস নি তো!
– বললে তুমি করতে দিতে? একটা ডিজাইনার অ্যাপারেল শপ। ওটা খুব নামী ব্র্যান্ডের শোরুম, খুব বড়লোকেরাই ও সব ড্রেস কিনতে পারে। তাই কেউ তেমন আসে না, তবে দিনে দুটো তিনটে সেল হলেই মাসের টারগেট উঠে যায়। কাজ বিশেষ থাকে না।
– কী কাজ করতে হয় ওখানে?
– ঐ কম্প্যুটারে সব হিসেব টিসেব রাখা; আর দরকার পড়লে জামা কাপড় ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখা, মাঝে মাঝে আয়রনও করতে হয় – তেমন চাপের কিছু নয়।
– তা, দামী জামাকাপড় বলছিস যখন, কয়েকটাদিন একটু বাড়িতে জামা ভাঁজ করা প্র্যাকটিস করলে তো পারতিস, তোর নিজের জামা তো সব সময় হান্ডুল মান্ডুল হয়ে থাকে। আজ অবধি নিজের কোন ড্রেস একটাও আয়রন করেছিস? পুড়ে টুরে গেলে? অনেক টাকা চেয়ে বসবে তো!
– ঐ ঐ ঐ, আবার টেনশন করতে বসে গেলে। ওই জন্যেই তো তোমাকে কিছু বলা যায় না, বললেই টেনশন করবে!
– কে জানে বাবা, তোকে এত কাঠ খড় পুড়িয়ে পাঠানো হলো, ও দেশে গিয়ে অন্যের কাপড় ইস্ত্রি করে ভাঁজ করবি বলে? বাড়িতে কোনদিন এসব কাজ করতে দিলাম না, তোর পড়ার ক্ষতি হবে!
– দাও নি কেন? দেওয়া উচিত ছিল। আজকের দিনে এগুলো সব লাইফ স্কিল – রান্না, ঘরের সব কাজ, ড্রাইভিং, টায়ার চেঞ্জ, গাড়ির ছোট খাটো রিপেয়ার, ইলেকট্রিক ফিউস বা ওয়ারিং পালটানো – এসব তো স্কুলেই শেখানো উচিত। এমন কি চুল কাটা, জামা সেলাই – সব আমাকে ইউ টিউব দেখে শিখতে হয়েছে। এখানে এসব কাজ করার কেউ নেই।
– এমন করে বলছিস যেন এখানে কাজ করতে বললেই সোনামুখ করে কাজ করতিস! ওখানে নেহাত উপায় নেই তাই – যাকগে, তা অত রাতে কিভাবে ফিরলি?
– টেমশন কোরো না মা। এখানে অনেক রাত অবধি ট্রেন চলে, বাস চলে। তাছাড়া যত রাতই হোক, এখানে কেউ কাউকে পাত্তা দেয় না, নিশ্চিন্তে হাঁটা যায়।
– ফিরে কিছু খেয়েছিলি? না কি না খেয়েই ঘুমিয়েছিস?
– ঘুম? ঘুমোবে কে? ঘুমের কথা ভুলে যাও। খিচুরি রান্না করে খেয়েছি। তারপর প্রোজেক্টের বাকি সব কাজ শেষ করে গাইডকে মেল করেছি, ডেডলাইন মিস হলে উনি আবার ক্যাঁও ম্যাও করবেন। তারপর ঘুমিয়েছি রাত চারটের সময়। আজ ঘুম ভেঙেছে দেরি করে, রোববার তো।
– সকালে কিছু খেয়েছিস? না কি খালি পেটেই ফোন করছিস?
– কফি আর স্যান্ডউইচ। আজ আবার লন্ড্রি স্লট নেওয়া ছিল, তাড়াহুড়ো করে যেতে হল। এখানে একবার স্লট মিস করলে সাতদিনের আগে আর পাওয়া যায় না। আমাদের সারা ডরমিটারিতে মাত্র ছটা মেশিন। আর বিশাল লম্বা লাইন। তারপর আজ রুম ক্লিন করতে হলো, আমার জামা বই ল্যাপটপ কফির কাপের ভিড়ে খাটে শোয়ার জায়গা হচ্ছিল না, চেয়ারটা যে বসার জন্যে, ভুলেই যাচ্ছিলাম।
– তা ঠিক। সেদিন ভিডিওতে তোর ঘরের মেঝেটা দেখলাম। কলকাতার ফুটপাথও ওর চেয়ে বেশি পরিস্কার।
– কি আর করি মা! এখানে যে ঝাড়ু নেই, ডাস্টার দিয়ে ঝাড়ু লাগাতে হয়।
– কেন? ফুলঝাড়ু পাওয়া যায় না?
– যায়, তবে দাম জানো? দশ থেকে পনের ইউরো। আমার কি মাথা খারাপ যে অত দাম দিয়ে ঝাড়ু কিনব! দাঁড়াও, একটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার যদি কেউ ছেড়ে যায় তো নিয়ে আসব।
– নিয়ে আসবি মানে?
– এখানে ডরম ছেড়ে যাওয়ার সময় সবাই যে যে জিনিস লাগবে না, ফ্রি স্টোরে রেখে যায়। সেখান থেকে যার যা লাগবে কুড়িয়ে নিয়ে আসে। ফ্রি বা খুব কম দামে। তারাও বেশিরভাগ জিনিস ঐভাবেই জুগাড় করেছিলো, এখানে সকলেই তাই করে।
– বলিস কি! তুই শেষ অবধি রাস্তার কাগজকুড়ুনী হলি!
– তো? এই যে আমার রুমে দেখছ এই কফিমেকার, মিক্সার গ্রাইন্ডার, এমনকি আমার এই ধুমসো জ্যাকেটটা – সবই তো এই ভাবেই জুগাড়।
– মা গো! শেষ অবধি জ্যাকেট? অ্যা ছি ছি। ডেটল দিয়ে ভাল করে ধুয়েছিলিস? হ্যাঁরে, তোকে কিছু টাকা পাঠাবো?
– লাগলে বলবো। এখন তো অড জব করেই ম্যানেজ করছি, রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্টের কাজটাও আছে, হয়ে যাবে, টেনশন নিও না। ও হ্যাঁ, শোনো, আমি সামনের উইকে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছি, বন্ধুরা মিলে। রোজ ফোন করতে না পারলে আবার টেনশন কোরো না।
– কোথায় যাচ্ছিস? আর কে কে যাচ্ছে? ওখানে থাকবি কোথায়? হোটেল বুক করেছিস?
– ভেবেছিলাম ফ্রান্স যাব, তা পয়সায় কুলোচ্ছে না। বর্ডার পেরিয়ে কয়েকটা জায়গায় ঘুরবো, যেগুলো ট্রেনে যাওয়া যায়। ওগুলো খটমট সব নাম, শুনলেও তোমার মনে থাকবে না, তোমাকে পরে মেসেজ করে দেব। আমার যে সব বন্ধুদের গল্প করি তোমাকে, তাদের সংগেই যাচ্ছি, টেনশন কোরো না। ইউথ হোস্টেলে থাকার চেষ্টা করছি, না পেলে এমন ভাবে প্ল্যান করব যেন রাতগুলো ট্রেনেই কাটে, ট্রেনে সেন্ট্রাল হিটিং আছে, ঘুমিয়ে নেব। আর সারা দিন ঘুরে বেড়াবো। হোটেলে থাকার টাকা নেই।
– কি কান্ড! এ ভাবে কেউ ঘোরে? অবশ্য, হ্যাঁ, এটাই তো ঘোরার বয়স। ওখানে তো ভিসার ঝামেলা নেই, যে কটা দেশ পারিস ঘুরে নে। পরে আমার বয়সে এলে আর পারবি না, শরীর তখন আরাম চাইবে।
– চলো, ঠিক আছে মা, এখন আমাকে লাঞ্চ বানাতে হবে। ছাড়ছি। আচ্ছা বলোতো দই আর ব্রকোলি দিয়ে কী রান্না করা যায়?
– বাবার জন্মে এমন কম্বিনেশন শুনি নি! দই আর ব্রকোলি। কেন? আর কিছু নেই?
– না মা, কাজের এত চাপে বাজারই করা হচ্ছে না। এই দুটোই আইটেম এখন ফ্রিজে পড়ে আছে। দেখি, একসঙ্গে নেড়েচেড়ে কিছু একটা বানিয়ে নি।
– ওটা খাওয়া যাবে তো রে? রেসিপি কি হবে?
– দেখি, স্টকে কী কী মশলা আছে, সব মিলিয়ে মিশিয়ে ঘেঁটে দেব।
– চমৎকার! তাহলে তুই তো সাংঘাতিক রাঁধুনী হয়ে গেছিস রে।
– শুধু রান্না বলছো? মা, আমি এখন ঘরের সব কাজেই এক্সপার্ট। দেশে ফিরে ভালো কোন চাকরি যদি না ও পাই, ডোমেস্টিক হেল্প সেন্টারে ঠিক কাজ পেয়ে যাবো। এমনিতেই সবাই বলছে আমাদের সাবজেক্টে চাকরি পাওয়া খুব শক্ত। এখন সারা জীবন ঐ ডক্টরেট, পোস্ট ডক্টরেট এসব করেই যেতে হবে।
– বাঃ বাঃ, কি সুখের কথা! এত কান্ড করে শেষে ডোমেস্টিক হেল্প! তবে এখন কেরিয়ার অপশন হিসাবে গেরস্থালীর কাজও খুব একটা খারাপ নয়। প্রচুর ডিম্যান্ড, মাইনেও ভাল, নিজের খুশিমতন কাজ বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে। ঠিক আছে, তুই বরং আরেকটু ঘর ঝাড়ামোছা, কাপড় কাচা, রান্না বান্না – এইসব প্র্যাকটিশ কর। সময় পেলে একটু পড়াশোনাও করিস। ওয়েটেজ বাড়বে।
– দেখি, এত কাজের মধ্যে পড়ার সময় বের করাই তো সমস্যা। যাক গে, ও কিছু একটা হয়ে যাবে, তুমি টেনশন কোরো না। এখন আর কথা নয় মা, লন্ড্রি স্লটের সময় হয়ে গেলো। আবার কাল কথা হবে, বাই মা, সুইটি মা।
– হ্যাঁ, শোন নিজের খেয়াল রাখবি, সময়মত ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করবি।
– ওক্কে মাম, বাই।
বন্দনা মিত্র।
Add comment