সাহিত্যিকা

আমার মা ও বাবা – আমার জীবনের পথে চলার গুরু

আমার মা ও বাবা – আমার জীবনের পথে চলার গুরু
প্রদীপ ভৌমিক, ১৯৭৪ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

বাবা-মা আমাদের ভাইবোনেদের মধ্যে যেন বৃক্ষের চারা রোপন করে দিয়েছিলেন, কখন কিভাবে দিয়েছিলেন আমরা বুঝতেই পারিনি। আজ জীবন সায়াহ্নে শেষ এসে এই লেখকের মনে হয়েছে যে তীব্র প্রত্যয় ও পরিবারের সকলের প্রতি ভালবাসাই উনাদের ইচ্ছাপূরনের সহায়তা করেছিল। মা-বাবার স্মৃতিতে আমার কিছু লিখতে ইচ্ছে হলো।

********

আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল উত্তরবঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার। কলেজে পড়বার সময় বন্ধুদের সঙ্গে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলাম। তবে সদ্য কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ন আমাদের সেই সময়ের চিন্তাভাবনা আমাদের নজর আর এখনের সত্তরোর্ধ্ব একজনের চোখের দেখা বা অনুভূতি হয় অন্যরকম।

কিছুদিন আগে শিলিগুড়িতে একটা বিয়ের নিমন্ত্রণ সেরে ডুয়ার্সে এসেছিলাম। এখানেই একটি জায়গা আছে – মালবাজার। নামটা দেখেই মনে ভেসে এলো প্রায় ষাট বছর আগেকার এক স্মৃতি। বাবা ট্রান্সফার হয়ে এসে এখানে কয়েকবছর চাকরি করেছিলেন। আমরা তখন আমাদের অর্ধনির্মিত বর্ধমানের বাড়িতে থাকি। আমরা মা ও ভাইবোনেরা মালবাজার কোনদিন যাইনি। বাবা কয়েকমাস অন্তর বর্ধমানের বাড়িতে আসতেন। যখন বাড়ি আসতেন দেখতাম বাবার চেহারাটা ভাল হয়েছে। হয়ত উত্তরবঙ্গের জলবায়ুর কারনেই।

আমার ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত বেশ কিছু বছর আমরা আসানসোলে ছিলাম। তারপর আসানসোল থেকে ট্রান্সফার হয়ে তারকেশ্বরে এসেছিলেন। তারকেশ্বরে আমরা ছিলাম দু’বছর, ক্লাশ সেভেন ও এইট এখানকার স্কুলে পড়েছিলাম। আমাদের বাড়িটা ছিল বাবা তারকনাথ মন্দিরের কাছাকাছি। বাড়ি থেকেই মন্দিরটা দেখা যেতো।

তারকেশ্বরে থাকতে থাকতে বাবা বর্ধমানে বাড়ি করলেন। শহর থেকে দূরে ও মাঠের মাঝখানে চাষের জমি পেয়ে বাবা সস্তায় অনেকটা জায়গা কিনে বাড়ি ও বাড়ির সঙ্গে পুকুর কাটালেন। আমরা মা ও ভাইবোনেরা তারকেশ্বরের পাট চুকিয়ে বর্ধমানে এসে থাকতে শুরু করলাম। বাবা তারকেশ্বরেই রয়ে গেলেন। সপ্তাহান্তে বর্ধমানের বাড়িতে আসতেন। যখন আসতেন সঙ্গে নানা ফল, তরকারি, ফুল, গাছের কলমের চারা বা বীজ নিয়ে আসতেন। ছুটির দিনে পুকুরের চারিধারে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, কলা, নারকোল, ইত্যাদির গাছ লাগাতেন, প্রচুর যত্ন করতেন। ছুটির দিনগুলিতে উনার গাছের পরিচর্যাতেই অনেকটা সময় কেটে যেতো। কয়েক বছরের মধ্যেই দেখলাম মা ও বাবার যত্ন-পরিচর্যায় পুকুরের চারিধারে গাছগুলো বড় হয়ে ফল দিতে শুরু করেছে। পুকুরে মাছ চাষ করা হলো। মাঝে মাঝে জেলে ডেকে মাছ ধরা হতো। বাবাকে প্রায়ই দেখতাম ছিপ ফেলে মাছ ধরতে। এতগুলো বছর অপরিসর ভাড়াবাড়িতে থাকবার পর বাবা-মাকে দেখলাম বড় ও খোলামেলা জায়গা পেয়ে খুব খুশি। যদিও শহর থেকে দূর হবার কারনে আমরা ভাই-বোনেরা খুব একটা খুশি ছিলাম না। আজ প্রায় ছয় দশক পর মনে হয়েছে বাবা হয়তো উনাদের পূর্ববঙ্গের বাড়ির কথা মনে রেখেই ছোট সংস্করনে বর্ধমানে বাড়ির পরিবেশ তৈরি করবার চেষ্টা করেছিলেন।

তারকেশ্বরে আমরা ভাইবোনেরা পড়াশোনায় ভালই করছিলাম। বর্ধমানের বাড়িতে এসে পড়াশোনার পরিবেশটা ব্যাহত হলো। মা একা আটজন ভাইবোনের পড়াশোনার দিকে মন দিতে পারতেন না। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। গরু, হাঁসের খেয়াল রাখা, চাষের জমি থেকে আসা ধানসিদ্ধ করাতেও মাকে অনেক পরিশ্রম করতে হতো। স্বল্প রোজগেরে পরিবারের ছেলেমেয়েদের দুধ-ডিমের ব্যবস্থার দিকেও মায়ের লক্ষ্য ছিল। দিনের রান্নাবান্নার কাজের সাথে বাড়িতে শাকসবজি ও তরকারির উৎপাদনও মাকেই দেখতে হতো। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করতেন। কোনদিন বসে থাকতে দেখেনি। আমার বোনেরাও তাঁকে সাহায্য করতো। বাড়িতে যারা কাজ করতে আসতো, তাঁদেরকে মা দুপুর বেলায় বসিয়ে খাওয়াতেন। আর এরই মধ্যে পরীক্ষার সময় আমি ভোররাতে উঠে পড়াশোনা করতাম। আমার এলার্মের ঘড়ির আওয়াজ শুনে পাশের ঘরে মা উঠে পড়তেন। এক গ্লাস গরম দুধ বা হরলিক্স নিয়ে এসে যতক্ষন না আমি গ্লাস খালি করছি ততক্ষণ উনি আমার সামনে বসে থাকতেন। কোন কথা বলতেন না পাছে আমার পড়ার ক্ষতি হয়।

বাবার অনুপস্থিতিতে এই সময় মাকে একটা অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছিল। আমাদের পাশের বাড়ির দুই কাকা সন্ধ্যের পরেই মার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করতো। ঝগড়া অবশ্য একপেশেই হতো। পড়াশোনার সময় এই ধরনের পরিবেশ আমার ও ভাই-বোনেদের অসুবিধা হতো। আর আমার মতন একজন কিশোর ছেলের মায়ের এই অপমানে মাথায় আগুন জ্বলে উঠতো। মনে হতো মার হয়ে আমিই গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়াই। আজ এত বছর পর তাঁরা কেউ বেঁচে নেই। পরে ছোটকাকু মার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। এই ছোট কাকুর চাকরির জন্যই বাবা উত্তরবঙ্গে ট্রান্সফার নিয়েছিলেন। এই ঘটনা ছাড়াও পাড়ায় পড়াশোনার পরিবেশ খুব একটা ভাল ছিলনা। বেশিরভাগ মানুষ ছিল পূর্ববঙ্গ থেকে আসা ছিন্নমূল পরিবারের। তাদের স্থায়ী রোজগার ছিলনা। স্কুলে কয়েকবছর পড়াশোনা করে তারা ছোটখাটো কাজে লেগে পড়তো সংসারে রোজগারের স্বার্থে।

তারকেশ্বরে চাকরী করতে করতে বাবা উত্তরবঙ্গের মালবাজারে ট্রান্সফার হলেন। ছোটকাকু ম্যাট্রিক পাশ করে তৎকালিন পূর্বপাকিস্থান থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন। এখানে এসে উনি বি.কম পাশ করেন। মার কাছে শুনেছি বাবা ব্যাংকের এজেন্টের কাছে ছোটকাকুর চাকরির জন্য তদ্বির করেছিলেন। তখনকার দিনে ব্যাংকের এজেন্টের অনেক ক্ষমতা ছিল। ব্যাংকের এজেন্ট শর্ত দিলেন বাবা ট্রান্সফার হলেই কাকুর চাকরি হবে। বাবা রাজী হয়ে গেলেন। আর আমরা মা ও ভাইবোনেরা বর্ধমানের নির্জন জায়গায় এসে বাস করতে লাগলাম। বড় ছেলে হিসাবে আমার বয়স তখন ১৪-১৫ বছর। তবে মার সাহস ছাড়া আমরা হয়তো এই বাড়িতে থাকতেই পারতাম না। রাত্রি বেলায় বাড়ির বাইরে মাঠে শেয়াল ডাকতো। সন্ধ্যের পর বাড়ির চারিপাশ অন্ধকারে ডুবে যেতো। বাড়িতে হ্যারিকেনের আলোয় আমরা পড়াশোনা করতাম। চাষের জমির উপর বাড়ি ও পুকুর তৈরি হয়েছিল বলে সাপের উপদ্রব ছিল। আমার ভাইয়ের আবার সাপ মারার ব্যাপারে বেশ সাহস ছিল। একদিন রাত্রিবেলায় মা দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলেন একটা সাপ দরজার খিলের গায়ে জড়িয়ে আছে। আমি তো ভয়ে একলাফে খাটের উপর উঠে গেলাম। মা হ্যারিকেনের আলোয় লাঠি দিয়ে সাপটাকে মারলেন।
এর বেশ কিছু বছর পর আমাদের বাড়িতে বৈদ্যুতিক আলো আসে।

বাবা স্বভাবে ছিলেন খুব চুপচাপ। আমাদের সাথেও উনি কাজের কথা ছাড়া অন্য কথাবার্তা খুব একটা বলতেন না। তবে আমাদের প্রতি ছিল তাঁর ভীষন টান ও ভালবাসা। কোনদিন বকাবকি বা গায়ে হাত তুলতে দেখিনি। ছেলেমেয়েদের শাসন মাকেই করতে দেখেছি। বাবা সবসময় চাইতেন ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে বড় হোক। টাকাপয়সার অভাব থাকলেও পড়াশোনার ব্যাপারে কার্পন্য করতেন না। তাসখেলার নেশা ছিল। আর ভালবাসতেন ফুটবল খেলা দেখা। আসানসোলে থাকবার সময় বাবা আমাকে বার্নপুর স্টেডিয়ামে ইস্টবেঙ্গল ও বার্নপুর ইউনাইটেড ক্লাবের ম্যাচ দেখতে নিয়ে যেতেন। ব্যাক্তিগত ও চাকুরী জীবনে অনেক কষ্ট করে থাকলেও আমাদের কাছে কখনো সেটা প্রকাশ করেননি। পরে জানতে পেরেছিলাম যে উনি যেখানে অফিসের কাজে ট্রান্সফার হয়ে যেতেন সেখানে আলাদাভাবে বাড়ি ভাড়া নিতেন না। রাত্রে অফিসেই ঘুমানোর ব্যবস্থা করে নিতেন। আলাদাভাবে বাড়িভাড়া নেবার খরচা বাঁচাতো।

১৯৬৯ সালে শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এলাম। একটি দৃশ্য প্রায়ই মনে ভেসে আসে। হস্টেল থেকে বাড়ি এসে ফেরার দিন মা-বাবা দুজনেই বাড়ির সদরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তেন। সেই ক্ষণগুলি কিছুতেই ভুলতে পারি না। আমি নিজের কাঁচা হাতে সেরকম একটি পেন্সিল স্কেচ করার চেষ্টা করেছিলাম।

১৯৭৪ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে মুম্বাইয়ে চাকরী পেয়ে যখন কেন্দ্রীয় সরকারে ক্লাশ ওয়ান গেজেটেড অফিসার হিসাবে জয়েন করলাম, উনি ভীষন খুশি হয়েছিলেন, তবে কোন বহিঃপ্রকাশ ছিল না। অনেকদিনের চেনা মানুষটার মুখের চেহারায় বুঝেছিলাম- চোখে যেন কয়েক ফোঁটা আনন্দের জল। ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করবার পর আমি আইআইটি তে এম টেক পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বাবাও বলেছিলেন আরো পড়াশোনা করতে, কিন্তু সেই সম্য আমার মনে হয়েছিল চাকরিটা করা দরকার।

জীবনের গোধূলি লগ্নে বাবা অনেক জায়গায় চাকরি করে বর্ধমানে হোম ব্রাঞ্চে বদলি হয়ে এলেন। সংসারের প্রয়োজনে সারা জীবন নিজেকে কষ্ট দিয়ে পয়সা বাঁচিয়েছিলেন। বাড়ি থেকে অফিস বেশ দূর থাকা সত্তেও প্রায়ই তিনি হেঁটে অফিস যেতেন। একটা দুর্ঘটনা ঘটার পর বাবাকে পায়ে স্টীলপ্লেট লাগাতে হয়েছিল। একটা পা মুড়তে পারতেন না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতেন। কিছুদিন বিশ্রাম নেবার পর আবার একইভাবে উনি অফিসে যাওয়া শুরু করলেন।

চাকরী পেয়ে প্রতিবছর মুম্বাই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বর্ধমানের বাড়িতে আসতাম। মা-বাবার সঙ্গে দেখা করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। চাকরি জীবনে অন্য কোথাও আমার আর ঘোরা হয়নি। সন্ধ্যের পরে বাড়ির সামনের বারান্দায় আমি আর বাবা চেয়ারে পাশাপাশি বসতাম। সামনে কিছুটা দূরে জিটি রোডের উপর দিয়ে হেড লাইট জ্বালিয়ে লরি ও বাস যাতায়াত করতো। চারিদিক অন্ধকার ও নিস্তব্ধ। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকের মাঝে আমরা দুজনে চুপচাপ বসে থাকতাম। মাঝে মাঝে একটু আধটু কথাবার্তা হতো। যেন নিস্তব্দতারও একটা ভাষা আছে। একটু আধটু কথাবার্তার মধ্য দিয়ে বাবাকে বোঝার চেষ্টা করতাম।

অবসর নেবার পর বাবা পাড়ার ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সম্পাদক হলেন। সার্বজনীন ও অন্যান্য পূজো নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। বিভিন্ন ক্লাবের মধ্যে প্রতিযোগিতা মূলক ফুটবল খেলার আয়োজকের অংশীদার হলেন। বলতেন ছেলেরা সারাদিন আড্ডা মেরে সময় নষ্ট করে। একদিন আমায় বললেন – আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিস তো! একটু অবাক হলাম। বাবা তো আমার কাছে কোনদিন টাকাপয়সা চান নি। জিজ্ঞেস করাতে বললেন – পাড়াতে সরকারের একটা ছোট খাস জমি আছে। ক্লাবের পক্ষ থেকে উনি বাচ্চাদের জন্য খেলার পার্ক করতে চান।

চাকরি থেকে অবসর নেবার পর উনি প্রথমবার মুম্বাই এলেন। আমি দাদার স্টেশনে উনাকে রিসিভ করতে এলাম। কম্পার্টমেন্ট নাম্বার জানতাম না। প্রথম থেকে শেষ সমস্ত কম্পার্টমেন্ট খুজেও বাবাকে পেলাম না। ভয়ে ও আতঙ্কে শেষ স্টেশন Mumbai VT স্টেশনে গিয়ে প্যাসেঞ্জার লিস্টে উনার নামও দেখলাম না। ভরাক্রান্ত মনে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে নীচ থেকে দেখলাম যে ব্যালকোনিতে লুঙ্গি ঝুলছে। আশ্বস্ত হলাম। ঘরে ঢুকে দেখলাম উনি স্নান করে ভাত খাচ্ছেন। দাদার স্টেশনে উনি আর আমার জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেন নি। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে সিডকো বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে বেলাপুরের বাস ধরে আমাদের বাড়ি এসে পৌছেছেন।

জীবনের শেষ দিকে উনি এক কঠিন চর্মরোগে আক্রান্ত হলেন। বিরল চর্মরোগ, Pemphigus Vulgaris। বর্ধমানের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন।আমাকে দেখে বললেন – ‘তুই আইছস! এইবার আমি ভাল হইয়া যামু ‘। কিছুদিন বাদে আমি মুম্বাই ফিরে এসেছিলাম। এরপর বাবার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। মৃত্যুর খবর পেয়ে পরের দিন সকালেই মুম্বই থেকে বর্ধমানের বাড়িতে চলে এলাম। দেখলাম বাবাকে একটা বরফের ফলকের উপর শোওয়ানো। আমার ভাইয়ের ছেলে সায়ন জ্বলন্ত ধুঁপকাঠি হাতে নিয়ে বাবার মৃতদেহের চারিধারে ঘুরছে। কতইবা তার বয়স! চার কি পাঁচ। শুনেছিলাম নার্সিং হোমে বাবা কোমাতে চলে গিয়েছিলেন। কোন সাড়াশব্দ করছিলেন না। আমার ছোটকাকু নাকি বাবার কানে জোরে জোরে বলেছিলেন – দাদা, প্রদীপ আইসে। বাবা চোখ খুলেছিলেন। তারপর সেই যে চোখ বন্ধ করলেন আর খোলেন নি।

জীবনকে উনি নিজের মত করে তৈরি করেছিলেন। কারো কাছে হাত পাতেন নি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন, ছয় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এমনকি ছেলেদের কাছেও কোনদিন হাত পাতেন নি।

আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পর সত্তরোর্ধ বয়স্ক ছেলের মনে হয়েছে বাবার এই সংসার জীবনের সংগ্রামের পেছনে মা ছিলেন স্তম্ভের মত। দুজনেই সংসারে নিজের নিজের কাজে শক্ত করে হাল ধরেছিলেন। বাস্তুচ্যুত দুজন মানুষকে অনেক কঠিন জীবনযাপন করতে হয়েছিল একটু থিতু হয়ে বসার জন্য। তবুও দুজনেই সন্তানদের জন্য নিজেকে উজার করে দিয়েছিলেন।

বাবার মৃত্যুর পর মা আরও তিরিশ বছর বেঁচেছিলেন। করোনা মহামারির সময়ই তাঁর মৃত্যু হয়। আজ উনাদের নাতি-নাতনীরাও ডাক্তার ও ইঞ্জিনীয়ার হয়ে দেশেবিদেশে যে যার মত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরও কিছু বছর বেঁচে থাকলে বাবাও দেখে যেতে পারতেন যে তাঁদের দেওয়া শিক্ষা নাতি-নাতনীদের মধ্যেও প্রবাহিত হয়েছে।

জীবনের গোধূলি বেলায় চোখ বন্ধ করলেই কত চিত্র, ঘটনা মনে এসে ভিড় করে। কত মানুষের ভালবাসা ও শিক্ষায় জীবনের এই প্রান্তে এসে আমরা পৌছাতে পেরেছি। প্রাইমারী স্কুলে ভর্তির আগে বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন এক মাষ্টার মশাইয়ের কাছে। অনেকটা টোল পণ্ডিতের মতো। বসবার আসনটা আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হতো। ফেরার সময় আবার আসনটা গুছিয়ে বাড়ি নিয়ে আসতে হতো। একদিন কোন কারনে আমার ক্লাশে যেতে দেরী হলো। মাষ্টার মশাই বেত দিয়ে মারার পর আমাকে সারাক্ষন কান ধরে দাড় করিয়ে রাখলেন। নিয়মানুুবর্তিতা কি জিনিষ তা হয়তো আমাকে কিছুটা বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছিল।

স্কুলের বৃদ্ধ মাস্টারমশাই পুলিনবাবুর কাছে টিউশন পড়তে যেতাম। উনি যত্ন নিয়ে ইংরাজি ও বাংলা পড়াতেন। স্কুলের দেওয়া একটা ঘরে একাই থাকতেন, নিজেই রান্না-বান্না করতেন। আমরা কয়েকজন সন্ধ্যেবেলায় হ্যারিকেন নিয়ে উনার কাছে পড়তে যেতাম। স্কুলে আমাদের ক্লাশে ইতিহাস পড়াতেন অচিন্ত্য বাবু। প্রথম চাকরি পাবার পর উনার সঙ্গে বর্ধমান স্টেশনে দেখা হলো। পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলাম। চাকরী করছি শুনে খুশি হলেন। কিছুক্ষন পর আমার দিকে তাকিয়ে মাইনের কথা জিজ্ঞেস করলেন। উত্তর পেয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বললেন – এত টাকা মাইনে! তখনকার দিনে স্কুলমাস্টার মশাইদের মাইনে খুব কম ছিল।

এরপর যখন কলেজে পড়ি, মাষ্টারমশাইরাও কত যত্ন করে আমাদের পড়াতেন। আলাদাভাবে কোন কিছু বুঝতে গেলে খুব খুশি হতেন। কত নাম মনে আসছে – প্রফেসর দীপক সেনগুপ্ত, অনিল চৌধুরী, সুকোমল তলাপাত্র, শঙ্কর সেন ও আরো অনেকে।

শৈশব ও প্রথম যৌবনেকালে মনোমত উপদেশ না পেলে মা-বাবার উপর অনেক সময় রাগ করেছি, তর্ক করার চেষ্টা করেছি। এই জীবন সায়াহ্নে এসে মনে হয়েছে উনারা আমার ভালো চেয়েই ঠিক পথ দেখাবার চেষ্টা করেছেন।

ছোটবড় কত মানুষের ঋন আমাকে আজকের অবস্থানে আসতে সাহায্য করেছে! সব ঋন হয়তো শোধ করা যায়না। সব ঋন শোধ করা যায়না বলেই হয়তো সমাজে দয়ামায়া, প্রেম- ভালবাসা, মনুষ্যত্ব আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।

“It’s a funny thing about mothers and fathers.
Even when their own child is the most disgusting
and little blister one could ever imagine,
the parents still think that their child is so wonderful.”

*******

Sahityika Admin

Add comment