কৃতজ্ঞতা স্বীকার
মানস ঘোষ, শিশির কুমার ঘোষের পুত্র
১৯৭০ সালে আমার জন্মের একবছরের মধ্যেই বাবা শিশির কুমার ঘোষের বদলি হয় বি ই কলেজের P. W. D (Electrical) অফিসে। সেই থেকে দীর্ঘ আঠারো বছর পরিবারটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে যায় এই ক্যাম্পাসের পরিবেশ, মানুষ, উৎসব, আনন্দের সঙ্গে। অনেক জ্ঞানী গুণী মানুষের সাহচর্য ও প্রতিবেশীদের আন্তরিক ব্যবহার বাবাকে পরিপূর্ণ ও সামাজিক ভাবে খুবই সক্রিয় করে তুলেছিল। কো-অপারেটিভ হোক বা কালীপূজা, দুর্গোৎসব হোক বা নাটকের মহড়া সবেতেই তাঁর ছিল সমান উৎসাহ। অসমবয়সী বন্ধু প্রদীপকাকু (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) ছিলেন সবেতেই তাঁর সঙ্গী।
আর এই সময় একটু একটু করে বড় হচ্ছিলাম আমরা। শিশু থেকে কিশোর, সে বয়সে বি ই কলেজে পড়া দাদারাই আমাদের চোখে হিরো। কল্যাণব্রতদার নাটক মনে পড়ে, পল্লবদার গান, বিমানদার রাজনৈতিক স্লোগান,স্পোর্টসে ব্রততীদির অলরাউন্ড পারফরমেন্স,বাস্কেট কোর্টে দাপিয়ে বেড়াত মহাদেব সোম, মানসদা, অরূপদারা, ক্রিকেট মাঠে, ক্যাপ্টেন হরিদা,পরমেশদা, সবার নাম আজ আর মনে নেই। স্বপ্নের মত দিনগুলো একসময় পার হযে যায়। সেই কিশোর এখন পঞ্চাশোর্ধ। তবু বারবার ঘুরে ফিরে এসে দাঁড়ায় বি ই কলেজ ফার্স্ট গেটের সামনে। কী যেন এক আগ্রহ তার চোখেমুখে। যেন গলা বাড়িয়ে একটু ভেতরদিকে তাকালেই দেখতে পাবে ফেলে আসা আঠারোটা বছর, তার গড়ে ওঠার দিনগুলি।
মানুষের শ্রেষ্ঠ গুরু যে তার মা-বাবা এ কথা সর্বজন স্বীকৃত। আমার জীবনেও তাঁদের প্রভাব নিয়ে লিখতে গেলে বড় একটা প্রবন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সে রচনা প্রায় ছত্রে ছত্রে মিলে যাবে, অন্য কোনো সন্তানের কৃতজ্ঞতা স্বীকারের অনুভূতির সঙ্গে। তাই মনে হল, বাবা মা, বা স্কুল কলেজের শিক্ষক,তাঁরা তো, tech যুগের ভাষায় বলতে গেলে – by default আমাদের শিক্ষাগুরু। কিন্তু জীবনে চলার পথে এই যে আমরা ক্রমাগত শিখে চলেছি, এই যে শিক্ষার একটা নিরন্তর প্রক্রিয়া, তার প্রতিটা বাঁকেই কিন্তু এক বা একাধিক গুরু থাকেন। কখনো কোনো ব্যক্তি আবার কখনো বা পরিবেশ, পরিস্থিতি, সময় এসে দাঁড়ায় সেই গুরুর ভূমিকায়। যেমন আমার গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় বি ই কলেজ ক্যাম্পাস পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম।
যেটুকু না বললেই নয়, ৫ নম্বর ছন্দে আছে বি ই কলেজের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাকটর অকালপ্রয়াত অরুণকাকুর কথা। শিশু কিশোরদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই আদৰ্শবান মানুষটি আজও আমায় প্রভাবিত করে রেখেছেন। একই কথা বলা চলে ড. প্রদীপ রায় (অধ্যাপক, বি ই কলেজ, সিভিল) কাকুর সম্পর্কে। ৩ নম্বর ছন্দে যে শেখার প্রক্রিয়ার কথা বলা আছে, তার অন্তরালে ছিলেন প্রদীপকাকু।
এখানে কয়েকটি দু/তিন লাইনের ছন্দের মাধ্যমে আমার জীবনের বিভিন্ন গুরুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবার চেষ্টা করেছি। শিক্ষাগুরুর অবদান কখনো টু লাইনারে প্রকাশ করা যায় না। তবু এই দু লাইনের আভাস যদি পাঠকের কল্পনাকে উজ্জীবিত করতে পারে, আনন্দ দেয়, তাহলেই আমার এ প্রচেষ্টা সার্থক।
গুরু
১
আটার থালায় মায়ের আঙ্গুল, এই দেখ ‘অ’ কেমন হয়।/
স্লেট পেন্সিল ছাড়াই হল বর্ণের সাথে পরিচয়!
২
ছোট্ট শিশুর শব্দখেলা ,অন্ত্যমিলে ধর্ণা দি /
কোবতে লেখার আস্কারা তো তুমিই দিলে সন্ধ্যাদি।
৩
কবেকার সেই কিশোরভারতী, শুকতারা-আনন্দ মেলা../
খেলার ছলে কত কী শিখেছি, ভরে ছিল ছোটবেলা।
৪
ফুল প্যাডেল ফুল প্যাডেল,ভারসাম্যের শুরু /
দৌড়ে চলেছে পাশে পাশে, দাদা,- আমার গুরু।
৫
এমনভাবে সাঁতার শেখাতে আর কে চায়?/
বুক জলে নেমে বললে.. চলে আয়!
৬
ধূম্রজালের মায়াঅঞ্জনে বড় হওয়া এক ঝটকায়/
গুরুই দিলেন গন্ধহরণ পেয়ারাপাতার টোটকায়।
৭
সময়ের ওঠাপড়ায় ভেসে উঠি, ডুব দি /
প্রকৃতির কাছে হাতেখড়ি, ঠেকে শেখায় সিদ্ধি।
৮
মূলমন্ত্র কবিগুরুই দিয়ে গেছেন মগজে /
যা কিছু হোক, অনায়াসে ‘সত্যরে লও সহজে’।
৯
হৃদয়ে, বিবেকে, সংবেদনায় তুমিই রয়েছ সতত/
পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতহি পরমং তপ!
পুনশ্চ : অনেকের কথাই বলা হল না। পরে কখনো হবে।
*******
Add comment