সাহিত্যিকা

স্মৃতিচারণ

স্মৃতিচারণ
@মানস সামন্ত, ১৯৮১ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

আমার আদি শৈশবকাল – কাতরাসগড়।
আমার বাবা কোল ইন্ডিয়ায় চাকরি করতেন। খুবই ঘনঘন বদলির চাকরির জন্য কয়েক বছর এই কোলিয়ারি তো কয়েক বছর অন্য কোলিয়ারিতে বদলি হয়ে গেলেন।

১৯৬৩ সালের শেষের দিকে বাবা ঝরিয়া থেকে বদলি হয়ে এলেন ধানবাদ জেলার কাতরাসগড় নামের এক ছোট গঞ্জ শহরে। এখানে আমরা প্রায় চার বছর ছিলাম। এর আগের শৈশব স্মৃতি আমার কাছে অনেকটাই ঝাপসা। ঝরিয়া বঙ্গ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছিল মনে আছে। স্কুল মোটেই যেতে চাইতাম না, এটাও মনে আছে। কান্নাকাটি করতে করতে, বাড়ির সারাদিনের কাজের মহিলা “কামিনবউ” এর হাত ধরে গররাজি হয়ে কয়েকদিন মাত্র ঐ স্কুলে গেছি আর কি!

কাতরাসগড়ে এসে আমার দাদা ভর্তি হলো কাতরাসগড় হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে (দাদা অবশ্য কয়েক বছর পরেই পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের বোর্ডিং এ চলে যায়) আর আমাকে ভর্তি করা হলো বাসা থেকে আধ মাইল দুরে কাতরাসগড় মিশনারি প্রাইমারি স্কুলের নার্সারি ক্লাসে। কেন জানি না, এই স্কুলে যাওয়ার জন্য আমি কোনো দিন পা ঘষি নি। তবে পিছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারি যে এই মিশনারি স্কুল ও কাতরাসগড় এর  স্বল্প স্থায়ীত্বটা আমার পরবর্তী জীবনে ও মননে অনেক বিষয়ে প্রভাব ফেলেছে, নিজের অজান্তেই।

ঐ স্কুলেই, আমার বাবার বন্ধুদের দুই ছেলে, সমবয়সিই প্রায় (যারা কয়েক দিনের মধ্যেই আমার পরম বন্ধু হয়ে গেছিল) তখন পড়ছে সিনিয়র কেজিতে। আমার তো খুব লজ্জা! খুব জোর লাগিয়ে পড়তে শুরু করলাম। মাত্র একমাসেই নার্সারির সব পড়া শেষ হয়ে গেলো! স্কুলের হেড মিস্ট্রেস মিসেস গোমেস, আমাকে জুনিয়র কেজির ক্লাসে বসতে বললেন। জুনিয়র কেজির পড়াও হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার সময় করে শেষ করে ফেলেছিলাম! তাই গরমের ছুটির পর আমাকে সিনিয়র কেজিতে বসতে বলা হলো, আমার ঐ দুই বন্ধু ছোটু আর বুড়ো র পাশেই! সিনিয়র কেজিতে ফার্স্ট হয়ে ক্লাস ওয়ানে উঠলাম।

এক বছরেই প্রমোশন পেয়ে তিন তিনটে ক্লাসে পড়তে অন্য কোনো স্কুল অনুমতি দিতো কি না জানিনা। তবে আমি নিশ্চিত যে মন দিয়ে পড়াশোনা বা কোনো কাজ করলে সুফল পাওয়া যাবেই, স্কুল কর্তৃপক্ষর এই সিদ্ধান্ত বা আমাকে বিশেষ অনুমতি দেওয়ার বিষয়টিও আমার ভেতরে সেই মানসিকতার বীজই বপন করে দিয়েছিল।

স্কুলটি একটা পাঁচিল ঘেরা পরিষ্কার ছিমছাম পরিসরে, টালির ছাদের বাড়ি, এক চিলতে খেলার জায়গা ও দুটো টিচার্স কোয়ার্টার সমেত ক্লাস ফোর অব্দি পড়ার জন্য উপযুক্ত ছিল। টিচার’রা বেশির ভাগই মহিলা ও এ্যাঙ্গলো ইন্ডিয়ান, একজন পুরুষ ছিলেন, স্যামুয়েল স্যার। আর একজন টিচারের নাম মনে আছে, মিস স্মিথ। নাম ভুলে গেলে কি হবে, স্কুলের আদবকায়দাগুলো বেশ মনে আছে। মিসেস গোমেস ধবধবে ফরসা, সাদা চুলের বয়স্কা মহিলা। ফোলা ফোলা গাল। প্রত্যেক শুক্রবার স্কুলের শেষ পিরিয়ডে চ্যাপেল হতো। মিসেস গোমেস অর্গ্যান বাজিয়ে গাল ফুলিয়ে চার্চ সঙ্গীত গাইতেন। অন্য টিচাররাও গলা মেলাতেন। চেনা গান হলে ( শুনতে শুনতে চেনা আর কি!) আমরাও গাইতাম বৈকি!

তবে আমাদের অপেক্ষা থাকতো গানের পরের অনুষ্ঠানের। সেই সপ্তাহে যারা ভাল পড়াশোনা বা খেলাধুলা বা অন্য কিছু ভাল করেছে, সেই ছাত্র ছাত্রী দের ছোট ছোট উপহার দিতেন মিসেস গোমেস। মহার্ঘ কিছুই নয়। সেন্ট এর সুদৃশ্য খালি শিশি বা ইউসড গ্রিটিংস কার্ডের পারসোনাল লেখাগুলো সুন্দর ভাবে ছেঁটে দেওয়া। সেই গিফট পাওয়ারও যে কত আনন্দ ছিল আমাদের! খালি সেন্টের শিশিতে যে অবশিষ্ট সুগন্ধ লেগে থাকে, সেটাকেই বুক ভরে উপভোগ করতাম।

ঐ স্কুলেই প্রথম ছবিতে বাইবেল এর সঙ্গে পরিচয়, গীতা- রামায়ন-মহাভারত হাত দেওয়ার আগেই। নোয়ার নৌকার গল্প, মোসেস এর পরিত্রাণের কথা বা অনুতপ্ত ছেলেকে ক্ষমা করে বুকে টেনে নেওয়ার উপাখ্যান বেশ আগ্রহের সঙ্গেই পড়েছি। শিখেছিও। সঙ্গে ইংরেজি শেখার প্রথম ধাপ, যে ভিত টা আমাকে পরবর্তী জীবনে বিশেষ উপকৃত করেছে। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত ঐ স্কুলে পড়েছিলাম। তারপর আবার বাবার বদলি।

স্কুল ছাড়াও কাতরাসগড় আমাকে আর একটা বিষয় শিখিয়েছে। জীবনে বন্ধুদের সঙ্গে সখ্যতার আনন্দ।

********

আমাদের টিফিনবেলা।
আমি ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস ইলেভেনের হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত পড়েছি বর্ধমান টাউন স্কুলে, ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৬।

আমি সেই সময়ে আমাদের স্কুলের টিফিন ও টিফিন পিরিয়ডের সেই আনন্দ স্মৃতিচারনা করার চেষ্টা করছি।
স্কুল শুরু হতো এগারোটায়। তিন পিরিয়ড পরে, একটার সময় টিফিনের ঘন্টা বাজতো। আধ ঘন্টার টিফিন পিরিয়ড। ব্যতিক্রম শুক্রবার। সেদিন দু পিরিয়ডের পরই টিফিনের ঘন্টা বাজতো আর টিফিন পিরিয়ড হতো এক ঘন্টা দশ মিনিটের। সে এক মহা আনন্দের দিন। পরবর্তী কালে চাকরি জীবনের TGIF এর রিলিফ যেন!

আমাদের স্কুলে সেকালে টিফিন স্কুল থেকেই দেওয়া হতো। আর মনে পড়ে গেল, মাসিক টিফিন ফি ছিল ৭৫ পয়সা! ফার্স্ট পিরিয়ডের রোল কলের পরেই কাশীনাথদা (যিনি স্কুলের ঘন্টা বাজানো এবং দারোয়ানের কাজটাও করতেন) ক্লাসে ক্লাসে ঘুরে সেদিনের উপস্থিতি সংখ্যা জেনে নিতেন আর টিফিন পিরিয়ডের আগে গামলা ভর্তি টিফিন সব ক্লাসে ক্লাসে রেখে যেতেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বেশ অনেক ধরনের টিফিনই দেওয়া হতো প্রতি দিন। যেমন,
– টিফিন কেক
– লম্বু (গোলাকৃতি মিষ্টি প্যাটিজ, সুজি আর নারকেল এর পুর ভরা)
– ক্রিমরোল
– দুটো করে ব্রিটানিয়া বিস্কুট ও একটা করে সন্দেশ (যেটা আমরা অনেকেই দুটো বিস্কুটের মাঝে স্যান্ডুইচ বানিয়ে খেতাম)
– একটা করে নিমকি ও বোঁদের লাড্ডু
– একটা করে কলা ও কমলালেবু (শীতকালে)
– দুটো সিঙ্গারা

আর কিছু মনে পড়ছে না তেমন। শুধু মনে পড়ছে, যে দিন দোনায় করে নিমকি -লাড্ডু পেতাম, সেদিন স্কুলের আকাশে চিলেদের ভীড় জমতো। ভুল করে যারা ঐ টিফিন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে চলে যেত আর বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে যেত, চিলের ছোঁ থেকে তাঁরা অনেকেই নিমকিটা বাঁচাতে পারতো না।

টিফিন পিরিয়ডের আর একটা আকর্ষণ ছিল, গেটের ঠিক বাইরেই বসা, নানান খাদ্যপসার নিয়ে সব “বন্ধু”রা। একজন বন্ধু বসতো নানান রঙের কাঠি আইসক্রিম, ছোট লাল কুল, আমসত্ত্ব নিয়ে। আর একজন নিয়ে আসতো ঘুগনি, আলুর দম। আরেকজন শোনপাপড়ীর লটারি নিয়ে। একজন “চোদ্দ মজা” হজমিগুলি চুরন নিয়ে। কোনো কোনো দিন এক বন্ধু নিয়ে আসতো গোলাপি রঙের গোলাকৃতি বুড়ির চুল।

মোটামুটি দশ -পনেরো পয়সা পকেটে থাকলেই রাজার হালে পছন্দসই দু একটা খাবার উপভোগ করা যেত। তারপর, একটা জিনিস কিনে অন্যের সঙ্গে ভাগ করেও খাওয়া তো ছিলই। কাঠি আইসক্রিম দুজনে চুষে ভাগ করেও নিতাম, জাত-ধর্ম নির্বিশেষে! তারও উপর একটু আধটু ধারও চলতো ঐ “বন্ধু” বিক্রেতার কাছে। তাই তো ওরা “বন্ধু”!

ও হ্যাঁ, টিফিন পিরিয়ডের আর একটা আকর্ষণ ছিল “জিলিপি” ফল পেড়ে খাওয়া। ঐ ফলের গাছ বা ফল অন্য কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তবে আমাদের স্কুলে প্রায় দশ বারোটা ঐ ফলের গাছ ছিল। একটু লম্বা গোছের। টিপ করে ঠিল ছুঁড়ে ঐ ফল পাড়তে হতো। পাকলে মেরুন রঙের ও মিষ্টি।

এ সব করেও, একটু সময় পেলে, দু-পা হেঁটে কোর্ট রুমে (বর্ধমান কোর্ট কম্পাউন্ডে লাগোয়াই আমাদের স্কুল) ছাগল চুরি, গরু চুরি ইত্যাদি ধরনের মামলা শুনতে ঢুকে পড়তাম। তারপর টিফিন শেষের ঘন্টা বাজতেই, দুড়দাড় যে যার ক্লাসে ঢুকে পড়তাম।

ও হ্যাঁ, নিজের নিজের জলের বোতল নিয়ে যাওয়ার চল তখনও আসেই নি। একটা গোটা দশেক কল লাগানো বড় চৌবাচ্চা ছিল। তাতেই মুখ লাগিয়ে জল খেতাম!

*******

Sahityika Admin

Add comment