ঝাঁটা (ছোটগল্প)
@ সুদীপ রায়, ১৯৭০ মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং
শুক্রবার সকাল আটটা। সেন’বাড়িতে সকাল থেকেই আজ সাজ সাজ রব। সপরিবারে দুদিনের জন্য বাড়ির সকলে মিলে দীঘা যাওয়া হচ্ছে। সবাই তৈরী হয়ে নিচে খাবার ঘরে এসে পড়েছে। এখন শুধু ব্রেকফাস্ট করাই যা বাকি। ব্রেকফাস্ট করেই গাড়িতে করে দীঘা রওয়ানা হবে। খালি গিন্নীমা অঞ্জলি এখনো কাজের মেয়েটিকে তাড়া দিয়ে চলেছেন।
‘এই জবা্ তাড়াতাড়ি কর। কাল পই পই করে বললাম আজ সকালে বেরুতে হবে, একটু তাড়াতাড়ি আসিস, তা সে’কথা কানে গেল না। কী হচ্ছে কী … তাড়াতাড়ি বেরুব বলে তুই কীভাবে ঘর ঝাঁট দ্দিচ্ছিস বল তো? পায়ের তলায় ধুলো কিচকিচ করছে। ভালো করে ঝাঁট দে বলছি।‘
‘ও কাকীমা, কদিন ধরে বলছি পুরনো ফুলঝাড়ুটা দিয়ে আর চলছে না। ও ঝাঁটা দিয়ে এর চেয়ে ভালো ঝাঁট আর হবে না।‘
অঞ্জলি এবারে খাবারের ঘরে বসা স্বামী অমিতকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘শুনছো … দুদিন ধরে অফিস যাওয়ার সময়ে বলছি একটা ফুলঝাড়ু এনে দিতে। তা দরকারি কথা তো তোমার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। এভাবে নোংরা ঘরে কোনো ভদ্রলোক থাকতে পারে? তোমার যত বয়েস বাড়ছে ততই ভুলোমন হচ্ছে। তোমার আর কী ? ল্যাংটার নাই কাপড়ের চিন্তা। ঘরদোর পরিষ্কার হল কী নোংরা রইলো তাতে তোমার কীই বা আসে যায়? আমারই হয়েছে মরণ দশা।’
তা সত্যিই তো! দুদিন ধরে অমিতকে অফিস যাওয়ার সময়ে অঞ্জলি একটা ফুলঝাড়ু আনতে বলছে। দুদিনই অমিত ভুলে গেছে। সত্যবচন, সুতরাং অমিত চুপ করেই অঞ্জলির কটুকথাগুলো হজম করল। বড় ছেলে শুভ্র বলল ‘মা চিন্তা কর না। সোমবার অফিস ফেরতা আমি তোমার ঝাঁটা নিয়ে আসব। তুমি তাড়াতাড়ি স্যুটকেস প্যাক করো। গাড়ি রেডি। বারটার মধ্যে রিসর্টে পৌঁছুতে হবে।‘
অঞ্জলি যেন মুখিয়ে ছিল, বলল ‘তুই আনবি ? তাহলেই হয়েছে। তুই তো বাপের ওপরেও এককাঠি। কোনো কাজ হয় তোকে দিয়ে ? দিন রাত্তির শুধু অফিস আর ফোন। এসব কাজের জন্য শোভনই ঠিক ছিল। ভীষণ রেস্পন্সেবল ছেলে। কিন্তু সে তো ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে বসে আছে। তাকে পাই কোথায় ?‘
শোভনের দাদা শুভ্র উইপ্রোতে কাজ করে। বাড়ি ফিরে এসেও রাতে আমেরিকান ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলার জন্য অন কল এ থাকতে হয়। তখন বাড়ি শুদ্ধু সবার মুখে কুলুপ এঁটে রাখাই নিয়ম। আমেরিকান একসেন্টে এখনো সড়গড় হয়নি শুভ্র। ফোন করার সময়ে তাই সবসময়ে তটস্থ থাকতে হয়। বাড়ির কাজে তাই সহজে তাকে ঘাঁটানো হয় না। মায়ের কথা শুনে শুভ্রও চুপ করে গেল। অঞ্জলি এবার শুভ্রর বৌ তনিমাকে বলল ‘শোনো বৌমা। এদের কাউকে দিয়ে কিছু হবে না। তুমিই না হয় সোমবার অফিস ত্থেকে ফেরার পথে একটা ঝাঁটা কিনে এনো।‘ তনিমা একটু ঘাবড়ালো। সোমবার ঝাঁটা কেনার কথা মনে থাকলে হয়।
শুভ্রর সাথে যখন অঞ্জলি উচ্চস্বরে কথা বলছিল তখনই ছোট ছেলে শোভনের ফোন এল অমিতের কাছে ওর লাইফ ইন্সিওরেন্স পলিসির কী একটা সমস্যার ব্যাপারে। পলিসিটা অমিতের বন্ধু শ্যামলকে দিয়ে করানো। শোভন ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করে। ফোনের মধ্যে দিয়েই মায়ের উচ্চকণ্ঠ শুনে বাবাকে জিজ্ঞেস করল মা কী নিয়ে এত চেঁচামিচি করছে। অমিত ঝাঁটার ব্যাপারটা বলল। শোভন হেসে বলল ‘মায়ের বি পি টা একবার চেক করিয়ে নাও। এসব হাই ব্লাড প্রেশারের লক্ষণ। এত ছোট ব্যাপারে এত হৈচৈ।‘ শোভন দাদার সঙ্গে দীঘা ট্রিপের ব্যাপারে দু একটা খোঁজ খবর নিয়ে লাইন কেটে দিল।‘
দীঘাতে দু দিনের ট্রিপ ভালোই কাটল। অঞ্জলি কিন্তু ওখানে গিয়েও মাঝেমাঝেই ঝাঁটার প্রসঙ্গ তুলল। তবে কেউই তেমন উচ্চবাচ্য করল না। কে আর চাইবে অপ্রিয় ব্যাপারে কথা বলে ছুটির মেজাজ নষ্ট করতে?
সোমবার বিকেলে প্রথম অফিস থেকে বাড়ি ফিরল অমিত, মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি্ হাতে ঝাঁটা। এসেই বলল ‘কইগো গিন্নী, এই নাও তোমার ঝাঁটা। আজ আর আমার ভুল হয় নি, ঝাঁটা কিনে এনেছি। কি রকম ফ্যান্সি এনেছি, বলো?‘
অঞ্জলি এসে মুখ ব্যাজার করে বলল ‘কিনেছ তা বেশ করেছ। তবে এখন ওটা আর দরকার নেই। তোমরা কবে ঝাঁটা আনবে তার জন্য বসে না থেকে বিকেলে বাজার গিয়ে আমি নিজেই একটা ঝাঁটা কিনে নিয়ে এসেছি। তোমারটা তোলা থাক, এটা খারাপ হলে তখন ওটা বার করব।‘
একটু পরে শুভ্র বাড়ি ফিরল … হাতে ঝাঁটা। এসেই হুঙ্কার ‘কোথায় গেলে মা। আমাকে দিয়ে নাকি কোনো কাজ হয় না। এই নাও তোমার ঝাঁটা।‘ অঞ্জলির মাথায় হাত। তিন তিনটে ঝাঁটা দিয়ে এবার করবে টা কী ?
আধঘণ্টা পরে তনিমা বাড়ি ফিরল সঙ্গে একটা নয়, তিন তিনটে ঝাঁটার একটা সেট নিয়ে।
‘ভালো ডিসকাউন্ট পেলাম … তাই সেট কিনে ফেললাম।‘
অঞ্জলির মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি। কেন যে মরতে সেদিন ঝাঁটা নিয়ে চেঁচামিচি করতে গেছিল।
দশ মিনিট পরে সদর দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ। দরজা খুলল অঞ্জলিই।
‘আমাজন থেকে আসছি আপনাদের আইটেম ডেলিভার করতে। ঝাড়ু আই মীন আ কমপ্লিট সেট অফ ব্রুমস্টিকস, অর্ডারড বাই মিস্টার শোভন সেন ফ্রম ব্যাঙ্গালোর।‘
ঝাঁটা গল্প টি খুব ভাল লাগল। বেশ মজার।