সাহিত্যিকা

প্রফেসর পি এন ব্যানার্জী স্মরণে

প্রফেসর পি এন ব্যানার্জী স্মরণে
প্রবীর কুমার সেনগুপ্ত, ১৯৬৯ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

সত্তরোর্ধ বয়সে এসে এখন আমরা বুঝতে পারি যে কলেজ হোস্টেলের সেই পাঁচটি বছর ছিল জীবনের সবচেয়ে আনন্দের। দিনের সাতটি ঘণ্টা কেটে যেতো ক্লাসরুমে শিক্ষকদের নরম গরম শাসনে আর ভাষণে। বাকি সতেরো ঘণ্টা কাটত হোস্টেল, ডাইনিং হল, ওভাল, লর্ডস, জিম, সুইমিং পুল, বোটানিক্যাল গার্ডেন অথবা ফার্স্ট গেট বা সেকেন্ড গেটে। ক্যাম্পাসের বাইরের দোকানগুলো ছাড়াও ৫৫ নং বাসে কলকাতায় সাহেবপাড়া ধর্মতলা সিনেমা হল অভিযানে। কলেজ পরবর্তী জীবনে এই হুল্লোড়ে সুযোগ আর পাইনি। কাজেই ক্যাম্পাসে বড় হওয়া আর সেরা শিক্ষকদের বিদ্যাদান ও স্নেহের সৌভাগ্যময় সান্নিধ্যে আমাদের ভবিষ্যৎ গঠনে এই সতেরো আর সত্তরের টানাপোড়েন বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ওই সময়ের সারা দিনের নির্ঘণ্ট হিসাব করলে বেশ বোঝা যায় সতেরো আর সত্তরের হিসাব নিকাশ।

সতেরোর কথা যদি বলতে হয় তবে কার কথা যে বলবো আর কার কথা বলবো না সেটাই সমস্যা। তবে একজনের নাম আমাদের বন্ধুমহলের আলোচনায় প্রায়ই চলে আসে। সেই ভাবনায় আজ আমি আমাদের ইলেকট্রিকালের প্রফেসর পি এন ব্যানার্জি’কে নিয়ে দু’চারটি কথা বলে তাঁকে প্রণাম জানাতে চাই।

প্রফেসর পি এন ব্যানার্জি বা প্রমথ নাথ ব্যানার্জি বললে অনেকেই হয়তো বুঝতে পারবে না, পঞ্চাশের দশক থেকেই উনি ভিন্ন নামে পরিচিত। ১৯৬৪ সালে কলেজে ঢুকেছিলাম। তারপর কেন উনার সেই নামকরণ হলো, কে এই নামকরণ করলো সে ইতিহাস কেউ জানি না। শুধু এইটুকু জানি যে বিগত দশ পনেরো বছর আগে উনি প্রথম যখন অধ্যাপক হয়ে কলেজে এসেছিলেন তখন থেকেই উনার এই নাম চলে আসছে। পরে অবশ্য উনি নিজেই একদিন ক্লাসে এই নামকরণের ইতিহাস আমাদের বলেছিলেন, সেই ঘটনায় পরে আসছি।

সম্প্রতি, বছর সাতেক আগে ২০১৭ সালে আমি আমার স্ত্রী’কে নিয়ে আমাদের ছেলে-বৌমা আর নাতি-বাবুর কাছে ইউ এস এ-র অ্যালাব্যামা স্টেটে বার্মিংহাম শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন বার্মিংহাম বেঙ্গলী এসোসিয়েশনের দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি চলছে। পঞ্জিকার তিথি মানা সম্ভব নয় তাই মহাষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত সকল আয়োজন কোন এক শনি আর রবিবারে ওই দুই দিনের মধ্যেই সারা হয়। আবালবৃদ্ধবনিতা অর্থাৎ সকল বয়সের নারী-পুরুষের রঙবাহারি পোষাকে মন্ডপ আলোকিত। সেই ভিড়ের মাঝে দেখলাম একজন কমবয়সী পুরুষ ধবধবে সাদা ধুতি আর নূতন গেঞ্জি গায়ে ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে পূজোর তদারক করছেন। আমার ছেলে ওনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, “শুভঙ্কর দা, আমাদের বেঙ্গলী এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং আমাদের পুজোর প্রধান পুরোহিত। ওনার স্ত্রী, সতী দি, অন্যান্য কয়েকজন মহিলার সাহায্যে আমাদের পূজোর সব আচার অনুষ্ঠান জোগাড় করেন”।

শুভঙ্করের সাথে পরিচয় হলো। এর পরেই আমার ছেলে জানালো, “তোমার জন্য শুভঙ্কর-দার আরও একটা পরিচয় আছে। উনি তোমাদের কলেজের প্রফেসর পি এন ব্যানার্জির ছেলে”।
শুভঙ্কর হাসতে হাসতে নিজেই বললো, “পি এন ব্যানার্জি বললে হয়তো আপনি চিনবেনই না। আমার বাবা পাগলা ব্যানার্জী নামেই পরিচিত ছিলেন।“
বলেই শুভঙ্কর হেসে উঠল। আরও অনেক গল্প হলো। আন্দাজ করলাম আমরা ১৯৬৯ সালে যখন পাশ করি, শুভঙ্করের বয়স তখন হবে নয়-দশ বছর।

এক নিমেষে আমি প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের দিন গুলোতে ফিরে গেলাম। সময়টা ১৯৬৯ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসের কোন একটা দিন। ফাইন্যাল পরীক্ষার ঠিক আগে সেদিন আমাদের কলেজ জীবনের শেষ ক্লাসটি হবে। ক্লাসে সব মাস্টারমশাই রয়েছেন। ডাঃ শঙ্কর সেন, প্র. আর সি পাল, প্র. পি এন ব্যানার্জি, প্র. বি কে বোস, প্র. বিষ্টু ভট্টাচার্য, চিত্ত’দা, যামিনী’দা, দীপ্তেন’দা, প্র. জয়ন্ত সেন, মুস্তফি স্যার এবং আমাদের ইলেক্ট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের প্রায় সবাই। ডঃ শঙ্কর সেন সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আজ তোমাদের শেষ ক্লাস। আজকে আমরা কেউই তোমাদের পড়াতে আসিনি। বরং তোমাদের কাছ থেকেই জানতে চাইছি। তোমাদের যে এতদিন পড়ালাম তার কোথায় কোথায় তোমাদের খারাপ লেগেছে বা কোথায় গলদ রয়েছে – আজ সেই দিকগুলো আমাদের খোলাখুলি বলো। যাতে পরের ব্যাচে ছাত্ররা একই সমস্যায় না পরে”। আমরা সবাই চুপ। সেই যুগে মাস্টারমশাইদের বিরুদ্ধে কিছু বলা আমাদের কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না।

এক এক করে সব মাস্টারমশাই আমাদের কিছু না কিছু বললেন।
এরপর এলেন প্রফেসর পি এন ব্যানার্জী। তিনি তার স্বভাবসুলভ হাসি মুখে প্রথমেই বললেন, “আমি জানি তোমরা সবাই আমাকে পাগলা ব্যানার্জী বলো। সামনের সিটে বসা একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন – কি আমাকে পাগলা ব্যানার্জী বলো কি না?” ক্লাসের আমরা সবাই হাসাহাসি করছি। এমনকি শিক্ষকদের মধ্যেও অনেকেই মুখ টিপে নীরবে হাসছেন।
উনি আবার বললেন, “কিন্তু তোমরা একবারও ভেবে দেখনি যে আমি সত্যিই পাগল কি না। আমি যদি সত্যিই পাগল হতাম তাহলে কি এইরকম একটা কলেজে তোমাদেরকে নিয়ে মাস্টারি করতে পারতাম?”

এবার উনি নিজেই নিজের নামকরণের ইতিহাস ব্যাক্ত করলেন। “আসলে কি জানো, আমি যখন এই কলেজে জয়েন করি, তখন মেকানিক্যাল, সিভিল, মেটালার্জি, মাইনিং এসব ডিপার্টমেন্টের ছাত্রদের ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজি পড়ানোর দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছিল। আর আমি দেখলাম যে এই অন্য ডিপার্টমেন্টের ছেলেদের আমার সাবজেক্ট ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজি জানবার জন্য কোন আগ্রহই নেই। শুধু পাশ করলেই হলো। এই অনাগ্রহী ছাত্রদের পড়াতে আমার অসুবিধা হতো। তখন আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসে। আমার পড়ানোতে তাঁদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য আমি ক্লাসে হাসি ঠাট্টা দিয়ে ওদের মনোযোগ আনবার চেষ্টা করি, মানে ছোটখাটো খানিক পাগলামি করি। ব্যাস, এবার সবাই আমাকে নতুন নামে ডাকতে শুরু করলো।”

আমরা সবাই খুব অবাক হলাম। নিজের প্রতি কতখানি দায়বদ্ধ হলে একজন শিক্ষক তাঁর প্রিয় ছাত্রদের পড়াশুনায় মনোযোগ আকর্ষণ করবার জন্য নিজেকে পাগল বানাতেও পিছ-পা হন নি। আত্মত্যাগ মানে যে সর্বদা কোন আর্থিক বা শারীরিক ত্যাগ হতেই হবে, এমন নয়। এই যে নিজের আত্মসম্মানকে নাটকীয় ভূমিকায় নিয়ে এসে উনার সেই ত্যাগ এর মূল্য আমাদের সেই বয়সে আমরা বুঝতে পারিনি। এখন ওই ঘটনাগুলো মনে পড়লে নিজে থেকেই আমাদের মাথা নত হয়ে পড়ে।

একটি দিনের কথা মনে পড়ে। সম্ভবত ফোর্থ ইয়ারের মাঝামাঝি। কোন একটা বিষয়ে পড়াবার সময় আমাদের একজনকে কিছু একটা প্রশ্ন করে যখন ঠিক মতো উত্তর পেলেন না তখনই হঠাৎ প্রশ্ন করলেন – “আচ্ছা বলো তো – তোমার মাথার ওপর যে পাখাটা ঘুরছে ওটা একটা রডের সাহায্যে ঝুলছে দেখেছো তো?”
আমরা সবাই জানি পাখার একটা রড থাকে, সেটাই ঘরের ছাদের হুকের সাথে ঝোলানো হয়। আমরা সবাই উপরে ঝোলানো পাখাগুলোর দিকে তাকালাম। আগে কখনোই ভেবে দেখিনি ওই রডটা না থাকলে কী হতো।
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কিছু ভালো ছাত্র, মানে আমরা যাদের গেঁড়ে বলতাম, তাদের কয়েকজন সিঙ্গেল ফেজ ইন্ডাকশন মোটরের থিয়োরি বলতে গেলো। স্যার সব্বাইকে এক ধমক দিয়ে থামিয়ে বললেন, “তোমরা এতদিনে কেউ কিচ্ছু বোঝোনি, কিচ্ছু পড়াশোনা করোনি। এই সামান্য প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে না।“ গম্ভীর মুখে বলতে লাগলেন, “ওই রড না থাকলে কি হতো বলতে পারলে না?”
তারপরে আবার বললেন, “পাখার ওই রডটা না থাকলে এই ঘরে গোবরের গন্ধ বের হতো”।
আমরা ভাবতে লাগলাম, পাখার রডের সাথে গোবরের কি সম্পর্ক। সবাই চুপ।
তিনি আবার বললেন, “বুঝলে না তো ? ওই রড না থাকলে ফ্যানটা ওপর থেকে ভেঙে পড়তো। কোথায় পড়তো ? পড়তো তোমাদের মাথায়। মাথা যেতো ভেঙে আর তোমাদের মাথার যত গোবর সব বের হয়ে ঘরময় গোবরের গন্ধ বের হতো। তোমাদের মাথায় তো ঘিলু নেই, ভগবান তো তোমাদের মাথায় ঘিলু দেয় নি, শুধু গোবর দিয়ে ভর্তি করে দিয়েছেন”।

আরও একদিন ক্লাসে একটা বিষয়ে প্রশ্ন করে যখন ঠিক মতো উত্তর পাচ্ছেন না তখনই ফার্স্ট বেঞ্চে বসে থাকা সত্যেনকে বললেন, “আচ্ছা নিমাই তুমি বলো তো”।
সত্যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো – “স্যার আমার নাম নিমাই নয়, আমি সত্যেন”।
স্যার তেমনই গম্ভীর ভাবে বললেন, “আমার নাম কি পাগলা? আমার বাবা-মা কি আমার নাম পাগলা রেখেছিলেন? তাহলে তোমরা আমাকে পাগলা বলো কেন? আমি তো তোমাকে নিমাই বলেই ডাকবো”।
আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম।

আমার কর্ম জীবনের প্রথম দিকে প্রায় দশ এগারো বছর কোল ইন্ডিয়াতে ছিলাম। আমি তখন এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। সেইসময় রাঁচির হেড কোয়ার্টারে আমাদের সাথে আলাপ হয়েছিলো সিভিলের সুপরিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার মিঃ ডি এন মুখার্জীর সাথে। উনিও আমাদের কলেজের প্রাক্তনী। একদিন বিকালে রাঁচির রাস্তায় মিঃ ডি এন মুখার্জীর সাথে স্যারকে দেখে অবাক হলাম। সামনে গিয়ে কথা বললাম আর ওই রাস্তার মাঝেই ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। শুনলাম ওনারা দুজনে ভায়রা ভাই। ডি এন মুখার্জি বড় আর স্যার ছোট। তারপর অনেকক্ষণ নানারকম কথা হলো।

আমরা তখন থার্ড ইয়ারে বা ফোর্থ ইয়ারে, সঠিক সময় মনে করতে পারছি না। স্যারের কিশোরী মেয়ে একদিন ফ্যামিলি কোয়ার্টারের বারান্দায় দাড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। তাই দেখে দুয়েক জন ছাত্র হাসাহাসি করে আর কিছু কটূক্তি করে। স্বভাবতই মেয়ে তাঁর বাবাকে নালিশ করে। স্যার ছেলেদুটিকে চিনতে পেরে তাদের আলাদা ডেকে বকাবকি করেন। তবে শোনা যায় নিজের মেয়েকে তার চেয়েও অনেক বেশী বকাবকি করেন। একদিকে নিজের সন্তান আর অন্য দিকে সন্তান সম ছাত্র।

ফিরে আসি শুভঙ্করের কথায়। আগেই লিখেছি ২০১৭ সালের পূজোর সময় আমরা বার্মিংহাম বেড়াতে গিয়েছিলাম। স্যারের ছেলে শুভঙ্কর তখন ওই অঞ্চলের একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। ডঃ ব্যান্ডি নামেই উনি পরিচিত আর অন্যান্যরা পাপু অথবা পাপুদা বলেই ডাকতো। সব সময় হাসি খুশী, বাবার মতই হাস্যরসিক। বেঙ্গলী এসোসিয়েশন অফ গ্রেটার বার্মিংহামের একজন ফাউণ্ডার মেম্বার আর বর্তমানে প্রেসিডেন্ট। স্ত্রী সতী, মেয়ে চাঁদনী আর ছেলে আলোককে নিয়ে সচ্ছল ও সুখী পরিবার। আমরা বার্মিংহাম থেকে কলকাতা ফেরার কয়েকদিনের মধ্যেই একটা ভীষণ দুঃসংবাদ শুনলাম।

২০১৮ এর ৯ই ফেব্রুয়ারি শুভঙ্কর আর সতী বার্মিংহাম থেকে আটলান্টা হয়ে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে পারিবারিক গেট টুগেদারে যাওয়ার পথে ফ্লাইট টেক-অফ করবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই শুভঙ্করের হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট এটাক হয়। পাইলট তখনই ফ্লাইট আবার বার্মিংহামে ফিরিয়ে আনে। ওকে প্লেন থেকে নামিয়ে একটা যায়গায় শুইয়ে দিয়ে ডাক্তার ওই সময় বুকে হাতের চাপ দিয়ে নানারকম ভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করে আর সতীকে বলে আঙুল দিয়ে হাতের পাল্স চেপে রাখতে – পাল্স-বিট আসে কি না দেখতে। কিন্তু সকলের সব চেষ্টা বিফল হয়ে যায়। পরে এই ঘটনার বিবরণ দিয়ে সতী বলেছিলো – আমি যখন শুভঙ্করের হাত ধরে বসে আছি তখন আমার যেন মনে হলো – ‘সই, কেমনে ধরিব হিয়া – আমার বধূয়া আনবারি যায় আমারই আঙিনা দিয়া’। শুভঙ্করের সাথে সামান্য পরিচয় হলেও তার কথা মনে হয়।

আজ স্যারের কথা মনে হয়। আমি যাকে নিয়ে লিখলাম তিনি সর্বজনপ্রিয় এবং অজাতশত্রু। বিই কলেজে এমন অধ্যাপক খুব কমই আছেন যিনি ডিপার্ট্মেন্ট নির্বিশেষে তিন দশক ধরে সকলের থেকে সন্মান ভালোবাসা পেয়েছেন। ছাত্রদের সাথে উনি যা করেছেন, অনেক পরে বুঝতে পারি যে সেগুলি পাগলামো ছিল না, ছিল অপার শ্বাস্বত স্নেহ। আজ আপনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু আপনার স্মৃতি আমরা বহন করে চলেছি।

সময় তার নিজের গতিতে এগিয়ে চলেছে, এর শেষ কোথায় আমি জানিনা।

A good teacher is like a candle,
it consumes itself to light the way for others.
– Mustafa Kemal Atatürk

********

শিক্ষা (দুটি ভিন্ন ঘটনা)

পর্ব ১
অনেক বছর আগের কথা। দিনটা ছিল ৩১ জানুয়ারী। অফিস ছুটির পর পার্ক স্ট্রিটে এসে মিনিবাস ধরবো বলে স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালাম। সব বাসেই প্রচণ্ড ভিড়। বাস এসে দাঁড়াতেই স্ট্যান্ডের সবাই একসাথে বাসের দরজায় ঝাঁপিয়ে পরছে আর বাসের হেল্পার রাস্তায় নেমে যতজনকে পারে ঠেলে ঠুলে কোন রকমে বাসের ভিতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর কন্ডাক্টর – “পিছন দিকে এগিয়ে যান, পিছন দিকে এগিয়ে যান” বলে তাদের ঠেলে ঠুলে পিছনের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

আমার দ্বারা এইভাবে বাসে ওঠা সম্ভব নয়। তাই বুদ্ধি করে এক স্টপেজ পিছিয়ে গিয়ে ময়দান স্টপের থেকে কোনরকমে একটা বাসে উঠলাম। এদিক ওদিক ঠেলাঠেলি করে একটা সীটের সামনে গিয়ে হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়ালাম। বেশ কষ্ট করেই দাঁড়িয়ে আছি।

পার্ক স্ট্রিট স্টপেজ আসতেই আবার অনেকেই বাসে উঠলো, কেউ পারলো না। একজন সুবেশা তরুণী বাসের পাদানিতে পা দেওয়ার সাথে সাথে তাঁর ঠিক পিছনে থাকা সঙ্গীকে বলে উঠলো – শ্যামলদা, শ্যামলদা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন। দেখলাম, অন্যদের ধাক্কা দিয়ে শ্যামলদা ঠিক উঠে পড়লো, আর প্যাসেঞ্জারদের ধাক্কা মেরে মেরে বাসের ড্রাইভারের পিছন দিকে দাঁড়াবার আশায় ওইদিকে এগিয়ে গেলো। আর মহিলা এগিয়ে এসে আমার প্রায় পিছনে এসে দাঁড়ালেন। আমি আমার ঠিক সামনের সিটের হ্যান্ডেল ধরে এমনভাবে দাঁড়ালাম যাতে এই সিট খালি হলে আমি বসতে পারি। অনেক দূর যেতে হবে। এই বাস যেখানে শেষ হয় অর্থাৎ দমদম সেন্ট মেরিজ।

আমার ভাগ্য ভালো। এসপ্ল্যানেড আসতেই আমার ঠিক সামনের সিটটা খালি হলো। আমার ঠিক সামনে বসা ভদ্রলোক নিজের হাঁটু সামনের দিকে এগিয়ে এনে আমাকে ইশারা করলেন জানলার দিকে বসবার জন্য। আমি আমার ঠিক পিছনে দাঁড়ানো সেই ভদ্রমহিলাকে জায়গা করে দিয়ে বললাম – আপনি বসুন।
ভদ্রমহিলা এক গাল হেসে বললেন – ভালই হল। আসলে আমাকে অনেক দূর যেতে হবে।
তারপর সামনে বসা ভদ্রলোকের হাঁটুতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে জানলার কাছে গিয়ে বসলেন।

চাঁদনি চক আসতেই আমার সামনের ভদ্রলোক সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন – আপনি বসুন, আমি নেমে যাবো। আমি ভাবলাম – যাক ভালোই হল। আমাকে অনেকটা দূর যেতে হবে।
কিন্তু আমাকে হতবাক করে সেই মহিলা নিজের ঢাউস ভ্যানিটি ব্যাগটা খালি সিটের ওপর রেখে তার ওপর নিজের হাত দুটো চেপে বলে উঠলেন – শ্যামলদা, শ্যামলদা তাড়াতাড়ি আসুন – আপনার জন্য সিট রেখেছি।
শ্যামলদা এতক্ষণ ড্রাইভারের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মহিলার ডাক শুনে সবাইকে ধাক্কা ধাক্কি করে আমার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়ালেন। আমি জানি আমি সরে না গেলে আমাকে ডিঙ্গিয়ে ওখানে কারো বসবার সাধ্য বা ক্ষমতা নেই। তাই আমাকে উনি বললেন – সরে যান আমি বসবো।

এত ঘটনা খুব তাড়াতাড়ি ঘটে গেছে। পার্ক স্ট্রীট থেকে চাঁদনি চক পর্যন্ত, মাত্র দুটি স্টপেজ। আশেপাশের লোকজন ব্যাপারটি বেশ ভালোই উপভোগ করছেন, কেউ কেউ হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছেন। মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক ওই মহিলাকে বলে দিলেন – দিদি, আপনি তো বেশ স্বার্থপর। এই ভদ্রলোক নিজে সুযোগ পেয়েও আপনাকে সিট ছেড়ে দিলেন। আর আপনি এখন ওনাকেই বসতে না দিয়ে আপনার শ্যামলদাকে ডাকছেন? এই রকম আরও অনেক মন্তব্য শুনে মহিলাটি নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ সরিয়ে আমাকে বললেন – আচ্ছা আপনিই বসুন।
শ্যামলদাও বললেন – হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি বসুন।

এইবার আমার বলার পালা। বললাম, “আপনার পাশে বসবার একটুও ইচ্ছা আমার নেই। আমার আরও অনেক কিছু বলার ইচ্ছা ছিল কিন্তু কিছু বললাম না।“
আমার সামান্য পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক বয়স্ক ভদ্রলোককে ডেকে বসতে দিলাম।

বাস চলছে। আশেপাশের গুঞ্জন থেমে গেছে। হঠাৎ আমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ওই শ্যামলদা বসে থাকা মহিলাকে বললেন, – চলে এসো। আমরা এখানে নেমে যাবো। এই বলে এয়ার ইন্ডিয়া অফিসের সামনে দুজনেই নেমে পড়লেন।
যাই হোক আমি এইবার বসলাম। আমাকে এখনও অনেক দূর যেতে হবে।

পর্ব ২
সেদিন বাসে যেতে যেতে আমার আরও একটা দিনের কথা মনে পড়লো। কতদিন আগের, আমার ঠিক মনে নেই। তবে ঘটনাটা আমার এখনও মনে আছে।

সেই দিনটা ছিলো রবিবার। শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে আমি-মিলি টিঙ্কা আর টিপুকে নিয়ে মধ্যমগ্রাম যাবো। রোববারের সকাল –রাস্তাও ফাঁকা। খুব তাড়াতাড়ি শিয়ালদা ষ্টেশনে পৌঁছে গেলাম। মিলি লেডিস কাউন্টারের ছোট লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটলো। আর আমরা টিকিট হাতে পেয়েই দৌড় শুরু করলাম। টিঙ্কা আর টিপু তখন খুব ছোট। ওরাও আমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে চার নম্বর প্লাটফরমের দিকে দৌড় লাগালো। ওদিকে কয়েক হাজার লোকও চার নম্বর প্লাটফরমের দিকে দৌড়চ্ছে, কে আগে গাড়িতে উঠে জায়গা দখল করতে পারে তারই প্রতিযোগিতা।

আমাদের এতদিনের মধ্যমগ্রাম যাতায়াতের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সামনের দিকে একদম ইঞ্জিনের কাছাকাছি একটু খালি কামরা পাওয়া যায়। কপাল ভালো থাকলে বসবার জায়গাও পেয়ে যেতে পারি। অনেকটা এগিয়ে মোটামুটি খালি একটা কামরায় বসবার জায়গাও পেয়ে গেলাম। লোকাল ট্রেনের তিনজনের বসবার সিটে চারজনের বসাটাই তখন নিয়ম হয়ে গেছে। তাই আমরাও বসতে পারলাম। টিঙ্কা, টিপু আর মিলি একটা সিটে বসলো। আমি ওদের উলটো দিকের সিটে কোনরকমে বসেছি।

ট্রেন ছাড়তে আরও প্রায় মিনিট পাঁচেক বাকি। ট্রেনে ভিড় বাড়ছে। এমন সময় হাওয়াই চপ্পল পরা একটি লোক আধময়লা পায়জামা আর সেইরকমই একটা ফুল হাতা সার্ট, মাথায় শতরঞ্চিতে বাঁধা এক বোঁচকা নিয়ে আমাদের কম্পারট্মেন্টে উঠলো। নজর করে দেখলাম সার্টের ভিতর থেকে ময়লা গেঞ্জিটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেসব দিকে ওর কোন চিন্তা আছে বলে মনে হল না। ঠিক তার পিছনে একটি মেয়ে, মনে হল তার বউ – একা হাতে কোলে একটা প্রায় নেংটা বাচ্চাকে ধরে আর এক হাতে আরও একটা বোঁচকা নিয়ে উঠলো। বাচ্চাটির গলায় দুটো তিনটে মাদুলি। বোঝা যায় বিনা টিকিটের যাত্রী। ট্রেন ছেড়ে দিলো। ওই মেয়েটি এদিক ওদিক করতে করতে বাচ্চা আর বোঁচকা নিয়ে আমাদের সিটের কাছে এসে দাঁড়ালো। তারপর কোনরকমে মাথার বোঁচকাটা উপরে তুলে দিয়ে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ট্রেনের ওই দুলনির মধ্যেও বেশ ব্যালান্স করে দাঁড়ালো। বাচ্চাটার নাক দিয়ে জল ঝরছে, মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠছে, আর মা তাঁকে সামলানোর চেষ্টা করছে।

বাচ্চাটার কথা ভেবে আমি উঠে দাড়িয়ে আমার সিট ছেড়ে দিয়ে ওই মা আর বাচ্চাটাকে বসতে দিলাম। আমাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে মিলি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো। বুঝলাম আমার এই কাজটা মিলি একেবারেই পছন্দ করে নি কিন্তু ভীড়ের মধ্যে কিছুই বলতেও পারলো না। বাচ্চা আর বউ বসার জায়গা পেয়েছে দেখে সেই লোকটি আরও অনেকটা এগিয়ে এলো। আমি একটু সরে গেলাম। ট্রেন চলতে লাগলো।

দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন আসবার একটু আগে বাচ্চার মায়ের পাশের প্যাসেঞ্জার উঠে দাঁড়ালো। বুঝলাম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে নামবে। আমি একটু পিছিয়ে গিয়ে তাঁকে এগিয়ে যাবার জায়গা করে দিলাম। আর এই সুযোগে বাচ্চাটির বাবা ওই খালি সিটে বসতে গেলো। তখনই বাচ্চার মা বলে উঠলো – না, না, তু এহানে বস্‌বেক ক্যান? উই দাদাটা মুকে বস্‌তেক দিলে। উই দাদাটেকে বস্‌তেক দাও নে ক্যানে?
বৌয়ের কাছে বাঁধা পেয়ে লোকটিও তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে আমাকে বসতে দিল। বুঝলাম বেশ লজ্জা পেয়েছে।
আমি দেখলাম এর পরেই বিরাটি আর নিউ ব্যারাকপুর আর তার পরেই মধ্যমগ্রাম। আর মাত্র দুটো স্টেশন। তাই বসবার চেষ্টা না করে ওই বাচ্চার বাবাকেই বসতে দিলাম।

নিজের মনেই ওই মেয়েটির তারিফ না করে পারলাম না।
এরা পয়সার অভাবে বই পড়া বিদ্যা পায়নি, স্কুল কলেজে যাওয়ার সুযোগও পায়নি। কিন্তু এই মেয়েটি প্রকৃত মানসিক শিক্ষা নিশ্চয় পেয়েছে। এরা এই শ্যামলদার বান্ধবীর থেকে অনেক বেশি শিক্ষিতা।

********

 

 

Sahityika Admin

Add comment