স্মরণীয় যারা
প্রবীর কুমার রায়, ১৯৭১ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আমি বি ই কলেজের ১৯৭১ সালের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্নাতক।
আমার কাছে অনুরোধ এসেছে যে আমাদের স্যারেরা যারা আমাদের পড়িয়েছিলেন
সম্ভব হলে তাদের কয়েকজনের সম্বন্ধে কিছু লিখতে।
আমার ছাত্রাবস্থায় প্রোফেসর ডক্টর শংকর সেন ছিলেন আমাদের হেড অফ দা ডিপারটমেন্ট।
ওনার সাক্ষাৎকার নিয়ে অসীম দেবের একটি সুন্দর লেখা কিছুদিন আগে আমার হাতে এসেছিল।
আর আমাকেও লিখতে হলে প্রথমে ওনার সম্বন্ধেই কিছু লিখতে হয়।
কারনটা এই রকম। আমার চাকুরিজীবনের একেবারে শেষ দিকে চাকুরিসুত্রেই ওনার সংগে যোগাযোগ হয় যা আমার ২০১০ সালে রিটায়ারমেন্ট পর্যন্ত প্রায় তিনবছর মত স্থায়ি ছিল। আমি তখন Institution of Engineers (India)এ পদাধিকার অনুযায়ী দ্বিতীয় ব্যক্তি আর উনি একটি বিশেষ উচ্চপদস্থ কমিটির পাঁচজন Honorary মেম্বারের মধ্যে একজন। এই কাজের সুবাদে আমরা দু’জন কয়েকবার একসঙ্গে ট্যুর করেছি। দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর আর হায়দ্রাবাদ। আমরা বেশিরভাগ সময়ই IEI (India) গেস্ট হাউসে পাশাপাশি রুমে থাকতাম ও সেই সন্ধ্যাবেলা Official Invitation না থাকলে একটু গল্পগুজব করেই কাটাতাম।
তখন ওঁনার আশীর উপর বয়স। স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে কয়েক বছর আগে। একমাত্র মেয়ে সপরিবারে বিদেশে থাকেন। তাই গল্ফ গ্রীনে ওনার ফ্ল্যাটে একলাই থাকেন। বছর কয়েক আগে রাজ্য সরকারের মন্ত্রিত্বও ছেডে দিয়েছেন। স্যারের বয়স হলেও উনি হাঁটা চলায় তখনও যথেষ্ট শক্ত সমর্থ। সিকিম গভর্নমেন্ট ওনাকে অত্যন্ত সন্মান দিয়ে Adviser পদে রেখেছে। ওখানে মাসে অন্তত একবার কয়েকদিনের জন্য যেতে হয়। এবং ওদের ব্যাবহার সৌজন্য সব মিলিয়ে উনি বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন। ওনার কথায় সেই রকমই মনে হয়েছিল। মন্ত্রী থাকাকালীন ওনার বেশ কিছু অভিজ্ঞতা উনি গল্পছলে আমাকে বলেছিলেন যা আমার বেশ ভালোরকম মনে আছে, সেরকম কয়েকটি এখানে লিখছি।
এখানে বলে রাখি, উনি যখন বিদ্যুৎমন্ত্রী ছিলেন তখন কলকাতার পাওয়ার জেনারেশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির তিনটে মুখ্য সংস্থার (WBSEB, DVC, CESC ) যাঁরা চিফ বা ডেপুটি চিফ ইন্জিনীয়ার বা ডেপুটি চিফ/সুপারিনটেন্ডেন্ট ইন্জিনীয়ার পদে ছিলেন, তাঁদের প্রায় সকলেই একসময় ওনার ছাত্র ছিল, তা শিবপুর বা যাদবপুর যাই হোক না কেন। কিন্তু শোনা যায় পরের দিকে এই শিক্ষক ছাত্র সম্পর্ক সুবিধার বদলে কিছুটা অসুবিধারই সৃস্টি করেছিল। তার বহু কারন থাকতে পারে। দুটি ঘটনার উল্লেখ করছি এখানে।
তখন ল্যান্ডলাইনের যুগ। মন্ত্রী থাকাকালীন একবার প্রায় রাত সাড়ে বারটা নাগাদ ওনার গল্ফ গ্রীনের বাড়িতে একটি ফোন আসে। যে লোকটি ফোন করেছিল, বোধহয় যাদবপুর বা গড়িয়া অঞ্চলের বাসিন্দা, সে জানায় যে, তার ওখানে প্রায় তিন ঘন্টার উপর বিদ্যুৎ সংযোগ নেই এবং ওই দুঃসহ গরমের রাত্রে ওখানে সকলের প্রান ওষ্ঠাগত। কেউ কিছু বলছে না এবং এত রাতে কেউ সারাতে আসবে বলেও মনে হয় না। আরও বলে “স্যার আপনি তো এসি’তে বসে আছেন। আপনি আমাদের কষ্ট ঠিক বুঝতে পারবেন না”। স্যার লোকটিকে জানান যে, আমার বাড়িতে এসি নেই। আপনার বিশ্বাস না হয় তো একদিন এসে দেখে যেতে পারেন। আর আপনার সমস্যাটা আপনি দেখছি।
যেহেতু ওটা সিইএসসি এলাকা, উনি ওনার ফোনবুক খুলে ওই জায়গার DS (Distribution Station) এর ফোন নম্বর খুঁজে বার করে নিজের পরিচয় দিয়ে ফোন করে অবিলম্বে ফল্ট (fault) সারাতে বলেন এবং হয়ে যাওয়ার পর ওনাকে জানাতে বলেন। সেই রাত্রেই ফল্ট সারিয়ে লাইন চালু হয়ে যায়। একথা শুনে আমি ওনাকে তৎক্ষনাৎ জানাই “স্যার কাজটি আপনি ঠিক করেন নি। আপনার সিইএসসির চিফ অথবা ডেপুটি চিফ (ডিস্ট্রিবিউশন) বা তার নিচে Mains Superintendent কে বলা উচিত ছিল নয়ত ডিস্ট্রিক্ট এন্জিনীয়র (সাউথ) কে বলা উচিত ছিল (এখানে জানাই যে সিইএসসিতে GOIT থাকার সুবাদে ওদের পুরো সেট আপ ও সাউথের অফিসগুলি আমার জানা ছিল) আপনি যে Protocol ভেঙ্গেছেন এরা কেউ এটাকে ভাল ভাবে নেবে না।“ উনি শুনলেন। মনে হল যে মনে মনে আমার কথা মেনেও নিলেন।
আরও একদিনের একটি ঘটনা বলেছিলেন যে কোনো একটি বড় মিটিং এ (উনি মিটিং এর চেয়ারপার্সন) যেখানে স্টেট বোর্ড, ডিভিসি, সিইএসসির মুখ্য কর্তারা (চিফ ইন্জিনীয়ার) আছেন সেখানে কাজের ধীরগতির জন্য বেশ উঁচু গলায় বকাবকি করেছিলেন। সেবারেও ওনাকে বললাম “স্যার আপনি বকাবকি করেন নি। আপনার একসময়ের প্রিয় ছাত্রদের কাছ থেকে কাজের পরিস্থিতি জানতে চেয়েছিলেন বা হিসাব চেয়েছিলেন।” উনার একসময়ের ছাত্রদের এককালে অবশ্যই হয়ত উনি বকাঝকা করে থাকতে পারেন কিন্তু এখন তো তারা প্রত্যেকেই উচ্চপদস্থ অফিসার। ব্যাপারটা তাদের ভাল নাও লাগতে পারে। অন্য কেউ মন্ত্রী হলে হয়ত অন্য ব্যাপার ছিল, কিন্তু স্যার যতই প্রিয় হোন, অফিসে বকা খাওয়া অনেকেই হয়তো পছন্দ করবেন না।
ব্যাঙ্গালোরে ওখানকার Honorary Council Members যেমন State Centre Chairman / Secretary বা অনান্য মেম্বাররা বেশ খাতির যত্ন করতেন। একবার সন্ধ্যাবেলায় ওখানকার Century Club এ (আমাদের কলকাতার Bengal Club এর মতন) আমাদের খানপিনার আয়োজন। আমি ততদিনে ড্রিংকস ও ধুমপান দুটোই বর্জন করে ফেলেছি। তার উপর আবার স্যারের সামনে? স্যার তখন নিরামিষ আহার করতেন। বলা বাহুল্য ড্রিংকসও নিলেন না।
একবার হায়দ্রাবাদ থেকে মিটিং শেষ করে রাতের বিমানে বাড়ি ফিরছি। প্লেন ছাড়তে দেরি করল। যেহেতু তারপর হাওড়া থেকে ট্রেনে আমাকে চন্দননগর ফিরতে হবে (ক্যাব ফেয়ার এরা দিত না) আমি ভাবছি আমার লাস্ট ট্রেন (১১-৪৫) না মিস হয়ে যায়। শুনে উনি বললেন তুমি আমার সংগে আমার বাড়িতে (গল্ফ গ্রীন) চলো। আমি তো একাই থাকি। কাল সকালে ওখান থেকে না হয় সোজা অফিস করবে। এতটাই অন্যের খেয়াল রাখতেন। যাই হোক প্লেন সময়মত দমদমে পৌঁছেছিল। আমিও বাড়ি ফিরতে পেরেছিলাম ঠিকমত।
কলেজে অনেক ছাত্রদের মধ্যে আমি তো একজন মাত্র ছিলাম। এতদিন পরে ওনার বেশ কাছের হয়ে গেছিলাম। আমাকে বড্ড স্নেহ করতেন। সাহিত্যিকা সম্পাদক অসীম দেবের সৌজন্যে স্যারের একটি ঘরোয়া ছবি পেয়েছি, এখানে শেয়ার করলাম।
*******
এবার দীপ্তেন দাসগুপ্ত স্যারের কথায় আসি। উনি ১৯৬২ সালের স্নাতক, প্রফেসর যামিনী দাসের ব্যাচমেট আর প্রফেসর চিত্তরঞ্জন মাহাতোর এক বছরের জুনিয়র। এনারা তিনজনই ইলেকট্রিক্যাল বিভাগে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের পর কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন। তখনো কারও ডক্টরেট করা হয়নি। এঁনারা সবাই সেই সময় লেকচারার হিসাবে ছিলেন। প্রফেসর যামিনী দাস ও মাহাতো স্যারদের থার্ড ইয়ারে পেলেও দীপ্তেন স্যারকে আমি পেয়েছিলাম ১৯৬৯ সালে আমাদের ফোর্থ ইয়ারে। পাওয়ার সিস্টেম ওয়ান পড়াতেন এবং স্টিভেনসনের বই ফলো করতেন। ওনার পড়ানো আমার অসাধারন লাগত। পরের বছর ওনাকে আবার আমরা পাই। আমাদের ফাইনাল ইয়ারে ইলেকটিভ টু সাবজেক্ট Relays for Automatic Protection পডিয়েছিলেন যার “ফান্ডা” আমার প্রায় সারাজীবন কাজে লেগেছে। যামিনী স্যার যেমনি মাঝে সাঝে, বিশেষ করে ল্যাবে একটু বকাঝকা করতেন, দীপ্তেন স্যার ছিলেন একটু নরম সরম, এবং মুখে হাসিটা লেগেই থাকত। শুনেছি দীপ্তেন দাসগুপ্ত স্যার শেষ দিকে পুরোপুরি আধ্মাতিক জগতে চলে গিয়েছিলেন।
সেই সময়ের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপারটমেন্টে আরও একজন অসাধারন স্যার ছিলেন যার কথা না বললেই নয়। তিনি অমিতাভ ঘোষ। মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের জন্য Theory of Machines এর Cyclostyled লেকচার নোট ডিস্ট্রিবিউট করে দিতেন। সেই নোট আমরাও বন্ধুদের থেকে নিয়ে পডেছি। উনি ১৯৭০ সালে আই আই টি কানপুরে চলে যান ও পরবর্তীকালে আই আই টি খড়গপুরের ডিরেক্টর পদ থেকে রিটায়ার করেন। তারপর প্রফেসার এমিরিটাস হয়ে কানপুর ও শিবপুরের সংগে যৌথভাবে যুক্ত ছিলেন। বিই কলেজ কে IIEST করার পিছনে ওনার অনেক অবদান আছে। ওঁনার সংগে এই বিষয়ে কাজ করেছে আমাদের ১৯৭১ ব্যাচের মেকানিকালের অমিতাভ ভট্টাচার্য, আই এ এস। অমিতাভ ঘোষ স্যারের সংগেও আমার Institution of Engineers (India) তে কর্মরত থাকার সময় বেশ কয়েকবার যোগাযোগ হয়েছে।
আমি আমার আরও একজন প্রিয় স্যারের ব্যাপারে কিছু লিখছি। প্রফেসর বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য্য ছিলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের কনিষ্ঠতম অ্যাসিস্টেন্ট প্রোফেসর। আমাদের কলেজের ১৯৫৫ সালের স্নাতক এবং তার পরে কলেজে শিক্ষকতার সংগে যুক্ত ছিলেন। অত্যন্ত যত্ন নিয়ে আমাদের চতুর্থ বর্ষে Circuit II পড়িয়েছিলেন। ওনার একটা বিশেষত্ব ছিল। উনি চন্দননগর থেকে যাতায়ত করতেন। মনে আছে সেই সময় যখন আমাদের সকাল সাতটায় ক্লাস শুরু হত, ওনার ক্লাস রাখা হত দশটায়, যেটা ছিল ফার্স্ট হাফের সর্ব শেষ ক্লাস। আমরা দেখেছি দশটার কিছু আগে উনি প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ফার্স্ট গেট দিয়ে ঢুকছেন। আমাদের এই ১৯৬৯-৭০ সালের ক্লাসটাই সম্ভবত ছিল ওনার শেষ ক্লাস। এরপরেই উনি আমেরিকা চলে যান এবং ওখানে Purdue University থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। দুর্ভাগ্য, উনি বেশিদিন বাঁচেন নি। হার্ট অপারেশন করতে গিয়ে ওখানেই মারা যান। ওনার স্ত্রী বর্তমান, ছেলের সাথেই আছেন ওই দেশে। ওনার ইউএসএ প্রবাসী পুত্র জয় ভট্টাচার্যকে প্রেসিডন্ট ট্রাম্প গতবছর Director NIH পদে মনোনীত করেছেন।
কলেজ থেকে পাস করে আজ ৫৪ বছর পরেও আমাদের জন্য এনাদের নিঃস্বার্থ অবদানের কথা ভুলতে পারি না।
What we want is to see the child in pursuit of knowledge,
and not knowledge in pursuit of the child.
– George Bernard Shaw
********
Add comment