প্রফেসর পি এন ব্যানার্জী স্মরণে
** প্রথম পর্বে – প্রবীর কুমার সেনগুপ্ত, ১৯৬৯ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
** দ্বিতীয় পর্বে- অথঃ পিএনবি কথা, মানস সামন্ত, ১৯৮১ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সত্তরোর্ধ বয়সে এসে এখন আমরা বুঝতে পারি যে কলেজ হোস্টেলের সেই পাঁচটি বছর ছিল জীবনের সবচেয়ে আনন্দের। দিনের সাতটি ঘণ্টা কেটে যেতো ক্লাসরুমে শিক্ষকদের নরম গরম শাসনে আর ভাষণে। বাকি সতেরো ঘণ্টা কাটত হোস্টেল, ডাইনিং হল, ওভাল, লর্ডস, জিম, সুইমিং পুল, বোটানিক্যাল গার্ডেন অথবা ফার্স্ট গেট বা সেকেন্ড গেটে। ক্যাম্পাসের বাইরের দোকানগুলো ছাড়াও ৫৫ নং বাসে কলকাতায় সাহেবপাড়া ধর্মতলা সিনেমা হল অভিযানে। কলেজ পরবর্তী জীবনে এই হুল্লোড়ে সুযোগ আর পাইনি। কাজেই ক্যাম্পাসে বড় হওয়া আর সেরা শিক্ষকদের বিদ্যাদান ও স্নেহের সৌভাগ্যময় সান্নিধ্যে আমাদের ভবিষ্যৎ গঠনে এই সতেরো আর সত্তরের টানাপোড়েন বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ওই সময়ের সারা দিনের নির্ঘণ্ট হিসাব করলে বেশ বোঝা যায় সতেরো আর সত্তরের হিসাব নিকাশ।
সতেরোর কথা যদি বলতে হয় তবে কার কথা যে বলবো আর কার কথা বলবো না সেটাই সমস্যা। তবে একজনের নাম আমাদের বন্ধুমহলের আলোচনায় প্রায়ই চলে আসে। সেই ভাবনায় আজ আমি আমাদের ইলেকট্রিকালের প্রফেসর পি এন ব্যানার্জি’কে নিয়ে দু’চারটি কথা বলে তাঁকে প্রণাম জানাতে চাই।
প্রফেসর পি এন ব্যানার্জি বা প্রমথ নাথ ব্যানার্জি বললে অনেকেই হয়তো বুঝতে পারবে না, পঞ্চাশের দশক থেকেই উনি ভিন্ন নামে পরিচিত। ১৯৬৪ সালে কলেজে ঢুকেছিলাম। তারপর কেন উনার সেই নামকরণ হলো, কে এই নামকরণ করলো সে ইতিহাস কেউ জানি না। শুধু এইটুকু জানি যে বিগত দশ পনেরো বছর আগে উনি প্রথম যখন অধ্যাপক হয়ে কলেজে এসেছিলেন তখন থেকেই উনার এই নাম চলে আসছে। পরে অবশ্য উনি নিজেই একদিন ক্লাসে এই নামকরণের ইতিহাস আমাদের বলেছিলেন, সেই ঘটনায় পরে আসছি।
সম্প্রতি, বছর সাতেক আগে ২০১৭ সালে আমি আমার স্ত্রী’কে নিয়ে আমাদের ছেলে-বৌমা আর নাতি-বাবুর কাছে ইউ এস এ-র অ্যালাব্যামা স্টেটে বার্মিংহাম শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন বার্মিংহাম বেঙ্গলী এসোসিয়েশনের দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি চলছে। পঞ্জিকার তিথি মানা সম্ভব নয় তাই মহাষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত সকল আয়োজন কোন এক শনি আর রবিবারে ওই দুই দিনের মধ্যেই সারা হয়। আবালবৃদ্ধবনিতা অর্থাৎ সকল বয়সের নারী-পুরুষের রঙবাহারি পোষাকে মন্ডপ আলোকিত। সেই ভিড়ের মাঝে দেখলাম একজন কমবয়সী পুরুষ ধবধবে সাদা ধুতি আর নূতন গেঞ্জি গায়ে ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে পূজোর তদারক করছেন। আমার ছেলে ওনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, “শুভঙ্কর দা, আমাদের বেঙ্গলী এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং আমাদের পুজোর প্রধান পুরোহিত। ওনার স্ত্রী, সতী দি, অন্যান্য কয়েকজন মহিলার সাহায্যে আমাদের পূজোর সব আচার অনুষ্ঠান জোগাড় করেন”।
শুভঙ্করের সাথে পরিচয় হলো। এর পরেই আমার ছেলে জানালো, “তোমার জন্য শুভঙ্কর-দার আরও একটা পরিচয় আছে। উনি তোমাদের কলেজের প্রফেসর পি এন ব্যানার্জির ছেলে”।
শুভঙ্কর হাসতে হাসতে নিজেই বললো, “পি এন ব্যানার্জি বললে হয়তো আপনি চিনবেনই না। আমার বাবা পাগলা ব্যানার্জী নামেই পরিচিত ছিলেন।“
বলেই শুভঙ্কর হেসে উঠল। আরও অনেক গল্প হলো। আন্দাজ করলাম আমরা ১৯৬৯ সালে যখন পাশ করি, শুভঙ্করের বয়স তখন হবে নয়-দশ বছর।
এক নিমেষে আমি প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের দিন গুলোতে ফিরে গেলাম। সময়টা ১৯৬৯ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসের কোন একটা দিন। ফাইন্যাল পরীক্ষার ঠিক আগে সেদিন আমাদের কলেজ জীবনের শেষ ক্লাসটি হবে। ক্লাসে সব মাস্টারমশাই রয়েছেন। ডাঃ শঙ্কর সেন, প্র. আর সি পাল, প্র. পি এন ব্যানার্জি, প্র. বি কে বোস, প্র. বিষ্টু ভট্টাচার্য, চিত্ত’দা, যামিনী’দা, দীপ্তেন’দা, প্র. জয়ন্ত সেন, মুস্তফি স্যার এবং আমাদের ইলেক্ট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের প্রায় সবাই। ডঃ শঙ্কর সেন সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আজ তোমাদের শেষ ক্লাস। আজকে আমরা কেউই তোমাদের পড়াতে আসিনি। বরং তোমাদের কাছ থেকেই জানতে চাইছি। তোমাদের যে এতদিন পড়ালাম তার কোথায় কোথায় তোমাদের খারাপ লেগেছে বা কোথায় গলদ রয়েছে – আজ সেই দিকগুলো আমাদের খোলাখুলি বলো। যাতে পরের ব্যাচে ছাত্ররা একই সমস্যায় না পরে”। আমরা সবাই চুপ। সেই যুগে মাস্টারমশাইদের বিরুদ্ধে কিছু বলা আমাদের কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না।
এক এক করে সব মাস্টারমশাই আমাদের কিছু না কিছু বললেন।
এরপর এলেন প্রফেসর পি এন ব্যানার্জী। তিনি তার স্বভাবসুলভ হাসি মুখে প্রথমেই বললেন, “আমি জানি তোমরা সবাই আমাকে পাগলা ব্যানার্জী বলো। সামনের সিটে বসা একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন – কি আমাকে পাগলা ব্যানার্জী বলো কি না?” ক্লাসের আমরা সবাই হাসাহাসি করছি। এমনকি শিক্ষকদের মধ্যেও অনেকেই মুখ টিপে নীরবে হাসছেন।
উনি আবার বললেন, “কিন্তু তোমরা একবারও ভেবে দেখনি যে আমি সত্যিই পাগল কি না। আমি যদি সত্যিই পাগল হতাম তাহলে কি এইরকম একটা কলেজে তোমাদেরকে নিয়ে মাস্টারি করতে পারতাম?”
এবার উনি নিজেই নিজের নামকরণের ইতিহাস ব্যাক্ত করলেন। “আসলে কি জানো, আমি যখন এই কলেজে জয়েন করি, তখন মেকানিক্যাল, সিভিল, মেটালার্জি, মাইনিং এসব ডিপার্টমেন্টের ছাত্রদের ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজি পড়ানোর দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছিল। আর আমি দেখলাম যে এই অন্য ডিপার্টমেন্টের ছেলেদের আমার সাবজেক্ট ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজি জানবার জন্য কোন আগ্রহই নেই। শুধু পাশ করলেই হলো। এই অনাগ্রহী ছাত্রদের পড়াতে আমার অসুবিধা হতো। তখন আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসে। আমার পড়ানোতে তাঁদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য আমি ক্লাসে হাসি ঠাট্টা দিয়ে ওদের মনোযোগ আনবার চেষ্টা করি, মানে ছোটখাটো খানিক পাগলামি করি। ব্যাস, এবার সবাই আমাকে নতুন নামে ডাকতে শুরু করলো।”
আমরা সবাই খুব অবাক হলাম। নিজের প্রতি কতখানি দায়বদ্ধ হলে একজন শিক্ষক তাঁর প্রিয় ছাত্রদের পড়াশুনায় মনোযোগ আকর্ষণ করবার জন্য নিজেকে পাগল বানাতেও পিছ-পা হন নি। আত্মত্যাগ মানে যে সর্বদা কোন আর্থিক বা শারীরিক ত্যাগ হতেই হবে, এমন নয়। এই যে নিজের আত্মসম্মানকে নাটকীয় ভূমিকায় নিয়ে এসে উনার সেই ত্যাগ এর মূল্য আমাদের সেই বয়সে আমরা বুঝতে পারিনি। এখন ওই ঘটনাগুলো মনে পড়লে নিজে থেকেই আমাদের মাথা নত হয়ে পড়ে।
একটি দিনের কথা মনে পড়ে। সম্ভবত ফোর্থ ইয়ারের মাঝামাঝি। কোন একটা বিষয়ে পড়াবার সময় আমাদের একজনকে কিছু একটা প্রশ্ন করে যখন ঠিক মতো উত্তর পেলেন না তখনই হঠাৎ প্রশ্ন করলেন – “আচ্ছা বলো তো – তোমার মাথার ওপর যে পাখাটা ঘুরছে ওটা একটা রডের সাহায্যে ঝুলছে দেখেছো তো?”
আমরা সবাই জানি পাখার একটা রড থাকে, সেটাই ঘরের ছাদের হুকের সাথে ঝোলানো হয়। আমরা সবাই উপরে ঝোলানো পাখাগুলোর দিকে তাকালাম। আগে কখনোই ভেবে দেখিনি ওই রডটা না থাকলে কী হতো।
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কিছু ভালো ছাত্র, মানে আমরা যাদের গেঁড়ে বলতাম, তাদের কয়েকজন সিঙ্গেল ফেজ ইন্ডাকশন মোটরের থিয়োরি বলতে গেলো। স্যার সব্বাইকে এক ধমক দিয়ে থামিয়ে বললেন, “তোমরা এতদিনে কেউ কিচ্ছু বোঝোনি, কিচ্ছু পড়াশোনা করোনি। এই সামান্য প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে না।“ গম্ভীর মুখে বলতে লাগলেন, “ওই রড না থাকলে কি হতো বলতে পারলে না?”
তারপরে আবার বললেন, “পাখার ওই রডটা না থাকলে এই ঘরে গোবরের গন্ধ বের হতো”।
আমরা ভাবতে লাগলাম, পাখার রডের সাথে গোবরের কি সম্পর্ক। সবাই চুপ।
তিনি আবার বললেন, “বুঝলে না তো ? ওই রড না থাকলে ফ্যানটা ওপর থেকে ভেঙে পড়তো। কোথায় পড়তো ? পড়তো তোমাদের মাথায়। মাথা যেতো ভেঙে আর তোমাদের মাথার যত গোবর সব বের হয়ে ঘরময় গোবরের গন্ধ বের হতো। তোমাদের মাথায় তো ঘিলু নেই, ভগবান তো তোমাদের মাথায় ঘিলু দেয় নি, শুধু গোবর দিয়ে ভর্তি করে দিয়েছেন”।
আরও একদিন ক্লাসে একটা বিষয়ে প্রশ্ন করে যখন ঠিক মতো উত্তর পাচ্ছেন না তখনই ফার্স্ট বেঞ্চে বসে থাকা সত্যেনকে বললেন, “আচ্ছা নিমাই তুমি বলো তো”।
সত্যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো – “স্যার আমার নাম নিমাই নয়, আমি সত্যেন”।
স্যার তেমনই গম্ভীর ভাবে বললেন, “আমার নাম কি পাগলা? আমার বাবা-মা কি আমার নাম পাগলা রেখেছিলেন? তাহলে তোমরা আমাকে পাগলা বলো কেন? আমি তো তোমাকে নিমাই বলেই ডাকবো”।
আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম।
আমার কর্ম জীবনের প্রথম দিকে প্রায় দশ এগারো বছর কোল ইন্ডিয়াতে ছিলাম। আমি তখন এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। সেইসময় রাঁচির হেড কোয়ার্টারে আমাদের সাথে আলাপ হয়েছিলো সিভিলের সুপরিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার মিঃ ডি এন মুখার্জীর সাথে। উনিও আমাদের কলেজের প্রাক্তনী। একদিন বিকালে রাঁচির রাস্তায় মিঃ ডি এন মুখার্জীর সাথে স্যারকে দেখে অবাক হলাম। সামনে গিয়ে কথা বললাম আর ওই রাস্তার মাঝেই ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। শুনলাম ওনারা দুজনে ভায়রা ভাই। ডি এন মুখার্জি বড় আর স্যার ছোট। তারপর অনেকক্ষণ নানারকম কথা হলো।
আমরা তখন থার্ড ইয়ারে বা ফোর্থ ইয়ারে, সঠিক সময় মনে করতে পারছি না। স্যারের কিশোরী মেয়ে একদিন ফ্যামিলি কোয়ার্টারের বারান্দায় দাড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। তাই দেখে দুয়েক জন ছাত্র হাসাহাসি করে আর কিছু কটূক্তি করে। স্বভাবতই মেয়ে তাঁর বাবাকে নালিশ করে। স্যার ছেলেদুটিকে চিনতে পেরে তাদের আলাদা ডেকে বকাবকি করেন। তবে শোনা যায় নিজের মেয়েকে তার চেয়েও অনেক বেশী বকাবকি করেন। একদিকে নিজের সন্তান আর অন্য দিকে সন্তান সম ছাত্র।
ফিরে আসি শুভঙ্করের কথায়। আগেই লিখেছি ২০১৭ সালের পূজোর সময় আমরা বার্মিংহাম বেড়াতে গিয়েছিলাম। স্যারের ছেলে শুভঙ্কর তখন ওই অঞ্চলের একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। ডঃ ব্যান্ডি নামেই উনি পরিচিত আর অন্যান্যরা পাপু অথবা পাপুদা বলেই ডাকতো। সব সময় হাসি খুশী, বাবার মতই হাস্যরসিক। বেঙ্গলী এসোসিয়েশন অফ গ্রেটার বার্মিংহামের একজন ফাউণ্ডার মেম্বার আর বর্তমানে প্রেসিডেন্ট। স্ত্রী সতী, মেয়ে চাঁদনী আর ছেলে আলোককে নিয়ে সচ্ছল ও সুখী পরিবার। আমরা বার্মিংহাম থেকে কলকাতা ফেরার কয়েকদিনের মধ্যেই একটা ভীষণ দুঃসংবাদ শুনলাম।
২০১৮ এর ৯ই ফেব্রুয়ারি শুভঙ্কর আর সতী বার্মিংহাম থেকে আটলান্টা হয়ে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে পারিবারিক গেট টুগেদারে যাওয়ার পথে ফ্লাইট টেক-অফ করবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই শুভঙ্করের হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট এটাক হয়। পাইলট তখনই ফ্লাইট আবার বার্মিংহামে ফিরিয়ে আনে। ওকে প্লেন থেকে নামিয়ে একটা যায়গায় শুইয়ে দিয়ে ডাক্তার ওই সময় বুকে হাতের চাপ দিয়ে নানারকম ভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করে আর সতীকে বলে আঙুল দিয়ে হাতের পাল্স চেপে রাখতে – পাল্স-বিট আসে কি না দেখতে। কিন্তু সকলের সব চেষ্টা বিফল হয়ে যায়। পরে এই ঘটনার বিবরণ দিয়ে সতী বলেছিলো – আমি যখন শুভঙ্করের হাত ধরে বসে আছি তখন আমার যেন মনে হলো – ‘সই, কেমনে ধরিব হিয়া – আমার বধূয়া আনবারি যায় আমারই আঙিনা দিয়া’। শুভঙ্করের সাথে সামান্য পরিচয় হলেও তার কথা মনে হয়।
আজ স্যারের কথা মনে হয়। আমি যাকে নিয়ে লিখলাম তিনি সর্বজনপ্রিয় এবং অজাতশত্রু। বিই কলেজে এমন অধ্যাপক খুব কমই আছেন যিনি ডিপার্ট্মেন্ট নির্বিশেষে তিন দশক ধরে সকলের থেকে সন্মান ভালোবাসা পেয়েছেন। ছাত্রদের সাথে উনি যা করেছেন, অনেক পরে বুঝতে পারি যে সেগুলি পাগলামো ছিল না, ছিল অপার শ্বাস্বত স্নেহ। আজ আপনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু আপনার স্মৃতি আমরা বহন করে চলেছি।
সময় তার নিজের গতিতে এগিয়ে চলেছে, এর শেষ কোথায় আমি জানিনা।
A good teacher is like a candle,
it consumes itself to light the way for others.
– Mustafa Kemal Atatürk
********
দ্বিতীয় পর্বে- অথঃ পিএনবি কথা
মানস সামন্ত, ১৯৮১ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আমি আমাদের ইলেকট্রিক্যালের পরম আদরের ও পরম শ্রদ্ধেয় পিএনবি স্যারের একটি ছোট্টো উপাখ্যান লেখার চেষ্টা করছি, কষ্টকল্পিত স্মৃতির সম্পূর্ণ পদলেহন করে।
ওনার পিতৃদত্ত আসল নামটা সত্যিসত্যিই একেবারে ভুলে গেছি। অবশ্য আদৌ কোনোদিন জানতাম কিনা সেই নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। আমি কেন, তিন দশক ধরে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী সকলেই ওনাকে শ্রদ্ধার সাথে মনে রেখেছে, কিন্তু তার মধ্যে কত শতাংশ নামটি মনে রাখতে পেরেছে, এটাই এক বড় প্রশ্ন। ভীষণ মনে পড়ে, খুব ছাত্র-প্রিয় প্রফেসর ছিলেন, তার থেকেও অধিক, একজন রসিক মানুষ ছিলেন। ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের প্রফেসর হলেও, অন্যান্য বিভাগের ছাত্রদেরকেও কাছে আসতে দিতেন, স্নেহ করতেন যথেষ্ট। ….তবে পাগলামি ব্যাতিরেকে নয়, ওটাই ওনার স্বাক্ষর ছিল মানে সিগনেচার চরিত্র, সেখানেই উনি আমাদের হৃদয় জয় করেছিলেন। অনেকটাই গোলমাল সিনেমার উৎপল দত্তের চরিত্রের আদলে।
আমরা তখন বোধহয় মেকানিকালের ফোর্থ ইয়ার, ইলেকটিভ সাবজেক্ট ইলেকট্রিক্যালের এক পেপার। ল্যাব-প্র্যাকটিকালের সময় ইলেকট্রিক তার গুঁজে দেয়া বিদ্যেতে অভ্যস্ত। ল্যাবের সময় ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টরা অনেক উৎসাহ নিয়ে ইলেকট্রিক তার-প্লাগ-সকেট্ যেখানে যেখানে গুঁজে দিতে বলতেন আমরা বিনা প্রশ্নে গুঁজে দিতাম, মোটর ঘুরতো, লাইট জ্বলতো, নম্বর উঠতো। কেন গুঁজে দিলাম, কি কারণে মোটর ঘুরছে সেই মাথাব্যাথা আমাদের ছিল না। অথচ স্যারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কে কোথায় কি কাজ করছে। কার বুকের পাটা আছে যে গিয়ে বলি, স্যার, আমরা মেকানিকালের ছাত্র, যেটা দ্যাখা যায়, তাই নিয়েই আমাদের পড়াশোনা…. লিভার, গিয়ার, ইন্জিন….. ইলেকট্রিসিটি দেখাই যায় না, বোঝা তো দূরের কথা, ইন্ডাক্সন-ক্যাপাসিটেন্স ইত্যাদি পদার্থগুলো জলে গুলবো না মালে ঢালবো, ভাবতে ভাবতেই ফাইনাল পরীক্ষা আসন্ন।
উল্ফে থাকি। আমি, আশীষ, রজত আর হিরক গ্রুপ স্টাডি করি, হিটন উইং এর একতলার কোনের ১০১ এ, আামার রুম-এ। ইলেকট্রিকাল ইলেক্টিভ পেপারের পরীক্ষার আগে দুদিনের গ্যাপ, ফ্লুইড মেকানিক্স এর পরীক্ষাটা কচি করে নামিয়ে, হস্টেলের একতলার লবিতে, ওভালের সবুজ দেখতে দেখতে, মর্চে ধরা টেবিলে দাদুর আনা সেকেন্ড গেটের মোগলাই আর চা সহযোগে সান্ধ্য-আড্ডা হচ্ছে। একটু রিল্যাক্সড।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল, নেক্সট পরীক্ষার জন্য কিছুই তৈরী নেই। আমরা চারমূর্তি গুটিগুটি রুম নম্বর ১০১ এ এসে ক্লাস-নোট্স আর বই সব বিছিয়ে বসলাম। কিছুটা সময়ের পরই বুঝলাম যে, অগাধ সমুদ্র… অথৈ জল…কোন চ্যাপ্টার পড়বো আর কোনটা ছাড়বো…একটা র্যাডার না হলে আমরা নির্ঘাৎ ডুববো।
সেই ব্রহ্ম-ক্ষনে রজতের মাথায় বুদ্ধির আবির্ভাব হলো—- চল পাগলা স্যারের কাছ থেকে সাজেসন নিয়ে আসি, যদি কিছু গতি হয়। উনি সর্বদা ছাত্রদরদী, আমাদের সমস্যা নিশ্চয়ই বুঝবেন।
স্যার তখন পান্ডিয়া হলের সুপার, লাগোয়া বাগান ঘেরা বাংলোয় থাকেন। আমরা চারজন, হাওয়াই চটি ফ্যাটফেটিয়ে চার-বুক আশায় ভর করে, ভর সন্ধ্যেবেলায় স্যারের কোয়ার্টারের দরজায় পৌছলাম। দরজা আদ্ধেক খোলাই ছিল। বাইরে থেকেই দেখলাম, স্যার পাজামা পরে আদুর গায়ে মাটিতে বসে চা খেতে খেতে, তিন- চার বছরের নাতনী টুনির সঙ্গে খেলা করছেন। আমরা এমতাবস্থায় ভেতরে ঢুকবো কি ঢুকবো না ভাবতে ভাবতে, নিয়তির টানে, কখন যে ঢুকে পড়েছি জানিনা। স্যারের চকচকে চোখের সহাস্য “এসো এসো” রবে আমরা সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
স্যারের বাড়িতে সেই প্রথম যাওয়া, তা সত্বেও তিনি জিজ্ঞেসও করলেন না, আমরা কেন ওনার কাছে হাজির হয়েছি…… সবই যে বুঝতে পারছেন, সেটা ওনার সেই চির পরিচিত মুচকি মুচকি হাসি থেকেই বেশ ঠাহর হচ্ছে। যাক, উনি বুঝতে পেরেছেন। আমরাও কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত।
উনি আমাদের বসতে বললেন। হাঁক মেরে অন্দরমহল থেকে আমাদের জন্য চা- বিস্কিট আনালেন। আমরা ইতস্তত করতে করতে চা-বিস্কিটের সদ্ব্যবহার করছি আর আমাদের প্রসঙ্গটা কথার ফাঁকে ফাঁকে যতই তোলার চেষ্টা করছি, আর স্যার ততধিক নাতনির গুনপনা আর আবদারের গল্প নিয়ে মেতে উঠছেন।
কি আর করা, আমরাও স্যারের মন ভেজানোর জন্য টুনির সঙ্গে আদেখলা শুরু করে দিলাম।
– টুনি, টু প্লাস টু কত হয়?
– টুনি, তুমি বা বা ব্ল্যাকশিপ জানো?
– টুনি, বলোতো বিড়াল কি ভাবে ডাকে?
– টুনি, — টুনি, —-টুনি।
টুনিকে নিয়ে আমরা ব্যস্ত হওয়ার ফাঁকে, হঠাৎই দেখতে পেলাম, স্যার উঠে দাঁড়িয়ে, অন্দরমহলের দিকে এগিয়ে চলেছেন। তখন আমাদের যেন নক্আউট ফুটবল ম্যাচের গোলশূন্য অবস্থায় নব্বই মিনিটের শেষ বাঁশীর চরম মুহূর্ত।
আমরা প্রায় সমস্বরেই আকুতি করে উঠলাম–
স্যার, কয়েকটা সাজেসন আপনি না দি….
আমাদের কথা শেষ হয়নি, স্যার ভেতরে যাওয়ার দরজায় পৌঁছে গেছেন। উনি আমাদের দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হতে হতে, নরম তুলতুলে আদুরে স্বরে বলে গেলেন….
টুনি, কাকু দের এবার সাজেসন গুলোও দিয়ে দিয়ো।
*******
Add comment