সাহিত্যিকা

অতঃ কিম !

অতঃ কিম !
@অধীর দাস, ১৯৬৯ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

পাঁচ বছরে বন্ধুদের সঙ্গে অনেক হৈ হুল্লোড় আমোদ ফুর্তি; আর ডাউনিং, মুচিপাড়া সাহেবপাড়ায় কাটিয়ে কলেজ জীবনের শেষে এবার সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। এর আগে বছর ঘুরলেই একটা ফাইনাল পরীক্ষা হতো বটে। কিন্তু এবারের ফাইনাল পরীক্ষায় বসাটা কেমন যেন আলাদা।

আমাদের সেই সময়ের একটা ফটো দিলাম,
বাঁদিক থেকে মধুসূদন দাস, কুণাল বাসু, আবদুল আহাদ বুন্দ, শ্যামাল দাসগুপ্ত, বিদ্যুৎ দত্ত, দীপক ভট্টাচার্য্য। এঁদের মধ্যে মধু আর আবদুল আমাদের ছেড়ে চিরকালের জন্য না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে।

যাই হোক পরীক্ষা পরীক্ষাই। উদ্দেশ্য পাস করা, তারপর কিছুই না হলে এক বছরের সরকারি ব্যবস্থা GOI ট্রেনিং,২৫০/-। কিন্তু সেই এক বছরও যখন শেষ হতে চলেছে, তখন দেখছি কঠিন বাস্তব। তখনও ভাবছি GOI ট্রেনিং এর পর কিছুই না হলে এম ই করব (মাস্টার ডিগ্রী), ২৫০/- দু বছরের জন্য। তার পরে পিএইচডি করা, ৪০০/-করে আর দু-চার বছর পাকা। বাকিটা পরে ভাবা যাবে!

যাদবপুরে ভর্তি হব ঠিক করেছি। কিন্তু সেখানে উগ্র রাজনীতি দানা বাঁধছে। যাদবপুর সব বিপ্লবের আতুঁর ঘর, আতঙ্ক বিশৃঙ্খলা প্রসবে অগ্রণী ভূমিকায়। কিছুই ঠিকঠাক চলছে না। অগত্যা কানপুর দিল্লী মুম্বাই আই আই টিতে সব জায়গায় এপ্লাই করলাম। কানপুর থেকে প্রথম ডাক পেয়ে একান্ত অনিচ্ছা ও মনঃকষ্ট (প্রথম বাড়ির বাইরে, কোলকাতার বাইরে যেতে হবে?) নিয়ে চলে গেলাম।

বন্ধু ফাল্গুনী (প্রয়াত ডঃ ফাল্গুনী ভট্টাচার্য) সয়েল মেকানিক্স নিয়ে যাদবপুরে ভর্তি হয়েছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে কানপুর ছেড়ে কোলকাতা চলে এলাম। পরের দিন HOD ডঃ সোম এর সঙ্গে দেখা করে আমার অভিযোগ (আমি কোন চিঠি পাইনি) ও অনুরোধ (আমি কানপুর আই আই টি ছেড়ে চলে এসেছি) ইত্যাদি জানাতে উনি আমার বায়োডাটা নিয়ে জানালেন, কিছু সম্ভব হলে জানাবেন। কিছুদিন বাদেই স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়ে গেলাম। নকশাল আন্দোলন তখন চরমে। ভয়, অরাজকতা, বোমা বন্দুক গুলিবাজি, কোনদিন ক্লাস হয় তো কোনোদিন হয় না। পরিতাপ হচ্ছে, কানপুর থেকে কেন চলে এলাম! অবশেষে ১৫ মাস বাদে প্রথম বছরের থিওরিটিক্যাল সাবজেক্টগুলোর কোর্স শেষ হলো। এক মাসের মধ্যে ফাইনাল পরীক্ষাও হয়ে গেল। এবারে শুধু আর একটি বছর প্রাকটিক্যাল, থিসিস সাবমিশন বাকি। বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন ইমিগ্রেশন নিয়ে আমেরিকায় চলে গেল।

একদিন ডালহৌসি পাড়ায় এক সিনিয়র দাদার সঙ্গে দেখা হলে খুলেই বললাম- GOI ট্রেনিং শেষ করে যাদবপুরে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পিজি করছি। শেষ কবে হবে জানিনা। দাদা বলল সরকারি চাকুরীর জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে যাও, আর বেসরকারি অফিসে গিয়ে গিয়ে দেখতে হবে! সরকারি চাকুরির কোন বিজ্ঞাপন তখনও অব্দি দেখতে পাইনি। কিন্তু কোন কোন প্রাইভেট কম্পানী আছে যেখানে চেষ্টা করতে পারি? উনি আমার অসহায় ভাব দেখে বললেন, ডালহাউসিতে আছে গ্যমন্স ইন্ডিয়া, ম্যাকিন্টোস বার্ন অফিস। গ্যামন্স অফিসে গিয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে দেখা করলাম। শুনেছিলাম উনি বি ই কলেজ থেকেই পাশ করা। আমাকে জানালেন যে সম্প্রতি নেপালের একটা প্রজেক্টে আমরা কজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়েছি। দরকার হলে আমাকে ডাকবেন।

ম্যাকিন্টোস বার্ন অফিসে গিয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে দেখা করলাম। কথাবার্তায় বুঝলাম উনিও বিই কলেজের প্রাক্তনী। আমাকে জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে বললেন। অল্প কিছু কথাবার্তার পর জিএম আবার চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আমি জানালাম চিফ ইঞ্জিনিয়ারই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। আচ্ছা, ঠিক আছে কিছু সম্ভব হলে তোমাকে ডেকে পাঠাব। পরে জেনেছিলাম জেনারেল ম্যানেজারও আমাদেরই কলেজের প্রাক্তনী।

ইতিমধ্যে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ গোপাল সেনকে কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যেই হত্যা করা হয়েছে। আমরা তখন কলেজের ভেতরে, ঘটনাস্থলে যেতে পারছিনা, গেটের বাইরেও যেতে পারছি না! কিছুদিন আর কলেজমুখো হলাম না। ডালহাউসি পাড়ায় ঘোরাঘুরি করছি। অনেকদিন ম্যাকিন্টোস বার্ন থেকে খবর নেই, যাই দেখা করে আসি। এবারে সোজা জি এমের কেবিনে। বেশকিছু কথাবার্তা হলো, শেষে প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাস বলবো না, দেখা যাক কিছু করতে পারলে অবশ্যই জানাব বলে আলোচনার ইতি টানলেন।

ঘোর অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে, এমন সময় ম্যাকিন্টোস বার্ন কোম্পানি থেকে একটা চিঠি পেলাম। পড়ে চোখের কোনে একটু জল গড়িয়ে এল! ওরা আমাকে নেবে, ওদের কনসালটেন্সি ডিভিশনে। এটা একটা পুরোদস্তুর এপয়মেন্ট লেটার! আমার প্রথম চাকুরী!
গিলানডার হাউসের ডিজাইন/ড্রইং অফিসে যোগ দিলাম। বিশাল হলঘরের পেছনের দিকে একটু উঁচুতে কিছু বড় বড় ড্রইংবোর্ড ছিল যেমনটি কলেজে দেখেছি। ওখানে খুবই পরিচিত দুজনাকে পেয়ে গেলাম। দুজনই আর্কিটেক্ট। একজন আমার ব্যাচের প্রসাদ রঞ্জন ওরফে বালু, গিটারিস্ট সংগীতজ্ঞ সুলেখক; আর অন্যজন আমাদের দাদা অশোক মুখার্জী ওরফে দৈত্য, সুবিশাল সৌম্য সুন্দর কান্তি, নৃত্যশিল্পী। কাজে কর্মে চিফ ইঞ্জিনিয়ারকেই রিপোর্ট করছি। পুরো যেন কলেজ বাতাবরণ।

পাঁচটা বাজলেই অফিস থেকে যাদবপুর গিয়ে গাইড প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করে সোজা ওয়ার্কশপে। টেকনিসিয়ানরা খুবই সহায়তা করতেন। ওনারা রাত ৭/৮ অব্দি থাকতেন, জানতেন যে নকশালী গন্ডগোলের কারণে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখানে বলে রাখি, যাদবপুরে যে এম ই করছি এ কথা অফিসের আবেদনপত্রে উল্লেখ করিনি, ভয় ছিল যদি আমার মধ্যে নকশালগন্ধ আশঙ্কা করেন!। এই “চেপে রাখার” বুদ্ধিটা কানপুর আই আই টি থেকেই উপলব্ধ হয়েছিল। তখন ওদের বদ্ধ ধারণা কোলকাতা থেকে আসছে, তবে তো জরুর নকশাল– ‘পুরা নেহি, কুছ তো হোগা আধা পৌনা!’

ম্যাকিন্টোস বার্ন ব্রিটিশ আমলের নামজাদা বড় ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। কলকাতার অনেক বিখ্যাত বেসরকারি / সরকারি বাড়ি / প্রতিষ্ঠান বানিয়েছে। রাইটার্স বিল্ডিং (পার্ট), ভিক্টোরিয়া হাউস, স্টেটসম্যান হাউস, গ্র্যান্ড হোটেল, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, জিপিও, দক্ষিণেশ্বর কালিবাড়ি, বিভিন্ন জমিদার বাড়ি, অনেক কিছু। আমার একবার সুযোগ হয়েছিল কোম্পানির আর্কাইভে গিয়ে কিছু ড্রইং দেখা। সেদিন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কনস্ট্রাকশন ড্রইংস দেখেছিলাম। কিছুদিন আগেও ইউরোপিয়ান সাহেবরাই ম্যাকিন্টোস বার্ণের সর্বোপরি কর্তা ছিল। ওদের হাতে সদ্য এবং শেষ যে নাম করা বাড়ি তৈরি হয়েছিল-রিজার্ভ ব্যাংক বিল্ডিং, ভারতে প্রথম এস্ক্যালেটর বসান (১৯৬৫-৭০)।

এক বছর প্রায় হবে। কোম্পানির কনস্ট্রাকশন ডিভিশনে মাঝেমাঝেই গোলমালের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কোম্পানির হাতে নতুন বড় কোন কাজ নেই, তাই ধাপে ধাপে কর্মী ছাটাই চলছে। খবর আসছে কর্মী অসন্তোষের। সরকার, ইউনিয়ন, কোম্পানির মধ্যে ঘন ঘন আলোচনা হচ্ছে। তখনের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জী ঘোষণা করলেন, সরকার ম্যাকিন্টোস বার্ন কম্পানি টেকওভার করবে। জন্ম নিল বাংলার ইতিহাসে প্রথম আধা সরকারি সংস্থা, ম্যাকিন্টোস বার্ন এন্ড কম্পানি, গভর্নমেন্ট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল। রাজ্য সরকারের মালিকানায় ম্যাকিন্টোস বার্নই প্রথম সংস্থা।

একদিন চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমাকে বললেন জিএম এর সঙ্গে দেখা করে হবে। জিএম আমায় জানালেন, আমরা এখন শুধুই কনস্ট্রাকশনের কাজ করব, আমাদের কনসালটেন্সি ডিভিশন আর থাকবে না। অনেককেই কাজ ছেড়ে দিতে হবে। আমরা চাইছি না তোমাকে চিঠি দিয়ে ছাড়িয়ে দিতে। চাইছি তুমি নিজে থেকে রেসিগনেশন দাও। আমরা এক মাসের এডভান্স মাইনে দিয়ে সেটেল করে নেব। জানতাম যে কোম্পানির এখন খারাপ সময়, কিন্তু এমনটির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। জি এম সাহেবের নির্দেশ মত চিঠি দিলাম, আর উনি আগে থেকেই তৈরি করা কোম্পানির একসেপ্টানস লেটার ধরিয়ে দিলেন। চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সাথে দেখা করে, বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে একটা কথা মনে এলো, -‘জীবনের প্রথম চাকুরিতে শুরুতেই স্বেচ্ছা অবসর’

অতঃ কিম !
যাদবপুরে দুবছরের কোর্স, এখনই দুবছর পাঁচ মাস হয়ে গেছে। তখন বম্বে আইআইটি বিজ্ঞাপন দিয়েছে, সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক্যাল-এ পিএইচডি-র জন্য। গেলাম, ২ ঘন্টার পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে জানালো ২ ঘন্টার ব্রেক, তারপর রেজাল্ট জানাবে। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্য ৩০ জন পরীক্ষা দিয়েছিল, ১০ জনকে ইন্টারভিউতে ডাকবে, ৪ জন নেবে। লিস্টে আমার নাম দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম। এবারে ইন্টারভিউ। ফাইনাল ৪ জনার মধ্যে আমার নাম থাকবে এটা সম্পূর্ন বোকামি, যাদবপুরে থিসিস এখনও সাবমিটই করা হয়নি। সাবমিট হলে রয়েছে ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল ভাইবা। আইআইটি ক্যান্টিনে টিফিন সেরে ইন্টারভিউ দিলাম। ১০ জনার ইন্টারভিউ এর শেষে ১৫ মিনিটের মধ্যেই লিস্ট বের করে দিল। আমার খুশি ভাষায় ব্যক্ত করা যাবেনা। পিজি করা হলো না, কিন্তু পিএইচডি তে চান্স এসে গেল! সপ্তাহ তিনেকের মাথায় চিঠি এলো, এক মাসের মধ্যে ভর্তি হতে হবে। তখন কত মাসে আমার পিজি কোর্স শেষ হবে তা অনুমান করাও দুঃসাধ্য। আমি ওদেরকে একটা চিঠি দিলাম, আমাকে আরো ৩ মাস সময় দেয়া হোক। নকশালী আন্দোলনের কারনে আমার ভাইভা ইনকমপ্লিট রয়েছে। জবাবে ওরা জানিয়েছিল- তিন মাস নয় এক মাস এক্সটেন্ড করা হল।

এদিকে তখন কয়েকমাস ধরেই কাগজে সরকারি চাকুরীর বিজ্ঞাপন আসছে। প্রথমে হাওড়া ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট। ইন্টারভিউ হলো, চাকরী পেয়ে এসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হয়ে রিপোর্ট করছি এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী অমল মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ইনিও কলেজের দাদা। কলেজের বেশ কিছু দাদাও সেখানে কাজ করছেন। আমরা চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে রিপোর্ট করতাম, তিনিও বি ই কলেজের। সবাই ব্যানার্জি’দা বলেই ডাকতেন। স্কলার ব্যক্তি, ওনাদের ব্যাচে প্রথম হয়েছিলেন। সেই প্রথম গেজেটেড অফিসার হলাম, লোকেরা আমার কাছে সার্টিফিকেট এটেস্ট করতে আসবে! অফিসের কাজের জন্য স্বতন্ত্র জীপগাড়ি রয়েছে, আর কি চাই।

দুএক মাসের মধ্যে আরো কয়েকটা চাকুরীর বিজ্ঞাপন এলো। ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট, সিইডিবি (ডিজাইন ব্যুরো অফ স্টিল প্লান্ট), সিএমডিএ, ইন্ডিয়ান অয়েল, … হঠাৎই যেন চাকুরীর বন্যা। সবেতেই এপ্লাই করেছি। আমার স্ট্রাইক রেট খারাপ ছিলো না। ইন্ডিয়ান অয়েলের ডাক পেয়ে বম্বে ছুটলাম। ইন্টারভিউ শেষ করে পরের দিন কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

ইন্ডিয়ান অয়েল থেকেও এপয়েন্টমেন্ট লেটার এসে গেল। কলকাতায় হেড কোয়ার্টার, শেক্সপিয়ার সরণিতে জয়েন করতে হবে। কোম্পানির বিষয়ে কিছুই জানতাম না, ওদের বম্বে অফিস দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। হাওড়া ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ছেড়ে ইন্ডিয়ান অয়েলে জয়েন করলাম। বড়দা (বিই কলেজ, ১৯৪৯) তখন পি ডব্লু ডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার, ওনাকে খবরটা দিতেই প্রশ্ন করলেন – সেটা আবার কী অফিস? আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারলাম না। বুঝলাম দাদা তেমন খুশি নন। বললাম কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা, মাইনে ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ভাল, কলকাতায় পোস্টিং। এখানে বাঙালী, বিই কলেজের দাদা ইত্যাদির পরিবেশ নেই। কসমোপলিটান অফিস। কিছুদিন পর মৌরিগ্রাম টার্মিনালে পোস্টিং হল মূলত টার্মিনাল ফেসিলিটিস, অপারেশন ইত্যাদি জানার জন্য। টার্মিনালের ফেসিলিটিস বলতে অনেকগুলো বড় বড় সাইজের অয়েল স্টোরেজ ট্যাংক, আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপে তেল আসে। সকাল ৮:০০ থেকে একের পর এক ট্যাংকার আসছে, তেল ভর্তি করে চলে যাচ্ছে। অফিসারদের কাজ সব অপারেশন ঠিক মত হচ্ছে কিনা দেখার।

একদিন টার্মিনাল ম্যানেজারের সঙ্গে কাজের ব্যাপারে ওর কেবিনে যাই। শুনেছিলাম উনি আমাদের কলেজের (বিই ৬৪), ঘরে কেউ নেই দেখে আমি ঘোষ’দা বলেই সম্বোধন করি! তখনও আমার স্বভাব, বাঙালি হলে বাংলায় কথা বলা, আর বিই কলেজের হলে সোজা দাদা বলে সম্বোধন করা। আন্তরিকতা দিয়ে কথা বলা আমার অভ্যাস। স্যার সম্বোধন না করা, বসতে না বলা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা এসবে অভ্যস্ত হয়নি। উনি একটু গম্ভীর স্বরে বললেন, কি ব্যাপার? দু চারটে দরকারি কথা যা বলার ছিল বলে চলে এলাম। বুঝলাম আমার আন্তরিকতা দিয়ে দাদা বলা এবং স্যার বলে সম্বোধন না করাটা ওনার পছন্দ হয়নি। একটু মনক্ষুণ্ণ হলাম। আগে এরকম অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। ভাবলাম ওনার মধ্যে তেল কম্পানির সাহেবের গন্ধ রয়েছে। আরেকদিন উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়ে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, টেকনিক্যাল আইটেমসের স্টক অডিট করতে হবে অর্থাৎ গতবছরের স্টক আর এবছরের স্টক কত, ব্যতিক্রম এবং কেন তা লিখতে হবে। (৩১ তারিখের মধ্যে)।

চিঠি হাতে নিয়ে আমিও বেরিয়ে এলাম। অনেক আইটেমের ডিটেলস নোট করা হলো, মুস্কিল বাঁধল বেশ কিছু স্টিল প্লেট বড় বড় সাইজের ৫/৬/৮/১০ মিলিমিটার থিক যা দিয়ে স্টোরেজ ট্যাংক বানানো হয়, তা নিয়ে। সেগুলোও বিভিন্ন যায়গায় একসঙ্গে অনেকগুলো অনেকদিন ধরে অব্যবহৃত স্ট্যাক করা। কিছু যায়গায় সেগুলো ঘাসে প্রায় ঢেকে গেছে। প্লেটগুলো এক একটা বের করে দেখতে হবে, তার সাইজ ও থিকনেস মাপতে হবে, প্রচুর লেবার আর সময়ের প্রয়োজন। গেলাম ম্যানেজারের ঘরে। কয়েকজন অফিসার বেষ্টিত হয়ে চা হাসিগল্প চলছিল। আমি ওনার কাছে গিয়ে জানালাম স্টিল প্লেট ভেরিফাই করতে কিছু লোক এবং লেবার চাই। উনি বলে উঠলেন, এর কি দরকার? স্টিল প্লেট গুলো বহু বছর ধরে পরে আছে, ব্যবহার হয়নি। গতবার যা ছিল তাই লিখে সই করে দিন। কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে মনে মনে ঠিক করলাম– এটা অনৈতিক, গতবার যে কোয়ান্টিটি লেখা সেটা ঠিক ছিল তার কি প্রমান? কিছু করলাম না। চুপ চাপ বসে গেলাম। ৩১ এ আমার ডাক পড়ল–বললেন রিপোর্ট পাঠাননি কেন? বললাম যে চেক না করে কিছু লিখব না, সই করব না তাই। ওনার মুখ লাল হয়ে গেল বুঝতে পারলাম। বললেন ঠিক আছে পেপারটা রেখে যান। পেপার ওর টেবিলে রেখে চলে এলাম। (বাঙালি, কলেজ, সিনিয়ার দাদাদের প্রতি অযাচিত ভালোবাসা কোথায় যেন একটু ধাক্কা খেল )। এখন থেকে পুরো টান টান সম্পর্ক, এ অবস্থায় কাজ করা আমার পক্ষে কস্টকর মনে হল। চিন্তা করছি!

অতঃ কিম !
একদিন উনি পিওনের হাত দিয়ে আমাকে একটা চিঠি পাঠালেন! তড়িৎ বেগে মনে এলো, বিপরীত কিছু থাকলে এক্ষুনি রিজাইন করব। মনে এল বড়দার কমেন্ট ‘এটা আবার কী কোম্পানি’। আবার ছোড়দা, (বাড়িতে একমাত্র নন ইনজিয়ার, কলেজে ফিজিক্স পড়ান) একটা ফিলজফিক্যাল কথা বলেছিলেন -”কি করছিস! এক জায়গায় স্থিতি হতে হয়! বলে না, রোলিং স্টোন গ্যাদার নো মস!!’ এই রকম আরো বেশ কিচু। মনটা নাড়া দিয়ে উঠল। কিছু একটা এবারে করতে হবে!

চিঠি পড়ে দেখলাম কলকাতা অফিসের ডিজিএম (ইঞ্জিনিয়ারিং) আমাকে ওনার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। ভেবেছিলাম মিঃ ঘোষ হয়ত আমার বিপরীতে কিছু রিপোর্ট করেছেন। মা ভৈ বলে ডিজিএমের সাথে দেখা করলাম। উনি জানালেন হলদিয়া রিফাইনারী সংলগ্ন ২০ একর জমিতে আমাদের মার্কেটিং টার্মিনাল হবে। চ্যালেঞ্জিং জব। আমি হবো প্রজেক্ট ইনচার্জ, আমার সঙ্গে গাড়ি, কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার ও স্টাফ থাকবে। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। চাকুরী ছাড়ার ভাবনা শিকেয় তোলা রইল। হলদিয়া চলে গেলাম, তিন বছর বাদে প্রজেক্টের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হলে কলকাতা অফিসে ফিরে এলাম।

এর পর থেকে মাথা উঁচু করে স্বভাবচিত আন্তরিকতা ও স্বাধীন ভাবে কাজ করে যাবার সুযোগ অব্যাহত ছিল এবং আমি তা সদব্যবহার করে যেতে পেরেছিলাম।

*******

Sahityika Admin

2 comments

  • তোমরা নানা কাজের ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও লেখালেখি প্রকাশনা ইত্যাদি কাজে সময় দিতে পার। সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা থাকলেই এমন সুন্দর “সাহিত্যিকা”র মুখদর্শন সম্ভব। খুব ভাল হয়েছে এড্ডিটিং।
    পুস্তককারে পেলে এবং সময় নিয়ে articles গুলো পড়তে পারলে ভাল হত।

  • অধীর দাসের লেখাটি পড়ে নিজের কথা মনে পড়লো। বাংলার সেই রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম। আমার কাকার কথামত পুণে চলে আসি আর এখানেই থেকে গেলাম। এখন আমার কোনো আক্ষেপ নেই, বরং মনে হয় রাজনৈতিক খুন খারাপি আর ধান্দাবাজি নোংরামির বাইরে এসে ভালোই করেছি।