এলোমেলো বেড়ানো: ধারাবাহিক নবম পর্ব
©অমিতাভ রায়, ১৯৭৯ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আগের পর্ব পড়তে হলে, লিংক
কাকনমঠ – ভুমিকা
এই বিশাল মন্দিরটি পাথরের তৈরি ২০ ফুট উচ্চতার একটি বর্গাকার ভিত্তির উপর নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটির বিশেষত্ব হল এটি পাথরের ওপর পাথর বসিয়ে নিছক ভারসাম্য বজায় রেখে তৈরি। সিমেন্ট বালির মিশ্রণ তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি সাবেক কালের ইমারতি মশলা চুন-শাঁখের গুঁড়ো ইত্যাদিও অনুপস্থিত। পেরেক-স্ক্রু-রিভেটেরও বালাই নেই। দুটো পাথর জোড়া লাগাতে আঠা জাতীয় কোনও উপাদানও ব্যবহার করা হয়নি। এক টুকরো পাথরের উপর আরেক খণ্ড পাথর সাজিয়েই গড়ে তোলা হয়েছিল এত বিশাল স্থাপত্য। দেখে মনে হবে একটা ধাক্কা দিলেই পাথরগুলো হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাবে।কাকনমঠের রহস্যময় মন্দির নিয়ে এবারের পর্ব, লিখলেন অমিতাভ রায়
কাকনমঠ
গোয়ালিয়রের পর্যটন মানচিত্রে দ্রষ্টব্য স্থানের কোনও অভাব নেই। গোয়ালিয়র ফোর্ট, জয়বিলাস প্রাসাদ, মোতি মহল, গোপাচল পর্বত, গুজারি মহল থেকে শুরু করে তানসেন-এর সমাধিগৃহ সবই দর্শকের অপেক্ষায় রয়েছে। কাছেই রয়েছে ‘ন্যাশনাল চম্বল ঘড়িয়াল ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি’। রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ আর মধ্যপ্রদেশের সংযোগস্থলে চম্বল নদীর উপর গড়ে উঠেছে এই স্যাংচুয়ারি। বিপন্ন প্রজাতির ঘড়িয়াল, কচ্ছপ, গঙ্গার ডলফিন, কুমির থেকে শুরু করে ডোরাকাটা হায়েনা, ভারতীয় নেকড়ে ইত্যাদি এখানে রয়েছে। দেশি বিদেশি পর্যটকরা কেউ তাড়াহুড়ো করে, আবার কেউ কেউ ধীরেসুস্থে সেইসব দ্রষ্টব্যস্থল সফর করেন। এর মধ্যে বাদ পড়ে যায় মোরেনা।
মোরেনা আসলে উত্তর প্রদেশের সীমানা ঘেঁষা মধ্যপ্রদেশের একটি জেলা। হাওড়া থেকে দিল্লি যাওয়ার রেলগাড়িতে এটাওয়া স্টেশনকে বলা যায় মোরেনা যাওয়ার সহজ প্রবেশ পথ। জেলা প্রশাসনের সদর শহরের নামও মোরেনা। গোয়ালিয়র থেকে জাতীয় সড়ক ধরে যাত্রা শুরু করলে মোরেনার দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার।
ন্যাশনাল চম্বল ঘড়িয়াল ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি
মধ্যপ্রদেশের এই জেলাটি চম্বল উপত্যকার হৃদয়পুর। এককালে মোরেনার পরিচয় ছিল বেহর-বাগি-বন্দুকের কেন্দ্রস্থল। চম্বলের দস্যু-ডাকাতদের নিয়ে আছে অন্তহীন আলোচনা। চম্বল উপত্যকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়েও অসংখ্য গবেষণাপত্র রচিত হয়েছে। আর বিভিন্ন ভাষায় লেখা হয়েছে গল্প-কাহিনি-উপন্যাস। কত? সংখ্যা হিসাব করতে গেলে আবার একটা গবেষণা প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। বাস্তব-কল্পনার মিশেলে রচিত এইসব আখ্যানের একসময় ভালোই চাহিদা ছিল। নির্মিত হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র। উনিশশো পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে এই শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত চম্বলের বেহর-বাগি-বন্দুক ছিল বাণিজ্য-সফল ফিল্ম ও ফিকশনের আকর্ষণীয় উপাদান।
দিন পাল্টেছে। দস্যু-ডাকাতদের অনেকেই সমাজের স্বাভাবিক স্রোতে নিজেদের মিশিয়ে দিয়েছেন। এককালের রুখা-শুখা জমিতে সেচের বন্দোবস্ত হওয়ায় বাগিদের অনেকেই চাষবাস করে সংসারী জীবনযাপন শুরু করেছেন। রাজনীতির আঙিনায় পদচারণা করে কেউ কেউ বিধায়ক-সাংসদও হয়েছেন। অনেকেই প্রয়াত। কারও কারও স্বাভাবিক মৃত্যু। আবার পুলিশের হাতে অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সঙ্গে লড়াইয়েও প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে।
পাল্টে গেছে মোরেনা জেলা সহ সমস্ত চম্বল উপত্যকার প্রাকৃতিক চরিত্রও। এখন দেশের সেরা মানের গম এবং ডাল উৎপাদন করে মোরেনার শস্যক্ষেত। মান এতটাই উন্নত যে এম পি (মধ্যপ্রদেশ) গম ও আটা একটা আলাদা ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাজারে এই ব্র্যান্ডের গম ও আটার দাম অন্যদের তুলনায় বেশি। তা সত্ত্বেও বিক্রি কমেনি।
মোরেনার শস্যক্ষেত
ছোট্ট জেলা-শহর মোরেনা এখন সবুজ মালভূমিতে ঘেরা এক সুন্দর জনপদ। মোরেনা পৌঁছনোর অনেক আগেই জাতীয় সড়ক থেকে একটি রাজ্য সড়ক ডানদিকে আম্বা-র দিকে চলে গেছে। সেই রাস্তায় গাড়ি গড়িয়ে দেওয়ার পর সড়ক ফলকের উপর সতর্ক নজর রাখা দরকার। ডানদিকে হঠাৎ করেই একটি সড়ক ফলকের উপর তির-চিহ্ন নির্দেশ করছে– ‘কাকনমঠ’। এখান থেকেই প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার অধীনে নির্মিত পাকা রাস্তায় পাড়ি দিলে কিছুক্ষণ পরেই এসে যাবে কাকনমঠ। নিতান্তই গ্রাম্য এলাকা। সেই রাস্তাতেই অবিরাম চলাচল করছে ছোট ছোট গাড়ি, অটো, ট্র্যাক্টর ইত্যাদি। হেঁটেও চলেছে অনেকে। দু’পাশে গমের ক্ষেত। গোয়ালিয়র থেকে কাকনমঠের দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। গাড়িতে যেতে সময় লাগে কমবেশি ঘণ্টা দেড়েক।
হঠাৎ করেই গমের সোনালি সবুজের মাঝখানে খণ্ডহারের মতো এক বিশাল পাথরের কাঠামোর দিকে নজর চলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। প্রাথমিকভাবে এটিকে একটি পুরনো কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ মনে হতে পারে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (এএসআই) তৈরি সীমানা প্রাচীরের কাছে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু কাঠামোটি সম্পর্কে ধারণা বদলে যাবে। নীল রঙের বোর্ডের উপর সাদা অক্ষরে ইংরেজি ও হিন্দিতে কাকনমঠের শিব মন্দিরের সংক্ষিপ্ত পরিচয় লেখা রয়েছে। লোহার তৈরি একটি বড় দরজা পেরিয়ে চত্বরে প্রবেশ করতে হয়। সীমানা প্রাচীরের পাশে পুরো সীমানা বরাবর সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন আকারের শত শত ভাঙা পাথরের খোদাই মূর্তির টুকরো বা ভগ্নাবশেষ। আর চত্বরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ১৫৫ ফুট উঁচু একটি মন্দির।
প্রথম দর্শনে মনে হতেই পারে, যে কোনও মুহূর্তে অত বড় কাঠামোটি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পড়েনি। আরও ভালো করে লক্ষ করলে নজরে পড়ে বিশাল মন্দিরটি পাথরের তৈরি ২০ ফুট উচ্চতার একটি বর্গাকার ভিত্তির উপর নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটির বিশেষত্ব হল এটি একটি পাথরের ওপর আরেকটি পাথর বসিয়ে নিছক ভারসাম্য বজায় রেখে তৈরি। সিমেন্ট বালির মিশ্রণ তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি সাবেক কালের ইমারতি মশলা চুন-শাঁখের গুঁড়ো ইত্যাদিও অনুপস্থিত। পেরেক-স্ক্রু-রিভেটেরও বালাই নেই। দুটো পাথর জোড়া লাগাতে আঠা জাতীয় কোনও উপাদানও ব্যবহার করা হয়নি। এক টুকরো পাথরের উপর আরেক খণ্ড পাথর সাজিয়েই গড়ে তোলা হয়েছিল এত বিশাল স্থাপত্য। দেখে মনে হবে একটা ধাক্কা দিলেই পাথরগুলো হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু শুধু কেবল একটা পাথরের ওপর আর একটা পাথর রেখে তৈরি এই মন্দির বিগত একাদশ শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত গত এক হাজার বছর ধরে বহু ঝড়ঝাপটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, আজও। কেবল চতুর্দশ শতাব্দীতে নাকি এক ভয়ংকর ভূমিকম্পে মন্দিরের কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যায়।
মন্দির কাঠামোর যেকোনও পাথরের টুকরোর দিকে তাকালেই তার ওজন সম্পর্কে একটা আন্দাজ করা যায়। অত ভারী ভারী পাথর রীতিমতো অঙ্ক কষে একের উপর আরেকটি সাজিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এক অনবদ্য স্থাপত্য। মন্দিরটির পাথর আরও অবাক করে। যে পাথরের ওপর পাথর রেখে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে তা এই অঞ্চলের ধারেকাছে কেন, বহুদূর পর্যন্তও পাওয়া যায় না। তাহলে কীভাবে কোত্থেকে এই ভারী ভারী প্রস্তরখণ্ড এক হাজার বছর আগে এখানে আনা হয়েছিল? প্রশ্ন থেকেই যায়।
গ্রামের নাম সিহোনিয়া। এক সময় ছিল কচ্ওয়াহা রাজ্যের রাজধানী। কথিত আছে, একাদশ শতাব্দীতে কচ্ওয়াহায় খুশওয়া বংশের রাজা কীর্তিরাজ রানি কাকনবতীর ইচ্ছা পূরণের জন্য সিহোনিয়ায় এই শিব মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। তবে অন্যমতে, কনক বা সোনা নির্মিত মন্দির বলেই এমন নাম। হবেও বা! তবে মন্দিরে এবং পাশের চত্বরে এখন এক কণা সোনার গুঁড়োও খুঁজে পাওয়া গেছে বলে জানা যায়নি। পিরামিড ধরনের মন্দিরের নকশা অনেকটা ইতালির পিসার লিনিং টাওয়ারের মতো অনিশ্চিতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ দেখায় এবং মনে হয় যেকোনও মুহূর্তে কাঠামোটি ভেঙে যেতে পারে। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এত শতাব্দীর ঝড়-জল সহ্য করে যখন দাঁড়িয়ে আছে তখন দুশ্চিন্তার কী দরকার! নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে মন্দিরের ভিতরে অন্য দর্শনার্থীদের সঙ্গে প্রবেশ করলে একটি শিবলিঙ্গ দেখা যায়।
সিহোনিয়ার কাকনমঠ
কাকনমঠের মন্দিরের পরতে পরতে রহস্য। মানুষের মুখে মুখে ঘোরে নানান রকমের রোমহর্ষক কাহিনি। এমন এক মন্দির যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের কাছেই এক কৌতূহল। মন্দিরটির দিকে তাকিয়ে সেইসব গল্পগাছার কথা ভাবলে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। কথিত আছে ১৫৫ ফুট উঁচু এই শিব মন্দির তৈরি হয়েছিল মাত্র একটি রাতের মধ্যে। তাও আবার তা কোনও মানুষের হাতে তৈরি নয়। তৈরি করেছিল একদল ভূত, যারা অশরীরী বলে সাধারণভাবে পরিচিত। রাতভর এই মন্দির নির্মাণ চালানোর পর পুব আকাশে সূর্য উঁকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণের কাজ অসমাপ্ত রেখেই ভূতেরা নাকি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। হবেও বা! এখনও এই মন্দিরের দিকে তাকালে অনেকের মনে হয় মন্দিরটি সম্পূর্ণ নয়। অনেক জায়গা যেন ফাঁকা রয়ে গেছে।
আপাততঃ এএসআই এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে। তবে সংরক্ষণের কোনও সুযোগ নেই। এমনভাবে পাথরের ওপর পাথর রেখে এই কাকনমঠ মন্দির তৈরি হয়েছে যে এখনও এই মন্দিরে হাত দিতে স্থাপত্যবিদেরা রাজি নন। ফলে আজও এই মন্দির নির্মাণের প্রযুক্তি এক রহস্য হয়েই থেকে গেছে।
রহস্য-গল্পগাছা-ইতিহাস দিয়ে মোড়া কাকনমঠের মন্দিরে কিন্তু দর্শনার্থীদের খামতি নেই। বেশিরভাগই স্থানীয় মানুষ। নবদম্পতিরা সুখী জীবনের প্রার্থনা করতে মন্দির দর্শনে আসেন। পড়ুয়ারা দলবেঁধে পরীক্ষার আগে আসে। একটাই প্রার্থনা সারা বছর পড়াশোনা ঠিক মতো না করলেও পরীক্ষার ফলাফল যেন ভালো হয়। এইরকম আরও কত শত প্রার্থনা করতে যে এখানে পুণ্যার্থীদের আগমন ঘটে তার হিসাব কে রাখে! এ যেন সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কলকাতার কালীঘাটের মন্দির অথবা দিল্লির কালকাজী কিংবা মুম্বাইয়ের সিদ্ধি বিনায়ক বা ভ্যাটিকান সিটির প্যাপাল ব্যাসিলিকা অফ্ সেন্ট পিটার-এ পুণ্যার্থীদের এই নিবেদন নিয়েই তো আগমন। শেষ বিচারে কিছু পাওয়ার আশায় মানুষের এত পরিশ্রম। কাজেই কাকনমঠও ব্যতিক্রমী নয়। নিছক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসা লোকের সংখ্যা যৎসামান্য।
অমিতাভ রায়
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।
Add comment