ইতিহাস যেখানে নীরব (ধারাবাহিক চতুর্থ পর্ব)
@দেবাশীষ তেওয়ারী, ১৯৬৯ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
তাল বেতালকে ছেড়ে চন্দ্র যখন জঙ্গল থেকে প্রাসাদে ফিরে এল তখন পূর্ব দিকে ভোরের লাল আভা ফুটে উঠেছে। সারা রাত জেগে কেটেছে, এখন নরম বিছানা তাকে হাতছানি দিচ্ছে শরীর এলিয়ে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু চন্দ্রের আর শোওয়া হলোনা। রাত থেকেই প্রধান সহকারী অংশুমান এসে অপেক্ষা করছে, মথুরা থেকে জরুরী বার্তা নিয়ে কপোতদূত এসেছে, খবর খুবই খারাপ।
মহামন্ত্রী কাত্যায়ন লিখেছেন, সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী শকদের হাতে হঠাৎ বন্দী হয়ে পড়েছেন, চন্দ্রর হাতেই এখন সাম্রাজ্যের ভালোমন্দ নির্ভর করছে। পত্র পাওয়া মাত্র যেন সে মথুরায় চলে আসে। সে এলেই পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করা যাবে।
মন্ত্রণা কক্ষে মাত্র তিনজন, চন্দ্র, কাত্যায়ন আর সেনাপতি দেবদত্ত। দেবদত্ত চন্দ্রকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্যক অবহিত করালো। সে জানালো রুদ্রসিংহ মথুরা আক্রমণ করবে বলে বেশ কিছুদিন ধরে চুপিসারে সেনা সাজাচ্ছিল। ত্রিগর্ত অভিযানে বেরিয়ে অগ্রবর্তী হাজার দশেক সেনা নিয়ে সম্রাট যখন গিরিপথ দিয়ে পর্বত পেরিয়ে যান, তারপরেই শকেরা গিরিপথের দখল নিয়ে নেয়। ফলে সম্রাট তাঁর মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, তারা পর্বতের বিপরীত দিকে আটকে থাকে। সম্রাট অবশ্য ঠিক বন্দী হয়ে নেই, তবে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ।
এই পর্যন্ত শুনে অবাক হয়ে চন্দ্র প্রশ্ন করল, ‘এটা কি করে সম্ভব হল? এ তো অতি নির্বোধের মত কাজ হয়েছে। আপনাদের মত দুজন এত অভিজ্ঞ সহকারী থাকতে সম্রাটকে পুরোবর্তী বাহিনীর সঙ্গে যেতে দিলেন? কে না জানে সামনের সেনাদের অনেক সময়েই অজানা বিপদের সামনা করতে হয়। নাঃ, এটা আপনাদের ঠিক কাজ হয়নি মোটেই।’
বহুদর্শী কাত্যায়ন চুপ করে থাকলেও দেবদত্ত কিন্তু বলে উঠলেন, ‘যুবরাজ, আপনি তো জানেন যে সম্রাট নিজের কয়েকজন বয়স্য ছাড়া কারুর সঙ্গে পরামর্শ করেন না, কারুর শলা তাঁর মনে ধরে না। শুনেছি তিনি যে বিরাট বীর তা দেখাতেই এই ঝুঁকি নিয়েছিলেন।’
‘সে যাই হোক, এখন সম্রাটকে অবরোধ মুক্ত করতে হবে। শকদের সঙ্গে কি যোগাযোগ হয়েছে?’
‘হাঁ, শকেরা অবরোধ তুলে নেবার একটা শর্ত দিয়েছে বটে, কিন্তু খুবই অপমানজনক সেই শর্ত। শর্তটি হল়, সম্রাজ্ঞী সুতনুকাকে রুদ্রসিংহের হাতে তুলে দিতে হবে।’
চন্দ্র এমনিতে ঠাণ্ডা মাথার লোক, কিন্তু এই কথা শুনে সে একেবারে লাফিয়ে উঠল। মন্ত্রী ও সেনাপতি অবাক হয়ে দেখল, চন্দ্রের মুখ লাল হয়ে উঠেছে, রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে খুব ধীরে ধীরে কেটে কেটে বলল, ‘কি? গুপ্ত সম্রাজ্ঞীকে চাই? হাঃ হাঃ হাঃ, রুদ্রসিংহ, তুমি কি জান তোমার এই ঔদ্ধত্য তোমার মৃত্যুকে ডেকে এনেছে, সে দুয়ারে এসে গেছে, এবার আর তোমার পরিত্রাণ নেই।’
বেশ কিছুক্ষণ আলোচনার পর ঠিক হল, সব আগে সম্রাটের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে, পরে শকদের আক্রমণ। তাই প্রথমে চন্দ্র তার নিজস্ব দুশো মত বাছাইকরা সৈন্য নিয়ে অন্ধকারের সুযোগে আজ রাতেই পাহাড় পেরিয়ে সম্রাটের সঙ্গে মিলিত হবার চেষ্টা করবে। কাল দেবদত্ত আক্রমণ করবে গিরিপথ দিয়ে।
চন্দ্ররা জানেনা, কিন্তু ঘটনা হল, নিজের নির্বুদ্ধিতায় শকদের হাতে প্রায় বন্দী হবার পরে রামগুপ্তর সব সাহস কর্পূরের মত উবে গেছে। তিনি এখন ভুলে গেছেন নিজেই সবার উপদেশ অগ্রাহ্য করে এই অভিযান করেছিলেন, তার ওপর কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই রাণীর কাছে বাহাদুরী দেখাতে অগ্রবর্তী বাহিনীর নেতৃত্ব দিতে গেছেন। এখন নিজের বোকামিতে বিপদে পড়ে তিনি যেমন করে হোক পরিত্রাণ পেতে চাইছেন, সবকিছুর জন্যে দোষী ঠাউরেছেন রাণীকে যে বেচারা এসব কিছুই জানেনা। তাঁর চিন্তাধারা এখন নতুন খাতে বইতে সুরু করেছে। সৌনকের মত বয়স্যরাও তাঁর এই ভাবনায় ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে। অবশেষে রামগুপ্ত সিদ্ধান্ত নিলেন সম্রাটের নিরাপত্তা সবচেয়ে আগে, এবং তার জন্য যদি সম্রাজ্ঞীকে শত্রু হাতে তুলে দিতে হয় তাই সই, তাতে সম্রাটের সম্মানের হয়তো কিছটাু হানি হবে, কিন্তু প্রাণটা তো বাঁচবে। একবার ছাড়া পেলে তখন দেখে নেয়া যাবে শকদের। রুদ্রসিংহকে খবর পাঠানো হল সম্রাট তার শর্তে রাজী আছেন।
এত সহজে গুপ্তরা তাদের সম্রাজ্ঞীকে সমর্পণ করতে রাজী হয়ে যাবে রুদ্রসিংহ মোটেই ভাবেনি। সুতনুকার সঙ্গে তারই তো বিয়ের কথা ছিল, কিন্তু তার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছিল গুপ্তরা, রুদ্রসিংহ তা কি সহজে ভুলতে পারে? তাই গুপ্তদের আরও অপমান করার জন্যে সে ঠিক করল পার্বতীপুরার প্রধান তোরণদ্বারে সর্বসমক্ষে গুপ্তসম্রাজ্ঞীকে সমর্পণ করার অনুষ্ঠান করতে হবে, সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে সম্রাজ্ঞীকে সমর্পণ করতে আসতে হবে তাদের এক প্রধান সেনাপতিকে। তার সঙ্গে থাকবে কিছু সশস্ত্র সেনাও। তারাও সবাই এই অনুষ্ঠানে তাদের অস্ত্র সমর্পন করবে। এই অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠান প্রাথমিক শর্তের মধ্যে ছিল না, কিন্তু রামগুপ্ত সহজেই নতি স্বীকার করায় রুদ্রসিংহ এটা জোর করে ঢুকিয়ে দিল। যারা নিজেদের সম্রাজ্ঞীর সম্মানই রাখতে পারেনা, তারা আবার রাখবে তাদের অস্ত্রের সম্মান। ছোঃ !
চন্দ্র শয়ন কক্ষে বিশ্রামরত, দিনের দ্বিতীয় প্রহর পার হতে চলেছে, আজ রাত্রেই যেতে হবে, কিন্তু চন্দ্র ভেবে পাচ্ছেনা কিভাবে শকদের তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব, এটা প্রায় অলৌকিক, তাল বেতাল হলে হয়ত অদৃশ্য হয়ে চলে যেত। যেইনা ভাবা, অমনি বেতাল এসে সামনে হাজির।
‘প্রভু, আমায় স্মরণ করেছেন?’
চন্দ্র অবাক, ‘একি তুমি? দেখ বেতাল, তোমায় কিন্তু আমি ডাকি নি, কিভাবে এই পর্বত পার হব শকদের এড়িয়ে, একান্তে তাই ভাবছিলাম। তখন তোমার কথা মনে এল। না না, তোমার সাহায্য আমার লাগবে না, তুমি এখন যাও।’
‘ঠিক আছে প্রভু। আমি বিদায় নিচ্ছি, সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে আসবো। যাবার আগে শুধু একটা কথা বলে যাই, যে ঝর্ণাটা পাহাড় থেকে বেরিয়ে যমুনায় গিয়ে মিশেছে, সেইটা ধরে পাহাড় ভেদ করে চলে যান, আপনার কার্যসিদ্ধি হবে।’
রাত্রি তখন দুই প্রহর। চন্দ্র তার দুশো সহকারী নিয়ে ঝর্ণা যেখানে পাহাড় ফুঁড়ে বেরিয়েছে সেখানে হাজির হল, কিন্তু কোন রাস্তা দেখতে পেলনা। সে মশালের আলোয় জায়গাটা ভালো করে দেখল। ঝর্ণার জল যেন হঠাৎই পাহাড়ের গায়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে, একটা বড় পাথরের এক জায়গায় ফাটল মত আছে, সেই ফাটল দিয়ে জল বের হচ্ছে। নাঃ, কোথাও কোন পথ নেই।
তাহলে? তবে কি বেতাল ভুল বললো? এটা কি করে সম্ভব? সে চেষ্টা করলো মনে করতে বেতাল কি বলেছিল। ‘পাহাড় ভেদ করে চলে যান।’ তাহলে কি পাথরের কোথাও ফাঁপা রয়েছে, সেটা ভাঙ্গলেই সুড়ঙ্গ পথ দেখা দেবে? সে ফাটলের দুদিকের পাথরে আঘাত করে দেখতে বললো কোন ফাঁপা আওয়াজ বেরোয় কিনা। না, কোন ফাঁপা শব্দ নেই, একটাই নীরেট পাথর, তার মাঝখানের ছোট ফাটল দিয়ে জল বেরিয়ে আসছে তোড়ে।
চন্দ্র আবার মনে করতে চেষ্টা করলো বেতাল কি বলেছিল। ‘সেইটা ধরে পাহাড় ভেদ করে চলে যান।’ সেইটা, অর্থাৎ ঝর্ণাটা। ঝর্ণা ধরে এসেই তো তারা আটকে গেছে। এখন আর এগোবার রাস্তা কই?
কেনো, ঝর্ণা ধরে! তার মানে জলের মধ্যে দিয়ে? সে ভাল করে ফাটলটা দেখল। দুহাত উঁচু, দেড় হাত চওড়া ফাটল দিয়ে ঝর্ণার জল বেরিয়ে আসছে। তার মধ্যে দিয়ে গুঁড়ি মেরে যাওয়া হয়তো কিছুটা যাবে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে কোন সুড়ঙ্গ না পেলে বাতাসের অভাবে মৃত্যু অনিবার্য।
চন্দ্র ঠিক করলো প্রথমে সে একাই যাবে ঐ ফাটল দিয়ে, অন্য কাউকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবেনা। সেটা ঠিক করার পর লম্বা শ্বাস নিয়ে সে ফাটলে ঢুকলো, হাতে একটা দড়ি যার অন্য প্রান্ত বাইরে অপেক্ষা করা এক সেনা নায়কের হাতে। দড়ির টানে সে নির্দেশ পাঠাবে।
কয়েক হাত যাবার পরই কিন্তু ওপর নীচ আর দুপাশের দেওয়াল ক্রমশ কাছে এগিয়ে এল, তা এত সরু হয়ে গেল যে গুঁড়ি মেরে যাওয়াও কঠিন, তার ওপর আবার জলের গতিও গেল বেড়ে। তবুও না দমে চন্দ্র এগোতে লাগল, বুকভরে যে বাতাস সে নিয়েছিল তা শেষ হতে আর বিশেষ দেরী নেই, একটু বাতাস পেলে ভাল হত। এইভাবে সে আরও কিছুটা এগোল, এখন তার মাথায় কেবল একটায় চিন্তা, বাতাস, কোন রকমে একটু বাতাস সে চায়, বুক ফেটে যাচ্ছে, একটু বাতাসের জন্য দেহ আকুলি বিকুলি করছে। নাঃ, আর সে পারছে না, চন্দ্র ভাবল এইভাবে অসহায় মৃত্যু বরণই কি তার নিয়তি ?
ঠিক এমন সময় তার চারদিক থেকে চেপে আসা দেওয়ালটা হঠাৎ যেন সরে গেল। সে প্রাণপণে মাথা তোলার শেষ চেষ্টা করল। আর দেওয়াল না থাকায় বিনা বাধায় অবশেষে তার মাথা জলের ওপর ভেসে উঠল। বাতাস, আঃ, জীবনদায়ী বাতাস। বুকভরে কিছুক্ষন বাতাস নেবার পর তার বুদ্ধি বিবেচনা ফের কাজ করতে লাগল, সে শান্ত ভাবে বোঝার চেষ্টা করল জায়গাটা কোথায়, কেমন। ঘন অন্ধকারে দৃষ্টি চলেনা, অনুমানে বুঝল এটা একটা মাঝারি আকারের জলাশয়, পাহাড়ের মধ্যে পাথরে গর্ত হয়ে এই জলাশয় সৃষ্টি হয়েছে। সুড়ঙ্গ পথে ঝর্ণার জল এসে সেই জলাশয়ে পড়ছে, আর নীচের দিকের পাথরের ফাটল দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। সুড়ঙ্গের মধ্যে হাওয়া আসছে, তার অর্থ অন্য প্রান্ত খোলা। সে আবার প্রাণ ভরে শ্বাস নিল, তার পরে হাতের দড়িতে টান দিল।
এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
১) সম্রাট রামগুপ্ত সন্দেহ করেন ভাবী সম্রাজ্ঞী সুতনুকা তাঁর ভাই চন্দ্রগুপ্তের প্রতি আসক্ত তার বীরত্বের জন্য। তিনি যে আরও বড় বীর সুতনুকাকে তা দেখাবার জন্য তিনি ঝুঁকি নিয়ে শকদের আক্রমণ করতে গিয়ে ফাঁদে পড়েন। এখন তিনি বিপন্মুক্ত হতে চাইছেন এমনকি নিজ রাণীকেও শকরাজাকে উপহার দিয়ে।
২) রাণী সুতনুকা তার পিতার বন্ধু শকরাজা রুদ্রসিংহকে ঘোরতর অপছন্দ করে। চন্দ্রের প্রতি সে অনুরক্ত তার সরলতা, সততা, বুদ্ধি ও বীরত্বের জন্য। সম্রাটকে তাকে সহ্য করতেই হয় কিন্তু তার প্রতি তার কোন বিশেষ ভালবাসা নেই। সে যখন জানবে সম্রাট নিজে বাঁচার জন্য তাকে রুদ্রসিংহকে উপঢৌকন দিতে প্রস্তুত তখন তার উদাসীনতা পরিণত হবে ঘৃণায়।
৩) রুদ্রসিংহ যেমন বড় বীর তেমনি কামুক। সে সমুদ্র গুপ্তের কাছে মথুরা হারিয়ে এমনিতেই রেগে ছিল এখন চন্দ্র তার বহুদিন ধরে বাগদত্তা সুতনুকাকে ত্রিগর্তরাজের কাছ থেকে চুরি করে আনায় মুখের গ্রাস ফস্কে যাওয়া বাঘের মতন ক্ষেপে আছে সে।
৪) চন্দ্র বিচক্ষণ এবং বীর। দাদার অনেক দোষত্রুটি সত্ত্বেও সে তাকে ভালবাসে। তেমনি রাণী সুতনুকার প্রতিও সে অনুরক্ত। সম্রাটকে মুক্তির প্রতিদান হিসেবে শকরাজা সম্রাজ্ঞীকে চাওয়ায় চন্দ্র তাকে মনেমনে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রেখেছে।
ঠিক এই অবস্থায় এসে গল্প দাঁড়িয়ে পড়েছে। কিভাবে এগানো যায় এখন সেটাই প্রশ্ন।
*********
Add comment