আমার পত্রমিতা
@ বিমলেন্দু সোম, ১৯৬৭ আর্কিটেকচার ও প্ল্যানিং
সালটা ছিল ১৯৬৬ জানুয়ারীর তেইশ অথবা চব্বিশ। আমি তখন ফিফথ ইয়ারে, থাকি ম্যাকডোনাল্ড হলে। প্রসঙ্গে বলে রাখি, যেহেতু আর্কিটেকচার, তাই আমাদের ফিফথ ইয়ার মানে ছ’বছরের কোর্সের প্রি-ফাইন্যাল ইয়ার। আমাদের উইং এর সামনেই লর্ডসের মাঠে ঢাউস প্যান্ডেল, রিইউনিয়ন চলছে। রাতে উত্তেজনায় ঠিকমতন ঘুমাতে পারিনি। ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিলো, কিন্তু সকালবেলাতেই আমার কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলো এক অজানা অনুভূতি ও উত্তেজনার ঠ্যালায়। আজ আমার জীবনে প্রথমবারের জন্য ঘটতে চলেছে এক নতুন অভিজ্ঞতা – সাত মাসের পত্রমিতাকে এই প্রথম দেখতে পাবো, দুপুর দু’টো নাগাদ ডে-আউট প্রোগ্রাম হয়েছে। চিনতে যাতে অসুবিধা না হয়, সেজন্য পরস্পরের পত্রালাপ মাধ্যমেই আমাদের ড্রেস কোড আর প্রতীক্ষাস্থল দু’টোই ঠিক হয়ে গেছে। সাদা হাফশার্ট পরণে, হাওড়া স্টেশন চত্বরের ‘কফি-কর্ণার’এর সামনের কলামের আশেপাশে দু’চোখে অপার “খুঁজে বেড়াই” কৌতুহল নিয়ে প্রতীক্ষারত যে যুবকটি থাকবে সে যে আমি, সে আমার পত্রমিতাকে সর্বশেষ চিঠিতে জানিয়ে দিই।
কয়েকটি মাস পিছিয়ে গিয়ে মনে পড়ছে এক বর্ষণ মুখর শনিবারের বিকেলের কথা। হোস্টেল প্রায় ফাঁকা, অধিকাংশই বাড়ি চলে গেছে। কিছু স্মার্ট হোস্টেল-মেটরা বেরিয়েছে বান্ধবীদের সাথে রুটিন মাফিক উইকএন্ড অভিসারে। কিভাবে আমার বন্ধুরা মেয়েদের নজরে আসে, কিভাবে তাঁরা আলাপ শুরু করে, তার প্রচুর প্রশ্ন করেও বুঝে উঠতে পারিনা যে ওরা যা অনায়াসেই করতে পারে আমি কেন তা পারি না?
আমার রুমেই আড্ডা চলছে। আছে সুবীর, আর উদয়দা। প্রসঙ্গের অভাব ছিল না, একসময় আলোচনায় উঠে এলো সপ্তাহ শেষের দুটো দিন আমাদের তিনজনের নিঃসঙ্গতার দুঃখের কথা। সুবীর মাথা খাঠিয়ে একটা প্রস্তাব রাখলো – ‘এত চেষ্টা করেও যদি প্রেমিকা এখনো জুটলো না, তাই বলে কি একটা পেনফ্রেন্ডশিপ আমরা চেষ্টা করতে পারি না? আমাদের এই বোরডমের হাহাকার হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারি’। কথাটা আমাদের মনে ধরলো। তখন ধর্মতলা স্ট্রিট থেকে সাপ্তাহিক ‘স্ক্রীন’ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো (পাক্ষিকও হতে পারে, আজ ৫৮ বছর পরে সঠিক মনে করতে পারছি না)। ভাবলাম বিজ্ঞাপন দিয়ে ভাগ্যে কি আছে একবার পরীক্ষা করা যেতেই পারে। আমাদের সম্মিলিত প্রস্তাবে সুবীর অবশ্য শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেল।
স্ক্রীন ম্যাগাজিনে বিজ্জাপন দিয়েই দিলাম। “শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফাইন্যাল ইয়ার আর্কিটেকচারের ছাত্র ইত্যাদি ইত্যাদি।“ যতটা সম্ভব এবং বিশ্বাসযোগ্য করে সত্যমিথ্যা মিশিয়ে (এবং অনেক বাঞ্ছনীয় নয়, এমন সত্য গোপন করে) নিজেকে আকর্ষণীয় করা যায়, সেটাই করেছিলাম। আর সেই সূত্রেই আমার জীবনে এক অপরিচিতা পত্রমিতা মালিনীর আগমন হলো। চিঠির উত্তর পেলাম। আমার অদেখা, আমার অনেক কৌতুহলের নায়িকা মালিনী শ্রীরামপুরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, মা-বাবার একমাত্র সন্তান। দক্ষিণ কোলকাতার নামিদামি মহিলা কলেজের ফাইনাল ইয়ার ইংলিশ অনার্সের ছাত্রী। কলেজ হোস্টেলে থাকে, সপ্তাহান্তে মা-বাবার কাছে বাড়ি আসে। মান্না দে’র গানের এই কূলে আমি বিই কলেজের আর্কিটেকচার আর ঐ কূলে তুমি ইংলিশ অনার্স। কল্পনায় দেখলাম আমাদের খুব ভালো জুটি হবে। কয়েকদিন ধরে ভেবেই গেলাম আমার মানসবান্ধবী কেমন দেখতে, লম্বা না মোটা, চুলের খোঁপা কেমন, কতটা স্টাইলিশ নাকি সাধারণ সাজপোষাকেই থাকে, এরকম হাজারো চিন্তায় কয়েকদিন কেটে গেলো। শুধু একটাই দুশ্চিন্তা ছিলো, ইংলিশ অনার্সের মেয়ে, আমার সাথে ফটফট শুধু ইংরেজিতেই কথা বলবে না তো?
সেদিন লাঞ্চের পর আমার ডে-আউট প্রোগ্রামের প্রস্তুতি পর্ব চলছে। হস্টেলের অনেকেই খবরটা জানে। শুভাকাঙ্খী উদয়দা এসেছে, আন্তরিক শুভেচ্ছা জানানোর আগে আমাকে জিজ্ঞেস করতে ভোলে নি – ‘তোর কাছে টাকা আছে তো? না কি নিবি আমার কাছ থেকে’? …. ‘লাগবে না উদয়দা’ – হেসে ধন্যবাদ জানাই আমি। … ‘বেশি দেরি করিস না, সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবি। রিইউনিয়ন প্রোগ্রাম একসাথেই দেখবো।…. আজ তোকে দারুণ স্মার্ট দেখাচ্ছে রে! … বেস্ট অফ লাক’। উদয়দা সহাস্য বিদায় জানায় আমাকে।
বেলা দু’টোর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশন লবিস্থ ‘কফি কর্ণার’ এর সামনে। সেটা ছিল ছুটির সময়, ভর দুপুরে হাওড়া স্টেশন চত্বর একদম ফাঁকা। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করেও মালিনীর না আসাটা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হ’লো। আমি কাছাকাছি হুইলার্স বুকস্টলে গিয়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে নানান রকম বই আর ম্যাগাজিন উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করে দিলাম। কিন্তু নজর প্রতিমুহূর্তে লোকাল ট্রেনের একজিট গেটের দিকে। বছর উনিশ কুড়ির নির্দিষ্ট ড্রেস কোডের কোন যাত্রিণীকে তো বেরিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না।
ভাবছি মজার ছলে আমাকে বোকা বানিয়ে দিলো না তো? অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষান্তে বেলা আড়াইটা নাগাদ আশার আলো দেখতে পেলাম। শাড়ির রং এবং ‘কফি কর্ণার’ মুখি গন্তব্য, ইতস্ততঃ কাউকে খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলো যে আমার আখাঙ্কীতা মালিনীর আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ পেছন ফিরে সে যেন কাউকে একটা ইশারা করলো। বুকস্টলের আড়ালে লুকিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম একজন মধ্যবয়সী মহিলা, ছাঁচে ঢালা মুখে মালিনীর প্রতিরূপ। আমার কোন সন্দেহই রইল না যে ঐ ভদ্রমহিলা অবশ্যই মালিনীর মা। তাহলে কি ও মা’কে সঙ্গে নিয়ে ডে-আউটে বেরিয়েছে? আবার মনে হলো যে মালিনীই হয়তো তার মাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে হবু জামাইকে দেখাতে। যেন স্কুলের পাঠ্য বইয়ে এস ওয়াজেদ আলীর ‘ভারতবর্ষ’ রচনার বিখ্যাত লাইনটি: ‘সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলছে’! আরও মনে পড়ে গেলো যে কলেজে ঢোকার পর কিছুদিনের মধ্যেই জানতে পেরেছিলাম বিয়ের বাজারে বিই কলেজের ছাত্রদের দারুণ ডিমান্ড। আমি নিজের সম্বন্ধেও সেরকমই ধারণাই পোষণ করতাম। শীতের বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে আসা গুরুজনেরা সপরিবারে কলেজের ফাইনাল ইয়ার দাদাদের সঙ্গে হোস্টেলে দেখা করতে আসতেন, প্রায়শই জ্যেঠতুতো, খুড়তুতো, পিসতুতো, মাসতুতো, এমন কী পাড়াতুতো সম্পর্কের দোহাই দিয়ে।
মনের সকল জড়তা ফেলে নিজেকে স্মার্ট বানিয়ে সহাস্যে এগিয়ে গেলাম মালিনীর কাছে ধরা দিতে। সামনে থেকে খুঁটিয়ে দেখি, – স্লিম, শ্যামবর্ণা, স্বাভাবিক উচ্চতা, দেখাচ্ছে যেন ‘গার্ল নেক্সট ডোর’। ঠাট্টা করেই প্রশ্ন করলাম: আমার চিঠির কাল্পনিক মানুষটির সাথে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির মিল আছে তো?… স্মার্ট জবাব: ‘একই রকম ইম্প্রেসিভ’!
প্রাথমিক উপচারিতা শেষে জানতে চাইলাম: ‘তাহলে আজকের কি প্রোগ্রাম’? এবারেও তার তৈরি জবাব: ‘জ্যোতি সিনেমা হলে ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’ চলছে, তোমার সঙ্গে দেখবো বলে হোস্টেল বন্ধুদের সাথে যাই নি’। এত সিনেমা থাকতে লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া? ভাবলাম, হবেই তো, ইংলিশ অনার্সের মেয়ে। … ‘বেশ তবে তাই হোক’ বলে এগিয়ে যাই আমি। সঙ্গে সঙ্গে জবাব ‘না, দুজনের একসাথে যাওয়াটাই সঙ্গত হবে’। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি মালিনী মায়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করছে ফিরে যাওয়ার জন্য। আমি দেখেও না দেখার ভান করে দুজনে এগিয়ে চললাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে। প্রথম দিনের দেখা, আমি হবু শিবপুরের আর্কিটেক্ট, সুতরাং বাসে করে যাবো নাকি? হোক কিছু পয়সা খরচ, ট্যাক্সিতেই যাবো।
দেরি হয়ে গেছে, ধর্মতলার জ্যোতি সিনেমায় হাউসফুল বোর্ড ঝুলছে। অতএব চলো মন বৃন্দাবন, থুড়ি ময়দান। খোলা আকাশের নীচে। শীতের পড়ন্ত বিকেলে জ্যোতি সিনেমা হল থেকে দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে ময়দানের সবুজে এসে থামলাম। কিভাবে যেন সময়টা কেটে গেলো। হাসি, গল্প, আর আবেগ মিশ্রিত অনুভূতিতে সময়টা থেমে নেই, তাই বিদায় নেওয়ার লগ্নও এসে গেল। মালিনীকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে, বেশ খানিকটা দূরে শ্রীরামপুরে। অতএব ময়দান ছেড়ে হাওড়াগামী বাসে দু’জনে উঠে বসি। এরপর প্রথম দিকে একটু আপত্তি করলেও মালিনী শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে আমাদের এই ডে-আউট প্রোগ্রামের মধুরেণ সমাপ্তি ঘটুক হাওড়া স্টেশনের কফিকর্ণারে কফি স্ন্যাক্সের সহযোগে। মালিনী পৌনে সাতটার লোকাল ধরতে চায়, তাই উঠতেই হলো।
ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে। ভেতরে যেতে হলে আমাকে প্ল্যাটফর্ম টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। সেটুকু সময় আমার কাছে নেই, তাই এন্ট্রি গেটের সামনেই মালিনী আমাকে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিয়ে ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেলো। শেষ কোচটাতে ওঠার আগে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে আমাকে ফিরে যাওয়ার ইশারা করলো। আমি তবু গেটের পাশে দাঁড়িয়ে। লোকাল ট্রেন চলতে শুরু করেছে। মালিনী দরজায় দাঁড়িয়ে, তখনও আমাকে হাত নেড়ে চলেছে। ট্রেনের অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত আমি ও তাই। শেষ হলো একটি ব্যতিক্রমী দিনের ডে আউট প্রোগ্রাম।
‘আমার পত্রমিতা’ যখন প্রথমবার লিখি, তখন আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমার এই অতি সাধারণ স্মৃতিচারণ আমার বন্ধুরা এতোটাই ভালোবাসবেন যে আমাকে – ‘তারপর কী হলো?’ প্রশ্নের জবাবও দিতে হবে। তাই শেষাংশ লিখতে বসলাম।
আমার পত্রমিতা: স্মৃতিচারণ শেষাংশ:
লোকাল ট্রেন মালিনীকে নিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলে আমিও বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে আমাদের পরিচিত পঞ্চান্ন নম্বর রুটের একটি বাসে গিয়ে উঠে বসি। বিগত ঘন্টাখানেক সময়টা যেন খুব তাড়াতাড়িই কেটে গেলো। সন্ধ্যার আঁধার আরেকটু পরে নামলে হতো না? আরও কিছুটা সময় আমরা তাহলে একসাথে থাকতে পারতাম। দিনের শেষে মনটা খুশি খুশি লাগলেও কোথাও যেন একটু শূন্যতাবোধও শুরু হয়ে গিয়েছিলো।
হোস্টেলে ফিরে দেখি উদয়দা-সুবীর গল্পে মত্ত। আমি সোজা ওদের কাছেই চলে এলাম। আমাকে দেখেই দু’জনের সে কি উত্তেজনা! দু’জনের অজস্র প্রশ্নবাণ, যেমন: মালিনী দেখতে কেমন, কোথায় কোথায় গেছি, দু’জনের মধ্যে কী কী কথা হলো, আবার কবে দেখা হবে? ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন। ওদের কৌতুহল মেটাবার জন্য আমি ডে-আউটের বিস্তারিত রিপোর্টিং করে দিলাম। এই সত্যভাষনে ও প্রথম দিনের মহান কীর্তিস্থাপনের রিপোর্ট দিতে আমারও যে আনন্দ হয়েছিলো, সে বলাই বাহুল্য।
এরপর তিনটি দিন কেটে গেল, রিইউনিয়ন আর কলেজের ক্লাস অ্যাটেন্ড করে। মনের গভীরে কোথাও যেন একটা গোপন অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। কেন জানি না আমার মনের মধ্যে একটা দুষ্টুবুদ্ধি এলো – মালিনীকে সপ্তাহখানেক চিঠি না লিখলে কেমন হয়! তাই করলাম। ওদিকে মঙ্গলবার পেরিয়ে গেলেও কোন চিঠি এলো না মালিনীর কাছ থেকে। ভাবলাম, এমন তো নয় যে আমার নামে হস্টেলে চিঠি এসেছে, আর আমার কোন শুভাকাঙ্ক্ষী নীলচে রঙের ইনল্যান্ড লেটারটি উঠিয়ে নিয়ে নিজের কৌতুহল মেটাতে আমার অজান্তে চিঠিটি খুলে পড়া শুরু করে দিয়েছে?
পরদিনই লাঞ্চের পর উদয়দা আমার হাতে মালিনীর কাছ থেকে আসা একটি চিঠি ধরিয়ে দিল। এক অজানা অনুভূতি নিয়ে চিঠি খুলে পড়লাম। মালিনী লিখেছে: ‘ ….. আজ রবিবার, রাত জেগে তোমায় লিখছি। সারাটা দিন এক ঘোরের মধ্যে কেটেছে! চিন্তায় সারাক্ষণ জুড়ে ছিলে একজন বিশেষ বন্ধু … শুধুমাত্র তুমি। জানো, এতদিন মুগ্ধ ছিলাম চিঠিতে তোমার মুক্তোর মতো হ্যান্ড-রাইটিং আর ভাষার মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর রোমান্টিক ছোঁয়া পেয়ে। ডে-আউটের পর তার সাথে যোগ হয়ে গেলে বন্ধু রক্ত-মাংসের তুমি এবং তোমার অকৃত্রিম সাহচর্য! ….’
মাথায় আমার তখনো দুষ্টুবুদ্ধি খেলা করছে, আমি মালিনীকে উত্তরে কোন চিঠি লিখলাম না। ভাবটা যেন: ‘দেখাই যাক না, কী হয়! …. আমি না হয় পরের চিঠিতে ক্ষমা চেয়ে নেবো’! পরের সপ্তাহে সোমবার দুপুরে মালিনীর দ্বিতীয় চিঠি পেলাম, লিখেছে: ‘তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর কেটে গেছে পুরো একটা সপ্তাহ, যেন এক স্বপ্নের ঘোরে চলেছি আমি। … কিন্তু তুমি চিঠি লিখছ না কেন? কিছুই ভালো লাগছে না আমার। অভ্যাসবশত আজও ডাকবাক্স খুলে দেখেছি, কিন্তু কই, সুন্দর সাজানো সেই বহু পরিচিত হস্তাক্ষর তো খুঁজে পেলাম না! আমার কি কোন অপরাধ হয়েছে, যা তোমার মত একজন উচ্ছ্বাসপ্রবণ মানুষকে মূক স্তব্ধ বানিয়ে দিয়েছে? … এমন যেন না হয়, এই চিঠিটা তোমাকে লেখা আমার শেষ চিঠি! আমি এখনও তোমার কাছে কিছু শোনার অপেক্ষায় রইলাম … ‘ । মালিনীর চিঠির করুণ আবেদন আমাকে ব্যাকুল করে তোলে। ক্ষমা চেয়ে আমি লিখে জানালাম: ‘…. যদি সম্ভব হয়, তাহলে আসছে শনিবার দুপুর দু’টো নাগাদ আবার কফি কর্ণারের সামনে দেখা কর। চিঠিতে সব কিছু বলতে চাই না। সাক্ষাৎ-এ বলাটাই ভালো। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো, ওই পরিচিত ‘কলাম’-এর আশেপাশে ….. ‘।
পরের শনিবার দুপুর দু’টো নাগাদ হাওড়া স্টেশন চত্বরে কফি কর্ণারের সামনে দাঁড়িয়ে আমি মালিনীর পথ চেয়ে আছি। গত কয়েকদিনে মাথা খাটিয়ে সম্মান বজায় রাখার মত জবাবদিহি তৈরি করে রেখেছি, আর তাছাড়াও জ্যোতি সিনেমা হলে ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’ ফিল্মটার অ্যাডভান্স টিকিটও কেটে এনেছি। সময় কাটানোর জন্য আমি সেই হুইলার্স বুকস্টলে ম্যাগাজিন নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। খেয়াল করিনি কখন নিঃশব্দে মালিনী আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে চমকে দিয়ে জিজ্ঞেস করল: ‘আর কারো কি আসার কথা আছে’? ফিরে তাকাই আমি: ‘তুমি কখন এলে’? … হাসছে মালিনী: ‘এক্ষুণি’।
আবার সেই ট্যাক্সি। সেই ‘জ্যোতি সিনেমা হল’, গত সপ্তাহের মিসড এডভেঞ্চার ডেস্টিনেশন। মালিনীকে অ্যাডভান্স টিকিট কাটার কথা বলা মাত্রই ওর চোখেমুখে একরাশ বিস্ময় ফুটে ওঠে, সঙ্গে খুব সম্ভবত অপ্রত্যাশিত আনন্দও। ওকে চিঠি না লেখার কারণ একবারও জানতে চাইছে না দেখে আমি নিজে থেকেই সমস্যাটা বুঝিয়ে বলার পর জিভ কেটে লজ্জিত হয়ে বলল: ‘এ মা, ছিঃ ছিঃ, আমি তোমাকে চিঠিতে কত বিচ্ছিরি ভাবে দোষারোপ করেছি! … আমি রিয়েলি স্যরি’। আমি স্বান্তনা দিয়ে বলি: ‘তোমার আউট-বার্স্ট খুবই স্বাভাবিক’। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দেখে মালিনী!
সিনেমা দেখে ফেরার পথে আবার সেই হাওড়া স্টেশন চত্বরে কফি কর্ণারে কফি সহ স্ন্যাকস। এবার আমি প্ল্যাটফর্ম টিকিট কেটে নিয়ে মালিনীকে ট্রেন ছাড়ার মুহূর্ত পর্যন্ত সঙ্গ দিই।
এভাবেই টানা সাতষট্টির জুলাই পর্যন্ত মাসে অন্তত একবার করে চিঠির মাধ্যমে আউটিং প্রোগ্রামের দিন ঠিক করে নিতাম। কখন যে মালিনীকে অসম্ভব ভালো লাগতে শুরু করলো টেরই পেলাম না। দেখা হলে এক অনন্য অনুভুতি দুজনেরই মন ছুঁয়ে যেতো। তার রেশ থাকতো কয়েকদিন। তারপর আবার দেখা, আবার দেখা, আবার দেখা এরকম চলতেই থাকলো। হস্টেলের বন্ধুদের কাছে আমাকে নিয়মিত রিপোর্ট দিতে হতো।
৬৭’র জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বি ই কলেজের পড়া শেষে হস্টেলের পাততাড়ি গুটিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। আর রেজাল্ট বেরোবার আগেই আমি চাকরি পেয়ে অগাষ্ট মাসে আসানসোল চলে গেলাম। আসানসোলে আমার নতুন অফিস পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইরেক্টরেট। কলকাতা ছাড়ার আগে এক আউটিং-এ মালিনীকে গুড নিউজ এবং সারপ্রাইজ নিউজটা দিলে সে খুশি হয়ে আমাকে অনেক অভিনন্দন জানালো। এরপর আমাদের পত্র-মিতালির যোগাযোগ অব্যাহত থাকে প্রায় দু’বছর। চিঠিগুলো আসতো আমার আসানসোল অফিসে। ততদিনে আমার আবেগ শুধুমাত্র পত্রমিতালিতেই আবদ্ধ ছিলো না, মনের দিক দিয়েও অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিলাম।
উনসত্তরের জুন মাসে এক দুর্ঘটনায় পত্র-মিতালিতে মাস ছয়েকের বিরতি মেনে নেওয়া ছাড়া আর অন্য কোন উপায় ছিল না আমার। অফিসের ইন্ট্রা-ডিপার্টমেন্ট ফুটবল খেলার সময় প্রতিপক্ষের এক প্লেয়ারের সাথে মুখোমুখি ভয়ঙ্কর সংঘর্ষে আমার ডান পায়ের হাঁটুর মালাইচাকি ভেঙ্গে পুরো ছ’টি মাস আমি ছিলাম শয্যাশায়ী। প্রথমে আসানসোল হাসপাতাল এবং তারপর দমদম নাগেরবাজারের বাড়িতে। ইচ্ছে থাকলেও এই দুর্ঘটনার কথা মালিনীকে জানানোর কোন উপায় ছিল না আমার কাছে। মোটামুটি সুস্থ হয়ে অফিস জয়েন করার পর সহকর্মী বন্ধু আমার হাতে ধরিয়ে দিল মালিনীর কাছ থেকে আসা বেশ কয়েকটি চিঠি। আমি তখনই আমার দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে আমার চিঠি লেখার অক্ষমতার কথা সবিস্তারে জানালাম পত্রমিতাকে। এর জবাবে দুঃখ প্রকাশ করে এবং তাড়াতাড়ি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার শুভকামনা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলো মালিনী।
এরপর আমাদের পত্র-যোগাযোগ সিস্টেম আবার চালু হয়ে যায়। পত্র-মিতালির স্থায়িত্ব ছিল উনিশশো বাহাত্তরের জানুয়ারী পর্যন্ত। স্টেট গভার্ণমেন্ট চাকরি ছেড়ে আমি তখন নাগপুর, সেন্ট্রাল গভার্ণমেন্ট চাকরিতে জয়েন করেছি।
আমরা দু’জন বিভিন্ন আউটিং-এ আলোচনার সময় কিংবা পত্রালাপের মাধ্যমে একে অন্যের পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে পুরোপুরি অবগত ছিলাম। আমি যেমন জানতাম, মালিনী একমাত্র সন্তান হওয়ার ফলে ওর মা-বাবার প্রচেষ্টা থাকবে দেরি না করে মেয়েকে পাত্রস্থ করার। তেমনি মালিনীও জানত, ওপার বাংলার ভিটেমাটি ছেড়ে আসা পরিবারের দশ ভাই-বোনের মধ্যে আমার পজিশন মাঝামাঝি। আমার কাঁধে বেশ কিছুটা সাংসারিক দায়িত্বভার চেপে আছে। আমার পক্ষে তাড়াতাড়ি বিয়ে করার প্রশ্নই ওঠে না। আমি সবসময় মালিনীকে বলে এসেছি: ‘তোমার মা-বাবা যদি অন্য কোথাও তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করেন তাহ’লে তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে দ্বিধাবোধ কোরো না’।
অবশেষে, বাহাত্তরের জানুয়ারী মাসে মালিনীর কাছ থেকে আসা শেষ চিঠিখানি পেলাম।
মালিনী লিখেছে: ‘….যে ভয় পাচ্ছিলাম,তাই হলো। মা-বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন একজন ডাক্তারের সাথে। তুমি তো আমার বিয়ের ব্যাপারে গ্রীন সিগন্যাল দিয়ে রেখেছো, কিন্তু তোমার কথা ভেবে মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে ….’। আমি আমার শেষ চিঠিতে মালিনীকে লিখলাম : ‘…. অগ্রীম অভিনন্দন রইলো সুখবরটার জন্য। বিদ্রোহী মন শান্ত করতে হবে তোমাকে। তোমার নতুন জীবনের জন্য আমার আন্তরিক শুভকামনা রইলো। আমার কথা ভেবে মন খারাপ করো না। আমার জন্য কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ, অপেক্ষা করছে….’।
Add comment