ডাইরীর পাতা…
রঞ্জন চক্রবর্তী, ১৯৮০ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
এটা পুরোন এবং ২০১৯ সালে আমার প্রথম প্রকাশিত বইয়ে ছিল।
ষষ্ঠীর যষ্ঠি
দুর্গাপুজো যে এসে গেল ভোরের ঝলমলে আকাশ দেখেই তার কিছুটা বোঝা গেল। আমেরিকাতে বসে এর থেকে বেশি কিছু তো বোঝার নেই। মাঠে প্যান্ডেল বলে কোন কিছু নেই। ভীড় নেই। মেলা নেই। পুলিসের তদ্বির নেই। শারদীয়া সংখ্যা নেই। নতুন সুরে গান বাজবে মাইকে তাও নেই। আর সেই লিষ্টে অফিসের ছুটিও নেই। তাই মনকে প্রফুল্ল রেখে রোজকারের মত ভোর ছ’টায় অফিসের পথে পা বাড়ানোর জন্য তৈরী হলাম। প্রসঙ্গত বলে রাখি আমার বাড়ি নিউ জার্সির প্রিন্স্টন শহরের কাছে ওয়েষ্ট-উইন্ডসরে আর বাড়ি থেকে অফিস প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে নিউ জার্সিরই আরো উত্তরে জার্সি সিটিতে। যাতায়াত করি ট্রেনে। আমার শহর থেকে নেওয়ার্ক স্টেশন অবধি এক্সপ্রেস ট্রেন। সময় লাগে আধ ঘন্টা আর তারপর নেওয়ার্ক থেকে “পাথ” ট্রেনে বাকিটা মিনিট দশেক। পথের অর্ধেকাংশ মাটির ওপর দিয়ে যায় আর বাকি অর্ধেক মাটির নীচে দিয়ে।
ষষ্ঠীর সকালে অন্য দিনের মতই যথারীতি ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে তৈরী হয়ে ঘুম ঘুম চোখেই বেরিয়ে পড়লাম ট্রেনের উদ্দেশে। এক একটা দিন ঘুমটা যেন একটু বেশিই পায়। সেদিনও তাই। মনে মনে ভাবছিলাম কলকাতায় থাকলে এই কটা দিন ছুটি নিয়ে একটু আয়েস করতাম। হয়ত একটু দেরীতে ঘুম থেকে উঠে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে টিভিতে পুজোর প্যান্ডেল পরিক্রমা দেখতাম। আর তারপর একটা শারদীয়া টেনে নিয়ে প্রিয় লেখকের উপন্যাসটা পড়তে শুরু করতাম। কিন্তু তার বদলে ছুটতে হচ্ছে অফিসে। যাই হোক, এক্সপ্রেস ট্রেনে একটা কামরা নির্দিষ্ট থাকে যেখানে কথা বলা, জোরে গান শোনা ইত্যাদি বন্ধ। সেখানে সেই নিঃশব্দতার মাঝে বেশ মৌজ করে ঢুলতে শুরু করেছিলাম। ইতিমধ্যে কখন যে নেওয়ার্ক চলে এল বুঝতেই পারলামনা। কোনক্রমে নিজেকে টেনে তুলে যন্ত্রের মত বেরিয়ে এলাম ট্রেন থেকে। তারপর গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম সেই “পাথ” ট্রেন ধরব বলে। “পাথ” কথাটা এসেছে ট্রেন সংস্থার ইংরাজি নাম “পোর্ট অথরিটি ট্রান্স হাডসন” থেকে। এই পাথ ট্রেনকে মাঝে মাঝে বড় নির্দয় মনে হয়। ট্রেনটা ছাড়ে নেওয়ার্ক থেকেই তবে ট্রেনের বিশেষত্ব হল এর দরজা নেওয়ার্ক ষ্টেশনে দুপাশের প্ল্যাটফর্মের দুদিকেই খোলে এক এক করে। ফলে যে দিকটা আগে খোলে, যাত্রীরা সেই দিক দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে আগেভাগেই সব সীট দখল করে নেয়। যেদিনই আমার সীটে বসার উৎসাহ বা উদ্দীপনা বেশি থাকে, সেদিনই দেখি আগে উল্টো দিকের দরজাটা খুলে যায়। ফলে বসার সুযোগ হয়েই ওঠেনা। আর আমেরিকা যতই সভ্য দেশ হোক এই ট্রেনে বসার জন্য সবাই একেবারে হামলে পড়ে। মনে হয় সবাই হয়ত সকালে ঘুমের জন্য একটা যুতসুই জায়গা খোঁজে। বিশেষ করে আজকের মত দিনে যেদিন চোখ থেকে ঘুম একেবারে যেতেই চায়না। তবে আমাদের মত লোকেরা যারা নেওয়ার্ক থেকে উঠি তারা যদিবা ভাগ্যক্রমে বসার জায়গা পাই, যারা পরের ষ্টেশন হ্যারিসন থেকে ওঠে তাদের বসতে পাওয়া আর ভগবানের দেখা পাওয়া একই ব্যাপার। তবে আজ দেখলাম মা দুর্গার কৃপায় ঠিক সময়েই প্ল্যাটফর্মে ট্রেন এসে গেল আর একটা বন্ধ দরজার সামনে এমন একটা কায়দা করে দাঁড়ালাম যাতে দরজাটা যদি আমার দিকে খোলে, তাহলে একটা সীট অন্ততঃ আমার কপালে জুটবেই মনে হল। হলও তাই। আমার তাৎক্ষণিক বুদ্ধি এবং তৎপরতায় বসতে জায়গা পেলাম। মনে মনে বললাম, “আজ কি কপাল করে বেরিয়েছি!”
অন্য সময় সীটে বসে হয়ত পকেট থেকে ফোনটা বের করে বন্ধুদের দু-একটা হোয়াটস্যাপের উত্তর দেওয়া, একটু আধটু খবর দেখা ইত্যাদিতে সময় কাটাই কিন্তু আজ মনে হল নাঃ, ঘুম ঘুম ভাবটা আবার নিয়ে আসি তাহলে আরো দশ মিনিট অন্ততঃ নিদ্রাদেবীর কোলেই থাকা যাবে। সেই মত চোখ বুঁজে ফেললাম। হ্যারিসন ষ্টেশন নেওয়ার্কের একেবারে গায়ে গায়ে লাগান। ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তের মধ্যে চলে এল। সেই ষ্টেশনে কয়েকজন উঠল। চোখ বন্ধ রেখেও মনে মনে উপলব্ধি করতে পারলাম। তাদের কারুর বসার জন্য সীট পাওয়া যে ভাগ্যে নেই সেই বিষয়ে আমি একেবারে নিশ্চিত। মনে মনে একটা মুচকি হাসি এনে নিদ্রাদেবীর কোলে আবার নিজেকে পরের দশ মিনিটের জন্য সঁপে দিতে যাব এমন সময়ে মনে হল আমার সামনে কেউ একজন ট্রেনের একটা রড ধরে দাঁড়িয়ে। মনে হল চোখ খুলে দেখব? পরের মুহূর্তেই মনে হল না, থাক। চোখ খুলে কাজ কি? শুধু শুধু ঘুমের বারটা। কিন্তু থাকা গেলনা। কিসের তাড়নায় মনে হল কোন ভদ্রমহিলা যদি হন আর তিনি যদি গর্ভবতী হন, তাহলে উঠে দাঁড়ান উচিৎ। ভগবানকে জপতে জপতে চোখটা একটু ফাঁক করতেই প্রমাদ গুনলাম। দেখি এক মাঝবয়সি মহিলা হাতে একটা লাঠি নিয়ে সটান আমারি সীটের সামনে দাঁড়িয়ে। মনে হল পায়ে বা হাঁটুতে সাময়িক কিছু হয়েছে বলেই লাঠির ব্যবস্থা। অগত্যা নিজের ঘুমের বলিদান দিয়ে উঠে দাঁড়ানই ঠিক মনে করলাম এবং মহিলাকে বসতে অনুরোধ করলাম। মহিলা যেন সীটটা তার প্রাপ্য সেই হিসেবে বসে পড়লেন। মুখে একটু হাসিও ছিলনা, সাধারণতঃ কৃতজ্ঞতা বশতঃ যা থেকে থাকে। আর কোন উপায় না দেখে আমি তখন পাশে দাঁড়িয়ে সেই যত্নের ফোনটিকে পকেট থেকে বার করে বন্ধুদের পাঠান মেসেজ দেখতে শুরু করলাম।
মনে হল ষষ্ঠীর শুরুটা ভালয় ভালয় হলেও একটু পরেই সেটা কেমন করে যেন কেঁচিয়ে গেল। মিনিট দুয়েক যেতে না যেতেই হঠাৎ মহিলার দিকে চোখ পড়ল আবার। মহিলাও তখন তার ফোনটি বার করে দেখলাম কাকে এস.এম.এস করছে। অন্য সময় আমি চোখ ঘুরিয়ে নিই কিন্তু আজ কি কারণে মহিলার ফোনের দিকে চোখ চলে গেল। অনধিকার চর্চা হলেও মনে হল দেখি তো কি লিখছে মহিলা। আর দেখেই আমার প্রচন্ড রাগ হল। মনে হল ঘাড় ধরে মহিলাকে সীট থেকে উঠিয়ে দিই, না না, ট্রেন থেকেই নামিয়েই দিই আর নিজে বসে পড়ি সেই সীটে, যেটা আমারই ছিল আর আমি ভদ্রতা বা দয়া না দেখালে সেই মহিলা কোনমতেই সেখানে বসতে পেত না। দেখলাম মহিলা মেসেজে লিখছে, “তুই ঠিকই বলেছিলি। আমি ট্রেনের কামরায় উঠতেই আমার হাতে লাঠি দেখে একটা লোক সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে আমায় বসতে বলল। তোর প্ল্যান যে এত সুন্দর ভাবে কাজ করবে ভাবতেও পারিনি। তাই খুব হাসি পেলেও মুখটা গম্ভীর করে রাখতে হয়েছিল। একটা লাঠি সঙ্গে থাকার কি জোর! আমি এতদিন যাতায়াত করছি এই ট্রেনে কিন্তু এই সময়ে বসতে জায়গা পেলাম জীবনে এই প্রথম। এরপর এই লাঠিই আমার চিরসঙ্গী হয়ে রইল।” এইসব দেখে অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করল কিন্তু বলতে পারলাম কই কারন মহিলা ওর ফোনে কি লিখছে সেটা আমার দেখা উচিৎ না। তাই কিল খেয়ে কিল হজম করে নিলাম।
মিনিট দশেক পরে আমার ষ্টেশন আসতে আমি নেমে গেলাম আর মা দুর্গাকে মনে মনে বললাম, “মাগো, আমার পুণ্যটা দেখ আর আজকের পুজোর দিনে মহিলার এই পাপটা মনে রেখ না। ক্ষমার চোখেই দেখ।”
16th October 2022
সপ্তমীর পাঁঠা
সুরেন্দ্রবাবুর বাড়িতে দুর্গাপুজোর নবমীর দিন পাঁঠার মাংস রান্নাটা একরকম নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কয়েকবছর আগে অবধি বাড়িতে তার দুই ছেলে, এবং তাদের সংসার নিয়ে খুব হৈচৈ হত পুজোর কটা দিন। গত বছর দুয়েক ধরে অবশ্য সব ওলটপালট হয়ে গেছে। বড় ছেলে চাকরি নিয়ে চলে গেল চেন্নাই আর ছোট ছেলে গেল দুবাই তাই ওরা কেউই পুজোর সময় ছুটি নিয়ে আসতে পারেনা। সুরেন্দ্রবাবুর অবশ্য ধারণা ওরা আর আসতে চায়না তাই আসেনা। সে যাই হোক, এখন সংসার বলতে সুরেন আর তার স্ত্রী কাবেরী। তা বলে এত বছরের নিয়মের তো হেরফের হবে না।
তবে এবছরে মহানবমী মঙ্গলবারে পড়ে গিয়ে একটু বেকায়দায় পড়ে গেছে সুরেন। গত বছর দুয়েক থেকে মঙ্গলচন্ডীর ব্রত রাখা শুরু করেছে কাবেরী এবং প্রতি মঙ্গলবার বাড়িতে পুজো আর্চা তো থাকেই তার সঙ্গে থাকে নিরামিষ রান্না খাওয়া। বাড়িতে সেদিন মাছ, মাংস ঢোকেই না। এদিকে ষষ্ঠী আর অষ্টমীতেও সকালে কাবেরীর উপোস থাকে আর রাতে নিরামিষ খাওয়া থাকে। সুরেন তাই মনে মনে ঠিক করেছিল এবারে সপ্তমীর দিন রবিবারেই ওর মাংস খাওয়ার সাধটা মেটাবে। কাবেরীকে বলে রাজিও করে নিয়েছিল। শুধু একটাই গন্ডগোল পাড়ায় নতুন আসা চ্যাংড়া বয়সের জয়ন্তর সঙ্গে প্রতি রবিবার মাংস কিনতে যাওয়া নিয়ে ওর সঙ্গে সুরেনের কম্পিটিশন লেগে থাকে। এর আগে বেশ কয়েকবার রবিবারে মাংস কিনতে গিয়ে হয় একেবারেই পায়নি নয়ত মনের মত মাংস পায়নি। সুরেনের পছন্দ সামনের “রান” বা পায়ের মাংস আর জয়ন্তরও তাই। গত কয়েকবারে পাড়ার একমাত্র দোকানে গিয়ে হুসেনকে আব্দারের কথা বলাতে ও বলেছিল “ওটা দিতে পারবনা। জয়ন্ত্ বাবু আগে থিকে বোলে গিয়েছেন”। ভীষণ রাগ হয়েছিল শুনে। কত সকালে মানুষ বাজারে যায় মাংস কিনতে যে আগে থেকে বলে রেখেছে?
সুরেন মনে মনে একটা স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে ভাবল এবারে সকাল সাতটার মধ্যে হুসেনের মাংসর দোকানে পৌঁছতেই হবে। মনকে বোঝালো যে সকালে ওঠা ওর পক্ষে খুবই কষ্টকর হলেও নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য এটুকু ঘুমের বিসর্জন ওকে দিতেই হবে। তাই রবিবার সকালের আয়েসটা চুলোয় দিয়ে বাজারের থলে নিয়ে সকাল সকাল মাংসর দোকানে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু অত সকালে পৌঁছেও এ কী দেখল? ঐ জয়ন্তটা তার আগেই পৌঁছে গেছে আবার! শুধু তাই নয়, দেখল দোকানে সুরেনের প্রিয় মাংস মানে ঐ পাঁঠার একটাই ঠ্যাং ঝোলানো আছে। একটুও সময় নষ্ট না করে সুরেন তাড়াতাড়ি বলল
— বাবা হুসেন, ঐ ঠ্যাংটা আমার জন্য এখনই রেখে দাও তো
— হোবেনা বাবু। ওটা জয়ন্ত্ বাবু আগেই বলে রেখেছেন
ধুত্তোর, নিকুচি করেছে তোমার জয়ন্ত্ বাবুর, বলে মনে মনে গাল দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন
— তোমার কাছে আরো মাংস আছে?
— না, এই পুজোর বাজারে আর সাপ্লাই আসেনি
শুনে হঠাৎ মাথায় রক্ত চড়ে গেল সুরেনের। জীবন যুদ্ধে এইভাবে বারবার হেরে যাবেন তিনি? তাও আবার একই লোকের কাছে? এ হতে পারেনা। ইতিমধ্যে হুসেন দড়িতে ঝোলানো মাংসের ঠ্যাংটা নাবিয়ে নিচে রাখতেই সুরেন তাড়াহুড়ো করে ছোঁ মেরে মাংসটাকে নিজের দখলে আনার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জয়ন্তই বা ছেড়ে কথা বলবে কেন? সেও এক দৌড়ে অন্যদিক থেকে ঠ্যাংটা ধরে টানতে লাগল। এভাবে দুই পরিণত বয়স্ক মানুষের মধ্যে শুরু হয়ে গেল পাঁঠার ঠ্যাং নিয়ে টাগ অফ ওয়ার। বাকি জনতা হাঁ করে দেখছে এদের কান্ড। দুজন মানুষের মধ্যে এরকম ভায়োলেন্ট কান্ড দেখে হুসেনের হাতের ছুরির কোপও মাঝপথে যেন স্থিরচিত্র হয়ে গেছে।
এরকম কতক্ষণ চলেছিল জানা নেই তবে হুঁশ ফিরে এল যখন কাবেরীর এক ধাক্কায় বিছানা থেকে প্রায় পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল সুরেন।
— এই ভোরে আমার হাত নিয়ে কী টানাটানি শুরু করলে বল তো?
বৌয়ের কটু কথা কটা শুনে সুরেন এবারে সম্বিত ফিরে পেল। এতক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখছিল তাহলে এই ভোর সকালে। কাবেরীর চোখ এড়িয়ে এক হাত জিব কেটে চোখ বুঁজে আবার পাশ ফিরে শুল। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল ছি, ছি বৌয়ের হাতটাকে পাঁঠার ঠ্যাং ভাবল শেষকালে।
30th October 2023
বিজয়া দশমী
বিজয়া দশমীতে বাবার সঙ্গে এবারে আর মুখোমুখি আলোচনা নয়, প্রথমে কথা কাটাকাটি থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত ঝগড়াতে গিয়ে দাঁড়াল। বাবা কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না যুগের পরিবর্তন হয়ে গেছে।
শুরুটা হয়েছিল এইভাবে।
— কি রে, দশমীর রাত শেষ হতে চলল আমাদের বাড়িতে এখনো কেউ বিজয়া করতে এল না তো?
— কে আবার আসবে?
— মানে? আগে পাড়ার ছোট, বড় কত ছেলে মেয়েরা আসত। এসে প্রণাম করত। আমার কিছু বন্ধুরাও আসত, তারা সব কোথায়?
— বাবা, কী যে বল? ওসবের দিন শেষ। কবে উঠে গেছে সে প্রথা।
— তুই বললেই হবে?
— আমাকে কিছু বলতে হবে না। এর প্রমাণ আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব। এই দেখ।
বাবাকে আমার ফোনের স্ক্রীনের ডিসপ্লে দেখাতে গেলাম। বাবা প্রায় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন
— ওটা আবার কী দেখাচ্ছিস?
— কত ফোন এসেছে দেখ। আর সেই থেকে কতজন আমাকে, আমাদের বিজয়ার শুভেচ্ছা জানিয়েছে জান?
— ফোনে? আর কোলাকুলি?
— ধুর, ওসব ফালতু হয়ে গেছে
— হিংসা, বিদ্বেষ, বচসা ভুলে মানুষ মানুষকে কাছে টেনে নেবে, শুভেচ্ছা বিনিময় করবে তাকে তুই ফালতু বলে উড়িয়ে দিবি?
— সেটা তো ফোনের স্ক্রীনেই হয়ে যাচ্ছে। ভার্চুয়ালি।
— আলিঙ্গনের কোন দাম নেই? শরীরের স্পর্শের কোন ভালো লাগা নেই? সেটা বুঝতে না পারলে তো হয়েই গেল তোর সঙ্গে কোন কথাই বলা যাবে না আর।
মনে হল বাবা যেন রাগ করে এবারে মুখ ফেরালেন। আমিও জুৎসুই কোন যুক্তি দিতে পারছিলাম না। মনে পড়ে গেল ছোট বেলায় স্কুলে পড়ার সময় পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনর আগে দিদি একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল
— বাবা, ভাই যদি এবার পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়, তাহলে ভাইকে কী দেবে?
বাবাকে বেশিক্ষন ভাবতে হয়নি, বলেছিলেন
— ওকে জড়িয়ে ধরব।
সেই মুহূর্ত আর আলিঙ্গনের ছোঁওয়ার রেশ যে আমার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনো দৌড়চ্ছে। সেই দৃশ্যর দিকে মনে মনে ফিরে তাকালেই কত অণুপ্রেরনা পাই আজও। তাই বাবার কথাকে ফেলতে পারলাম না। কী বলব যখন ভাবছি তখন বাবা আবার বললেন,
— আর তোর মা যে এত ঘুগনি আর নারকোল নাড়ু করে রেখেছে তার কী হবে?
— মা কিছুই করেননি। যুগ পাল্টে গেছে। এখন কেউই আর কিছু করেনা।
— তুই রান্নাঘরে দেখে আয়
আমি তড়িঘড়ি রান্নাঘরে যেতেই মা হেসে আমাকে করে রাখা খাবার দেখালেন। ঠিক যেমনটি বাবা বলেছিলেন। কথা না বাড়িয়ে মাকে প্রণাম করে বললাম একটা বাটিতে দুটো নাড়ু দাও তো। মা আমার গালে চুমো খেয়ে আশীর্বাদ করে বললেন
— ঘুগনি খাবি না? তুই বোস, আমি তোকে সাজিয়ে দিচ্ছি।
— আগে তুমি দাও তো। আমি আবার ফিরে আসছি।
জোর করে মা’র হাত থেকে নাড়ু দুটো নিয়ে ফিরে গেলাম বাবার কাছে। ফ্রেমের ছবিতে বাবাকে প্রণাম করে বললাম
— তুমি ঠিকই বলেছ, এই নাও, খাও।
বাবা যেন মুচকি হেসে বলতে চাইলেন। তোরা বদলে যেতে পারিস কিন্তু আমরা সেই একই আছি রে।
মনে মনে বললাম
— কোথায় একই আছ? তাহলে সেই প্রশস্ত বুকের ছোঁওয়া কোথায়? কোথায় সেই বলিষ্ঠ হাতের কাছে টেনে নেওয়া আদর?
7th September 2022
বিজয়ার খোলা চিঠি
আজ আবার অনেকদিন পরে বাবার মুখোমুখি বসলাম। বসলাম মানে বসতে হল আর কি। বাবা জিজ্ঞেস করলেন “কি রে, ঠাকুর বিসর্জন হয়ে গেল, ঢাকের বাদ্যিও থেমে গেল। বিজয়ার প্রণাম শুভেচ্ছা জানিয়ে সবাইকে চিঠি লিখবি না?”
বললাম “ও সব এখন পুরোন, অচল হয়ে গেছে”।
— সে কি রে?
— হ্যাঁ, খবর তো রাখ না। এখন সবাই সামাজিকভাবে “ফিট” হতে চায়।
— শারীরিক ফিটনেস শুনেছি। সামাজিক “ফিট”-টা কী?
— আমিই বানিয়েছি। ইংরিজি কথা দিয়ে। FIT মানে ফেসবুক, ইন্স্ট্যাগ্রাম, টুইটার – এইসব। এখন আবার যোগ হয়েছে হোয়াটস্যাপ।
— সেগুলো কী
— ও অনেক কথা। পরে হবে না হয়। এখন যত শুভেচ্ছা, ভালোবাসা সব কিছুর আদান প্রদান হবে ফোনে তবে কথা বলে নয়, লিখে।
— ফোনে তো কথা বলে। লেখে কী করে? আর সেগুলো কি চিঠির মত যাদের উদ্দেশ্যে লেখা, তাদের কাছেই পৌঁছে যায়?
— আজকাল ফোনে লেখা যায়। বাবা, লেখাটা ঠিক আছে কিন্তু মাধ্যমটা বদলে গেছে। তবে যে কোন মানুষকেই লেখা যায় কিন্তু আজকাল সবাই চায় পৃথিবীর সবাই জানুক তাদের কথা।
— সে কী রে? আমাদের বাড়ির কথা সবাই জেনে যাবে?
— তাই তো হচ্ছে। অন্যদের বাড়ির খবর, হাঁড়ির খবর জানতে পেরে কেমন যেন মনে হয় আমারও সব খবর জানিয়ে দিই।
— এ তো অদ্ভূত ঝামেলা। তা লিখে সব খবরাখবর কুশল সংবাদ নেয়া যায়?
— হ্যাঁ, তা যায় বৈকি
— কী জানি! কিন্তু সেই হাতের ছোঁওয়া তো নেই। পোস্ট অফিসের পিওনের বাড়ি বয়ে দেয়া হাতের লেখা চিঠির গোছা পাওয়া। তার মজাই আলাদা ছিল। কত যত্ন করে আমরাও লিখতাম।
— তা আর জানিনা? তোমার মুক্তোর মত হাতের লেখা! সেই লেখা নকল করেই তো আমি আমার হাতের লেখার উন্নতি করেছিলাম। তবে কবে সবচেয়ে মজা পেয়েছিলাম জান? যেদিন একটা পুরোন পোস্টকার্ড হাতে পেলাম। তাতে তোমার ঝকঝকে হাতের লেখায় বিজয়ার স্নেহ ভালোবাসা মোড়া কথাগুলো পড়লাম।
কথা কটা শুনে বাবা হঠাৎ মুচকি হাসি হাসল। বলল
— ওটা তোর হাতে কী করে গেল সেদিন?
— কী জানি। পুরোন বাক্সে কিছু খুঁজতে গিয়ে বোধহয় হাতে এসে গিয়েছিল। প্রথমে বুঝতেই পারিনি কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা কারণ নামের জায়গায় শুধু দুটো ইংরিজি অক্ষর। মানে যাকে বলে “ইনিশিয়াল”, তাই ছিল। তখন তো জানতাম না মাকে তুমি নাম ধরে না লিখে ঐরকম ভাবেই চিঠিতে সম্বোধন করতে।
বাবা কিরকম লজ্জা পেল যেন। হঠাৎ সামনের দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর পড়তে দেখি বেলা বেড়ে যাচ্ছে। বললাম,
— যাই, এবারকার পুজোয় কাটানো সময়ে বাড়ির কয়েকটা ছবি দিয়ে তাড়াতাড়ি ফেসবুকে সবাইকে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে দিই।
ছবির ফ্রেমের ভেতর থেকে বাবা যেন খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলতে চাইল
— দেখিস, আমার পোস্টকার্ডের ছবিটা যেন সবাইকে দেখাস না। তোদের মত আমি কিন্তু চাইবনা আমার বাড়ির কথা আর সবাই জানুক। ছবিতে বাবাকে বিজয়ার প্রণাম জানিয়ে মনে মনে বললাম “তোমার মনের কথা আমি আমার কাছেই জমা রাখলাম, একান্তে, মনের মণিকোঠায়। পোষ্টকার্ডের স্মৃতির মোড়কে”।
রঞ্জন
৭ই সেপ্টেম্বর ২০২২
*******
Add comment