প্রয়াগ কুম্ভ ২০১৯ (ধারাবাহিক) (প্রথম পর্ব)
@তিলক ঘোষাল, ১৯৭২ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সম্পাদকের কলমে
তিলক’দা নিজের একটা লেখা আমাকে (অসীম দেব) পাঠিয়েছিলেন, আমার নিজের পড়ার জন্য। আমি পড়েই জানালাম যে, এটা সাহিত্যিকায় নিতে চাই। কিন্তু লেখক, মানে তিলক’দার ঘোর আপত্তি, ওনার মতে এটা ২০১৯ এর কুম্ভ, মানে পুরনো ব্যাপার স্যাপার যা আজকের হাইফাই ২০২৫ এর কুম্ভের কাছে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। তার উপর এবারের এত হাইফাই IIT বাবা, এলান মাস্ক (AI image), মুকেশ আম্বানী, সুন্দরী সন্ন্যাসিনী মোনালিসা, বলিউডের প্রাক্তন অভিনেত্রী, …… ঘরে বাইরে সব চর্চা হচ্ছে। ….. কিন্তু আমরা দাবী করলাম যে এইটাই চাই, এবং নাছোড়বান্দা। আমাদের কাছে এটাই কুম্ভের সনাতন রূপ। বলা যায় লেখককে বুলডজ করেই এই লেখা আদায় করা……
ছবিগুলি নেওয়া হয়েছে BBC আর TOI রিপোর্ট থেকে
প্রথম পর্ব
২০১৯ এর ফেব্রুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রয়াগে কুম্ভে যাবার সুযোগ হ’ল। হটাতই – কোন পরিকল্পনা ছিল না। অনেকটা ‘উঠল বাই তো কুম্ভ যাই’ গোছের ব্যাপার আর কি! তা, কাটিয়েও এলাম চার দিন, চার রাত। তৃপ্ত হ’ল বহু দিনের এক সুপ্ত বাসনা – যা আরও প্রবল হয়েছিল কলেজ জীবনে ‘কালকূটের’ ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ পড়ার পর থেকেই। আপাত দৃষ্টিতে তীর্থ দর্শন মনে হ’লেও, আমার bohemian এবং ভবঘুরে মনের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল নিজের অজ্ঞাতপরিচয়তার (anonymity অর্থে) সুযোগ নিয়ে লক্ষ কোটির ভিড়ে এক নতুন ধরনের একাকীত্ব আস্বাদনের প্রলোভন আর মানুষ দেখা এবং বোঝা কি এমন সেই ’আকর্ষণ যা’র টানে কোটি কোটি আবালবৃদ্ধবনিতা (বিশেষত গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষ) ছুটে আসে এই কুম্ভে – কড়া শীত, যাতায়াতের ঝক্কি/খরচা আর থাকা/খাওয়ার এত কষ্ট সহ্য করে! কেন জানিনা, আমি কখনোই মানতে পারি নি যে এ’টা নিছকই এক ধর্মান্ধতা বা কোন অন্ধ বিশ্বাস বসত। অনেকটাই হয়তো তাই কিন্তু এর সংগে যে মিশে আছে একটা sense of adventure এবং দুরূহ কিছু achieve করার বাসনাও, লোকজনের সংগে কথা বলে তা’ বেশ বুঝেছি। …… সেই চার দিন সব যা দেখলাম, যা শুনলাম আর অনুভব করলাম তা দিনান্তে তাঁবুতে ফিরে রোজ ছোট্ট করে লিখে রাখতাম ইংরিজিতে – রোজনামচার মত। তা’ Facebook এ ঐ গোটা ছয়েক পোস্ট পড়ে জনা কয়েক বন্ধু আর আমারই মত কিছু ভবঘুরে টাইপের লোকের হুকুম হ’ল যেন ফিরে এসেই – স্মৃতি এবং রেশ তরতাজা থাকতে থাকতেই – বাংলায় একটা travelogue মত লিখতে হ’বে – একটু বিস্তৃত ভাবে !! সত্যি বলতে কি, নিজেরও সে’ রকম একটা ‘দুরভিসন্ধি’ ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থেওঃ মাঝে মধ্যে নিজেও রি-লিভ করা সেই অসামান্য অভিজ্ঞতা!! এ’ স্মৃতিচারণ সেই Daily diary র entry গুলোর ওপর ভিত্তি করেই, আর একটু বিস্তৃত ভাবে লেখা, নিজের বার বার ফিরে ফিরে যাওয়ার জন্যে – যখনই মন চাইবে…..আর যদি অন্য কারুরও মনে ধরে, তো তাদের জন্যেও!
কোলকাতায় বসে কুম্ভ যাত্রার আর বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে মনে হ’ল ও পথ দিয়েই যখন যাচ্ছি তখন কাশীতে বাবা বিশ্বনাথকে এক বার হ্যালো বলে গেলেই হয়, অনেকদিন দেখা হয় নি! ….. তবে যেহেতু এ’ লেখাটা কুম্ভ নিয়ে, তাই ঐ দেড় দিনের বারানসী ভ্রমণ নিয়ে বেশী সময় নেব না। শুধু সন্ধ্যের পর গঙ্গায় নৌকো চেপে ঘুরে ঘুরে দেখলাম সব ঘাটগুলো……মণিকর্ণিকা ঘাটে সারি সারি জ্বলন্ত চিতা দেখে বুঝলাম কাশীতে মৃত্যু হ’ক বা না হ’ক, এই ঘাটে দাহ হ’লেই যে “মোক্ষ প্রাপ্তি” নিশ্চিত, সে বিশ্বাস এখনও অটল ………সব শেষে দশাশ্বমেধ ঘাটের সামনে নৌকা এসে দাঁড়াল। অন্ধকারে নদী তখন আর দেখা যাচ্ছে না – শুধু কলকল শব্দ আর ভক্তদের এখানে সেখানে ভাসিয়ে দেওয়া প্রদীপের টিমটিমে আলোগুলো জানিয়ে দিচ্ছে তার উপস্থিতি। তারপর আরম্ভ হল সেই গঙ্গা আরতি – অপরূপ সুরে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে। প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে চলা সে সমারোহ চোখ, কান, মনকে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে……
পরের দিন সকালে গাড়িতে কুম্ভের দিকে যাত্রা করার পথে বিশ্বনাথ দর্শন। রাস্তায় কাতারে কাতারে মানুষ কাল রাত থেকেই হাসি মুখে লাইন দিয়েছে ঐ একই দর্শনের জন্যে। আমার মত ‘অবস্থাপন্ন’ লোকের পক্ষে তো গ্যাঁট গচ্ছা দিয়ে “অতি বিশিষ্ট ব্যক্তি’ খাতির পেতে অসুবিধে নেই, তাই সে কষ্ট করতে হ’ল না। এক্সপ্রেস দর্শন হ’ল – যদিও একটা অপরাধ বোধ থেকেই গেল। মনে হল যেন রাতভোর কষ্ট করে লাইনে দাঁড়ান ঐ প্রকৃত ভক্তের ন্যায্য পাওনায় একটা অংশে আমি থাবা বসিয়েছি। সে অন্যায়বোধ যদি কিঞ্চিতও লাঘব হয় এই আশায় ফেরার পথে গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে আন্তরিক ভাবে হাত জোড় করে তাদের দিকে চেয়ে চেয়ে এগোলাম। প্রত্যুত্তরে তাদের অনেকও নমস্কার করল – কেউ কেউ ‘জয় ভোলেনাথ’ বলে উঠলো। কি ভেবে করল বা বলল জানি না, তবে আমার মনটা খানিক হাল্কা হ’ল তা’তে !
০৮/০২/২০১৯:
গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে গাড়ি ছুটছে হুহু করে এলাহাবাদের (থুড়ি, প্রয়াগ্ররাজ) পথে। ভদোই পৌঁছে কিঞ্চিত পা ছাড়ানো আর ছোটখাটো ইনপুট/আউটপুটের জন্যে অল্প থেমে আবার রওনা। বেশ তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম প্রয়াগ্ররাজ সীমানায়। কিন্তু তারপরই সব শম্বুক গতি। এ’ রাস্তায় ব্যারিকেড, তো সে’ রাস্তা ওয়ান-ওয়ে…সামনে কাতারে কাতারে ট্রাক, গাড়ি, বাস। শহরে পৌছতে যতটা সময় লেগেছিল তার প্রায় অর্ধেক সময় চলে গেল নিজের তাঁবুতে চেক-ইন করতে। তবে শেষমেশ যে কুম্ভতে পৌঁছেছি সে’টা ভেবে ও সব কথা আর মনে এলো না – বিশেষত যখন মেলায় ঢোকার মুখেই চোখে পড়ল একটা হোর্ডিং । তাতে বড় বড় হরফে লেখা – “প্রয়াগস্ত প্রবেশেউ পাপম নশ্যাতি তক্সনাত” (প্রয়াগে প্রবেশ মাত্র সঞ্চিত সব পাপ তৎক্ষণাৎ ধুয়ে যায়)! নিজেকে বললাম – আর কি চাই বাছা, কেল্লা তো ফতে করে ফেলেছ প্রায়!……
তাঁবুটা বেশ – ষ্টীলের পালং, নরম বিছানা, বালিশ আর বালাপোশ, একটা সাইড টেবিল, সঙ্গে চেয়ার আর ব্যাগ রাখার স্টুল। লাগোয়া প্রাইভেট বাথরুম, সকালে গরম জলেরও ব্যবস্থা আছে। আমাদের মত creature comfort seeking শহুরে মানুষদের জন্যে এই সব ব্যাবস্থা – গাঁটের কড়ি ফেল আর মাখ তেল। সাধারণ মানুষ, মানে প্রকৃত অর্থে তীর্থযাত্রী – তা’দের জন্যে রয়েছে সরাকারি ‘রৈন বসেরা’ – বিরাট বিরাট তাঁবু, মেঝেতে খড় পাতা, নিজের বিছানা নিজে লাগিয়ে শুয়ে পড়ো – ব্যস। যাদের কপালে তাও জোটে না, রাস্তার ধারে একটা পলিথিন সীটের ছাউনি করে নিয়ে তারই নিচে আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে টেনে ঘুম লাগায় তারা….. আমার তাঁবু সঙ্গমের পশ্চিম দিকে – যমুনার পাড়ে। ত্রিবেণী সঙ্গম ও’ পারে। আজ এখানে পৌছতে পৌছতে প্রায় বিকেল হয়ে গিয়েছিল – কাজেই ও’পারে যাওয়া বাদ দিলাম। তাঁবুতে মুখ হাত ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম প্রাথমিক একটা পর্যবেক্ষণে।
প্রথমই যা’ চোখে পড়ে, তা’ হ’ল মেলা পরিসরের বিশালতা……নদীর এপার ওপার মিলে, আলো ঝলমল করা প্রায় ৩৫০০ হেক্টের জুড়ে বসেছে এই মেলা। ৫-৬ কিমি হেঁটে পৌঁছলাম যমুনা তীরের সোমেশ্বর মহাদেব ঘাটে। ঐ পারটা হ’ল ত্রিবেণী সঙ্গম। পারাপারের জন্যে সারি সারি ৮-১০ ফুট চওড়া পন্টুন ব্রিজ করে লাগানো রয়েছে, তার অর্ধেক এ পাশে আসার, অর্ধেক ও দিকে যাওয়ার। পায়ে হাঁটা মানুষের (যা ৯৮%) সুবিধার্থে বিশেষ পাস ছাড়া গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ – বিশেষত শাহি স্নানের দিন গুলোতে। কয়েক শ’ মিটার অন্তর অন্তর সারি সারি পোর্টেবল টয়লেট, পিছনে HDPE সোক পিট। ‘খুলে মে শৌচ একদম মনা হ্য’ – এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কোনদিন দেখি নি এ হেন জন সমুদ্রে। নদীর জলও অভাবনীয় ভাবে পরিষ্কার – অর্ঘের ফুল, পাতা পর্যন্ত জাল দিয়ে তুলে ফেলছে ‘সাফাই’ কর্মীরা।
সন্ধ্যের সোমেশ্বর মহাদেব ঘাটের রূপ শান্ত, সমাহিত। ওপারে ত্রিবেণী সঙ্গমের দিক এখন আরও বেশী জমজমাট। দু’পারের এল.ই.ডি আলোর ছটায় কুলের জল ঝলমল করলেও, খানিক দূরে অন্ধকার অন্ধকার। আর সেখানে কাগজের নৌকোর ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে প্রদীপ – ভক্তদের পুজোর অর্ঘ। সেই টিমটিমে আলোয় নদীর জলের ছোট ছোট অংশ ঝিকমিক করছে। ভারি সুন্দর দৃশ্য…….এক দল ভক্ত এসে হাজির – আর খোল করতাল বাজিয়ে শুরু হয়ে গেল নাম গান। দূরে ঝলমলে আলো, মাঝে অন্ধকার নদীর বুকে ভাসমান প্রদীপের চিকমিক আর এখানে আলো আঁধারির মধ্যে সঙ্কীর্তন! বেশ একটা মন ভালো করে দেওয়া পরিবেশ। লোকেরা এসে বসে উপভোগ করছে। একটা সুবিধে হল যে ফেরিওয়ালার উৎপাত নেই – তারা বসে আছে রাস্তার ধারে। প্রয়োজন গিয়ে কিনে আনো – ঘটে বসে তা পাওয়া যাবে না। এই আলো আঁধারির মধ্যে একাকীত্ব ভীষণ ভাল লাগছিল!
আজ আর বেশী দেরী করা যাবে না। খেয়ে দেয়ে চটপট শুয়ে পড়তে হবে – কাল সকাল থেকে তো কেবল হাঁটা আর হাঁটা…….ঘাটে আসার পথে দেখেছিলাম ৩-৪ কিমি আগে একটা ফুড কোর্ট আছে। সে’ দিকে রওনা দিলাম। পুরো মেলা জুড়ে শুধু স্বাত্তিক খাবার – রান্নায় রসুন পর্যন্ত ব্যবহার হচ্ছে না। দোকানে গিয়ে দেখলাম যে সব খাবারের জন্যেই অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে – আমার তা পোষাবে না। তাই বাধ্য হয়ে তেল চবচবে ছোলে-ভটুরে দিয়েই কাজ চালাতে হ’ল। পাশে বসা দিল্লী থেকে আগত পরিবারের সঙ্গে কিছু গপ্পো হ’ল। ওরা দু’দিন আগে এসেছে – কাল ফিরবে। কথায় কথায় জানলাম সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে ২ কোটির ওপর মানুষের অস্থায়ী আস্তানা এই মেলা প্রাঙ্গণ! ২ কোটী মানুষ একই জায়গায়, একই উদ্দেশ্যে জড় হছে – ভাবতে পারা যায়?
খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়লাম……আরে হ্যাঁ, একটা কথা বলা হয় নি। তাঁবুতে অন্যান্য সাধারণ সুবিধে থাকলেও, চা/কফি করার কোন ব্যবস্থা নেই। সেই জন্য নিজের দূরদৃষ্টির প্রমাণস্বরূপ একটা ১/২ লিটার থার্মোস ফ্লাস্ক বয়ে এনেছিলাম। ফুড কোর্টএর খানিক দুরে একটা চা আর দুধ বিক্রির গুমটি। সেখানে গিয়ে এক গ্লাস গরম দুধ খেয়ে, ফ্লাস্কে ৩ কাপ চা ভরে তাঁবুর পথে রওনা দিলাম। ঐ ঠাণ্ডায় গরম দুধ শরীর একেবারে চাঙ্গা করে দিল! ………একটা হাল্কা সোয়েটার, ট্রাক স্যুট আর মাথায় টুপিটা পরেই ঢুকে পড়লাম বালাপোশের তলায়……… রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকের জন কোলাহলও ধীরে ধীরে কমে এলো। শেষে শুধু গোটা কয়েক লাউড স্পিকারে দূর থেকে ভেসে আসছে “ওম, নম শিবায়’……“গঙ্গা মাইয়া তেরো দর্শন’……’হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ”……সে’ সব লয়, সুর, তাল, ছন্দ রাতের ঠাণ্ডা বাতাসে মিলে মিশে সৃষ্টি করল এক অনৈসর্গিক ঘুম পাড়ানি গান। চোখের পাতা যে কখন বুঝে এসেছে বুঝতেও পারি নি।
০৯/০২/২০১৯:
সকালে উঠে ফ্লাস্কের চা দেখি একই রকম গরম আছে। দিল খুশ হয়ে গেল আর নিজের দূরদর্শীতাকে আরও একবার বাহবা দিতে দিতে কাপে চুস্কি দিতে লাগলাম। তারপর প্রাতঃকৃত্য সেরে, জামাকাপড়, তোয়ালে (যদি ঠাণ্ডা জলে নামার সাহস জোগাড় করতে পারি এই আশায়) ব্যাকপ্যাকে ভরে বেরিয়ে পড়লাম সকাল ৭ টা নাগাদ। পথে থামলাম অন্য এক ভোজনালয়ে। ঢোকার মুখেই দেখি ওপরে লেখা – “মোক্সওয়ালা ভোজনম”!! গত কালের “…..পাপম নশ্যাতি তক্সনাতের’ পর এই! আমার মোক্ষ আটকায় কে ??!! পুরি-সব্জি খেতে খেতে চোখে পড়ল এক গেরুয়াধারি সাধু। জিজ্ঞেস করলাম ‘চায় পিয়েঙ্গে?’ ঘাড় নেড়ে সম্মতি। বললাম “থোড়া কুছ খা ভি লিজিয়ে’। আবার ঘাড় নেড়ে সম্মতি – মুখে কথা নেই। মৌনী সাধু হ’বেন বোধ হয়। তাঁকে চা, খাবার ধরিয়ে, নিজের চা শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম পথে – ও পারে – ত্রিবেণী সঙ্গমের দিকে।
হাঁটতে আরম্ভ করলাম পন্টুন ব্রিজের ওপর দিয়ে শম্বুক গতিতে চলা “মানুষ প্যাসেঞ্জার ট্রেনের” শেষ কামরার মত, ঢিকির ঢিকির করতে করতে। ব্রিজে শুধু মাথা আর মাথা। পাশে চলা বুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম কোথা থেকে আর সঙ্গে কে এসেছে। জানালো ইটাওয়া জেলার কোন গ্রামে বাড়ি। ছোট খাটো চাষবাস করে চলে। সঙ্গে স্বামী, নাতি আর নাত বউ (গোটা ১৮ বছরের ছোট্ট খাট্ট মেয়েটি)। কি জন্যে আসা প্রশ্ন করায় খানিকটা থমকে গেলে নাতি জবাব দিল – ‘দাদী বলে কুম্ভের সঙ্গমে একবার অন্তত স্নান না করলে মরে শান্তি পাওয়া যায় না – তাই আসা’। মুখ ভর্তি ফোগলা দাঁতের হাসি নিয়ে বুড়ি সজোরে ঘাড় নাড়ল নাতির কথায়!
ওপারে পৌছতে ঘণ্টা খানেকের ওপর লাগলো। তীরে পৌঁছে ঠিক করলাম বাঁ দিকে যাব। মাইল তিনেক হাঁটার পর নজরে পড়ল এই প্রান্তের সারি সারি বিভিন্ন আখাডা। আপাদমস্তক ভস্ম মাখা নাগা সাধুদের তাঁবুগুলোতে ধুনির সামনে বসে ২-৩ জন সসম্ভ্রমে কথা বলছে। বাকিগুলোতে চলছে প্রবচন – লাউডস্পিকারের দৌরাত্ম্যে কান ঝালাপালা। একটা শিবিরে দেখা হ’ল অতি পুরনো সুহৃদ – প্রভাস আর ইন্দিরার সঙ্গে। কুম্ভে এসে এই প্রথম চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা। খানিক গল্প টল্প করে আবার এগোলাম। কয়েকটি শিবিরে চলছে সুর করে গীতাপাঠ আর ভজন। বেশ লাগছিল। তারই একটাতে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম – খানিক শুনতে, খানিক পা ছাড়াতে। বেশীর ভাগ তাঁবুতেই চলছে ধর্মরক্ষার গুরুদায়িত্বের কথা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর প্রচেষ্টা – রাজনৈতিক দলগুলো আর তাদের নেতাদের নামও উঠে আসছে মাঝে মধ্যেই। এক যায়গায় শুনলাম একজন বলছেন কীর্তনের সাথে, প্রয়োজন হলে, কর্তনও করতে হবে ! মহামানবের এমন মিলন স্থলে ‘কর্তন’ কথাটা ভয়ঙ্কর বেসুরো আর নির্মম ঠেকল। আর তার পরেই মনে পড়ল! আরে, এ’ তো হবারই ছিল – এ’ যে ভোটের মরসুম – তাও আবার লোকসভার!!…ভাল লাগল না – বেরিয়ে এলাম ওখান থেকে। বাইরে এসে যখন দেখলাম সে সব কর্তন ফর্তনের কথায় বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে আপামর জনতা কুম্ভ মেলার আনন্দে মশগুল, মনটা আবার ভালো হয়ে গেল – নাহ, মনুষ্যত্ব এখনও ‘শুধু জীবিতই নয়, বেশ পা ছোড়াছুড়িও করছে’ !! বেলা গড়িয়ে প্রায় দুপুর ১২টা – রোদের তাপও বেশ বাড়ছে। এ’ বেলার মত ফিরতি পথ ধরলাম। শুকিয়ে যাওয়া বালি আর ধুলোর ঝড়ে চোখে কালো চশমা আর নাকে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে এগোতে থাকলাম নিঃশব্দে – বাকিদের পিছন পিছন।
বোধ হয় সবারই খিদে পেয়েছিল – তাই ব্রিজের ওপর জনতা পাসাঞ্জারের গতি এবার একটু দ্রুত। সকালের তুলনায় বেশ চটপটই পৌঁছে গেলাম ‘নিজেদের পাড়ার‘ সোমেশ্বর ঘাটে। সেখানে চলেছে স্নান – বেশ ভিড়। রোদের তাপের মধ্যে নদীর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা জলের আহ্বান এড়ানো গেল না। প্যান্ট, শার্ট ছেড়ে, ব্যাকপ্যাকটা এক পরিবারের হেফাজতে রেখে শর্টস পরে নেমে পড়লাম জলে। ঘাটের ধারের বালির ওপর বিছোন আছে খড় আর স্নানের জায়গার পাড় বাঁধানো বালিরই ব্যাগ দিয়ে। নেমে পড়লাম। প্রথমে ছ্যাঁক করে উঠলেও বেশ লাগলো। কোমরের একটু ওপর অবধি জল এখানে। লম্বালম্বি সারি সারি রং বেরঙ্গের বয়া দিয়ে সীমারেখা টানা হয়েছে। তার ওপারে জল গভীর – যাওয়া নিষেধ। NDRF জওয়ানরা তাঁদের কমলা রঙ্গের রবারের ডিঙ্গিতে বসে সতর্ক নজর রাখছে চারিদিকে। খানিক ইতস্তত করে ‘জয় মা’ বলে নিজেকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি করে দিলাম এক ডুব। মনে হল হাড় যেন জমে গেল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের জন্যেই। মাথা তুলতেই কোথায় উবে গেল ঠাণ্ডা! তার পর আর কি – ডুব, শুধু ডুব …আবার ডুব। উঠতে মন নারাজ। শরীরের সঙ্গে মনও চাঙ্গা হ’ল। আর অজ্ঞাতপরিচয়তার ফলে কোন রকম “কে দেখছে এই ছেলেমানুষি …..কে কি ভাবছে” সে সঙ্কোচ তো নেই – তাই বিন্দাস হয়ে ডুব আর ডুব। উঠলাম, যখন দেখলাম আমার ব্যাগের দায়িত্বে থাকা পরিবার এবার ফেরার তোড়জোড় করছে। ঐ জনসমুদ্রের মধ্যেই আবার বিন্দাস হয়ে জামাকাপড় বদলে হাঁটা দিলাম সেই ফুড কোর্টের দিকে – খিদেটা বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে। গরম গরম রাজমা-চাওল বেশ লাগলো খেতে। তারপর ধরলাম বাড়ি (অর্থাৎ নিজের তাঁবুর) পথ। খানিক জিরিয়ে নিয়ে সন্ধ্যেয় আবার বেরোনোর জন্যে একটু এনার্জি জোগাড় করে নিতে।
সন্ধেয় আবার ধড়া চূড়া পরে পথে – আবার ও পাড় – যে আখাডা গুলো সকালে দেখা হয় নি সে গুলোয় একটু ঢুঁ মারতে। সব মিলিয়ে আবার ৮-১০ কিমি হাঁটা। এখন ভিড় যেন আর একটু বেশী। ব্রিজ, রাস্তা, ঘাট সব গিজগিজ করছে লোকে। মাইকে অবিরত চলছে প্রবচন – শিবিরের ভেতরে যারা বসে আছে তারা ছাড়া বাইরের কারুর সে দিকে মন আছে বলে তো মনে হ’ল না। অনেকেই ব্যস্ত পথের ওপর গরম জামাকাপড়, কম্বল ইত্যাদির দোকানে দরদাম করতে। রঙ্গ বেরঙ্গি সাড়ি, ইমিটেশন গয়না, প্রসাধন সামগ্রীর দোকানে মহিলাদের উপচে পড়া ভিড়। বোধ হয় এখানের অলিখিত নিয়ম হ’ল সকালে ভাগবত আর সন্ধ্যেয় ভোগবিলাস। তীর্থ আর বাণিজ্য দুইই চলতে পারে একই সঙ্গে – কোন বিবাদ নেই !
প্রায় দু’ ঘণ্টা ধরে ঘুরে বেড়ালাম বিভিন্ন শিবিরে – নতুন কিছুর সন্ধানে। একটু নিরাশই হ’তে হ’ল – সকালে যে ধরনের প্রবচন/আলোচনার ধারা ছিল – এখনও তাই – সেই একই সুরে বেজে চলেছে – সকলকে ধর্মের গুরুদায়িত্ব বোঝানোর নিরন্তর চেষ্টা। কেন যে এরা মানুষ কে ছেড়ে দেয়না যে যার নিজের নিজের ঈশ্বর খুঁজে নিতে, তা’ আজ অবধি বোধগম্য হ’ল না।…যাক সে কথা …বোধ হয় আগামী কালের (বসন্ত পঞ্চমী) শাহি স্নানের দরুন আজ ‘ভাণ্ডারা’ লেগেছে অনেক বেশী – শিখেদের লঙ্গরও কয়েকটা। গরীব মানুষ তৃপ্তি করে খাচ্ছে দেখে কি ভাল যে লাগলো। মনে হল ধর্মের নামে লোক না ক্ষেপিয়ে সকলেই এমন ঈশ্বর সেবা কেন করছে না? ……যাক, তাদের ব্যাপার তারা বুঝবে ভেবে ফেরার পথ ধরলাম।
একটা রিক্সা ধরার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমি যে দিকে যাব সে’দিকের রাস্তাতেই নাকাবন্দি। এক শীর্ণকায় রিকশাওলাকে জিজ্ঞেস করলাম। কি ভেবে সে’ গেল ব্যারিকেডের ধারে এক কনস্টেবলের কাছে। হয়ত তাকে দেখে মায়া হওয়াতেই সে তাকে যাবার অনুমতি দিল। উঠে বসে সবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছি অমনি পিছন থেকে অন্য এক কনস্টেবলের হুমকি – ‘অ্যায়, কিধর চলা রে তু? চল ওয়াপাস”। রিক্সা চালক কাকুতি মিনতি করল……আমিও বললাম যে তাদেরই এক সহকর্মী অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু সে’ হতভাগা শোনার পাত্র নয়। নেমে যাব ভাবছি, এমন সময় চালক ফিসফিস করে বলল – ‘আপ বৈঠে রহিয়ে’ বলে সেও খানিক দাঁড়িয়ে রইল। তারপর যখন দেখল সেই কনস্টেবল অন্য দিকে মুখ করে কারুর সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত, সে সাঁ সাঁ করে ছোটালো তার ফেরারি – আমাকে বলল শুধু মাঝ মাঝে দেখতে ব্যাটা পিছু করছে কি না – দুই কো-কন্সপিরেটর বেশ মেতে উঠলাম এই মজার ছেলেমানুষি খেলায়! সামনে ঢাল থাকায় ফেরারির গতিও হ’ল আরো দ্রুত। আধ ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম ব্রিজের মুখে – যেটা হেঁটে আসতে সময় লেগেছিল প্রায় ৩ ঘণ্টা !!
কুম্ভের একটা বিশিষ্টতা লক্ষ্য করলাম – এখানে কারুর কোন বিশেষ গন্তব্য স্থল থাকে না। কাজ শুধু চষে বেড়ানো। পথে কিছু ভালো বা অদ্ভুত লাগলে দাঁড়িয়ে পড়া, দেখা……কোন সাধু, সন্তের সামনে বসে কথা শোনা, প্রশ্ন করা…..লাউড স্পিকার ভেসে আশা কোন প্রবচন বা ভজন ভালো লাগলে সেই আখাডায় ঢুকে খানিক শোনা…যার যেমন ইচ্ছে বা মনের ধারা সেই মত। আবার এগিয়ে চলা। কতবার দেখেছি পথের মোড়ে দলের লোকেরা ভোটাভুটি করে ঠিক করছে ডান দিকে যাবে না বাঁ দিকে। আমার বেশ লাগে এই খামখেয়ালি ভাবে পথ চলতে। নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকলে সব যেন কেমন বাঁধা ধরা – নিয়ম মাফিক। আর এই ভবঘুরের মত চলার মধ্যে আছে একটা মনমাতানো ছন্নছাড়া ভাব যা শহুরে জীবনে সারাদিন ধরে উপভোগ সম্ভব নয়। গভীর রাত পর্যন্ত – লক্ষ লক্ষ মানুষ পায়ে হেঁটে চলেছে কাতারে কাতারে। মাথায় পুঁটলি, হাতে লাঠি, নড়বড়ে শরীর নিয়ে কতজন – কিন্তু মুখে কোন অভিযোগের লেশ মাত্র নেই – বরং এক অনাবিল আনন্দের ছাপ। আসল পুণ্যার্থীরা বোধ হয় এই রকমই হয়।
যেমন বললাম, আগামী কাল বসন্ত পঞ্চমীর ‘শাহি স্নান’ – ত্রিবেণী সঙ্গমে……….স্থনীয় লোকের মুখে জানলাম শাহি স্নানের ব্যাপারটা। কুম্ভের সময়ে পাঁচটা দিন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ – পৌষ সংক্রান্তি (যেদিন কুম্ভ মেলা শুরু হয়), মৌনি আমাবস্যা, বসন্ত পঞ্চমী, মাঘী পূর্ণিমা আর মহা শিবরাত্রি (যার পর মেলায় যবনিকা পড়ে)। এর মধ্যে আবার তিনটে দিন আরও বেশি মহত্ত্বপূর্ণ – তার মধ্যে একটা হ’ল বসন্ত পঞ্চমী (বাকি দুটি – যতদূর মনে পড়ে – পৌষ সংক্রান্তি আর মৌনি আমাবস্যা)। কাজেই, আজকের সকালের ডুবকির মজা পাওয়ার পর এই বিশেষ দিনের তকমাটা লোভ যে আরো বাড়িয়ে দিল তা’ তো বলাই বাহুল্য!
আবার ফুড কোর্ট (রুটি, ডাল আর আলু-কপির সব্জি ভোজন), তারপর এক গ্লাস গরম দুধ আর ফ্লাস্কে চা ভরে বাড়ির পথ ধরলাম। মনে মনে হিসেব করে দেখলাম আজ সকাল থেকে সব শুদ্ধু অন্তত ২০-২৫ কিমি হেঁটেছি………..নিজের পিঠ নিজেই আর একবার না চাপড়ে থাকা গেল না।………আগের রাতের মত এবারও সেই হাল্কা সোয়েটার, ট্রাক স্যুট আর মাথায় টুপিটা পরে ঢুকে পড়লাম বালাপোশের তলায়।
(ক্রমশঃ)
ভারতের সনাতন রূপ লেখক খুব সুন্দর দেখিয়েছেন। আড়ম্বরহীন সাধারণ মানুষের এই মেলাই আমাদের দেশের প্রকৃত চিত্র। লেখকের বর্ণনা সাবলীল, আর সাথের ছবিগুলোও কুম্ভের চিত্র চোখের সামনে তুলে ধরেছে।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় আছি।
ধন্যবাদ
সুন্দর লেখার ধারা।
২০১৯ এ চোখ ধাঁধানো চাকচিক্য ছিল না। IIT বাবা, সন্যাসিনী মোনালিসার প্রচার ছিল না, ভি আই পি দের খাতিরের অত্যাচার ছিল না।
সেই ২০১৯ হলো আমাদের আসমদ্রু হিমাচলের মিলনক্ষেত্র। তার চিত্র তিলোকবাবুর লেখায় সুন্দর ফুটে উঠেছে।