রসিক কর্মকারের কুলগাছ
@দীপঙ্কর রায়, ১৯৮০ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
কোটামামা ঝাক্কা
কুল ফ্যাল পাক্কা
বিল্টু মন্টু সাণ্টু ঝণ্টু ঝিলিক ঝিমলিদের কিচির মিচির হৈ চৈ ঝাঁকড়া কুলগাছ ঘিরে। গ্রাম ছাড়িয়ে পথটা যেখানে মাঠ ছাড়িয়ে বাঁক নিয়েছে পাকা রাস্তার দিকে সেখানেই দুটো টোপাকুলের গাছ ডালপালা ছড়িয়ে ঝুপসি হয়ে দাঁড়িয়ে। আর যখন শিরশিরে হাওয়ার কুয়াশা মিশিয়ে শীতের সকাল জেগে ওঠে, তখন ঝাঁকে ঝাঁকে বুলবুলি পাখী সে কুলগাছের ডালে এসে বসে পাকা কুলের লোভে লোভে। বিল্টু মণ্টুদের দলও আসে কিন্তু পাকা পাকা কুল পাড়তে অনেক কাঁটার বাধা। হাত পা ছেড়ে যায়। তাই বুলবুলি পাখীর দল গাছের ডালে বসলেই ওরা হাততালি দিয়ে বলে ওঠে, কোটামামা ঝাক্কা,কুল ফেল পাক্কা। কোটামামা কেন বলে কে জানে? তবে বুলবুলির দল ঠিকই বোঝে। এদিক ওদিক চায়, গাছের ডালে লেজ ঝুলিয়ে পাকা কুল ঠুকরায় আর ঠোঁটে ডাল ধরে ঝাক্কা। কুল পড়ে পাক্কা।
কচিকাঁচারা পাক্কা কুল কুড়োচ্ছে হৈ হৈ করে, এদিকে রসিককাকু চলেছে গুণগুণিয়ে গান ধরে। মাঝবয়েসী মানুষ, একটু ক্ষয়াটে চেহারা, কিন্তু মুখে সবসময় লেগে আছে হাসি আর গান। কুল গাছটার পেছন যে পুকুরপাড়, তার পাশেই রসিক কর্মকারের কামারশালা আর ঘর। সেখানে হাপর চালায় ছেলে হারু, আর রসিক কর্মকার নানা মাপের লোহার রড হাপরের আগুনে লাল টকটকে গরম করে, হাতুড়ি পিটিয়ে বানায় কত কী? লাঙলের ফাল, কাস্তে, কোদাল, খুন্তি, ছুরিকাঁচি আরও কত কী। সেইসব জিনিস নিয়ে রসিক কর্মকার বিক্রি করে নানান হাটে আর গাঁ গেরস্তের বাড়ি বাড়ি। খুব ভালো গানও গায়। একটু মন খারাপের বিকেলে হাতুড়ির ঠকঠক তালে পড়ে, আর রসিকের গান ভেসে আসে। তো রসিককাকু কুলগাছের পাশ দিয়ে চলতে চলতে হাঁক দিলো, এই বিচ্ছুর দল, অত কুল খাইস না। প্যাট কামড়াইব রে! শুনে বিল্টু মন্টুরা হৈ হৈ করে উঠল, একা খায় কে রসিক কাকু? তোমার লগে খামু যে?
কাকুর কামারশালায় হরেক মজা। হারুদাদা কত খেলা জানে, আর রসিককাকু ছাঁট লোহার কত ছোট ছোট খেলনা বানিয়ে রাখে যে!
ছোট ছোট পুতুল, পাখী, গাড়ি। বাচ্চারা কামারশালার পাশে হৈচৈ করে খেলে আর রসিক কাকু হাতুড়ি পিটিয়ে গান গায়,
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম …
কুচোরা ভাবে, আগে কেন, এখনই তো কী সুন্দর দিন!
এক শীতের দুপুরে যখন গরম রোদের নরম চাদর গ্রাম মুড়েছে, কুল গাছটার ছায়া ছোট, আর বুলবুলির দল একটা দুটো কর আসছে গাছে, তখন সেই তখনই রসিক কর্মকারের কামারশালায় আগুন লাগল। কামারশালার ছাত থেকে বেরুতে লাগল গলগলে কালো ধোঁয়া। তার ফাঁকে আগুনের গোলাপী লকলকে জিভ চেটে নিচ্ছে খোড়ো ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর, হাপর, হাটে যাবার ঠেলাগাড়ি সব সব। গ্রামের মানুষ সবাই মিলে ছুটেছে কামারশালায়। পাশের পুকুর থেকে বালতি বালতি জল নিয়ে ঢালছে আগুনে। ধোঁয়ায় কিছুই দেখা যায়না। রসিক কর্মকার আর হারু কোনরকমে বেরিয়েছে ঘর থেকে। তাদের বসিয়ে রাখা হয়েছে একপাশে। হুহু করে কাঁদছে। তবে আগুনও নেভে এক সময়। যা খাবার তা খেয়ে নিয়ে আগুন শেষকালে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন ভোরে কুয়াশার চাদর সরে গেলে, রফিক চাচা, অনাদি খুড়ো, লালন ভাই আরও ক’জন গাঁয়ের লোকজন গেল কামারশালায়। সমস্ত জায়গাটা পুড়ে কালো ছাই। আগুন খেয়ে নিয়েছে সবকিছুই। লালন ভাই পোড়া কামারশালার চারদিক ঘুরে এল। হারু নেহাইয়ের পাশে রাখা লোহার শিকের ডাঁইয়ে জল ঢালছে ঠাণ্ডা করতে, যদি কিছু উদ্ধার হয়। আরেক দিকে বিক্রির জন্য রাখা ছুরি, খুন্তি, হাতে আগুনে পুড়ে কালো হয়ে তালগোল পাকিয়ে আছে। কামারশালার ছাত পুড়ে ছাই। চারদিকে আধপোড়া বাঁশের খুঁটি আর টালি ছত্রাকার। পাতলা ধোঁয়া ঝুলে আছে চারদিকে। বসত বাড়ির ছাত ধ্বসে গেছে, দেওয়ালে আগুনের লালসার চিহ্ন। কিন্তু রসিক কই? তাকে তো কোথাও দেখা যায়না? রফিক চাচা, অনাদি খুড়ো, লালন ভাই চারদিক খোঁজে, ডাকে, রসিক দাদা ওওও রসিক দাদা, কোতায় গ্যালে গো?
রসিক কর্মকারকে পাওয়া গেল পুকুর পাড়ে কুলগাছের পাশে। গাছ নয়, গাছের গুঁড়ি। ডালপালা পাতাটাতা খেয়ে, আগুন এক স্তুপ ছাই ছড়িয়ে রেখেছে। শুধু আগুনে আধপোড়া গুঁড়িটা শুধু দাঁড়িয়ে আছে পুকুর পাড়ে, আর তার পাশে বিধ্বস্ত অসহায় মুখে রসিক কর্মকার। অনাদি খুড়ো কাঁধে হাত রাখে …
– অ রসিক, এত ভেঙ্গে পোড়োনি বাপ।
রসিক চুপ। সবাই সামনে বসে।
– চিন্তা কোরোনিগো। আবার সব হয়ে যাবে গো, আমরা সবাই আছি তোমার সাথে।
রসিক মুখ তুলছেনা এক ঘোরের মাঝে। সেই সদা হাস্যময় রসিক কর্মকার বোবা হয়ে আছে।
– রসিক?
রসিক হঠাৎ মুখ তুলে কেঁদে ওঠে হুহু করে। অ খুড়ো, আমার কামারশালা তো তোমাদের চেষ্টায় গড়ে যাবে গো … কিন্তু এই বরই গাছ কিভাবে আসবে গো? সেই আমার বৌএর হাতের গাছ, হারুর সমান বয়স। তাকে তো আগুন মেরে দিল গো রফিক চাচা ওঃ হো হো …
বুলবুল পক্ষী, পোলাপানের খেলা …সব এখন পোড়া কাঠ …পোড়া কাঠ ..
রসিক কর্মকার সব হারিয়ে হুহু করে কাঁদে। তার হাসি হারিয়ে গেছে আগুনের গ্রাসে। রফিক চাচা, অনাদি খুড়োরা স্বান্তনা দেবার ভাষা পায়না …
বিল্টু মন্টু সাণ্টু ঝণ্টু ঝিলিক ঝিমলিরা অবিশ্যি সেদিনই ঠিক করে ফেলেছে। টিফিনের পয়সা একটু জমলেই, এই সামনের রথের মেলাতেই কুলগাছের চারা কিনে লাগাবে আবার। রোজ জল দেবে ইস্কুল থেকে ফিরে। যতদিন না আবার সবাই মিলে বলতে পারে ….
কোটামামা ঝাক্কা
কুল ফ্যাল পাক্কা
******
Add comment