ভালোবাসার খেলা
@অজয় দেবনাথ, ১৯৭০ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
ছোটবেলা থেকেই আশীষ খেলাধুলায় ভালো, যে কোন খেলাতেই সেরা হওয়ার যেন একটা সহজাত ক্ষমতা আছে। খেলা ছিল ওর প্রাণ, ওর ভালবাসার জায়গা। সব খেলার মধ্যে আশীষের ভালবাসাটা বেশি ছিল ফুটবলের ওপর আর তার পরেই ছিল ব্যাডমিন্টন। এই ব্যাপারে মা খুব একটা নাক গলাতে চান না কারণ তিনি ধরেই নিয়েছেন এটা বয়সের দোষ, সময়ে কেটে যাবে। কিন্তু পড়াশুনার ব্যাপারে বাবা ভীষণই কট্টর; কোন চান্সই নিতে চান না। নামী ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, তবুও ছেলের খেলাধুলার ঝোঁকটাকে মেনে নিতে পারতেন না। আর আশীষ পড়াশুনায় যে খুব একটা খারাপ তাও বলা যাবে না। ছেলের পড়াশোনায় বাবা সময় দিতে পারতেন না, তাই প্রাইভেট টিউটর রেখে দিলেন, প্রায় প্রতিটা বিষয়ের জন্য। পরীক্ষায় মোটামুটি একটা সম্মানজনক নম্বর পাবার জন্য এনারাই আশীষকে সাহায্য করতেন।
ক্লাশ ইলেভেনে ওঠার আগে আশীষ পড়ে গেল টাইফয়েডের কবলে; সেরে উঠলো প্রায় ২১ দিন পরে। ডাক্তারবাবু বললেন তিন মাস রেস্ট নিতে হবে নাহলে শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ হবে না। স্কুলের পরীক্ষাতেও আশীষ বেশ ভাল রেসাল্ট করলো, তৃতীয় হয়ে সায়েন্স বিভাগে। নতুন ক্লাশে উঠে প্রথম দিনেই আশীষ বুঝতে পারলো ওর চোখের কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে। বোর্ডের লেখা গুলো ঠিক মত পড়তে পারছে না। ডাক্তার দেখিয়ে ক’দিনের মধ্যেই চশমা পড়তে হলো, কিন্তু এটাও বুঝতে পারলো যে ওর খেলার জীবন থেকে ফুটবল চিরতরে হারিয়ে গেল। বিকেলবেলা মাঠে গিয়ে ওর চোখ ফেটে জল এল; একটু সরে এসে দেখলো ব্যাডমিন্টনের নেট টাঙানো চলছে। দৌড়ে বাড়ি গেলো র্যাকেট আনতে; সর্টস আর কেডস শু পরে পুরোপুরি তৈরী হয়ে এলো। চার পাঁচ জন পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে তাপসকে দেখতে পেয়ে যেমন ভাল লাগলো, তেমনি অবাক হলো রজতের সঙ্গে ওর বোন টুপুরকে দেখে।
আশীষ নিজেই বেশ ভাল খেলে কিন্তু এতদিন পরে কোর্টে এসে অনভ্যাসের ফোঁটা চড়চড় করতে লাগল। স্টেপিং জড়িয়ে যাচ্ছে, শট গুলো জোরে আর সঠিক জায়গায় পৌছচ্ছে না। মোটামুটি এক সপ্তাহ লাগলো ফর্মে আসতে, মনে একটা জোর এলো। দিন কয়েকের মধ্যেই আবার সবাইকে ছাপিয়ে গেলেও তাপস কিন্তু কাছাকাছিই রইলো। আর ও মজার ব্যাপার এই যে টুপুর কিন্তু বেশ ভাল খেলে এমনকি ওর দাদার থেকেও।
একদিন স্টেট চ্যাম্পিয়ন ও পাড়ার নামী প্লেয়ার বিক্রমদা এসে হাজির। ওদের সঙ্গে খানিকক্ষন খেলে আশীষ, তাপস, রজত আর টুপুরকে ডেকে বললো, তোরা তো মোটামুটি ভালো খেলিস; আমাদের ক্লাবে চলে আয়, খুব ভাল ট্রেনিং পাবি; হয়ত ভবিষ্যতে তোদের মধ্যেই কেউ স্টেট বা ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ন হবি, যাবি নাকি? অন্যরা তো সাথে সাথেই রাজী কিন্তু আশীষের ভয় বাবাকে নিয়ে। বাড়ী এসে মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক আবদার করে বাবাকে রাজি করার দায়িত্ব মা’কেই দিল। মাও বাবাকে বোঝালেন যে ওতো ভালোই রেজাল্ট করেছে, পড়াশুনাটাও মন দিয়ে করে; খেলার সঙ্গে ওর কোন বিরোধ তো নেই। বাবা হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তবে মনে রাখবে যে সামনেই বিরাট পরীক্ষা, তারপরে জয়েন্ট। একটু খারাপ হলেই কিন্তু খেলা বন্ধ।
ওঁরা চারজনে খেলা আর পড়া দুটোই ব্যালান্স করে চালাচ্ছিল। বিক্রমদা এবার নিজেই ওদের র্যাকেট দিয়ে বললেন, আয় তোদের এটা সঠিক ভাবে ধরা শেখাই। ফোরহ্যান্ড গ্রিপ হচ্ছে হ্যান্ডশেকের মতো; এটা হালকা শক্তভাবে ধরতে হবে আর ব্যাকহ্যান্ড গ্রিপ হচ্ছে থাম্ব র্যাকেট এগেনস্টে ফ্ল্যাট রেখে শক্ত কিন্তু একটু রিলাক্সড ওয়েতে ধরতে হবে। খানিক বাদে আশীষ নিজেই বুঝতে পারলো যে ও সহজাত ভাবে যেরকম গ্রিপ নিতো সেটাই মোটামুটি ঠিক।
সকলেই এই খেলাটার মধ্যে বেশ মনপ্রাণ দিয়ে ঢুকে পড়েছিল। মাস দুয়েক পরে ওদের খেলা দেখে বিক্রমদা বুঝতে পারলো আশীষদের সার্ভিসে দুর্বলতা আছে; এটা নিয়ে ওদের সঙ্গে অনেক খাটতে হবে। ওদের সবাইকেই হাতে ধরে শেখালেন কত রকমের সার্ভিস হয়, যেমন শর্ট বা লো সার্ভিস যেখানে শাটল একটি মৃদু টোকায় নেটের জাস্ট উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে উল্টো দিকে কোর্টের সামনের লাইনের উপরে পড়ে। এটা করার সময় অপোনেন্ট যেন অনুমান করতে না পারে, না হলে তার পক্ষে সরাসরি স্ম্যাশ বা নেট কিল করা সহজ হবে। এরপর হাই সার্ভিস হল শাটলকে উপরের দিকে খুব জোরে এক স্ট্রাইক যা কোর্টের পিছনের লাইনে ডীপ হয়ে পড়ে যাবে। বিক্রমদা বললো, যদিও এটা একটা শক্তিশালী সার্ভ এবং এই টেকনিক ভালো প্লেয়াররা ব্যাবহার করে, তবুও এটি এমন একটি সার্ভ যা লুকিয়ে রাখা এত সহজ নয়, আর বিশেষ করে যেহেতু তোরা যখন ফোরহ্যান্ড গ্রিপ ব্যবহার করছিস। অপোনেন্ট তো অলরেডি শাটলকক কোর্টের পিছনে নামবে বলে আশা করবে।
তিন নম্বরে আসবে ফ্লিক সার্ভিস যা উপরের দিকেও খেলা হয় কিন্তু অনেক কম হাইটে । এখানে প্লেয়ার ব্যাকহ্যান্ড ব্যবহার করে আর এই গ্রিপে শক্তি কম থাকায় ট্র্যাজেক্টরি কম হয়। সার্ভিস এমনভাবে করে যে মনে হয় শর্ট সার্ভিস হতে যাচ্ছে কিন্তু অনুমান করা শক্ত বলে প্লেয়ারদের কাছে খুব জনপ্রিয়।
আর চার বা সবার শেষে আসছে ড্রাইভ সার্ভিস যা খুবই আক্রমণাত্মক আর পপুলার সার্ভিস যেখানে শাটল সরাসরি অপোনেন্টকে টার্গেট করবে, ফেরানো শক্ত হবে আর পয়েন্ট পাওয়াও সহজ হবে। কিন্তু এটিতে ঝুঁকি আছে কারণ অপোনেন্ট বুঝতে পারলে সে উল্টে সার্ভারকেই শাটলকক দিয়ে হিট করতে পারে। আশীষ ক্লাবের বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে খেলতে তুখোড় হয়ে উঠতে লাগলো; ওদিকে পড়াশুনাটাও ভালোভাবেই চলছিলো।
ওরা যখন সার্ভ করাতে পারদর্শী হয়ে উঠছে, নানা রকমের বৈচিত্র আনছে তখন বিক্রমদা ওদের দেখে খুশী হল ঠিকই কিন্তু এতে থেমে থাকলে তো চলবে না। এবার ওদের ফুটওয়ার্ক শিখতে হবে। এবারে খেলার অন্যান্য মৌলিক বিষয় গুলোতেও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। ফুটওয়ার্ক ব্যাডমিন্টনের একটি অপরিহার্য অংশ যা স্ট্রোককে প্রভাবিত করে, তাই বিক্রমদার পরামর্শে আশীষরা ফিটনেস স্তর উন্নত করার জন্য কিছু ব্যায়াম শুরু করল। যেমন সপ্তাহে কমপক্ষে তিন দিন আধ ঘন্টা করে জগিং, প্রতিদিন দশ মিনিটের জন্য স্কিপিং যা টো এর সহনশীলতা বাড়াবে আর পা হালকা এবং চটপটে রাখবে। এরপর ক্রমাগত শ্যাডো প্রাকটিস করা যাতে মনে হয় যে ফুটওয়ার্কটা যেন ওর সহজাতই ছিল। তার পরে সাইলেন্ট ফুটওয়ার্ক; নড়াচড়া করার বা লাফিয়ে নামার সময় পায়ের শব্দ যত কম হবে ততটাই স্বাচ্ছন্দ্য আসবে খেলার সময়।
বিক্রমদা বারবার বলে চলেছে যে পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। আর এরাও চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব এই খেলাটা মন দিয়ে খেলতে। এর মধ্যে দুদিন রজত আর টুপুর এলনা; আশীষের মনটা একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল, বেশী করে টুপুরের জন্য। তবে কি টুপুরকে ওর ভাল লাগতে শুরু করেছে? ওরা ফ্যামিলী শুদ্ধ কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছিল। রজত টুপুরের থেকে এক বছরের বড় কিন্তু এক বছর অসুখের জন্য ড্রপ দিয়ে একই ক্লাশে পড়ে। যেমন ভাব তেমনই ঝগড়া। পড়াশুনা, খেলাধুলায় দুজনেই বেশ ভাল। টুপুরের এই দুদিনের অনুপস্থিতিতে আশীষের মনে একটু আলোড়ন তুলে দিল।
দিন চলে যায় আপন ছন্দে; কিন্তু ওদের খেলায় যেন স্ট্রেন্থটা ঠিক আসছেনা। সবাই মিলে ঠিক করল বিক্রমদার কাছে সাজেশন চাইবে এই খামতি কি ভাবে ম্যানেজ করা যায়! বিক্রমদাও খুব খুশী ওদের এই সেল্ফ এসেসমেন্টে। কয়েক দিনেই শিখিয়ে দিল নানা রকমের ডন যেমন ডায়মন্ড পুশ-আপ, স্পাইডারম্যান পুশ-আপ, ক্ল্যাপ পুশ-আপ যা তার বাহু, কাঁধ এবং পিঠের শক্তি বাড়াবে কারণ সেগুলি ব্যাডমিন্টনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের বৈঠক যেমন ফ্রগ স্কোয়াট, স্কোয়াট কিকব্যাক এবং সাইড লেগ লিফট স্কোয়াট এই প্র্যাকটিসে যোগ করলো দুর্দান্ত বৈচিত্র্য আনার জন্য যা quadriceps বা থাই মাসলের শক্তি বাড়াবে। শুধু এইখানেই থেমে থাকল না বিক্রমদা আর সেই সঙ্গে যোগ করালো বারপিস (Burpees) যা বিস্ফোরক শক্তির যোগান দেবে পায়ে সঠিক সময়ে। এছাড়া বক্স জাম্প (2 ফুট উচ্চতার) ও Crunches যা কোর স্ট্রেন্থ তৈরি করার জন্য একটি পরিচিত ব্যায়াম।
ভালোয় ভালোয় ওদের হায়ার সেকেন্ডারির টেস্ট হয়ে গেল; এরপরেই শুরু হল ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ। মেয়েদের গ্ৰুপে ভালো প্রতিযোগিতা হলেও প্রত্যাশা মতো ফাইনালে টুপুরই চ্যাম্পিয়ন হলো কাজলকে হারিয়ে। ছেলেদের গ্ৰুপে কোয়ার্টার ফাইনালে রজত হেরে গেল, যদিও আশীষ আর তাপস ফাইনালে উঠে বিক্রমদার মুখ রাখলো। ফাইনাল শুরু হতে প্রথমদিকে দুজনেই পরস্পরকে মেপে খেলার চেষ্টা করছিল। দুজনেই একটা করে সেট জেতার পর বিক্রমদা বলল এবার দুজনেই একটু হাত খুলে খেল; খেলাটা তো বোরিং হয়ে যাচ্ছে। খেলা তো শুধু জেতার জন্য নয়, নিজে ও অন্যদের আনন্দ পাবার ও দেবার জন্যও বটে! যাই হোক খেলাটা শেষ পর্যন্ত তিন সেটে মীমাংসা হল। তাপস একটু যেন বেদম হয়ে গিয়ে হার স্বীকার করে নিলো ২১-১৯, ১৮-২১, ২১-১৩ গেমে।
এবার জোরকদমে পড়াশুনা চালু হয়ে গেল ফাইনাল পরীক্ষার জন্য। আশীষের জন্য ব্যাডমিন্টন একটু ব্যাকস্টেজে পড়ে গেল কারণ বাবার স্ট্রিক্ট অর্ডার; হায়ার সেকেন্ডারি আর জয়েন্ট দুটোতেই ভালো রকমের সাকসেস চাই। তবুও আশীষ কোর্টে যায় যাতে প্র্যাকটিস নস্ট না হয়ে যায়। এই সব বিক্রমদার চোখ এড়ায় না; বলে তোর হবে। খেলার প্রতি তোর ভালবাসাই তোকে জেতাবে। আশীষের মনে হল টুপুরের কথা; সেও তো আশীষের ভালবাসা। কখন যে টুপুর ওর হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে ও কি ছাই বুঝতে পেরেছে!
পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলে আশীষ কয়েক দিনের জন্য খেলার কথা যেন ভুলেই গেল। বাবার মান রাখতেই হবে; জয়েন্টে ওকে ভাল রাংক করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হবে; ডাক্তারীটা ওর ঠিক পছন্দ নয়, মানুষের শরীর কাটা ছেঁড়া যেন একটা আতঙ্কের ব্যাপার। এখন বাবা মা দুজনেই খুব খুশী হবেন কেন না মা অনেক দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বাবাকে রাজী করেছিলেন।
আশীষ খুব ভালো পরীক্ষা দিলো। রজত আর টুপুরও বেশ ভালই দিয়েছে বললো কিন্তু তাপস বললো ভালোই, কিন্তু খুব ভাল মনে হচ্ছে না। যাই হোক ওরা সবাই যে যার মত বাবা মার সঙ্গে দিন পাঁচ ছয়েকের জন্য বেড়িয়ে এসে আবার ক্লাবে চুটিয়ে প্র্যাকটিস করতে লেগে পড়ল। মাঝে কয়েকদিন জয়েন্টের পরীক্ষার জন্য রজত, টুপুর আর আশীষ না এলেও তাপস জয়েন্ট দিল না ওর বাড়ির সমস্যার জন্য।
বিক্রমদার কোচিংয়ের যাতে বদনাম না হয় সে ব্যাপারে সকলেই সচেষ্ট ছিল। এদিক ওদিক ম্যাচ খেলে নিজেরা আরও পরিণত হবার চেষ্টা করছিলো। ইতিমধ্যে রেজাল্ট বের হলে দেখা গেল তাপস পেয়েছে ৮০%, আর বাকি তিনজনই প্রথম একশোর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। এর সঙ্গে সংগতি রেখে ওরা জয়েন্টেও চান্স পেল; আশীষ ভর্তি হল IIEST তে, সে হোষ্টেলে থেকে পড়বে, আর বাড়ির কাছে থেকে বিক্রমদার পরামর্শ পাবে। রজত আর টুপুর কিছুই ঠিক করতে পারছে না কারণ ওদের বাবা ব্যাঙ্গালুরু ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছেন, আর ওদের ছেড়ে মা থাকতে পারবেন না। ওখানেই যাবার সম্ভাবনা বেশী। আশীষ খানিকটা ভেঙে পড়লেও সামলে নিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না ওরা দুজন হঠাৎ করেই ব্যাঙ্গালুরু চলে গেল ওদের মা বাবার সঙ্গে।
রজতের সঙ্গে টুপুরও চলে যাওয়ায় আশীষ একটু মুষড়ে পড়লেও ও যখন বাড়ি এসে ক্লাবে প্র্যাকটিস করতে গেল বিক্রমদা বললো একটা কথা মন দিয়ে শোন, আমরা যখন একটা খেলা বাছাই করি, তখন একটা নির্দিষ্ট স্তরে স্ট্যাগনান্ট হয়ে যাই কারণ বেশিরভাগ লোকই জানে না কীভাবে আরও ভালো হতে হয়, তাই মানসিক জড়তা তাদের দখল নিয়ে নেয়। তোদের সাথে এটা ঘটতে দিবি না!
বিক্রমদা মাসদুয়েক আশীষকে দেখে নেওয়ার পরে বললেন এবার তোর বেষ্ট বন্ধুকে বেছে নে যার সঙ্গে তোকে স্পেশাল ট্রেনিং দেব। আমি যা পারিনি তোদের দিয়ে তাই করিয়ে দেখাবো। আশীষের মনে পড়ল টুপুরের কথা; ওই তো ওর বেস্ট ফেন্ড ছিল, কোথায় যে গেল! যাই হোক আশীষের পার্টনার হিসাবে তাপস এলে বিক্রমদা বললেন তোদের এবার হাফ-কোর্ট সিঙ্গেলস খেলতে হবে মানে কোর্টের ফার্স্ট পার্টটাকে ব্যবহার করতে হবে। এটি ফুটওয়ার্ক বা ধৈর্যের পরিবর্তে কৌশলের উপর ফোকাস করতে শেখায়।
যেহেতু ভেবে নিতে হবে যে পিছনের অর্ধেক কোর্ট নেই অতএব স্ট্রোক ব্যবহার করতে হবে লিমিটেড ভাবে, আর তাতে তোদের বিশেষ স্ট্রোকের উপর ফোকাস করার অভ্যাস করবে। এরপর শুধু পেছনের কোর্টে সিঙ্গেলস খেলতে হবে; যতটা সম্ভব উঁচু করে অনেকক্ষন ধরে ৱ্যালি করবি। এটা করলে ড্রাইভ এবং অন্য স্ট্রোকগুলোকে ডেভেলাপ করতে পারবি; শাটলের সাথে কানেক্ট করার সময় সঠিক টেকনিক এবং কোর্টের উল্টোদিকে পিছনে শাটলটা কে উঁচু করে পাঠাতে প্রয়োজনীয় এনার্জি দেবে। তোদের উইক স্ট্রোক গুলো এতে স্ট্রং হবে আর নানা রকম স্ট্রোকের মধ্যে স্যুইচও করতে পারবি। অবশ্যই খেয়াল করে শাটলটা একজন আরেকজনের শরীরের চারদিকে পাঠাবি যাতে শাটল ফেরানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের স্ট্রোক ব্যবহার করতে বাধ্য হবি। এর পরে যে স্ট্রোকের সাথে তোদের সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হয় সেগুলিতে ফোকাস করতে হবে। অনেক প্লেয়ারের ব্যাকহ্যান্ড উইক থাকে তখন পুরো সেশনটি শুধুমাত্র ব্যাকহ্যান্ড দিয়ে শাটল ফেরত দিতে হবে। এই স্ম্যাশ করা এবং স্ম্যাশ তোলা এমন একটা ক্ষমতা যা ভাল আর সাধারণ প্লেয়ারদের আলাদা করে দেয় । এই প্রাকটিসের জন্য, একজন শুধু লিফ্ট করবে আরেকজন শুধু স্ম্যাশ করে যাবে, ক্রমাগত এইভাবে পাল্টাপাল্টি করে প্রাকটিস করলে দুজনেই এক্সপার্ট হয়ে যাবি।
এই টিপস নিয়ে আশীষ হোস্টেলে ফিরে আসে। প্রতিদিনই ক্লাস শেষে সামান্য খাওয়া দাওয়া করে ব্যাডমিন্টন কোর্টে ছোটে। পার্টনার ও পেয়ে গেল সেকেন্ড ইয়ারের এক সিভিলের ছাত্রকে। রাজস্থান থেকে এসেছে ; নাম ললিত মীনা। ওকে বুঝিয়ে বলল ব্যাপারটা। ওরা আধ ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা ফ্রন্ট কোর্ট আর রিয়ার কোর্ট প্রাকটিস করে শেষে দু তিনটে গেম খেলবে। এইভাবে হোস্টেল আর বাড়ি ফিরে আশীষ ব্যাডমিন্টনকে আঁকড়ে ধরলো টুপুরকে ভুলে। পরপর চার বছরই আশীষ চ্যাম্পিয়ন আর ললিত রানার্স আপ হল। ফিফ্থ ইয়ারে অল ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়নশিপে আশীষ আর ললিত দুজনেই চললো ব্যাঙ্গালুরুতে IIEST কে প্রতিনিধিত্ব করতে।
আশীষ মনে একটা ক্ষীণ আশা জিইয়ে রেখেছে যদি ব্যাঙ্গালুরুতে টুপুরের সাথে দেখা হয়ে যায়। এর আগে আশীষ মোবাইলে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু কোনও এক কারণে বা পড়াশুনার চাপে টুপুর বা রজত কারোর সঙ্গেই আর যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। ওখানে পৌঁছেই প্রথম দিন একটু ওয়ার্ম আপ আর প্রাকটিস করে আশীষ চললো ব্যাঙ্গালুরু ক্যাম্পের দিকে যদি মনের মানুষটির আর বন্ধুটির দেখা পাওয়া যায়! সামান্য কয়েক পা যেতেই দেখা মিললো রজতের। জড়িয়ে ধরতেই স্বাভাবিক ভাবে একটু পরে টুপুরের কথাটা উঠলো। রজত বললো যে ওরা দুজনেই এসেছে ওদের ইউনিভার্সিটির হয়ে। আশীষ ছটফট করে উঠলো, চল চল শিগগির চল কতদিন পরে দেখা হবে বলতো! যেতে যেতে আশীষ বলতে লাগলো তোদের মোবাইলে বা সোশ্যাল মিডিয়া কোথাও পাওয়া গেল না কেন বলতো? রজত জানালো যে ওর বাবার কড়া নির্দেশ কলকাতার কারোর সঙ্গেই আর যোগাযোগ রাখা যাবে না, কারণ ওর বাবার অফিসে একটা বাজে কেসে ওর বাবাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে কলকাতা ছাড়া করার চক্রান্ত হয়েছিল; যদিও পরে দেখা যায় এ ব্যাপারে উনি একেবারে নির্দোষ কিন্তু মনে যে আঘাত পেয়েছেন তারই ফলশ্রুতিতে উনি বা পরিবারের সবাই ঠিকই করে ফেলেছিল যে আর কলকাতার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখবে না।
খানিক বাদেই ওরা মেয়েদের ক্যাম্পে পৌছে গেল। আশীষের হৃদয়ে তুফান; কেমন ভাবে দেখবে ওর সেই কিশোরবেলার রাই কিশোরী টুপুরকে। খবর পেয়ে টুপুরও এসে আশীষকে দেখে লাফিয়ে উঠল। কি রে আশীষদা! রজত বললো বাবা তুই আবার কবে থেকে ওকে আশীষদা বলতিস! টুপুর জানালো, আসলে অনেকদিন দেখিনি তো; তার ওপর ও যা লম্বা চওড়া আর হ্যান্ডসাম হয়েছে যে আমার মুখ থেকে অটোমেটিক্যালি দাদা বেরিয়ে গেছে। আশীষের মুখ থেকেও যেন ফস্কে বেরিয়ে এলো, আর তুইও কি দারুন দেখতে হয়েছিস রে! ঠিক যেন উর্বশী! রজত হো হো করে হেসে উঠে বললো তার পেছনে আবার রৌতেলা জুড়ে দিসনি যেন! সবাই মিলে হৈ হৈ করে মজা করতে লাগলো। এক ফাঁকে আশীষ টুপুরের কানের কাছে এসে ফিস ফিস করে বলে উঠলো টুপুর আই লাভ ইউ। টুপুর লজ্জায় লাল হয়ে বললো আস্তে দাদা শুনতে পাবে; আই লাভ ইউ টু..উ।
আশীষের মনটা কানায় কানায় ভোরে ওঠে আনন্দে। জিজ্ঞাসা করে তোরা কেউ খেলা ছাড়িস নি সেটা বুঝতে পারছি কিন্তু কোনো কোচের কাছে শিখছিস? ওদের কথায় বুঝতে পারলো ওদের কলেজে খুব ভাল কোচ আছেন তার কাছে শেখে কিন্তু ওরা ইন্টারনেটে ভিডিও দেখেও অনেক কিছু শিখেছে।
টুর্নামেন্টে আশীষ দ্বিগুন উৎসাহে খেলতে লাগলো। সিঙ্গলস ইভেন্টে প্রথম কয়েকটা রাউন্ড ওরা তিনজন আর ললিত সহজেই স্ট্রেট সেটে জিতে গেলো কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে ললিত আর সেমিফাইনালে রজত হেরে গেল। মিক্সড ডাবলসে ফাইনাল উঠলো রজত আর টুপুর; মেয়েদের ফাইনালে টুপুর তিন সেটে ২১-১৩, ১৮-২১, ২১-১৭ পয়েন্টে জিতে চ্যাম্পিয়ন হলো। মিক্সড ডাবলস ফাইনালে রজত আর টুপুর স্ট্রেট সেটে ২১-১৪, ২১-১৫ পয়েন্টে জিতলো। ছেলেদের ডাবলস ফাইনালে আশীষ আর ললিত আবার তিন সেট পর্যন্ত্য হাড্ডাহাড্ডী লড়াই করে ২০-২২, ২৪-২২, ২১-১৬ পয়েন্টে জিতে চ্যাম্পিয়ন হল। ছেলেদের সিঙ্গলস ফাইনালে আশীষ স্ট্রেট সেটে ২২-২০, ২১-১৮ পয়েন্টে জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলার মুখ উজ্জ্বল করলো। বিক্রমদা আগাগোড়া নজর রাখছিলেন কলকাতা থেকে আর প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছিলেন; খুব খুশী শিষ্যের এই কৃতিত্বে।
রজত বুঝতে পারছিল আশীষ আর টুপুরের ব্যাপারটা তাই ফেরার পথে ওদের একটু নিভৃতে মেশার সুযোগ করে দিল। টুপুর জিজ্ঞাসা করলো, এরপর কি? আশীষ হাসতে হাসতে বললো, এরপর স্টেট তারপর অল ইন্ডিয়া আর তারপর অল ইংল্যান্ড। টুপুর মুগ্ধ হয়ে বলে, বাব্বা এতটাই ভাবা হয়ে গেছে! আশীষের পরের জিজ্ঞাসা, আর তোর ? টুপুরও চার্জড হয়ে স্বগতোক্তি করে আমিও তাহলে সেটাই টার্গেট করবো। তরপর টুপুরের প্রশ্নের পালা; এরপর কি? আশীষ একটু ফাঁকা জায়গা দেখে ওকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ একটা চুমু খেয়ে বলে এরপর দুটো বাচ্চা হবে আমাদের। টুপুর আরক্তিম মুখে কোনরকমে শুধু অস্ফুটে বলে ধ্যাৎ, অসভ্য।
*******
Add comment