দুটি গল্প – নকশী কাঁথা, থার্ড ডিগ্ৰি
@ অনিরুদ্ধ রায়, ১৯৮৩, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং
নকশী কাঁথা
মেয়ের আমার খুব ভালোই বিয়ে হয়েছে। জামাই ভালো রোজগেরে, মেয়েকে নিয়ে আমেরিকায় সংসার পেতেছে, মেয়েও খুব সুখী। ও এখন একটা স্কুলে কী’সব কাজ করে, আমি অতশত বুঝিনা। শুনেছি, ওখানে সবাই কিছু না কিছু করে।
বাচ্চাদের ছবি আঁকা শিখিয়ে স্বল্প রোজগারে আমার একমাত্র মেয়েকে মানুষ করতে আমাকে কোনো ঝামেলাই পোহাতে হয় নি, মেয়ে তাঁর নিজের চেষ্টাতেই ভালো ভাবে স্কুল,কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বড় হয়ে গেল। তারপর একদিন ওদেরই স্কুলের বাংলার দিদিমনি নিজে আমাদের বাড়িতে তার আদরের ভাইপোর সাথে সম্বন্ধের প্রস্তাব নিয়ে আসে, আর সেখানেই আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। জামাইয়ের বাবা বলেছিলো কিচ্ছু না দিতে কারন ওখানে কিছুই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবে না, খালি বরযাত্রীদের একটু ভালো ভাবে আপ্যায়ন করতে। সে দায়িত্বও মেয়ের মেসোমশাই পালন করেছিল। ওনার ক্যাটার়িং এর ব্যবসা, আমি খালি মূল্য ধরে দিয়েছিলাম।
মেয়ের স্কুল থেকে একবার ক্লাসের সবাইকে মুর্শীদাবাদ নিয়ে গেছিল, সেই একবারই ওর বাড়ির বাইরে যাওয়া। আমার আর কোথাও না যাওয়া, কোনো কিছু না দেখা, অনভিজ্ঞ মেয়ে একা প্লেনে চেপে সুদুর ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে গেল সংসার করতে, এটা ভাবলে আমারই কেমন রোমাঞ্চ হয়! মেয়ের ভবানীপুরের শ্বশুর বাড়িতে আমি খুব কম যাই, ওরা বড়লোক, কেমন একটা অসোয়াস্তি হয়, যদিও শ্বশুর, শাশুড়ি খুব সজ্জন, আমাদের কখনো ছোটো করেন না। ওনারা যেবার ছেলের কাছে গেল আমি ওদের হাত দিয়ে পাটালি গুড় আর গিন্নির সেলাই করা কয়েকটা নকশী কাঁথা পাঠিয়েছিলাম, মেয়ে জামাই সেগুলো পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল।
একবছর বাদে মেয়ে যখন এল, আমাদের কাছে সে এক সপ্তাহ ছিলো। নতুনভাবে মেয়েকে দেখলাম, সাক্ষাত অন্নপূর্ণা। সে সব কিছু পারে, গাড়ি চালাতেও জানে। আমি মুগ্ধ, এ আমারই মেয়ে? মেয়ে অনেক চকোলেট নিয়ে এসেছিলো। আমার বাড়িতে ফ্রিজ নেই, তাই পাশের বাসুদার বাড়ীর ফ্রীজে রেখেছিলাম নাহলে গলে যাবে। ওঃ কী সব স্বাদ! পাড়ার সবাইকে দিয়েছিলাম।
ফেরত যাওয়ার দিন মেয়ে আমায় তিরিশ হাজার টাকা দিয়ে বলল – বাবা, তুমি একটা ফ্রীজ আর একটা কালার টিভি কিনো। আমি কেন জানিনা টাকাটা নিতে পারিনি। ওকে আশ্বস্ত করেছিলাম টাকা আমার কাছে আছে। পরে ফ্রীজ আর টিভি আমি নিজের জমানো টাকা থেকেই কিনেছিলাম নাহলে মেয়ে দুঃখ পাবে, যদিও ফ্রীজ, টিভি আমাদের লাগে না।
গিন্নির সেলাইয়ের শখ, আমি বিভিন্ন ডিজাইন কাপড়ে এঁকে দি, আর উনি তাতে সেলাই করেন। মেয়ের বিয়ের পর তো অখন্ড অবসর, তাই ওই কারুকার্যই আমাদের একমাত্র শখ। মেয়ে তার মায়ের বানানো বেশ কয়েকটা আসন, কাঁথা সাথে নিয়ে গেল। পরে আবার ওর বন্ধু মারফত আমাদের অনেক কাজ ওকে পাঠিয়েছি, কী করে কে জানে ? খুশি তো হয় নিশ্চয়ই, তাহলেই হলো।
আমার গল স্টোনের জন্য আমি হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাই, ডাক্তার বলেছে সময় লাগবে কিন্তু সেরে যাবে। এদিকে মেয়ে মানল না, ওর নির্দেশে বড় এলোপ্যাথি ডাক্তার দেখালাম, সে বলে অপারেশন করতে হবে নামি দামি এক নারসিং হোমে। সে তো অনেক টাকার ধাক্কা? আত্মীয় স্বজন,বন্ধু বান্ধবরা যারাই শুনলো বলে বসলো – তুমি টাকার চিন্তা করছ কেন, তোমার মেয়ে আছে তো? মেয়েকে আমি বলতে পারিনি, কিছুই তো দিইনি ওকে। খালি হাত পেতে নেব? শেষে গিন্নির চাপে তার শেষ সম্বল হাতের বালা দুটো বেচে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। নাহলে মেয়ে খুব কষ্ট পাবে। গিন্নি আমার অবস্থা বোঝে, সাথও দেয়, তাকেও তো কিছু দিইনি কোনোদিন?
অপারেশনটা সুষ্ঠ ভাবে হলো, জামাইয়ের বাবা মা প্রায় রোজই হাসপাতালে দেখতে আসতেন, ভারী ভালো লোক এরা। বৈশাখ মাসে সুখবর এলো, মেয়ের বাচ্চা হবে। মেয়ে ধরে বসলো টিকিট পাঠাচ্ছে আমাদের ওখানে যেতে হবে। জামাইয়ের বাবা মা যখন যায় তখনও হয়তো ওরা টিকিট পাঠায় ,সব ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু ওরা তো বড়লোক, ওদের ব্যাপার আলাদা! আমরা কী করে যাই?
জামাইয়ের বাবা ভরসা দিলেন,উনিই লোক ধরে পাসপোর্ট করিয়ে দিলেন। গিন্নির খুব যাওয়ার ইচ্ছে বিশেষ করে এই সময়, কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছে না। এতোটা খরচের মধ্যে ফেলব এদের? মেয়ে যখন গত শনিবার ফোন করলো, আমি বলেই ফেললাম আমার সংকোচের কথা। মেয়ে বলল – বাবা, তোমার এই আত্মসম্মানবোধকে আমি আর তোমার জামাই শ্রদ্ধা করি, তোমরা তোমাদের টাকায় আসবে। তোমাদের তৈরি কাঁথা স্টিচের কাজ এখানে এক্সিবিশনে প্রচুর নাম হয়েছে,অনেক টাকায় বিক্রি হয়েছে। আমি সেই টাকা থেকেই টিকেট কেটে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমাদের দেখার জন্য আমাদের অনেক বন্ধু উদগ্ৰীব হয়ে আছে, আমার এই সময় তোমরা পাশে না থাকলে কী করে হবে ? তোমার নাতনি হবে জান তো? আমরা ওর নামটা ঠিক করে ফেলেছি- চারুকলা, তোমার ড্রইং স্কুলের নাম।
আরে দেখ কান্ড, আমাদের কাজের এতো কদর ? সারা জীবন এঁকে কোনো সম্মান পাই নি, ওখানে আমাদের কাজ লোকে ডলার দিয়ে কিনছে ?
আমাদের ভিসাও গতকাল হয়ে গেল, এবার যাওয়ার অপেক্ষা।।
থার্ড ডিগ্ৰি
আমার বাবাকে জ্ঞানত কোনদিন কোনো কাজ করতে দেখি নি। সারাদিন খালি গায়ে লুঙ্গি পড়ে বাড়ির সামনের চিলতে রকে বসে থাকতেন। বাবার বৈশিষ্ট ছিলো দুপুরে সর্ষের তেল মেখে চান করা আর খাওয়ার সময় পিঁড়ি পেতে খাওয়া। এই সর্ষের তেল মাখাটাই ছিল বাবার একমাত্র বিলাসিতা।
বাবা ছিলেন কালিঘাট পোস্টাপিসের রাইটার। দরজার মুখে টেবিল চেয়ার নিয়ে বসতেন। চিঠিতে লোকের ঠিকানা লিখে দেওয়া, মানি অর্ডারের ফর্ম ভর্তি করা এই সব কাজই নিষ্ঠার সঙ্গে একনাগাড়ে তিরিশ বছর করেছেন। আর তার পরে সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে উনার ডান হাতটা অবশ হয়ে যায়। লেখালেখি আর করতে পারতেন না আর কানেও শুনতেন না। সেই থেকে ঘরেই থাকতেন। আমরা ইশারায় বাবার সাথে কথা বলতাম। মার আর বাবার বয়সের তফাত ছিল বাইশ বছর। মায়ের বাবা দোজবরে কন্যা সম্প্রদান করে কেতার্থ হয়েছিলেন। আমার বাবার আগের পক্ষের এক মেয়ে আছে। তার বিয়ের পর স্ত্রী বিয়োগান্তে বাবা পুনরায় দার পরিগ্ৰহণ করেন। সেই বড়দির সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল ক্ষীণ।
আমার মাকে সবসময় বাবার সেবা করতেই দেখতাম। আমার দিদি আমার থেকে দশ বছরের বড়। দিদির পরেও মার দু’টি মেয়ে হয়ে মারা যায়, অপুষ্টিতেই হয়তো। তার পরে মার শীর্ণকায় অবয়বে চতুর্থ গর্ভে আমার জন্ম। ছেলে হওয়ার জন্যই যত্নআত্তি বেশি পেয়ে আমি টিকে গেছি। দিদি বিয়ে পাশ করেছিল, সেই জন্য বাবা মার খুব গর্ব ছিল। আমি ছোটোবেলা থেকেই দিদিকে দুটো টিউশনি করে পড়াশোনা চালাতে দেখেছি। আমাদের সংসার মা যেভাবে চালাতেন কোন ইকনমিক্সের থিওরিতে তার ব্যাখ্যা সম্ভব ছিল না। মাঝেসাঝেই বাবার নবগ্ৰামের দেশবাড়িতে মা আমাকে নিয়ে গিয়ে ভাগের শাক সবজি, কলা, আলু আর চাল নিয়ে আসতেন। সেই চাল বেচা হতো, আলু, কলাও বাজারের দোকানে গিয়ে আমি বেচে আসতাম। আমরা চিরকাল রেশনের চাল খেয়েছি। মাকে দেখতাম কৌটো করে চাল মেপে হাঁড়িতে ঢেলে আবার তার থেকে একমুঠো তুলে একটা আলাদা ডালডার কৌটোতে রেখে দিতে। সেই সঞ্চয়ের চাল দিয়ে আমাদের ঘোর দুর্দিনের ভাত রান্না হতো। আমাদের এক কামরা ঘরের ভাড়া দীর্ঘ দিন বাকি ছিল, সেই জন্য বাড়িওয়ালা জল দিতো না আর ইলেকট্রিক কানেকশনও কেটে দিয়েছিল। আমাদের উচ্ছেদ করার জন্য কেসও করেছিল, পরে বাড়িওয়ালা গোপী জেঠু মারা যাওয়ার পরে আমাদের অবস্থা বুঝে ওর ছেলে গজুদা কেস তুলে নেয়।
দিদি কলেজে স্টুডেন্টস ইউনিয়ন করার জন্য সবাই তাঁকে চিনতো। পাশ করে এক প্রফেসরের সুপারিশে ওষুধের ডিস্ট্রিবিউটারের অফিসে চাকরি পেয়ে যায়। সেই থেকে আমাদের অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। মা সেবার পাড়ার দুর্গাপুজোয় একুশ টাকা চাঁদা দিলো। দিদির জন্য সকালে আমি পাউরুটি কিনে আনতাম, গয়লার কাছ থেকে রোজ এক পোওয়া করে দুধ নিয়ে আসতাম। দিদি সকালে দুধ পাউরুটি খেয়ে অফিস যেতো। তারপর দিদি চলে গেলে বাবা আর আমি পাউরুটিতে দুধ লাগিয়ে চিনি দিয়ে খেতাম। দিদি অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলায় ভাত খেয়ে নিতো। মা খালি বিকেল বেলা্তেই রাঁধতেন, তাই সকালে আমরা পান্তা খেতাম।
আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ক্লাস টিচার রমেনবাবু ক্লাসে নোটিশ পড়ে শোনালেন, যে পরের মাস থেকে তিন টাকা করে স্কুলের ফী বাড়বে। নোটিশ শুনে আর কার কী অবস্থা হলো জানি না, কিন্তু আমার মনে হলো দিদিকে কী করে বলব? ওর তো খুব চাপ পড়ে যাবে।
বিকাল বেলা আমারা কয়েকজন নবাদাদের বাড়ির সামনের তিনকোনা জায়গাটায় ফুটবল খেলতাম। পাম্পিং স্টেশনটা এক কোনে রেখে আমাদের খেলার জন্য কলকাতা কর্পরেশন অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলো। বেণুদা ছিল আমাদের পাড়ার গর্ব, সেকেন্ড ডিভিশনে ফুটবল খেলত। সে হঠাৎই অযাচিত কোচ হয়ে আমাদের খেলা শেখাতে লাগলো। প্রথমে পিটি করাতো, লাইনে দাঁড়ানো, ফাইলে দাঁড়ানো, হাত পা ছোঁড়া, এইসব। তার পর বলে হেড্ দেওয়া, কিক্ করানো। প্র্যাকটিসের পর দুই দলে ভাগ হয়ে আমরা খেলতাম। কয়েকদিন পরে বুঝতে পারলাম যে নবাদার ভাগ্নী ঝুলনটাকে বেণুদা টার্গেট করেছে। আর তাই আমাদের সাথে এখানে এসে আখড়া গেড়েছে। একদিন ঝুলনকে বারান্দায় দেখে বেণুদা আমাদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে চেঁচিয়ে ইংরেজিতে বকতে লাগল, “বয়েজ ডোন্ট টক্। আই রিপিট,ডোন্ট টক্। ইফ ইউ কেন নট বিহেভ প্রপারলি, দেন ডোন্ট্ বিহেভ”। ঐ ইংরেজি শুনেটুনেই ঝুলন শেষে বেণুদার প্রেমে পড়ে গেলো।
আমাকে সন্ধ্যার মধ্যাই বাড়ি ফিরতে হতো, নাহলে দিদি মায়ের ওপর খুব রাগারাগি করত। ঘড়িটড়ির কোনো দরকার ছিল না, যখন সব বাড়িতে শাঁখ বাজতো সেটাই ছিল আমার বাড়ি ফেরার সময়। দিদি একদিন অফিস যাওয়ার সময় বাস থেকে পড়ে যায়। রামরীক হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ট্যাক্সি করে দিদি বাড়ি চলে আসে। আমাকে দিদি অফিসের ফোন নাম্বার দিয়ে ওষুধের দোকান থেকে ফোন করতে পাঠায়। আমাকে তো ধরে আনতে বললে বেঁধে আনি। আমার কাছে অ্যাক্সিডেন্টের ভয়াবহ বিবরণ আর দিদির প্রাণ সংশয় শুনে দিদির অফিসের সেই লোক তো বিকেল বেলা আমাদের বাড়িতে দিদিকে দেখতে আসবে জানিয়ে দিলো। বাড়িতে এসে সেকথা বলতেই তো দিদির চিন্তা শুরু হয়ে গেলো। এই ঘরে তাদের কোথায় বসতে দেবে? আমাদের ঘরে একচিলতে জায়গা ছেড়ে একটা ইঁট দিয়ে উঁচু করা চৌকি ছিল। চৌকির নীচে স্টোভ জ্বেলে মা রান্না করতেন। ঐ চিলতে যায়গায় চেয়ার পাতা যাবে না। আমি মা’র কথায় পাশের রুনুকাকুর বাড়িতে গিয়ে কাকিমাকে বলাতে উনি ওনাদের বাইরের ঘরটা আমাদের ছেড়ে দিলেন, ওখানে দিদিকে ফ্যান চালিয়ে খাটের ওপর শুইয়ে দিলাম। আমার মনে হলো এসব খাট, ফ্যান, টিউব লাইট, জানালার পর্দা দেখে দিদির অফিসের লোকরা আমাদের খুব বড়লোক ভাববে, বেশ মজা হবে!
তিনজন এসেছিল, তার মধ্যে কেশবদাও ছিল। সেই পরে আমার জামাইবাবু হলো। মা আমাকে শ্রী মালক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে রসগোল্লা আর নিমকি আনতে পাঠলেন। আমি গলির মুখে চারদিক তাকিয়ে কেউ নেই দেখে ছটা স্পঞ্জের রসগোল্লা একে একে মুখে ঢুকিয়ে পুরো রসটাই চুষে নিলাম। তারপর সেই মুখ নিঃসৃত ছিবড়ে রসগোল্লাই দিদির কলীগরা খেলো।
আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। বাবার শরীরটা কয়েক দিন ধরে খারাপ যাচ্ছে। মুখে অরুচি, মা আমাকে একদিন পাশের বাড়ির কাকিমার কাছ থেকে দই এর জোড়ন আনতে পাঠালেন। দই পেতে বাবাকে দই ভাত খাওয়াবেন। কাকিমা আমাকে একটা বড়ো হাঁসের ডিম দিয়ে বললেন যে উনার দাদার পোল্ট্রির, আমরা যেন খাই। “আমরা” বলতে হয়ত কাকিমা আমার আর দিদির কথাই বলেছিলেন। মা সেই ডিম সেদ্ধ করে, সুতো দিয়ে চার ভাগ করে ডিমের কারি রেঁধেছিলেন। আমি এক টুকরোই খেয়েছিলাম, সেটা আজো মুখে লেগে আছে। আমি তখন আমার ঐ বয়সে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে চাকরি পেয়ে আমি বাড়ির সবাইকে আস্ত ডিম খাওয়াবো।
মনে আছে, বাবার শেষ সময় আমি শিওরে বসেছিলাম। আমার চোখের সামনে বাবা চলে গেলেন। আর আমি জীবনে প্রথম মৃত্যু চাক্ষুষ করলাম। মা চাইলেন তাই বাবার শ্রাদ্ধ খুব ঘটা করে হয়েছিলো। নাহলে জ্ঞাতিরা কী বলবে? কাছা পরে আমি বাবার অনেক জ্ঞাতি ভাইবোনকে শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন করে এলাম। দিদি খুব খরচা করেছিলো। খাওয়ানো হয়েছিল লুচি, বেগুন ভাজা, ভাত, মুগের ডাল, এঁচড়ের তরকারি, আমের চাটনি, পাপড়, দই, রসগোল্লা। আড়াই’শ জন লোক রাতে খেয়েছিল। বাবার জ্ঞাতিরা কব্জি ডুবিয়ে খেলো। আমার ও দিদির বন্ধুরা, দিদির অফিসের লোকজন সবাই খেলো। কেশবদার তত্ত্বাবধানে বাবার শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। আমরা যে এত খরচা করতে পারি আমার নিজেরই সেই ধারণা ছিল না। বাবার দুর সম্পর্কের খুড়তুতো ভাই ভেলুকাকুর শোকের খাওয়া দেখে আমি তাজ্জব। পুরো ভরপেট খাওয়ার পরে আধ কিলো দই আর সাতাশটা রসগোল্লা খেয়েছিলেন।
আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেলো। পড়ার বই কী পড়ব, কিছুই তো তেমন বুঝি না? বাড়িতে বাবার অনেক বই ছিল, বঙ্কিম রচনাবলী, শরৎ রচনাবলী, কালীসিংহের মহাভারত, তাই মন দিয়ে পড়তাম। আর বঙ্কিমের আশীর্বাদে আমি সেকেন্ড ডিভিশনে পাশও করে গেলাম। আর আমি যেবার হায়ার সেকেন্ডারি দিলাম দিদি আর কেশবদার সে বছর বিয়ে হয়ে হলো। সেবারও বেশ ঘটা হলো, আমার বন্ধুরাই সব পরিবেশন করলো।
দিদির বিয়ের পর মা আর দিদির কাছ থেকে টাকা নিতে চাইতেন না। এতকাল কষ্ট করে থেকেছেন, অসীম সহ্যক্ষমতা। আমাদের দুটো পেট ঠিক চলে যাবে। দিদিও এরপর শ্বশুরবাড়ি বেলুড় থেকে অফিস করে আর আমাদের কাছে আসতে পারত না। পরে বুঝেছিলাম আমার আর মার হীনদশায় শ্বশুর বাড়িতে দিদির খুব লজ্জা করত। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে আমি চাকরি খুঁজতে লাগলাম। বেণুদা খোঁজ দিলো টালিগঞ্জের একটা পেট্রলপাম্পে হিসেবপত্র বোঝা আর সবকিছু দেখার জন্য একটা ছেলে নেবে। বেণুদার সুপারিশে সেখানেই আমার চাকরি হলো। দেড় হাজার টাকা মাইনে, নব্বই সালে ঐ টাকা আমার মতো ছেলের কাছে অনেক। আমি গজুদাকে বাড়ি ভাড়া চারশ টাকা করে দিলাম, কলের জল এবার চলে এলো। আমার চাকরির তিন মাসের মধ্যেই ঘরে ইলেক্ট্রিসিটি এলো। টিউব লাইট জ্বালিয়ে, ফ্যান চালিয়ে চৌকির ওপর বসে আমি আর মা খেলাম। মাকে বললাম একটা টিভি কিনব, দেওয়ালে তাক করে রাখব। মাকে বললাম আর কাকিমার বাড়ি গিয়ে এখন থেকে রামায়ন দেখতে হবে না।
পেট্রল পাম্পে আমার কোনো ছুটি নেই। সকাল নটা থেকে রাত আটটা অবধি কাজ। কামাই করলেই মাইনে কাটা। আমি দেড় বছর একটাও কামাই করিনি। ইচ্ছা আছে মাকে পুরী নিয়ে গিয়ে জগন্নাথ দর্শন করাবো। হাতে কিছু টাকাও জমেছে। মালিককে বলতেই পরের মাসে চার দিনের ছুটি মঞ্জুর হয়ে গেলো। কিন্তু সন্ধ্যা সাতটার সময় গজুদা পেট্রলপাম্পে ফোন করে আমাকে বলল – শিগ্গিরি বাড়ি আয়, কাকিমা আগুনে পুড়ে গেছে।
– আগুন? আগুন কি ভাবে লাগলো???
– আজকে তোর বাবার মৃত্যুদিন। ফটোর সামনে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলো। ওখান থেকেই শাড়িতে আগুন লেগে গেছে। পড়িমরি করে বাড়ি এলাম। ট্যাক্সি ডেকে কোনোমতে মা’কে কাপড়ে মুড়িয়ে শম্ভুনাথে নিয়ে গেলাম, গজুদাও সাথে গেল। এমারজেন্সী থেকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার সময় মা বলল – চাল ডালডার কৌটোতে আছে, কেরোসিন তেলের টিনটা পচার দোকানে দেওয়া আছে, সাবধানে থাকিস।
গজুদা বললো, বাড়িতে ছেলেরা এত জোরে টিভি চালিয়ে শারজার ওয়ান ডে ম্যাচ দেখছে যে কাকিমার চিৎকার শুনতেই পাই নি। পোড়া গন্ধ পেয়ে বারান্দায় এসে দেখি তোদের দরজার পর্দা পুড়ছে আর কাকিমা বাথরুমের সামনে মাটিতে পড়ে আছে।
দিদি, কেশবদা হাসপাতালে এলো। মার সাথে ওদের কথা হয় নি। সারা রাত আমি হাসপাতালে। রাতে বড়ো ডাক্তার দেখে গেলেন। বললেন থার্ড ডিগ্ৰি বার্ণ, বাঁচার আশা কম। সকালে মা চলে গেলেন। শ্মশানের কাজ হয়ে গেলে দিদি জিজ্ঞেস করলো আমার কি ইচ্ছে, কিভাবে মার শ্রাদ্ধ করবো?
– হ্যাঁ, মার শ্রাদ্ধ তো করতেই হবে। খুব ঘটা করেই করবো, ভেলু কাকুকেও নেমন্তন্ন করবো। তোমাকেও তো কোনোদিন খাওয়াইনি দিদি। এই আমার শেষ কাজ। কেশবদা’কে বলো খুব ঘটা করে ব্যবস্থা করতে। তোমার শ্বশুর বাড়ির সবাই যেন আসে, টাকার কোনো অসুবিধা হবে না।
আর, আমার তো চারদিন ছুটি নেওয়াই আছে।।
Add comment