Remembering our Director Dr. Sparshamani Chatterjee.
Pradip Chakraborty, 2001 Civil Engineering.
১৯৯৭ সাল। সময়টা শতাব্দীর সন্ধিক্ষণের কিছুটা আগে। আগের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ততদিনে Deemed University (DU) হয়ে গেছে। আমরা যারা রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জয়েন্টে rank করে বুক ফুলিয়ে সারা পাড়া মাইক বাজিয়ে জানিয়ে দিয়ে কলেজের ক্যাম্পাসে এসে সদ্য পা রেখেছি তাদের কাছে তখন কলেজ কি জিনিষ সেটাই বুঝি না, আর এই DU এর মানে একেকজনের কাছে একেকরকম। বেশিরভাগেরই হোস্টেল জীবনের অ আ ক খ শেখা নেই।
কলেজের প্রথম দিনের সকালে ফার্স্ট ইয়ার হোস্টেল থেকে রীতিমতো শোভাযাত্রা করে কলেজে পৌঁছনোর পথে সেকেন্ড লবিতে প্রথম দেখতে পাই তাঁকে। সৌম্যকান্তি, মাথার চুল পাতলা হতে হতে স্পষ্ট টাক দেখা যাচ্ছে, সোনালি ফ্রেমের চশমার আড়ালে অভিজাত্যর ছাপ সুস্পষ্ট। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মানুষটি আমাদের সকলের পোশাক পরিচ্ছদ মায় পায়ের জুতোজোড়া অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। তাঁকে দেখে ঠিক ভয় যে হয়েছিল সেকথা বলবো না। কারণ তাঁর মুখের বা শরীরী ভাষা কোনোটাই ভয় পাওয়ানোর মতো ছিলো না। তখন চিনতে পারিনি কিন্তু অচিরেই জানতে পেরেছিলাম উনি স্পর্শমনি চ্যাটার্জী অর্থাৎ আমাদের কলেজের Director, পরে আমাদের কাছে আদরের ডাকে ছোট্ট করে ডিরু! এরপর থেকে প্রতিদিন সকালে এবং দুপরের লাঞ্চ বিরতির পর যখনই লাইন দিয়ে সবাই হস্টেল থেকে কলেজে গিয়েছি, প্রতিবারই সেকেন্ড লবির দালানে উনি দাঁড়িয়ে থাকতেন, যেন ধ্রুবতারার মতোই অটল!
সদ্য স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজের আবহাওয়ায় মুক্তজীবনের আস্বাদ পেয়ে বাঁধন ছাড়া আঘ্রান নিতে শেখা বাচ্চা ছেলেগুলি তখন হামেশাই বকুনি খেতো ডিরুর কাছে। কখনও চটি পড়ে ক্লাস করতে আসার জন্যে, আবার কখনও শাল গায়ে দিয়ে আসার জন্যে! ক্লাসে দেরি করে ঢুকতে গেলে তো আর কথাই নেই! প্রায়শই শুনতে পেতাম রীতিমতো তিরস্কার করে উনি বলছেন “Why late? Why late?”! এরকম কতবার হয়েছে ডিরুর কাছে ধরা পড়ে ছেলেরা পোশাক বদলে আসতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো কম বয়েসের নিয়মেই কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের ভয় একটু একটু করে কাটতে শুরু করে দিয়েছিল। তখন নিজেদের মধ্যে আমরা ফন্দি আঁটতাম কিভাবে ডিরুর চোখে ফাঁকি দেওয়া যায়! আরও কিছুদিন পরে ডিরুর কঠোর নিয়মের কীর্তিকলাপ নিয়ে সিনিয়র দাদারা তো রীতিমতো parody গান বানিয়ে ফেলেছিলো ডিরুর কথা বলার ধরন, তার পোশাক আশাক ইত্যাদি নিয়ে। একটা সময় গিয়ে যখন কলেজ আরও কিছুটা পুরোনো হলাম তখন অনেকেই ওনার সামনে দিয়ে চটি পড়ে ক্লাসে গেছি। ক্লাসে দেরি হয়ে গেলে ডিরুর বকুনির ভয়ে যাওয়ার তৎপরতা আর বাড়াইনি। উনিও পরবর্তীকালে কিছুটা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। ঠিক যেমন নিজের ছেলে বয়ঃসন্ধিক্ষনে পৌঁছলে বাবা ধীরে ধীরে তাঁর শাসনের রাস আলগা করতে থাকেন।
আজকে আমার এই ৪৫+ বয়েসে এসে যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন ভাবি সত্যি ওনার কি এগুলো করার প্রয়োজন ছিলো? উনি তো দিব্যি পারতেন নিজের AC ঘরে বসে কলেজ পরিচালনা সংক্রান্ত নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোনিবেশ করে নিজের দিন কাটাতে। একজন দক্ষ Director হিসেবে তাঁর তো সেটাই ছিলো কর্তব্য। কিন্তু না। তিনি এই বাউন্ডুলে ছেলেগুলোর অভিভাবক হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে শুধুমাত্র দিনের পাঁচসাত ঘন্টা পড়াশোনা শেখার জায়গা নয়, এটি যে জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের প্রস্তুতির প্রশিক্ষনের কেন্দ্র, সেটাই উনি বোঝাতে চেয়েছিলেন। পুঁথির জগতের বাইরে একজন সুদক্ষ পেশাদার ইঞ্জিনিয়ারের প্রাথমিক শিক্ষা হবে অনুশাসন, সময় ও নিয়মানুবর্তিতা, চাই কথাবার্তায়, বেশভূষায়, চেহারায় পেশাদারিত্বের ছাপ।
আমরা পাশ করেছি ২০০১ সালে, আর ২০০০ সালে ডিরু অন্য দায়িত্ব নিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। সুতরাং আমরা ওনাকে পেয়েছি মাত্র তিনটি বছর। অনেক পরে মনে হয়েছে, আমাদের ওনার কাছে আরও হয়তো অনেক কিছুই শেখার ছিল। সুদীর্ঘ চারটি বছরে অনেক শিক্ষক আমাদের Civil Engineering এর পাঠ পড়িয়েছেন। কিন্তু ক্লাসের গন্ডির বাইরে গিয়ে জীবনের পাঠ এভাবে ডিরু ছাড়া আর কেউ পড়িয়েছেন বলে আমার তো মনে পড়ছে না। তার সেই পাঠ ছিল জয়েন্টের rank বা ইঞ্জিনিয়ারিং stream সবকিছুর উর্ধে। আজকে যখন কর্মক্ষেত্রে গিয়ে দেখি নবীন প্রজন্মের কিছু ছেলেমেয়ের ব্যবহারে এবং কথাবার্তায় চেহারায় বা নানান কারণে পেশাদারিত্বের অভাব তখনই বুঝি এরা কলেজ জীবনে কোনো ডিরুকে পায়নি। পেশাদারি জীবনে কয়েক দশক কাটিয়ে আজকেও যেন কোথাও ওনার সেই শিক্ষা নিজের মধ্যে বহন করে নিয়ে চলেছি। চেষ্টা করে চলেছি যাতে পরবর্তী প্রজন্ম সেই একই শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে।
Sir, আজ আপনি আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন আর আপনার বকুনির মহিমা আপনার ছাত্ররা দেরিতে হলেও বুঝেছে সেটা দেখে বেশ খানিকটা হেসে নিন!
******
Add comment