শান্তনুর কড়চা
©শান্তনু দে, ১৯৮৯ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
কয়েক দিন আগে একটা গান শুনলাম…তার মোদ্দা কথা হলো ,” বাবু খাইছো?” চিন্তায় আকুল বেবি ,বাবুকে খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।”
অনেক দিন আগে ,সেই ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর লিখেছিলেন ,”আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”…শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে বাঙালী খাওয়া দাওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবে নি। গু গা বা বায়, গুপী গান গাইতে পারার বর চেয়েছিল,আর বাঘা ঢাক বাজাতে পারার। এই ব্যতিক্রম ছাড়া বাঙালী ভূত বা ভগবানের কাছে খাওয়া দাওয়া ছাড়া আর কিছুই চায় নি।আর হবে নাই বা কেনো ? সেই কোন যুগে কবি কালিদাস বলেছেন ‘আশ্বাস : পিশাচো হপি ভোজনেন’। অর্থাৎ পিশাচকেও ভোজন দ্বারা বাগে আনা যায়। তা এই কোটি কোটি পিশাচসম জাতিকে বাগে আনতে গেলে তন্ত্রমন্ত্র কোনো কাজে আসবে না …সেটা কালিদাসবাবু অনেকদিন আগেই বুঝেছিলেন।
দুঃখের ব্যাপার হলো ,আজকালকার সাহিত্যিকরা সেটা বুঝতে পারছেন না। হাজার হাজার বই লিখেছেন ,তন্ত্রমন্ত্র ভূত প্রেত নিয়ে। আরে খাবার দাবারের রেসিপি বই লিখুন ,ফুড-হরর বা ফুড-রহস্য রোমাঞ্চ টাইপের কিছু নতুন ধারা প্রবর্তন করুন ।বেস্ট সেলার হতে বাধ্য। তবে খাবারের রুচি বিশেষতঃ আমিষ খাবার দাবার খুবই সংকীর্ণ হয়ে উঠেছে । মুরগি/পাঁঠা আর মাছ ছাড়া কোনো বিশেষ অপশন সে রাখে নি।ধৃতিকান্তবাবু নাকি বাদুড়ের মাংস খুব ভালবাসতেন। তারপরে আর কাউকে দেখি নি, বাদুড়, সজারু, হরিণ, ব্যাঙ, সাপ, আরশোলা, কাঠবিড়ালি (হেমিংওয়ে খুব ভালোবাসতেন নাকি কাঠ বেড়ালিভাজা একটু লেবুর রস দিয়ে) ইত্যাদির মাংস ট্রাই করতে।চন্ডী মঙ্গলে বাংলা সাহিত্যের প্রথম ফুডি ,কালকেতু গোসাপ শিকার করে নিয়ে এসে,ফুল্লরাকে বললো,
“খুদ কিছু ধার লহ সখীর ভবনে
কাঁচড়া খুদের জাউ রান্ধিও যতনে।
রান্ধিও নালিতা শাক হাঁড়ি দুই তিন
লবণের তরে চারি কড়া কর ঋণ।
সখীর উপরে দেহ তন্ডুলের ভার
তোমার বদলে আমি করিব পসার।
গোধিকা রাখ্যাছি বান্ধি দিয়া জাল-দড়া
ছাল উতারিয়া প্রিয়ে কর শিক-পোড়া।”
এখানে কালকেতুর ডিটেইলিং এর দিকে কী রকম নজর সেটা দেখুন…কোথা থেকে কী প্রকিওর করবে ,কী ভাবে রান্না করবে সব বলে দিচ্ছে।তারপর তো ফুল্লরা বাড়ি ফিরে এসে দেখে জুন আন্টি বসে আছে। সে অন্য গল্প। সে যাই হোক,গোসাপের শিক কাবাব …ভাবতেই কী রকম রোমাঞ্চ হচ্ছে। শুধু ভ্যারাইটি নয় ,পরিমানের দিক থেকেও সে স্বর্ণ যুগ আর নেই। কোথাও একটা পড়েছি,রাজা রকম মোহন রায় ,প্রায়ই একটা গোটা পাঁঠার মাংস একাই সাবড়ে দিতেন। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে দশটা ফিশ ফ্রাই, হাফ কেজি মাংস খেয়ে ,শ-খানেক রসগোল্লা উড়িয়ে দেওয়ার গল্প শুধু বইতেই পড়েছি, চোখে দেখি নি।
********
“চার বছর বিই কলেজে ,অনেক অনেক যাকে বলে “extra curricular activity’ করে ও সামান্য কিছু পড়াশোনা করে একটা চাকরিও পেয়ে গেলাম। সত্যি কথা বলতে ,ইন্টারভিউতে সেরকম কিছু করতে পারি নি। সেটাই হয়তো শাপে বর হয়েছিল। ইন্টার্ভিউয়াররা ভেবে ছিলেন আর যাই হোক,এ মক্কেল চাকরি ছেড়ে চলে যাবে না।ওঁরা দূরদর্শী ছিলেন,এইটুকু বলতে পারি।
যাই হোক ,চাকুরিস্থল ভিশাখাপটনম। একটু মফস্বল মত জায়গা। স্টিল প্ল্যান্ট ও শহর থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে।পাহাড় ,সমুদ্র …ছবির মত সুন্দর জায়গা।ক্লাবে এগারো টাকা ওল্ড মন্ক রামের পেগ, কল্যাণী ব্ল্যাক লেভেল বা নক আউট বিয়ার ও তাই। সব মিলিয়ে বেশ সুখেই ছিলাম। গন্ডগোলটা বাধলো ,বাবা-মা আমার কাছে বেড়াতে এসে।
প্রথম দিন আমার ছিল মর্নিং শিফট (স্টিল প্ল্যান্ট 24*7*365 চলে। অফিসাররাও অনেকে শিফটে আসেন। মর্নিং ,আফটারনুন ও নাইট শিফটে কাজকর্ম হয়)। শিফটের শেষে কালি ঝুলি মেখে বাড়ি ঢুকতেই,মা আমাকে দেখে আঁতকে উঠলেন। “একি চেহারা !এত কালি কেন ?”
খেয়েদেয়ে ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে উঠে দেখি বাবা-মা গম্ভীর মুখে চা খাচ্ছেন।” আমাকে দেখে বাবা একটু গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন…” মানে, ইয়ে,বলছিলাম কী, তুই যে চাকরিটা করিস, সেটা ইঞ্জিনিয়ারদের তো?” মা বলেন “আমি কিছু শুনতে চাই না। এ চাকরি চলবে না। অন্য চাকরি দেখো। চাকরি না পেলে বাড়িতে বসে টিউশন করো।” বাবাও কথা চালু রেখেছেন, “বাড়িতে বসে এমবিএ-র প্রিপারেশন নিয়ে পরীক্ষা দাও, তারপর এমবিএ করো।” এবার আমার পালা, “নতুন প্ল্যান্ট, ওয়ার্কাররাও নতুন। কাজ কর্ম ভাল করে শেখে নি। আমরাই শেখাই ,তাই একটু কালি টালি লাগে। ওরা শিখে গেলেই লাইফ একদম পিসফুল। আমি কোথাও যাবো না। আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে (আহা রে কত বড় দিগগজ মেটলারজিস্ট রে) এম বি এ কেন করবো?”
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে, গঙ্গা -গোদাবরী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে…বছর বছর নতুন এমটিটি জয়েন করছে।তারাও শিফটে কাজ করছে।তারা এখনো ওয়ার্কাররাদের শিখিয়ে যাচ্ছে,ও কালিঝুলি মেখে বাড়ি যাচ্ছে।বুঝতে পারছি আমি ওয়ার্কারদের লার্নিং কার্ভ নিয়ে খুব বেশী অপটিমিষ্টিক ছিলাম।”.
**********
আচ্ছা ,আপনারা আশা ভোঁসলের এই গানটা শুনেছেন ,”ফুলের গন্ধ নেই, সে তো ভাবতেই পারি না!” কী বোকা বোকা না! এরকম হাজার হাজার ফুল আছে, যার কোনো গন্ধই নেই। প্রকৃতির রাজ্যে ফুলে হয় রঙ থাকবে, নয় তো গন্ধ। গোলাপই একটা ব্যতিক্রম। তবে সাদা গোলাপও হয় …. বিভিন্ন রঙের গোলাপ হয়। এত জটিল আলগোরিদম ভগবান (নাস্তিকরা মাদার নেচার পড়বেন) সামলাতে পারেন নি, তাই সব গোলাপকেই গন্ধ দিয়ে দিয়েছেন।
যাই হোক গত কয়েক সপ্তাহে টুম্পা সোনা, টুনির মা এই সব ফালতু ব্যাপারে ভাটিয়ে অনেকের বিরাগের কারণ হয়েছি। তাই আজকের ভাটের টপিক বেশ সিরিয়াস…বই। আশা ভোঁসলে যদি গাইতেন, বইয়ের গন্ধ নেই, সে তো ভাবতেই পারি না, তা হলে তার একটা মানে থাকতো। যে কোনো বই, গন্ধগোকুল হতে বাধ্য। আরো মজার কথা,এই যে বই যত পুরোনো হয় গন্ধ ততই পরিবর্তিত হতে থাকে। তবে এই গন্ধ, পেপার ব্যাক না হার্ড কভার, নিউজ প্রিন্টে ছাপা না ভালো কাগজে, কোন প্রকাশনা, বই দেশী না বিদেশী তার উপর ডিপেন্ড করে। মানে আনন্দ আর দে’জ বই এর গন্ধ একটু আলাদা। নেপালের বই এর ম্যাদাগাস্কারের বই-এর গন্ধ আলাদা হতে বাধ্য।
বই এর এই যে গন্ধ, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। বই এর কাগজে থাকে লিগনিন নামের এক রাসায়নিক যৌগ যা ভ্যানিলিন গোত্রের কাছাকাছি, তাই পুরনো বই-এ ভ্যানিলা আইসক্রিমের গন্ধ পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। ধরুন আজ দুপুরে মাংস ভাত খেয়ে আপনার একটা আইস ক্রিম খেতে ইচ্ছে হচ্ছে…কিন্তু ক্যালোরি বা ব্লাড সুগার ইত্যাদি কারণে খেতে একটু গিলটি ফিলিং হচ্ছে। কুছ পরোয়া নেই…আলমারী থেকে বের করুন আপনার দাদুর কেনা বাহান্ন সালে প্রকাশিত সিগনেট প্রেসের বনলতা সেনের ফার্স্ট এডিশন। ভ্যানিলার গন্ধে ম ম করবে সে বই। তা ছাড়া এর সাথে যোগ হবে পার্সোনাল টাচ…ধরুন আপনার দাদু বা বাবা যে বইটা কিনেছিলেন, তিনি স্মোকার বা মা/ঠাকুরমা রান্না বান্না সেরে স্নান করে কিউটিকিরা পাউডার মেখে বইটা অলস দুপুরে উল্টে পাল্টে দেখেছেন তাহলে ঐ ভ্যানিলা, তামাক, কিউটিকিউরা পাউডার, হলুদ আর প্রায় সত্তর বছরের স্মৃতি মিলে যা অনির্বচনীয় গন্ধ বেরোবে তা শ্যানেল বা হারমেস এর বানাতে আরো দুশো বছর লাগবে।
ঘন্টা দুয়েক ধরে শুঁকতে থাকুন সে বই।মাঝে মাঝে পড়ুন ও ,না হলে লোকে কী বলবে।
6th December 2023
*********
সাবান-শ্যাম্পু নিয়ে আরেকটা (পুরনো পোস্ট)
সত্তর আশির দশকে জীবন খুবই আন-কমপ্লিকেটেড ছিল। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান (চার বছর পরে পরে বিশ্ব কাপ ফুটবল), উত্তম -সৌমিত্র, হেমন্ত-মান্না, কংগ্রেস-সিপিএম …মানে বলতে চাইছি, চয়েজ অনেক কম ছিল। বাথরুমেও তার প্রতিফলন দেখা যেত… চৌকো মত লাক্স বা লাইফবয় সাবান (শীতকালে ওভাল শেপের গ্লিসারিন সাবান), আর লম্বা মতন ক্লিনিক শ্যাম্পু।
ঝামেলা শুরু হলো সি কে প্রহ্লাদ বাবু ‘Fortune at the bottom of Pyramid’…লিখে ফেলায়। চেন্নাই-এর চিক শ্যাম্পু bottom of the pyramid এ ঢুকতে গিয়ে আম-জনতার জন্যে, ট্র্যাডিশনাল বোতল ছেড়ে সস্তায় শ্যাশেতে শ্যাম্পু বিক্রি করা শুরু করে। পরে অবশ্য অন্যান্য এফ এম সি জি কোম্পানিও একই পথে হাঁটা শুরু করে। সেই শ্যাশেতে একটা খাঁজ কাটা। উদ্দেশ্য -ওখানে টান মারলে ওটি খুলবেন। কিন্তু সাক্সেস রেট ছিল খুবই কম। আমি একবারই ট্রাই করেছি…মিনিট পনেরো ধস্তাধস্তি করে হাত থেকে স্লিপ করে কমোডে পড়ে তার সলিল সমাধি (ট্যেকনিকালি হয়তো ভুল শব্দ) হয়। হয়তো একটু অফ দ্য ট্রাক ,তাও বলে রাখি এই সব হাল আমলের প্যাকেট খোলায় আমি খুব একটা পারদর্শী নই ।
একবার গ্লোবে কী একটা সিনেমা দেখতে গিয়ে ইন্টারভ্যালে এক প্যাকেট লে’জ নিয়ে ঢুকেছি। মিনিট পনেরো টানা হ্যাঁচড়া করে পাশের দাদাকে (অচেনা অবশ্য) বললাম,”দাদা একটু খুলে দিন না “…এমন কটমট করে তাকালো যে রক্ত হিম হয়ে গেল। মিনিট দশেক পরে অন্য পাশের বৌদি কে সেই একই অনুরোধ জানালাম। “পাগল না কী!” বলে দু চারটে সিট ছেড়ে বসলেন। সেই প্যাকেট হাতে করে বাড়ি নিয়ে গিয়ে কাঁচি দিয়ে কেটে খেয়েছিলাম, সেটা আজও মনে আছে।
যাই হোক,আসল টপিকে ফিরে আসি…আজকাল চয়েজ বেড়ে গিয়ে, বাথরুমে ঢুকে দেখা যায় থরে থরে শিশি-বোতল। শাওয়ার জেল, হেয়ারজেল, শ্যাম্পু, ময়েসচেরাইজার…সবই বোতলে। তবে সুবিধে হলো সিলভার লাইনিং ও বলা যায় জিনিষগুলোর ইন্টার-চেঞ্জেবিলিটি খুবই ভালো। ধরুন আপনি, শাওয়ার জেল ভেবে একটু ময়েসচেরাইজার গায়ে মেখে নিলেন, বা শ্যাম্পু ভেবে মাথায় শাওয়ার জেল মেখে নিলেন…কিছুই ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না।
তবে এই রবিবার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। হাত থেকে শ্যাম্পুর বোতলটা পড়ে গেল। আমিও হাতড়ে হাতড়ে বাথরুমের মেঝে থেকে একটা বোতল তুলে মাথায় মাখলাম। গন্ধটা একটু অদ্ভুত লাগলো। নতুন কোনো ব্র্যান্ড ভেবে ইগনোর করলাম। স্নান করে বেরোতেই গিন্নি মাথাটা একটু শুঁকে মড়া কান্না জুড়লেন, “ওরে ডিলান (আমার ছেলে), তোর বাবা মাথায় ফিনাইল দিয়ে চান করে এসেছে”…ইত্যাদি প্রভৃতি।”
*******
Add comment