সাহিত্যিকা

ইতিহাস যেখানে নীরব (ধারাবাহিক তৃতীয় পর্ব)

ইতিহাস যেখানে নীরব (ধারাবাহিক তৃতীয় পর্ব)
@দেবাশীষ তেওয়ারী, ১৯৬৯ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

আগের পর্বের লিংক

ইতিহাস যেখানে নীরব (ধারাবাহিক দ্বিতীয় পর্ব)

পর্ব-৩
মথুরায় শকদের যে ক’জন গুপ্তচর আছে তাঁদের মধ্যে সরাই মালিক ‘অতিশয়’ খুবই ধুরন্ধর। তাঁর সরাইয়ে অনেকেই মাধ্বী পান করতে আসে, আর একটু নেশা হলেই কে যে কত গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে তা জাহির করার প্রতিযোগিতা লেগে যায়। কে কত গোপন খবর জানে বড়াই করে বলতে থাকে। এইসব গোপন কথা অবশ্য বেশীরভাগই তেমন গোপন কিছু নয়, বিশেষ কোন কাজেও লাগে না। কিন্ত তবুও এরই মধ্যে দুএকটা জরুরী খবর বেরিয়ে আসে, পাকা জহুরীর মত ‘অতিশয়’ সেখান থেকে খবর বেছে নেয়। নেশার ঘোরে কাল জম্বুক যা বলে ফেলেছিল তা শত্রুপক্ষ জেনে গেলে ছোট রাজার ভয়ানক বিপদ হতে পারে বুঝেও অর্থ লোভী ‘অতিশয়’ তা শক সেনানায়ক নাহাপণকে জানিয়ে দিল।

সামনে খুলে রাখা একটা নক্সার দিকে নাহাপণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাপড়ে আঁকা এই নক্সায় ধরে রাখা আছে মথুরার পশ্চিম দিকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা জঙ্গলের বিস্তারিত বিবরণ। এই জঙ্গলকে দুভাগ করে মাঝ বরাবর এক পর্বতমালা দক্ষিণ থেকে উত্তর পর্যন্ত চলে গেছে, মাঝে একটি মাত্র গিরিখাত, অর্থাৎ পশ্চিমে ত্রিগর্ত থেকে পূর্বে মথুরায় আসতে গেলে ঐ গিরিখাত দিয়ে আসা ছাড়া অন্য উপায় নেই। জঙ্গল নামেই ত্রিগর্ত রাজের অধীন, আসলে দক্ষিণ দিকের শকরাই তাতে রাজত্ব করে। নাহাপণ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না মাত্র পাঁচশ সৈন্য নিয়ে চন্দ্রের মত বিচক্ষণ রাজা এত ঝুঁকি নিয়ে গিরিখাত পেরিয়ে শত্রু কবলিত পার্বতীপুরের দিকে গেল কেন? নিশ্চয় সেরকম বিশেষ কোন কারণ আছে যার জন্যে চন্দ্রকে জেনেশুনেই এই ঝুঁকি নিতে হয়েছে।

নাহাপণ গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর তার কুঞ্চিত ভ্রূ কিছুটা সহজ হলো। সে বুঝতে পেরেছে চন্দ্রের মতলব, এবার তার সেনাপতি হওয়া কে আটকায়। নাহাপণের মুখে ফুটে উঠল এক বিজাতীয় হাসি।

সুতনুকাকে প্রাসাদ থেকে নিয়ে বনের মধ্যে মগধ শিবিরে পৌঁছুতে রাত্রির তৃতীয় প্রহর পেরিয়ে গেল। ফিরে এসেই চন্দ্র চরদের কাছ থেকে দুঃসংবাদ পেল যে গিরিখাতে দু একজন শকসৈন্য দেখা গেছে। তার মানে বাকী সব সৈন্য নিশ্চয় পাহাড়ে লুকিয়ে আছে, তাঁরা অতর্কিতে আক্রমণ করবে। মথুরা ফেরার পথ আপাততঃ রুদ্ধ। এদিকে আবার পিছনে রয়েছে ত্রিগর্তের বাহিনী, তাঁরাও নিশ্চয় রাজকুমারীকে খুঁজছে। চন্দ্র ভাবলেশহীন মুখে সব শুনে প্রধান সেনানায়ক অংশুমানকে ডেকে কিছু জরুরী নির্দেশ দিলো।

রাত তখনও ভোর হয়নি, মগধ শিবির থেকে চার অশ্বারোহী নিঃশব্দে বেরিয়ে উত্তর অভিমুখে যাত্রা করেছে। দুজনকে আমরা চিনি। চন্দ্র ও সুতনুকা, সুতনুকার পরণে পুরুষের পোষাক, বাকী দুজন চন্দ্রের দেহরক্ষী। মগধ সেনাছাউনিতে কিন্তু চন্দ্রের শিবির থেকে রাজপতাকা নামল না, উপরন্তু তার পাশে আর একটি নতুন শিবির দেখা গেল, এটিতেও উড়ছে রাজপতাকা।

গিরিখাতের ঠিক ওপরে এক পাহাড়ী গুহা। কাল রাত থেকেই নাহাপণ সেখানে শিবির পেতেছেন। এখান থেকে জঙ্গলের ভেতর মাগধীদের ছাউনি পরিষ্কার দেখা যায়। সেও দেখতে পেল দুটি রাজ অভিজ্ঞান লাঞ্ছিত শিবির। নাহাপণের মুখে বিচিত্র হাসি খেলে গেল। তার হিসেব মিলে গেছে। তাদের ভাবী সম্রাজ্ঞী আর মগধের রাজপুত্র, দুজনেই আজ তাঁর কব্জায়। সে অগ্রবর্তী বাহিনীর অধিনায়ককে খবর পাঠালো তার আদেশ ছাড়া যেন মগধ সেনাকে আক্রমণ করা না হয়।

সারা দিন ঘোড়া ছুটিয়ে যখন দিনের আলো প্রায় অস্তগামী, তখন চন্দ্র ও সুতনুকা একটা ছোট্ট নদী পেরিয়ে এল। নদী পার হবার আগেই চন্দ্র দেহরক্ষীদের বিদায় দিয়েছে। তাঁরা রাতের মধ্যেই সেনাছাউনিতে পৌঁছে যাবে। ওখানে তাঁদের বিশেষ প্রয়োজন।

নদীর এইদিকে কুশানদের রাজ্য। তারা যদিও মগধের মিত্র নয়, তবে শত্রুতাও তেমন নেই। কুশানদের সাম্রাজ্য এক সময় বিশাল ছিল, এমনকি শকরাও তাদের অধীনস্থ সামন্তমাত্র ছিল। এখন তাঁদের আর সেই সুদিন নেই। সাম্রাজ্য সীমানা কমতে কমতে একটা ছোট্ট রাজ্যের আকার নিয়েছে, সেনা শক্তিও আর তেমন নেই, সীমা সুরক্ষারও নিশ্চয় তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। এখানে জঙ্গলও হাল্কা হয়ে গেছে। পূর্ব দিকে আর দুদিন গেলেই মগধের সীমানা পড়বে। এমন সময়েতেই হঠাৎ আক্রমণটা এলো। চন্দ্রকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত করে হঠাৎ গুটি ছয় কুশান সেনা যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হলো।
‘তোমরা কোন রাজ্যের বাসিন্দা হে? এখানে কি মতলবে এসেছ?’
‘প্রভু, আমরা ত্রিগর্ত রাজের প্রজা, শিকার করতে জঙ্গলে ঢুকেছিলাম, পথ ভুল করে এখানে চলে এসেছি।’
‘উঁহু, বিষয়টা এত সহজ মনে হয় না। তোমাদের বেশভূষা, অস্ত্র শস্ত্র দেখে মনে তো হচ্ছে না তোমরা কোন সাধারণ প্রজা। চল, আমাদের নায়কের কাছে চল।’
তাঁদের পাণ্ডা সুতনুকার ঘোড়ার কেশর ধরে টানাটানি করাতে তাঁর আর ঘোড়া ছুটিয়ে পালাবার উপায় থাকল না। অগত্যাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও চন্দ্রকে অস্ত্র ধরতে হল। তার ইশারায় দুই দেহরক্ষীও কুশানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অসম সেই লড়াইয়ে তারা দুজনেই বীরগতি পেল বটে, কিন্তু তবে চার কুশান সেনাকে খতম করে। বাকী দুজন কুশান সেনা চন্দ্রের বল্লমের ঘায়ে শয্যা নিল। এক সৈনিকের তলোয়ারের আঘাতে রাজকুমারীর ঘোড়াও বসে পড়ল।

দুই সেনা ও তিনটি ঘোড়া এই হঠাৎ আক্রমণে মারা গেছে, কিন্তু আর শোক প্রকাশের সময় নেই। এই প্রহরীদের সহযোগীরা একটু পরেই এদের খুঁজতে বেরোবে, এবং ঘটনা জেনে হত্যাকারীদের ধরার জন্যে চারদিকে খোঁজাখুঁজি সুরু করবে। তাই এখুনি বেরিয়ে পড়ে আজ রাতের মধ্যেই এখান থেকে যতটা পারা যায় দূরে সরে যেতে হবে। হাতে কেবলমাত্র চন্দ্রের ঘোড়া, ঐ ঘোড়াতেই দুজনের যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

জঙ্গল এখানে মোটেই ঘন নয়, হাল্কা, প্রধানতঃ তৃণভূমি, মাঝেমাঝে দুএকটা বড় গাছ আছে বটে, তবে সংখ্যায় কম। এরই মধ্যে দিয়ে একটা ঘোড়া ছুটে চলেছে পিঠে দুই আরোহী নিয়ে। চাঁদনি রাত, কখন নিশ্চুপে মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে আর তার আলোয় চরাচর ধুয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে যেন নাম না জানা ফুলের গন্ধ ভেসে এসে ক্ষণেক্ষণে আনমনা করে দিচ্ছে। ঘোড়ায় চন্দ্রের পিছনে বসে এই বিস্তীর্ণ মায়াবী প্রান্তর দিয়ে যেতে যেতে সুতনুকার এক অদ্ভুত অনুভূতি হল, ‘সবাইকেই তো একদিন স্বর্গে যেতে হবে। আহা, স্বর্গ যেন এইরকমই হয়।’
‘আচ্ছা কুমার, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
অবশেষে সে বাস্তবে ফিরল। এতক্ষণ পরে সুতনুকার মনে হয়েছে তারা কোথায় যাচ্ছে তা অন্তত জানা উচিত।
‘রাজকুমারী, আমরা যাচ্ছি পূর্বদিকে, মগধের অধিকারে থাকা মথুরা নগরে।’
সুতনুকার ভয় হল এই রাত্রিতে পথ ভুল করে আবার ত্রিগর্তে না চলে যায় তারা। এত কিছুর পর আবার সেই রুদ্রসিংহ? নাঃ, আর ভাবতে পারছে না সে।
‘আচ্ছা কুমার, দিক ভুল হয়ে যাবে না তো? এখন তো রাত্রি।’
‘রাত্রি বলেই দিক ভুল হবার সম্ভাবনা নেই। বাঁদিকে দূর আকাশে ঐ যে তারাটি দেখছ, ওটিকে চেন রাজকুমারী?’
সুতনুকা মাথা নাড়ল।
‘ওর নাম ধ্রুবতারা। অন্য তারারা আকাশে অবস্থান বদলায়, কিন্তু ধ্রুবতারা সবসময় উত্তর দিকে এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে।’
‘বেশ মজার তো। আমি এটা জানতাম না।’
‘ধ্রুবতারাকে বাঁদিকে রেখে যদি যাওয়া হয়, তাহলে আমরা সব সময় পূবদিকে যাব। আমাদের দিক ভুল হবে না।’
এতক্ষণে আশ্বস্ত হয়ে পরম আবেগে চন্দ্রকে আলিঙ্গন করে পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রা গেলো।

দুই দিন দুই রাত গিরিখাতকে অবরোধ করে রাখার পর নাহাপণ চর মারফৎ খবর পেলো যে পাখি উড়ে গেছে। না চন্দ্র, না রাজকুমারী, কেউই মগধ শিবিরে নেই। আরও একবার চন্দ্রের কাছে বুদ্ধির খেলায় হেরে ভগ্নমনোরথ নাহাপণ অবরোধ তুলে তার ঘাঁটিতে ফিরে গেল। নীচু স্তরের সেনাদের সঙ্গে লক্ষ্যহীন লড়াই করে লোকবল ক্ষয় করার অর্থ নেই। তার আর সেনাপতি হওয়া হল না।

দিনের বেলা লুকিয়ে থেকে এবং সারারাত ঘোড়া ছুটিয়ে অবশেষে চন্দ্র রাজকুমারীকে নিয়ে তৃতীয় দিন ভোরে মথুরা পৌঁছালো। তার এই অসাধারণ বীরত্বেও কিন্তু রামগুপ্ত মোটেই খুশি নয়। একে তো সে ত্রিগর্ত রাজকে ধরে আনেনি, তার ওপর সম্পূর্ণ একা ভবিষ্যৎ সম্রাজ্ঞীকে নিয়ে এসেছে, একই ঘোড়ার পিঠে দুজনে রাত্রিভর একত্রে চলেছে। নানা রকম কুটিল সন্দেহ তার মনে ভিড় করে এল। সিদ্ধান্ত নিলো যে রাজকুমারীর সঙ্গে চন্দ্রর দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করে দিতে হবে। চন্দ্রকে পাঠিয়ে দেওয়া যাক মথুরা থেকে দূরে।

সম্রাট রামের এতদিন পর মনে পড়ল যে পাটলিপুত্রই মগধের আসল রাজধানী। সেখানে এতদিন রাজবংশের কেউ না থাকাটা ভাল দেখায় না। সাতদিনের মধ্যেই সে চন্দ্রকে পাটলিপুত্র পাঠাল সেখানকার রাজা করে।

*******

রামগুপ্ত তো চন্দ্রকে মথুরা আর তার ভাবী সম্রাজ্ঞীর থেকে দূরে পাঠিয়ে দিলেন, কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। সুতনুকা বেচারী এত কিছু জানে না। সে সহচরীদের কাছে প্রায়ই চন্দ্রের কথা জানতে চায়, মথুরা পৌঁছানোর পর চন্দ্রর সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। কিন্তু এই সহচরীরা সকলেই সম্রাটের অনুচর, তাঁরা সত্য মিথ্যা মিশিয়ে সম্রাটকে এমন সংবাদ দিলো যে স্বভাবসন্দিগ্ধ রাম নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে চন্দ্র ও সুতনুকার মধ্যে গোপন সম্পর্ক আছে। এর ওপর আবার তাঁর বয়স্যরা আছে, তাঁরাও রামগুপ্তকে খুশি করার জন্য এই ধারণায় ইন্ধন যুগিয়ে দিলো। অবশেষে ঈর্ষাতুর রাজা এই সিদ্ধান্তে এলেন যে চন্দ্রের বীরত্ব দেখে ভাবী রানী তার প্রতি অনুরক্ত। সম্রাট নিজে যদি আরও বড় কোন যুদ্ধ জয় করে দেখান, তবে নিশ্চয়ই তাঁর বীরত্ব দেখে সুতনুকার মন তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হবে। এই ভেবে মন্ত্রী ও সেনাপতির সুপরামর্শ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিনি শকদের আক্রমণ করা স্থির করলেন।

তখন পাটলিপুত্রে যা ঘটছে – – – –
আসুন, এবার আমরা ফিরে যাই এই গল্পের সুরুতে (প্রথম পর্ব)। সেই অমাবস্যার রাত, সেই গহন বন, যেখানে চন্দ্র আর বেতাল সুরু করেছিল এক জীবন মরণ খেলা।
বেতালের প্রথম তেইশটি গল্প বলা হয়ে গেছে এবং পাঠক জেনে সুখী হবেন প্রতিটি গল্পের পর বেতাল যে প্রশ্ন করেছিল চন্দ্র তার সঠিক উত্তর দেওয়ায় তাকে মারতে না পেরে বেতাল প্রতিবার গাছে ফিরে যায় এবং চন্দ্র আবার তাকে নামিয়ে আনে। এই খেলা তেইশবার চলার পর এবার সুরু হতে চলেছে তার শেষ গল্প। এই গল্পের পরে করা প্রশ্নেরও যদি চন্দ্র সঠিক উত্তর দিয়ে দেয় তবে বেতালের আর গাছে ফেরা হবে না, তাকে যেতে হবে চন্দ্রের সাথে তান্ত্রিকের কাছে।

বেতাল সুরু করলো তার চব্বিশতম গল্প –
অবন্তীপুরা নামে এক ছোট রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের রাজার এক সুন্দরী স্ত্রী ও কন্যা ছিল। একবার প্রতিবেশী রাজ্য তাঁদের আক্রমণ করে। রাজা বীরত্বের সঙ্গে লড়লেন বটে কিন্তু খুব সুবিধা করে উঠতে পারলেন না। অবশেষে পরাজয় নিশ্চিত জেনে তিনি রানী এবং রাজকন্যাকে নিয়ে বনে পালিয়ে গেলেন। বনের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর পরে তাঁরা ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লে স্ত্রী এবং কন্যাকে একটি নিরাপদ বৃক্ষতলে রেখে রাজা খাবারের সন্ধানে একাকী আরও গভীর বনে ঢুকলেন। কিন্তু অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে যাবার পরেও তিনি না ফেরায় বন্য জন্তুর হাতে রাজা নিহত হয়েছেন ধরে নিয়ে রানী ও রাজকন্যা ক্ষুধায়, ভয়ে, দুঃখে, ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাঁদতে লাগলেন।

এদিকে ঠিক সেই সময়েই সেই রাজ্যের রাজা ও রাজপুত্র ঐ বনে মৃগয়ায় এসেছিলেন। কান্নার শব্দ শুনে তাঁরা খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে এসে দুই অসহায় রমনীকে দেখতে পেলেন এবং তাঁদের পরিচয় জেনে রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যই রাজা রাজকন্যাকে ও রাজপুত্র রানীকে বিয়ে করলেন। যথাকালে রাজার একটি কন্যা সন্তান ও রাজপুত্রের একটি পুত্র সন্তান হল।
‘এখন বলতো রাজা এই দুই নবজাতকের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক কি হবে?’
প্রশ্নটি করে বেতাল হাসতে লাগল। সে নিশ্চিত জানে এই প্রশ্নের যাই উত্তর দিক চন্দ্র, তা সঠিক হবে না।
চন্দ্র বেতালকে কাঁধে বহন করে নিয়ে চলেছে, সে উত্তর দেওয়ার নাম করছে না দেখে বেতাল বলল, ‘রাজা, আর তো সময় দেওয়া যাবে না, কিছু একটা তো তোমায় এবার বলতে হবে।’
বেতালকে অবাক করে চন্দ্র বললো, ‘দুঃখিত বেতাল, এই প্রশ্নর উত্তর আমার জানা নেই।’
‘তুমি বলেছ, এই প্রশ্নের উত্তর তোমার জানা নেই’ বেতাল বললো,’আশ্চর্য, এটাই তো সঠিক উত্তর কেননা সময়, কাল ও পাত্র ভেদে এই প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন উত্তর হয়। অতএব তুমি খেলায় জিতে গেছো এবং খেলার পূর্ব শর্ত মতো আমাকে এই দেহ ছেড়ে যেতে হচ্ছে, তুমি এই শবদেহ সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যেতে পারো। তবে রাজা, যাবার আগে তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি যে যার কাছে তুমি আমার এই মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছ, সেই তান্ত্রিক এক মহা পাপিষ্ঠ, ভণ্ড, সেই শয়তান অতি উচ্চাকাঙ্খী,তোমার শত্রু, তোমায় মেরে সর্বশক্তিমান হতে চায়।’
এরপরে বেতাল চন্দ্রকে বললো কেন তান্ত্রিক এই যজ্ঞ করছে, কিভাবে সে চন্দ্রকে বলি দিয়ে এই যজ্ঞের আহুতি দিতে চায়। যাবার আগে চন্দ্রকে শিখিয়ে দিল কি করে শয়তান তান্ত্রিকের হাত থেকে সে পরিত্রাণ পাবে।

তান্ত্রিক চন্দ্রকে শবদেহ নিয়ে ফিরতে দেখে খুশি, সে দ্রুত যজ্ঞ শুরু করে দিল। যজ্ঞের শেষে তাঁর কথামত চন্দ্র স্নান করে এলে তান্ত্রিক বলল, ‘রাজা, সাধনায় আমার সিদ্ধিলাভ হবে বটে তবে তুমিও বঞ্চিত থাকবে না। এই যজ্ঞে সাহায্য করার জন্যে তুমিও বিশ্ববিজয়ী সম্রাট হতে পারবে। তাই যজ্ঞের পূর্ণাহুতি দেবার আগে তুমি দেবীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম কর।’
বেতালের শেখানো মত চন্দ্র বললো সে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম জানেনা। সন্ন্যাসী তাকে কিভাবে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতে হয় তা যখন করে দেখাচ্ছে, চন্দ্র তলোয়ারের এককোপে তার মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দিল। এক ভয়াবহ নরবলির মধ্যে দিয়ে সেই যজ্ঞের শেষ হলো।

তখন হঠাৎই প্রচণ্ড দুর্যোগ সুরু হলো। প্রবল বৃষ্টি, ঝড়, বজ্রপাতের মধ্যে দুই ছায়ামূর্তি এসে চন্দ্রকে প্রণাম করে দাঁড়াল। এদের মধ্যে একজন চন্দ্রের পূর্ব পরিচিত বেতাল, অপর জন সদ্য মৃত সন্ন্যাসীর আত্মা, তার নাম তাল। জানালো যে তাঁরা এখন পিশাচযোনী পেয়েছে, চন্দ্র তাঁদের প্রভু এবং চন্দ্র যখনই স্মরণ করবে তাঁরা তৎক্ষণাৎ হাজির হয়ে তাঁর আদেশ পালন করবে।
চন্দ্র বললো, ‘দেখ, আমি কোনও পিশাচের প্রভু হতে চাই নি। এই ইচ্ছা নিয়ে কোন যজ্ঞও করিনি। অন্যের করা যজ্ঞ বাধ্য হয়ে আমায় শেষ করতে হয়েছে। আমি তোমাদের নিঃশর্তে মুক্তি দিচ্ছি।’

এই কথা শুনে চন্দ্রকে প্রচুর স্তুতি করে তাল চলে গেল, বেতাল কিন্তু কিছুতেই যেতে রাজী হলো না। সে বললো, ‘প্রভু, আমি এখনই মুক্তি নিতে পারছি না। আপনার ওপরে ঘোর বিপদের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। যতক্ষণ এই ছায়া থাকবে, আমি কিন্তু আপনাকে অলক্ষ্যে অনুসরণ করে যাব, আপনি দয়া করে মানা করবেন না।’ এই বলে বেতাল অদৃশ্য হয়ে গেল।

*******

ঠিক তখন বর্তমান রাজধানী মথুরায় – – – –
রামগুপ্ত ঠিক করলেন প্রথমেই আক্রমণ করবেন শকদের মিত্র ত্রিগর্তরাজকে। সুতনুকার বাবা, তাঁর শ্বশুর, তাঁকে নীচু নজরে দেখে, সে তাঁকে মেয়ে দিতে রাজী না হওয়াতেই তো চন্দ্রকে ত্রিগর্তে পাঠাতে হয় সুতনুকাকে জোর করে নিয়ে আসার জন্যে।
এছাড়াও তাঁর এক গোপন অভিসন্ধি আছে। তিনি সুতনুকাকে শাস্ত্রমতে বিয়ে করতে পারেন নি কেননা তাঁকে জোর করে তুলে আনা হয়েছে, তিনি বিয়ে করেছেন রাক্ষস মতে। কিন্তু এই বিবাহও সিদ্ধ নয় কারণ সুতনুকাকে তিনি নিজে তো তুলে আনেননি, এনেছে চন্দ্র। তাই তাঁর মনে ইচ্ছা সুতনুকার বাবা ত্রিগর্তের রাজা বুধাজিৎকে ধরে এনে মেয়েকে সম্প্রদান করিয়ে শাস্ত্রমতে বিবাহ সম্পন্ন করা। অতএব প্রথমেই বুধাজিৎকে ধরার জন্য লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে সম্রাট ঢুকলেন পশ্চিমের জঙ্গলে। ভাবী সম্রাজ্ঞী সুতনুকাকেও সঙ্গে নিলেন, মনে গোপন ইচ্ছা, সামনে থেকে দেখুক রানী, পিতার হেনস্তা, ও তাঁর বীরত্ব।
‘তাহলে শকদের কি হবে? তারাই তো সাম্রাজ্যের আসল শত্রু, তাদের ছেড়ে দিয়ে – -‘
সেনাপতির কথা শেষ হলনা, সম্রাট বললেন। ‘ওঃ, তাদের পরে দেখা যাবে, আগে বুধাজিৎ।’
যথাসময়ে গুপ্তচর অতিশয় মারফৎ শকেরা কিন্তু খবর পেয়ে গেল সম্রাট ত্রিগর্ত আক্রমণ করতে চলেছেন।

পাঠক অবগত আছেন এই সেই জঙ্গল যেখানে চন্দ্র প্রবেশ করেছিল সুতনুকাকে ধরে আনতে, যার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে টানা পাহাড় আর তার মধ্যে দিয়ে একটি মাত্র সংকীর্ণ গিরিপথ। এখন সেই গিরিপথ তাঁর নিজস্ব হাজার দশেক দেহরক্ষী বাহিনী সহ পেরিয়ে গিয়ে সম্রাট ঘাঁটি গাড়লেন ত্রিগর্ত রাজ্যের পূর্ব দিকের জঙ্গলে। বাকি বাহিনী পড়ে থাকল পর্বতের অপর পারে, প্রয়োজনে এদিকে আসবে। অদূরেই ত্রিগর্তের রাজধানী পার্বতীপুর। বুধাজিৎকে তিনি দূত মারফৎ আদেশ পাঠালেন পরের দিনই এসে আত্মসমর্পণ করার জন্যে। না হলে পার্বতীপুর ধ্বংস করে দেওয়া হবে।

তখনও ভালো করে দিনের আলো ফোটেনি। দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান সম্রাটের সুখনিদ্রার ব্যাঘাত ঘটালো। পাহাড় জুড়ে শকসেনাদের দেখা যাচ্ছে। গিরিপথও শকসেনাদের দখলে। ত্রিগর্তের দিক থেকেও শকদের দেখা যায়। এতদিনে রামগুপ্ত কঠোর বাস্তবের সম্মুখীন হলেন। কিন্তু বড় দেরী হয়ে গেছে, মাত্র দশহাজার সৈন্য নিয়ে তিনি ভয়াবহ শত্রু শকদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। রাজধানী মথুরা, তাঁর বাকি নব্বই হাজার সৈন্য, সবার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, যোগাযোগের আর কোন উপায় নেই।

সকাল হতেই বার্তা এল শকদের কাছ থেকে। কোন সাধারণ সেনানায়ক নয়, বার্তা প্রেরক স্বয়ং শক কুলতিলক, মহাক্ষত্রপ, মহারাজা, মহামহিম সম্রাট, রুদ্রসিংহ।
‘রামগুপ্ত, তুমি এখন চারদিক থেকে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে আছ, আমাদের বন্দী। কিন্তু আমরা তোমার কোন ক্ষতি করবো না। মুক্তি এখন সম্পূর্ণ তোমার ইচ্ছাধীন, তুমি অনুরোধ করলেই আমরা এই অবরোধ তুলে নেব, শুধু মাত্র একটি শর্ত।
সম্রাজ্ঞী সুতনুকাকে আগে আমার হাতে তুলে দিতে হবে।’

(ক্রমশ)

*******

Sahityika Admin

2 comments

  • ঐতিহাসিক পটভূমিকায় বেশ ভালো লিখেছেন। সাথে ছবিগুলিও এর শ্রীবৃদ্ধি করেছে।

  • বেশ ঝরঝরে লেখা।
    আর সাথে আগের পর্বের লিংক আর গল্পের সাথে রঙিন ছবিগুলোও ভালো এডিটিং এর পরিচয়।
    পড়ে ভালো লাগে।