ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, পরী এবং বি ই কলেজ
নারায়ণ প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ১৯৬৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আমার ছোটোবেলায় মায়ের কাছে অনেক পরীর গল্প শুনেছি। নীল পরী, লাল পরী, প্রজাপতি পরী – নানান রূপের পরীর বিচিত্র সব অলৌকিক কাহিনী। কিন্তু পরে যখন কলকাতার ভিক্টোরিয়ার চূড়ায় পরী দেখলাম, সেটি আমার মনে বিশেষ একটি স্থান করে নিয়েছিলো। সেদিন বুঝতে পারিনি এই ভিক্টোরিয়ার চূড়ায় পরীর জন্যই কর্মজীবনে একদিন চিন্তার ভাঁজ পড়বে অনেক ইঞ্জিনিয়ারের কপালে।
তার আগে কিছু ভুমিকা দিয়ে রাখি।
১৯৬৫ সালে আমি তখন বিই কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়ি। সপ্তাহান্তে শনিবার বাড়ি এসে জানতে পারলাম যে পরের সপ্তাহে আমার পিসতুত দাদা অফিসের কাজে কলকাতায় আসছে। আর আমার হোস্টেলেও আসবে দেখা করতে। দাদা তখন বম্বেতে Explosives India র অফিসে উচ্চপদস্থ অধিকর্তা। প্রসঙ্গত বলে রাখি সে যাদবপুর থেকে পাশ করা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
এক শনিবার সকাল এগারোটায় হোস্টেলে এসে ও আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো পার্ক স্ট্রিটে। প্রচুর ঘোরাঘুরি এবং খাওয়া দাওয়া করে যখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর পাশ দিয়ে আমাদের ট্যাকসি যাচ্ছে তখন দাদা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো
“ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর আরকিটেক্ট এর নাম জানিস?”
আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে আছি দেখে দাদা উত্তর দিলো –
“উইলিয়াম এমারসন। একজন ব্রিটিশ আরকিটেক্ট।”
তারপরে আবার প্রশ্ন- “তুই জানিস এই পরী ঘোরে?”
এর উত্তর আমার জানা ছিল। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম, “জানি। যখন বিই কলেজে এডমিসন টেস্ট দিতে এসে সেই সময় বাবার সঙ্গে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালটা ঘুরে দেখেছিলাম। আর বিশাল উচ্চতায় সেই পরীর দিকে সেদিন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। অপূর্ব স্থাপত্যর নিদর্শন এই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।“
দাদা আবার প্রশ করলো, “আচ্ছা ভাই বলতো কিসের সাহায্যে পরী ঘুরছে?”
“মনে হয় মোটর আছে” আমি আন্দাজে বললাম।
– একদমই না। ওটা Wind speed এ ঘোরে। যদি প্রতি ঘন্টায় 15 km বা তার বেশি জোরে হাওয়া দেয় তাহলেই পরী ঘোরে”।
আমি খানিক বাদে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা দাদা পরীর ওজন কতো? ওতে কি কোনো ball bearing আছে যাতে পরী সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সহজেই ঘুরতে পারে?”
– পরী খুব ভারী। পরীর সঙ্গে একটা লম্বা shaft লাগানো আছে । shaft সমেত ওজন প্রায় পাঁচ টন। ওপরে এবং নিচে দুটো বল বিয়ারিং আছে। অবশ্য এই সব আমার এক মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুর কাছ থেকে শোনা। ওর সম্পর্কে এক দাদু মার্টিন কোম্পানি তে কাজ করতো। ওই কোম্পানি কনট্রাকটা পেয়েছিলো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরী করার। বন্ধুর বাবাও শিবপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
– আচ্ছা দাদা পরী কিসের তৈরী? এতো ভারী কেনো?
– এই পরী ব্রোঞ্জ এর তৈরী আর প্রায় ষোলো ফুট লম্বা।
আমার মনে অনেক প্রশ্ন তখন, “ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর উচ্চতা বোধ হয় দেড়শো দুশো ফুটের কাছাকাছি। এতো উচ্চতায় পরী দাঁড়িয়ে আছে lightning হলে তো খুব বিপদ।”
– হ্যাঁ, সেরকমই হওয়া উচিৎ, কিন্তু একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো যে এই পরীর জন্যই আজ পর্যন্ত বাজ পড়লেও ভিক্টোরিয়ার কোন ক্ষতি হয়নি। পরী নাকি lightning arrester হিসেবে কাজ করে।
– নিশ্চয়ই earthing এর ব্যবস্থা আছে।
– একটা পটে mercury রাখা আছে। Shaft এর নীচের শেষ প্রান্ত ওই mercury তে ডুবানো থাকে। তাছাড়া একটা লম্বা copper rod ওপর থেকে গ্রাউন্ড পর্যন্ত কানেকটেড।
আবার আমার মনে প্রশ্ন, “Mercury র কি ফাংশন?”
– এই mercury র কি ফাংশন আমি তোকে বলতে পারছিনা। তবে আমার যেটা মনে হয় নিচের ball bearing এর lubrication আর cooling একটা purpose হতে পারে। বাজ পড়লে তো বিয়ারিং গরম হয়ে যেতে পারে। আর একটা উদ্দেশ্য হতে পারে earthing, তবে আমি guess করে বলছি। তুই তোর প্রফেসরদের জিজ্ঞেস করতে পারিস।
কথা বলতে বলতে আমরা বি ই কলেজের গেটে ঢুকে পড়েছি। দাদা আমাকে হোস্টেলে নামিয়ে দিয়ে হাওড়া রামরাজাতলায় মামার বাড়িতে ফিরে গেলো।
এবারে আসল কাহিনী।
১৯৭৯ সালে CMERI তে নতুন চাকরি নিয়ে Machine Tools ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছি। একদিন ডিরেক্টর সাহেব Dr. সুশীল কুমার বসু ডিপার্টমেন্ট ভিজিট করতে এলেন। উনি বি ই কলেজের ১৯৫৩ সালের প্রাক্তনী, মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
সেদিন ওনার মুখে আবার ভিক্টোরিয়ার পরীর কথা শুনলাম। উনি জানালেন যে পরী ঘুরছে না। একদিকে হেলে গেছে, এ নাকি আগেও হয়েছে। ভিক্টোরিয়া কর্তৃপক্ষ সমস্যাটা অনুসন্ধান করার জন্য আমাদের কোম্পানিকে অনুরোধ করেছে।
ঠিক হলো আমার বস ডক্টর বিষ্ণু যাবেন, সঙ্গে একজন অভিজ্ঞ scientist, একজন ড্রাফটসম্যান, এবং একজন টেকনিশিয়ান যাবেন। যতদূর মনে আছে দু’তিনটে ভিজিট হয়েছিলো। investigation থেকে জানা গেলো যে mercury এবং কপার রড মিসিং ছিলো। হয়তো সেগুলি চুরি হয়ে গেছে। ফলে নিচের বিয়ারিং সিজ হয়ে যায়।
যে টেকনিক্যাল টিম গিয়েছিলো তাদের মতে industry র সাহায্য ছাড়া এটা ঠিক করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এই স্মৃতিসৌধ এর ডোম না ভেঙ্গে ওপরের বিয়ারিংও চেক করা যাবে না। এই সব কারণে CMERI কাজটা নিয়ে আর এগোতে পারেনি।
এর কয়েকমাস বাদে ভিক্টোরিয়া কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের একটা expert কমিটি তৈরি করে যেখানে ছিলেন যাদবপুর মেকানিকাল ডিপার্টমেন্ট এর প্রফেসর মধুসূদন ভট্টাচার্য, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার অরূপ মুখার্জি এবং আরকিটেক্ট কে এন পাঠক। দশ হাজার টাকার পুরস্কারও ঘোষনা করা হয়েছিলো। অবশেষে Jessop Engineering Works এবং এই কমিটির যৌথ উদ্যোগে এই সমস্যার সমাধান হয়। ডোম ভেঙ্গে ওপরের বিয়ারিং রিপেয়ারিং করতে হয়েছিলো বলেই শুনেছিলাম।
পরিশেষে একজন মানুষের কথা না বললে এই লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই মানুষটিকে সম্মান জানাতে তাঁর একটি সুন্দর প্রস্তর মুর্তি এখন শোভা পাচ্ছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর গার্ডেনে। তাঁকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের রূপকার বলা হয়। মূল নকশার কিছু পরিবর্তন ওনারই মস্তিষ্ক প্রসূত। আজও যখনই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর পাশ দিয়ে যাই এই অপূর্ব স্থাপত্য এর পেছনে স্যার রাজেন্দ্র নাথ মুখার্জির অবদানের কথা মনে পড়ে যায়।
বর্তমান IIEST তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে যাত্রা শুরু করেছে। স্যার রাজেন্দ্র নাথ ওখানে তিনটে বছর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন। আমাদের দেশের শিল্পের প্রসারে এই মহান ব্যক্তির কর্মকান্ডর কথা ভাবলে বি ই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে অবশ্যই গর্ব বোধ হয়।
*******
Add comment