কভি কভি মেরে দিল মে……
@অর্ণব চ্যাটার্জী, ১৯৮৩ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
বেশ মনে আছে একদিন বিকেলে কলেজ থেকে হস্টেলে ফিরে নরদা’র ক্যান্টিনে পাউরুটি চিবোতে চিবোতে হঠাৎই ঠিক হলো আজ নাইট শো’তে নবভারতে “কভি কভি” যেতেই হবে। ভরসা নেই, আজ না দেখলে কাল হয়তো চেঞ্জ হয়ে অন্য সিনেমা চলে আসবে। আর দেখতে হলে আজকেরই নাইট শো। সুতরাং কিছু করার নেই।
কভি কভি রিলিজ হয়েছিলো ১৯৭৭ সালে, যখন আমি হাফ প্যান্ট পড়ে স্কুলে যাই। তখন আমার পক্ষে স্কুল পালিয়ে দেখার সাহস হয় নি। কিন্তু, এই গানটা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিলো। এই গানটা আমি নিজের মনেই গাইতাম। একদিন মা শুনে বাবাকে বলেছিলো, ছেলের মতিগিতি সুবিধের নয়।
সে অনেক অতীত। এখন আমাকে কলেজ পালিয়ে, বা নাইট শো’তে কে আটকায়? তাই, পাজামার উপর প্যান্ট গলিয়ে দৌড়লাম আমরা কয়জন, আমি জগা, কুশ, মৃণাল, বেতো আর বিপুল। মনে পড়লো আমাদের টিংকু রানীও আগে একবার বেতোকে বলছিলো এই সিনেমাটা সে দেখতে চায়। কথাটা পাড়তেই বেতো বাদে বাকীরা আমাকে যেন মারতে এলো। “তোর কি মাথাটা গেছে? একটা লেডিস হস্টেলের মেয়েকে নাইট শো’তে সিনেমায় নিয়ে যাওয়ার হ্যাপা জানিস? আর তাও কিনা হাওড়ার ঐ গলিতে, নবভারত হলে? তুই জানিস নবভারতের ক্রাউড কি জিনিস?”
সেই সময় বেতো আমাদের টিংকু রাণীর হৃদয়ের কোণে সামান্যতমও একটুখানি স্থান পাওয়ার জন্য সবরকমের কৃচ্ছসাধনের জন্য মানসিক সংকল্প নিয়েছিলো। দেখলো এই সে সুযোগ। মিনিমিন করে প্রস্তাব দিলো “কিন্তু ধর ওঁকে রাজি করানো গেলো, তা নবভারতে কি দোতলায় ড্রেস সার্কল বা দামী সিট নেই?”
কি করে বেতোকে বোঝাই যে নবভারতের সবথেকে সম্মানীয় ক্রাউড হলো আমাদের ফার্স্ট গেটের জোলো’দা, সাট্টার বিলেদা, আর সেকেন্ড গেটের গোপাল’দা। যাই হোক, সেদিন বেতো খুবই দুঃখ পেয়েছিলো, ওর বেদনার মূল্য কেউ দিলো না। শুধু মনে মনে গাইলো, কভি কভি মেরে দিল মে……
সিনেমা হলে গিয়ে সে আরেক বিপত্তি••• দো কা চার দো কা চার বেল্যাকে নেবেন টিকিট? হাঁটু অবধি গোটানো লুঙি পরিহিত ছ্যাতলা পড়া পাবলিক দাঁত বার করে জিজ্ঞেস করল। একে “বেল্যাকের” বেশি পয়সা তার ওপর “বেল্যাকার” এর ওই চেহারা। আমার সঙ্গীদের যাবতীয় রাগ এসে পড়ল আমার ওপর কারণ আমার বাড়ি হাওড়ায়। যেন আমি বেল্যাকারের পৃষ্ঠপোষক। এদিকে সিনেমা শুরু হয় হয়। অনেক লোক টিকিটের জন্য এদিক ওদিক ঘুরছে। দেরি না করে আমাদের যার কাছে যা ছিল তাই দিয়েই টিকিট কাটা হলো। সিনেমা হলের দেয়ালে পানের পিক। হলে ঢুকে বসার পর ছাড়পোকার কামড়। মাথার ওপর ঝিমিয়ে পড়া পাখা। এসব মিলিয়ে আরও এক প্রস্থ গালি খেলাম বন্ধুদের কাছে। যেন আমিই নবভারত হলের মালিক আর এর যাবতীয় রক্ষণাবক্ষেণের দায়িত্বও আমার।
এখানেই শেষ না। আশেপাশের দর্শকের অধিকাংশই দেখলাম সীটে পা তুলে বসেছে। ওরা সব্বাই এসেছে গুরু (অমিতাভ বচ্চন) ভিলেনকে কেমন ক্যালায় শুধু তাই দেখতে। শুধু বুঝতে পারছে না, এখানে খলনায়ক বা নায়িকা কে? শশী কাপুর? ঋষি কাপুর? ওয়াহিদা রেহমান? রাখী? নিতু সিং? সে যেই ভিলেন হোক, ফাইটিং সিন দেখলেই এঁরা সিটি বাজিয়ে দেবে।
“তোদের হাওড়ার পাবলিক গুলোই এরকম”, সকলে মিলে আমার পা টানাটানি শুরু করে দিলো। খুব প্রতিবাদী চরিত্র নয় আমার। তথাপি একটু রেগে গিয়ে বললাম, “ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে তো গঙ্গা পেরিয়ে সেই হাওড়াতেই আসতে হলো। এখন চুপ করে সিনেমা দেখ।“ সিনেমা শুরুর অনতিবিলম্বে সীটে পা তোলা পাবলিকের দল আসতে আসতে পাতলা হতে শুরু করল কারণ “কভি কভি” সিনেমায় ঝাড়পিট নেই, এদের মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া সিনেমা।
সেদিন অত্যন্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা সিনেমাটা প্রাণ ভরে উপভোগ করেছিলাম। হোক সে হাওড়ার গলির নবভারত। তখন বাতানুকূল আইনক্স বা পিভিআর ছিলো না। ছিলো না হলের মধ্যে সুগন্ধীর সুবাস। ছিলো ছারপোকার কামড়, আশেপাশের কিছু লুঙ্গি তোলা পাবলিক। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমি সেদিন আমার কলেজ জীবনের একটা সেরা সিনেমা দেখেছিলাম। আর কভি কভি যদি যশ চোপড়ার এক সুন্দর সিনেমা হয়, সেই সিনেমাকে আরেক উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন আমাদের খৈয়াম সাহেব।
পরদিন কথাটা আর চাপা থাকলো না। সিনেমার, বিশেষত গানগুলির উচ্ছসিত প্রশংসা শুনে টিংকু রাণী সকালের ক্লাসের শেষে ঠিক ধরেছে বেতোকে। বেতোর পালানোর উপায় নেই। চতুর্দিকে খোঁজ নিয়ে, সেই সপ্তাহেই বেতো ওর টিংকু রাণীকে নিয়ে ঐ কোথায় লেকটাউনের জয়া সিনেমা হলে ইভনিং শোতে কভি কভি দেখে এলো। পরদিন আমরা ধরলাম টিংকু রাণীকে। “না রে, কি দারুণ গানগুলো!” এরপরের ঘটনা গল্প নয়, একদম সত্যি। টিংকু রাণী আর বেতোর প্রিয় গান হয়ে গেলো কভি কভি মেরে দিল মে, খেয়াল আ যাতা হ্যায়। একটি কালজয়ী কবিতার কয়েকটি লাইন, আর তাঁর সাথে কালজয়ী সুরের সাক্ষী ছিলাম আমরা।
মহম্মদ যাহুর খৈয়াম হাসমি, সংক্ষেপে খৈয়াম সাহেব। আমরা যারা একটু পুরোনো দিনের হিন্দি গান পছন্দ করি তারা সকলেই এই নামের সাথে পরিচিত। খৈয়াম সাহেবের মিউজিক পরিচালনায় কালজয়ী অনেক গান আমার মনের কোণে গেঁথে আছে, সেই আমার স্কুল জীবনের সমাপ্তি থেকে কলেজ জীবনের কালে। কিছু অমলিন স্মৃতি যা কিনা ওনার সৃষ্ট বেশ কিছু গানের সাথে জড়িয়ে আছে। হিন্দী চিত্রজগতকে গজল ও ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের মাধুর্য দিয়ে তিনি সিনেমার জনপ্রিয়তাকে আরও এক উচ্চ মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলান।
উনি অনেক সাম্মানিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর দীর্ঘ চার দশকের সুরসৃষ্টির নিরিখে পেয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মবিভূষণ, সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার পুরস্কার (কভি কভি, ১৯৭৭, আর উমরাও জান, ১৯৮২)। আর ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম এচিভমেন্ট পুরস্কার। কিন্তু এই সম্মানের তালিকা দিয়ে তাঁর অবদানকে পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
সত্তরের দশকের শেষ দিকে সাহির লুধিয়ানভির কবিতার শব্দগুলি যাঁর সুরমূর্ছনায় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিল তিনি আমাদের খৈয়াম সাহেব। “কভি কভি মেরে দিল মে খয়াল আতা হ্যায়” অথবা “ম্যায় পল দো পল কা শায়ের হুঁ, পল দো পল মেরি কহানী হ্যায়” ••• “কভি কভি” ছবির গান দুটি তখন সুপার ডুপার হিট।
मैं पल दो पल का शायर हूं पल दो पल मिरी कहानी है
पल दो पल मेरी हस्ती है पल दो पल मिरी जवानी है
मुझ से पहले कितने शायर आए और आ कर चले गए
कुछ आहें भर कर लौट गए कुछ नग़्मे गा कर चले गए
वो भी इक पल का क़िस्सा थे मैं भी इक पल का क़िस्सा हूं
कल तुम से जुदा हो जाऊंगा गो आज तुम्हारा हिस्सा हूं
पल दो पल में कुछ कह पाया इतनी ही सआ’दत काफ़ी है
पल दो पल तुम ने मुझ को सुना इतनी ही इनायत काफ़ी है
कल और आएंगे नग़्मों की खिलती कलियां चुनने वाले
मुझ से बेहतर कहने वाले तुम से बेहतर सुनने वाले
हर नस्ल इक फ़स्ल है धरती की आज उगती है कल कटती है
जीवन वो महंगी मुद्रा है जो क़तरा क़तरा बटती है
सागर से उभरी लहर हूं मैं सागर में फिर खो जाऊंगा
मिट्टी की रूह का सपना हूं मिट्टी में फिर सो जाऊंगा
कल कोई मुझ को याद करे क्यूं कोई मुझ को याद करे
मसरूफ़ ज़माना मेरे लिए क्यूं वक़्त अपना बरबाद करे
বি ই কলেজের সব থেকে রসকসহীন ছেলেটিও বোধহয় রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন হয়েছে এ গানের যাদুতে। সেও হয়তো আড়ালে আবডালে গান দুটি বার কয়েক আওড়ে প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন করেছে মনে মনে।
এখানে একটা কথা আমি বলে রাখি, সুর দেওয়ার ব্যাপারে খৈয়ামজীর পছন্দ ছিলো, ইংরেজিতে বললে preferred to work with poets rather than film lyricists. এই কারনে দেখা যায় ওনার অধিকাংশ গানের কথাগুলিই লিখেছেন মির্জা গালিব, মজরু সুলতানপুরী, সাহির লুধিয়ানভি, জান নিসার আখতার, মহম্মদ ওয়ালী, আলী সর্দার জাফরী, ও নকশ ল্যায়লপুরী। সেইজন্য খৈয়ামজীর গানের কথায় কবিতার সৌন্দর্য ও সুরে গজল ও ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রভাব দেখা যায়।
১৭ বছর বয়সে পঞ্জাবের বাড়ি থেকে পালিয়ে দিল্লি এসে পন্ডিত অমরনাথে কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নেন। এরপর লাহোরে গিয়ে সংগীত পরিচালক বাবা চিস্তির সহকারী হয়ে কিছুদিন কাজ করে, তারপর লুধিয়ানা চলে আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিছুদিন ভারতীয় সৈন্যদলে কাজ করার পরে ১৯৪৮ সালে বম্বে এসে রহমান ভার্মাজির সাথে জুটি বেঁধে শর্মাজি-ভার্মাজি কোম্পানির প্রথম সিনেমা হীর রঞ্ঝায় সুরদান করেন (১৯৪৮)। দেশভাগের সময় রহমান ভার্মাজি পাকিস্তান চলে যান।
শুরুতে বানিজ্যিক সাফল্য তিনি পান নি। কারণ সেই নিজস্বতা, বানিজ্যিক সিনেমার গানে ভালো কবিতার উপর গজল বা উচ্চাঙ্গ সংগীতের বানিজ্যিক প্রভাব তখনও বাজারে অতটা আসে নি। পরবর্তীকালে খৈয়ামজীর বিভিন্ন সময়ের গানের জন্য উল্লেখযোগ্য সিনেমা গুলি ফুটপাথ (১৯৫৩), ফির সুবা হোগি (১৯৫৮), শোলা আউর শবনম (১৯৬১), শাগুন (১৯৬৪), আখরি খত (১৯৬৬)। এগুলো আমার স্কুলের সময়ের, বা তারও আগের। ১৯৭১ সালে অভিনেত্রী মীনা কুমারীর নিজস্ব এলবামেও (I Write, I Recite) সুর দিয়েছিলেন। বিই কলেজে ভর্তি হয়ে আমি প্রথমদিকে খৈয়ামজীকে পেয়েছি কভি কভি (১৯৭৬), ত্রিশুল, বাজার, দর্দ, নুড়ি, থোড়ি সি বেওফাই, খানদান, এসব সিনেমায়। এরপর এলো উমরাও জান, আর আমার ফাইন্যাল ইয়ারে রাজিয়া সুলতানা। উমরাও জান উনার আরেক অবিস্মরণীয় কীর্তি যা চিরকাল ভারতীয় সংগীত জগতের ইতিহাসের শীর্ষস্থানে থাকবে।
২০১৯ সালে ৯২ বছর বয়সে খৈয়াম সাহেব দেহ রাখেন। তাঁর কিছুদিন আগেই, নিজের ৮৯ তম জন্মদিনে নিজের সঞ্চিত সমস্ত অর্থ, প্রায় দশ কোটি, তিনি নতুন নতুন শিল্পীদের সুগোগের জন্য Khayyam Jagjeet Kaur KPG Charitable Trust এ দান করে যান।
We miss you Khayyam Saheb.
********
দারুন