সাহিত্যিকা

ভুতুড়ে কান্ড

ভুতুড়ে কান্ড
@ সুকৃৎ বসু, ১৯৭৩, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

সেটা বর্ষা কাল! অমাবস্যার রাত!
আমি তখন কলেজে তৃতীয় বর্ষের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। হোষ্টেল নং ৯ এর তিন তলার একদম কোনার ঘরে থাকতাম। আমার দুই রুমমেট মলয় আর অমিয় কলকাতায় কাছাকাছি বাড়ি থাকায় দুদিন এর ছুটিতে বাড়ি চলে গেছে। আমার বাড়ি দূরে মালদায়, তাই ইচ্ছে থাকলেও যখন তখন বাড়ি যাওয়া সম্ভব হয় না।

ফলে রুমে আমি একাই ছিলাম! মনটা ভালো ছিল না। একলা থাকলে প্রায়ই ভয় করতো। কারণ, আমাদের হোষ্টেল এর পাশেই দেওয়ালের বাইরে এক বিশাল কবরস্থান। আমাদের তিনতলা থেকে ভালোই দেখা যেত! লোকেরা প্রায়ই দলবল নিয়ে নিকট আত্মীয়র মৃতদেহ নিয়ে আসতো। কান্না কাটি, তারপর কবর দিয়ে চলে যেত! তারপর শুনশান! মাঝে মাঝে রাতে কত রকমের যেন বিশ্রী আওয়াজ শুনতে পেতাম! বুঝি না, সে আমার মনের ভ্রম, না ভয়ের পরিনাম! আমি অনেক সময়ই ভয় পেতাম। কিন্তু দুই সাহসী বন্ধু মলয় আর অমিয় অভয় দিয়ে বলতো “ও কিছু না!”
আমাকে বোঝাত, শেয়ালগুলো ভয় পেয়ে ডাকছে মনে হয়! ভয় পাস না, ঘুমিয়ে পড়!
অথচ আমার ঘুম আসে না!

আজ দুই বন্ধুই রুমে নেই। আর অত বড় ঘরে আমি একা। সকাল থেকেই তাই মনটা ভয় ভয় করছিল। আমার পাশের ঘরেও কেউ নেই। শুধু তার পাশের ঘরে একজন আছে, বিমল।
এদিকে সন্ধ্যে হতেই তুমুল ঝড় শুরু হয়ে গেল! শোঁ শোঁ শব্দের সাথে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি!
তাড়াতাড়ি নীচে ডাইনিং হলে গিয়ে ডিনার সেরে এলাম। আগামী দুদিন ছুটি থাকায় ডাইনিং রুমও খালি খালি শুনশান।
ডিনার সেরে এসে ঘরে ঢুকে ই দরজা লাগিয়ে দিলাম।

প্রচন্ড ঝড় সমানে চলেছে। এরই মধ্যে লোডশেডিং শুরু হয়ে গেল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার!
ভয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।
মাঝেমাঝেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! রুম থেকে কবরস্থানটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অসংখ্য কবর ও সঙ্গে ছোট ছোট স্মৃতি সৌধ!
ঘুম আর আসে না।

হঠাৎ দরজায় একটা টোকা পড়লো! ভয়ে আঁতকে উঠলাম। দরজার দিকে তাকাতেই কাঁচ এর ওপর শুধু একটা চোখ দেখতে পেলাম! আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল! কান দুটো গরম লাল হয়ে উঠলো যেন।

আবার জোরে আওয়াজ!
আমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছিল! ভয়ে গলা থেকে স্বর বেরোচ্ছিল না- “কে? কে?” বলে উঠলাম।
– দরজা খোল! আমি বিমল।
বিমলও ভয়ে পালিয়ে এসেছে। একসঙ্গে থাকবে বলে। ধরে যেন প্রান ফিরে এলো!
দরজা খুলে দিতেই বিমল এসে পাশের খালি বিছানায় শুয়ে পড়লো।
– ভয় লাগছিল রে! চলে এলাম। আজ রাতে এখানেই শোবো, বুঝলি!
আমিও ততটাই ভয়ে আছি, মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম, ঠিক আছে।

বিমল তো কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো, আর বিকট শব্দে নাক ডাকাও শুরু হয়ে গেলো! মনে হচ্ছিল, যেন ব্রহ্মদৈত্যি এসে সংগীতের সাধনা শুরু করেছে।
এদিকে ভয় আর ব্রহ্মদৈত্যির নাক ডাকার অওয়াজে আমার আর ঘুম আসে না।

রাত মনে হয় ভোরের দিকে। পাঁচটা হবে, আন্দাজেই মনে হলো। হাল্কা ঘুম ততক্ষণে এসে গেছে। এমন সময় হঠাৎই বাজের আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে গেলো, আর বিদ্যুৎ চমকানিতে এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখে আমার হাড় হিম হয়ে গেল!
দেখি … দুটো অল্প বয়সী ছেলে ও মেয়ে এক কবরের ওপর বসে গল্প করছে…
ওরা অদ্ভুত নাকি সুরে কথা বলছে – পা তো দেখছি না ওদের? কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে ওরা? …
ভুত! ভু…. ত! আমার গলা দিয়ে গোঙানির শব্দ…
বিমলের ঘুম ভেঙে গেল –
আমাকে জোরে ঠেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো, “তোকে ভুতে ধরেছে নাকি? ”
…. তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখছিলাম?

ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে। দেখি অসংখ্য কাকের ভয়ংকর আওয়াজ…… কা কা কা …… কাকগুলো ঐ কবরের ওপর জমা হয়ে চিৎকার করছে… যেখানে অদ্ভুতুড়ে ছেলে ও মেয়ে দুটি ঐ ঝড়ের রাতে বসে গল্প করছিল। কাকগুলোও মনে হয় খেয়াল করেছে, তাই ভয় পেয়ে মিছিল করে কিছু বলতে চাইছে,
ভুত … ভুত….

দুদিন পরে দুই নাস্তিক বন্ধু মলয় ও অমিয় বাড়ি থেকে ফিরে এসে ব্যাপারটা হেসেই উড়িয়ে দিলো, “তুই স্বপ্ন দেখেছিস …. ভয় পাস্ না… ভুত নেই!”
কিন্তু আমাকে কে বোঝাবে?
ওদিকে মলয় ও অমিয়কেও একটু বিচলিত লাগছে!
ওরা আমাকে প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা, ঐ সময়ে তুই কি বললি? ওদের তো পা ছিল না? তাহলে হাঁটছিলো কিভাবে? ”
আমি কোনমতে বললাম, “তাই তো! আমি ভয় পেয়ে গেলাম – ভুত ভেবে!”
ওরা শুধু ঢোক গিললো! কিছু বললো না।

তার ঠিক একমাস পরে এক অমাবস্যার রাতে আরেক ভয়ংকর ঘটনা ঘটলো।
সেদিনও ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। ডিনার সেরে এসে আমি শুয়ে আছি। মলয় আর অমিয় জেগে আছে। খানিক পরেই লোডশেডিং শুরু হলো!
হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল! ঘুম থেকে উঠে দেখি অমিয় আর মলয় দুজনেই দরজার কাছে মাটিতে পড়ে, নিশ্চিত যে অচৈতন্য অবস্থায় ছিলাম। দরজাটাও খোলা!

আমি চিৎকার করে পাশাপাশি রুমের বন্ধুদের ডাকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই এসে গেল।
মলয় ও অমিয়কে জল ছিটিয়ে জাগানো হলো।
ওরা যা জানালো – ভয়ংকর!
সেই পা কাটা অল্পবয়সী ছেলে আর মেয়ে দুটো নাকি খুব জোরে জোরে দরজায় নেড়ে ছিল। মলয় ও অমিয় দুজনেই উঠে ওদের সেই পা কাটা চেহারা দেখে ভয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল।
আমার ঘুম ভাঙ্গেনি, খুব পরিশ্রান্ত ছিলাম বলেই হয়তো!

পরে জানা গিয়েছিল – ঐ ছেলে আর মেয়ে দুটি নাকি প্রেমিক ও প্রেমিকা ছিল। এক দুর্ঘটনায় ওদের দুজনেরই পা কাটা যায় ও পরে মারাও যায়। ওদের অতৃপ্ত আত্মা নাকি অমাবস্যার রাতে ওদের কবরস্থানে বেড়িয়ে আসে ও গল্প গজব করে। অনেকেই নাকি ওদের দেখেছে! এমনিতে কাউকে ক্ষতি করে না। কিন্তু কেউ অবিশ্বাস করলে ওরা নাকি তাদের কে বুঝিয়ে দেয় যে অতৃপ্ত আত্মাদের ভূত আছে। পারলৌকিক কাজ ঠিক মতো না হলে ভূত হয়ে অদ্ভুতেড়ে কান্ড ঘটায়।

অমিয় ও মলয় তার পর থেকে ভূতে বিশ্বাস করে।
এরপর আমরা তিন বন্ধু হোষ্টেল সুপারের অনুমতি নিয়ে অন্য হোষ্টেল এ চলে গিয়েছিলাম।

কলেজ হোস্টেলের এই ভুতুড়ে কান্ড মনে এলে আজও আমার গায়ে কাঁটা দেয়।

 

Sahityika Admin

Add comment