আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, তবুও শান্তি তবু অনন্ত জাগে
রমা সিনহা বড়াল, ১৯৭৬ আর্কিটেকচার ও প্ল্যানিং
** ইতিপূর্বে সাহিত্যিকা ৩৭ সংখ্যায় প্রকাশিত (August 2024)
বয়স হয়েছে, ছোটখাটো রোগ তো আছেই। এবার কিন্তু একটু কঠিন রোগ, মানে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঢুকতে হলো সল্ট লেকের এক বড় নার্সিংহোমের আইসিসি ইউনিটে। কালক্ষেপ না করে, সঙ্গে সঙ্গেই সিস্টার আমার হাতে চ্যানেল করে স্যালাইন ও ইঞ্জেকশন চালু করে দিলেন। মুহুর্তেই লোকজন রক্ত নিতে চলে এলেন, রকমারি রক্ত পরীক্ষার জন্য। এরপর আমার সারা শরীরে রকমারি যন্ত্র লাগিয়ে হার্ট, প্রেসার, অক্সিজেন লেভেল ইত্যাদি দেখা শুরু হলো। সবথেকে কষ্টকর রক্তে কার্বন পরিমাণ মাপার জন্য Bipap machine এর মাস্ক। বড়লোক ঘরের মেয়েদের সারা গায়ে গয়না থাকে, আরা আমাকে সাজিয়েছে নাকে মাস্ক, গায়ে ইঞ্জেকশনের সুচ, সরু সরু টিউব এসব দিয়ে। আর পাশে রেখে দিয়েছে কয়েকটা যন্ত্র। মাঝে মাঝে এক একজন এসে এক একটা রিডিং দেখে যাচ্ছে, ভেবে দেখলাম কি করছে প্রশ্ন করে লাভ নেই।
শুধু খাবার সামান্য সময়টুকু ছাড়া চব্বিশ ঘণ্টাই আমাকে তারমধ্যে রাখা হয়েছিল। জলতেষ্টা পেলেও অনেক বলার পর হয়তো এক ফোঁটা জল দেবার জন্য খুলে আবার নাক বন্ধ করে দিয়ে মেসিন চলতো। জানতে পারলাম যে আমার অজান্তে আমারই রক্তে নাকি বিপজ্জনক মাত্রায় কার্বন ডাইঅক্সাইড বিরাজ করছে, আর অক্সিজেনের মাত্রাও কমে গেছে। তাই Bipap machine এর টেস্ট আমাকে করাতেই হবে। সেই সঙ্গে সকাল বিকাল রক্ত পরীক্ষার জন্য লোক এসে রক্ত নিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে কষ্টকর হাতের কব্জির শিরা থেকে রক্ত নেওয়া। উঃ! মনে হলো একশ’টা কাঠপিঁপড়ে যেন একসঙ্গে কামড়ে দিলো।
সাতদিন ধরে সকাল বিকাল সিনিয়র ডাক্তার, জুনিওর ডাক্তার, বড় সিস্টার, মাঝারি সিস্টার, জুনিওর সিস্টারদের নানান রকমের টেস্ট মনিটরিং ও পরীক্ষা নিরীক্ষায় রীতিমত ভয় শুরু হলো। তাঁর উপর পরিবারের বাবাই. তানিয়া. অভিষেক, দিলীপের চিন্তিত মুখে আসাযাওয়ায় বুঝলাম আমাকে শক্ত কোন অসুখ কয়েক কোটি মাইল দূরে কোথাও নিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করছে। যদিও মুখে কেউ ওরা প্রকাশ করছে না।
সারাদিন ঐ ভাবে শুয়ে শুয়ে মনটা বড়ই অশান্ত হয়ে উঠছিল। মনের মধ্যে একটা গান বেজে চলেছে – “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে. বন্ধু হে আমার রয়েছো দাঁড়ায়ে।” মনে হচ্ছিল আমার এই জীবনের অনেক কাজ এখনও বাকি। এখনই মরে গেলে অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করবো কি করে? তবে সুখের কথা, পরদিনই সকালে বাবাই এসে মন শান্ত করার মন্ত্র কানে শুনিয়ে গেল। ভাল লাগলো। মনে হলো “তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতো দূরে ধাই, কোথাও দুঃখ কোথাও দৈন্য, কোথা বিচ্ছেদ নাই।” কবিগুরুর গানের কথা মনকে দিল এক অপার শান্তি।
সেদিনই রাত সাড়ে এগারটায় আমার সামনেই অন্য বেডের বৃদ্ধ ভদ্রলোক এক অদ্ভুত আওয়াজ করে থেমে গেলেন। বেশ কিছুক্ষন সিস্টার, নার্স, ওয়ার্ডবয়দের ছোটাছুটি দেখতে পেলাম। খানিক পর পর্দায় ঘেরা জায়গাটা নিশ্চুপ হয়ে গেল। খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখতে পেলাম। যদিও জীবনের পরম সত্য এক স্বাভাবিক ঘটনা, কত না পরিচিত জনকে আমি নিজেই এইরকম পরিস্থিতিতে সান্ত্বনা দিয়েছি, কিন্তু সেই মুহুর্তে মনে হলো আমরা কতই না অসহায়। সারা রাত আর ঘুমোতে পারলাম না।
কিন্তু জীবন চলমান, সে থেমে থাকে না। পরের দিনই আমার ঠিক বাঁ দিকের বেডে রাত দশটার সময় এক ভদ্রলোক এসে ভর্তি হলেন। সে দিন কেন জানি না Bipap নিতে আমার একটুও ইচ্ছা করছিল না। সিস্টারের সাথে ঝগড়া করে ও মেসিন লাগালেই আমি বার বার খুলে দিচ্ছিলাম। শেষবারে ও রেগে গিয়ে আমাকে সেভাবেই ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।
তখন রাত দেড়টা। হঠাৎই আমার পাশের বেডের পেশেন্টের মনিটরিং মেসিনে আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। সিস্টার দৌড়ে এসে দেখেই চিৎকার করে উঠলো। এই মানুষটাও জীবনের সকল মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেলেন। অনুভব করলাম, আমার শরীরে যেন ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এরকম শারীরিক অভিজ্ঞতা আমার নেই। সারারাত ভয়ের চোটে চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। ঠিক করলাম পরদিনই ডাক্তার বাবুকে অনুরোধ করবো আমাকে ছেড়ে দিতে। কিন্ত পরদিন সকাল থেকেই শরীরে ইউরিক আসিড বেড়ে গিয়ে বাঁ হাটু ফুলে ঢোল। পা নাড়াতে পারছিনা। অসম্ভব যন্ত্রণা। দিলীপ দেখা করতে এলে কেঁদে অস্থির হলাম। কিন্ত মাস্কের মধ্যে দিয়ে আমি কি বলছি ও হয়তো কিছুই বুঝলো না। রোজই আমার শরীরে কিছু না কিছু সমস্যা দেখা দিতে শুরু হয়েছিল। আর ডাক্তাররা একটার পর একটা ওষুধ দিচ্ছেন, কখনও বা পাল্টে দিচ্ছেন, কখনও নতুন কোন টেষ্ট করাচ্ছিলেন।
ঠিক বারোদিন পর আমার শরীর খানিক স্থিতিশীল হলো। কিন্ত Bipap যথারীতি চলছিল। চৌদ্দ দিনের দিন আমাকে শিফট করিয়ে জেনারেল বেডে দেয়া হলো। কিন্ত অক্সিজেন চলছে। বেডে পা ঝুলিয়ে বসতে পারলাম। মনে হলো কি আরাম!! এবং এবার আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে অনুমতি দেওয়া হলো। অবশেষে পনেরো দিন পর বাড়ি ফিরলাম। প্রথম সাতদিন হাঁটতে পারিনি। স্বরূপ এক্সরসাইজ করিয়ে আমাকে হাঁটতে সাহায্য করছে।
এতক্ষণ আমার নিজের অসুখের কথাই বললাম, কিন্তু যাদের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া বেঁচে ফিরতে পারতাম না তাঁদের কথা না বললে অন্যায় হবে। আমাকে সচল রাখতে, সুস্থ করতে যে সব নার্স, সিস্টার, আয়া মাসীদের সাহায্য নিতে হতো, প্রয়োজনে তাঁদেরই মনে হতো ঈশ্বরের প্রতিনিধি। এঁরাও নারীর অন্য আরেক রূপ। সকলেরই ঘর সংসার, নানান সমস্যার টানাপোড়েন আছে। কিন্ত কাজের সময়, দায়িত্ববোধে রোগীর সেবায় এঁরা সকলেই তখন অন্য মানুষ। রোগীদের সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে পাঠানোটাই তখন এঁদের ধ্যান জ্ঞান। সবাইকে আমি আমার প্রণাম জানাই।
এবার আসি জুনিওর ডাক্তারদের (আর এম ও) কথায়। সারাদিন নানান রোগীর আপতকালীন সমস্যার সমাধানে এনারা সদাই সচেতন। সিনিয়র ডাক্তাররা দিনে একবার ও রাতে একবার আসতেন। আর বাকি সময়টুকু জুনিয়র ডাক্তাররাই সামলাতেন। সারাদিনের পরিশ্রমের মাঝে হয়তো এক কাপ কফি ছাড়া অন্য কিছু মুখে দেওয়ার সময়ই পেতেন না। সিনিয়র ডাক্তাররা যা নির্দেশ দিতেন সেই মতোই তাঁদের কাজ করতে হতো। অনেক সময়ই সিনিয়র ডাক্তারদের নির্দেশে কোন সই থাকতো না। সেক্ষেত্রে এই আর এম ও দের বেশ দ্বিধায় পড়তে হতো। সব দায়িত্ব এঁদের। তাঁরা নিজেদের মধ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করতেন।
একদিন এক রোগিণীকে দেখতে একসাথে আটজন এলেন। রোগিণী খুবই অসুস্থ। এক একজন ডাক্তার এক একরকমের পরীক্ষা করাতে বলছেন। একজন বললেন ইকো কার্ডিওগ্রাম, অন্য একজন বললেন এনজিওপ্লাস। ভদ্রমহিলা কোন কথা বলছিলেন না, ডাকলে সাড়া দিচ্ছিলেন না, তাই তৃতীয় ডাক্তার ই এন টি ডাকতে বললেন। এই ভাবেই সপ্তম ও অষ্টম ডাক্তার যথাক্রমে এম আর আই ও বোন ম্যারো টেস্ট করাতে বললেন। এতো সব শুনে বাড়ির লোক প্রচন্ড চিন্তায় পড়লেন। আর এম ও জুনিওর ছেলেটি চুপচাপ সব নোট করে নিচ্ছিল ও সিস্টারদের সেই মতোই টেস্ট করাবার কথা বলে দিচ্ছে।
আমি কাছেই নিজের বেডে শুয়ে চুপচাপ সব শুনছিলাম । সবাই চলে গেলে আমি জুনিওর আর এম ও কে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম “আচ্ছা ভাই, এতোগুলো উপদেশে এবার তুমি কি ভাবে চিকিৎসা করবে? সারারাত তো তোমাকেই সামলাতে হবে!” সদ্য পাশ করা, বুদ্ধিমান, সম্প্রতিভ নবীন ডাক্তার উত্তর দিলো, “ওনারা সবাই সিনিয়র ডাক্তার। তাই সবার কথাই শুনলাম। আর আমার নিজের বিচারবুদ্ধিতে মোটামুটি আস্থা আছে, সেই মতো পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দেবো।” সপ্রতিভ, আপাত দৃষ্টিতে বুদ্ধিমান ছেলেটির কথা শুনে ভালো লাগলো।
সবার শুভেচ্ছায় হোম সুইটি হোমে ফিরে এসেছি। আপাতত সুস্থ হবার পথে। আমার ওয়াকার এখন আমার পরম বন্ধু, ছায়াসঙ্গী। তাকে নিয়েই হাঁটা চলা করছি। পায়ের এক্সরসাইজ করিয়ে ফিজিওথেরাপিস্ট স্বরূপ আমাকে ভালো করে তুলছে।
সবাই কে ধন্যবাদ।
সবাই ভালো থেকো।
*******
Add comment