সাহিত্যিকা

ইতিহাস যেখানে নীরব (ধারাবাহিক দ্বিতীয় পর্ব)

ইতিহাস যেখানে নীরব (ধারাবাহিক দ্বিতীয় পর্ব)
@দেবাশীষ তেওয়ারী, ১৯৬৯ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

প্রথম পর্বের লিংক
https://sahityika.in/2025/05/28/%e0%a6%87%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8-%e0%a6%af%e0%a7%87%e0%a6%96%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%87-%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%b0%e0%a6%ac/

সেই মহাভারতের সময় থেকেই ত্রিগর্ত রাজ্যটি এক ছোট্ট জনপদ হওয়া সত্ত্বেও নির্বিঘ্নে শান্তিতে আছে। শান্তি বজায় রাখতে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয়নি, বিরাট কিছু সৈন্যসামন্তেরও দরকার পড়েনি। শুধু নিকতবর্তী কোন এক শক্তিশালী রাজার সঙ্গে সখ্যতা, আত্মীয়তা বা খুব বেশী হলে বশ্যতা স্বীকার করেই তারা তাদের রাজ্য সীমানা অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছে। অন্য কোন রাজ্য ত্রিগর্তের দিকে নজর দিলে বন্ধুরাজ্যই তাদের রক্ষা করেছে।

এখন ত্রিগর্তরাজ বুধাজিতের সখ্যতা শকরাজা রুদ্রসিংহের সাথে। শুধু সখ্যতা নয়, একে আত্মীয়তার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার সঙ্গে নিজের মেয়ে সুতনুকার বিয়েও সে ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু এরই মধ্যে সেদিন মূর্তিমান আপদের মত রামগুপ্তের দূত এসে হাজির হলো মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। যেমন কিম্ভূত সেই দূতের চেহারা, তেমনি তার কথাবার্তা। বুধাজিৎ তো তাকে যাহোক বুঝিয়ে ফিরিয়ে দিলো, কিন্তু সাথে সাথে রুদ্রসিংহকেও ঘটনাটা বিস্তারিত জানিয়ে দিল। রুদ্রসিংহ জানতো যে মগধ এই প্রত্যাখ্যান সহজে মেনে নেবে না, সে অগ্রবর্তী ঘাঁটির সেনানায়ক নাহাপণকে নির্দেশ দিল নজরদারি বাড়াতে। ঠিক হল বিয়েটাও তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে। আর পার্বতীপুরে বুধাজিৎকেও সন্দেশ পাঠাল, ‘রাজকন্যা শুনেছি নগরীমধ্যে প্রায়শঃ ভ্রমণ করেন। নিরাপত্তার খাতিরে এটা বন্ধ হওয়া দরকার।’
সুতনুকার বাইরে বেরানো বন্ধ হয়ে গেল।

যাকে নিয়ে এত কাণ্ড, এবার সেই রাজকন্যার দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। কন্যা সার্থকনামা। কবি কালিদাস তখন সবে লেখা সুরু করেছেন, আর কিছুদিন পরে হয়তো এঁকে দেখেই তাঁর কলম থেকে বেরোবে সেই কালজয়ী দুটি ছত্র,
তন্বী শ্যামা শিখরদশনা পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী
মধ্যে ক্ষামা চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা নিম্ননাভিঃ
বাকী অংশের সঙ্গে অবশ্য সুতনুকার তেমন মিল নেই। সে শ্রোণীভারে অলসগমনা নয়, স্তোকনম্রাও নয়,হয়তো আরও বয়স হলে হবে। আপাততঃ তাঁর চেহারা চাবুকের মত, পনেরো বছরের এই রাজকুমারীকে চোদ্দ বছরের রাজকুমার বলে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায়, অস্ত্রে ও শস্ত্রে, অশ্ব চালনায় সমান পটু। সারা রাজ্যে সে ইচ্ছামত ঘুরে বেড়ায়, প্রজারা তাকে খুব ভালবাসে, সেও কোন গরীব প্রজার কষ্ট দেখলে কাতর হয়ে পড়ে, যতক্ষণ না সেই কষ্ট দূর করতে পারছে, সে স্থির থাকতে পারে না। প্রজাদের নানান সমস্যা নিয়ে এই আদুরে, জেদী কন্যাটি রাজাকে প্রায়শই বিব্রত করে।

কিন্তু কদিন হল, হঠাৎ তাকে কিছু না বলেই তার বাইরে বেরানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে প্রথমে তার খুব রাগ হলো, তবে অবাক হল তার চেয়েও বেশী! কি ব্যাপার, এরকম তো আগে কখনও হয় নি! পিতাকে জিজ্ঞেস করেও সঠিক কোন উত্তর পেলো না। তিনি বললেন, ‘দিনকাল খারাপ, চারিদিকে দস্যুদের উৎপাত, তাই কিছুদিন প্রাসাদের বাইরে না যাওয়ায় ভাল।’
মেয়ে বলাবাহুল্য, মোটেই খুশী হলনা এই উত্তরে।

অবশেষে মা প্রভাবতী দেবীর কাছে দরবার করে সুতনুকা আসল কারণটি জানতে পারলো। তার বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে। বিরাট বীর, মহামহিম, মহাক্ষত্রপ, মহারাজাধিরাজ, শক কুলতিলক, শক সম্রাট রুদ্রসিংহ, যার ভয়ে দক্ষিণে সাগর থেকে উত্তরে নগাধিরাজ হিমালয় পর্যন্ত থরহরি কম্পমান, তিনি নাকি নিজে তাকে বিয়ে করবেন বলে প্রস্তাব দিয়েছেন। এর চেয়ে আর বড় কি সৌভাগ্য হতে পারে। এই সামনের আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়াতে বিয়ের দিন। আর মাত্রই কয়েক মাস, এখন আর বাইরে বেরানো ঠিক দেখায় না, তাই এই নিষেধাজ্ঞা।

রুদ্রসিংহ? হায় কপাল, শেষে তাঁর জন্য এরকম বর জুটলো! একে তো বাবার বয়সী লোক, তার ওপর তেমনি চেহারা। এক বিশাল নাক, কোলা ব্যাঙের মত মুখের অর্ধেক জুড়ে আছে, লাল চোখ সব সময় ঘুরছে আর কটমট করে চাইছে এদিক ওদিক, কি বিচ্ছিরি চোখের চাউনি, মেয়েদের সহজাত ক্ষমতাবলে সে জানে যে এরকম লোক কখনোই ভাল হয় না, ভাল হতে পারে না। সুতনুকা প্রচণ্ড আপত্তি জানাল, মাকে ধরে পড়ল এ বিয়ে সে করবে না, এটা যেমন করে হোক বন্ধ করতেই হবে। বেচারা মহারানী, তিনি যে রাষ্ট্রনীতির দাবা খেলায় কত অসহায় সেকথা এক বাচ্চা মেয়ে জানবে কি করে? তিনি আড়ালে কাঁদলেন, কিন্তু সামনে মেয়েকে প্রবোধ দিলেন, ‘তোর কি সৌভাগ্য, এমন স্বামী পেতে চলেছিস। রুদ্রসিংহ মহাবীর, সারা পশ্চিম ভারত তার পায়ে নতজানু। তুই বিশাল সম্রাজ্ঞী হতে চলেছিস। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হয় বটে, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু মানিয়ে নে মা।’

মেয়ে বুঝে নিল যা বোঝার। সে রাজনীতির যূপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত, পিতার স্নেহ, মায়ের ভালবাসা এখানে তাকে বাঁচাতে পারবে না, বাঁচাতে আসবেও না, যা করতে হবে তাকে নিজেকেই। কিন্তু সে করবেটাই বা কি? এই প্রথম তার নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো। এক রোষকষায়িত ঘূর্ণিতলোচণ দানব যে তার সর্বস্ব হরণ করে নিতে চলেছে। তার হাত থেকে কে তাকে পরিত্রাণ করবে?

তাঁর মনে পড়ল এমনি এক অসহায় নারীর কথা। মহাভারতের় দ্রৌপদীকে রক্ষা করেছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু তিনি ছিলেন দ্রৌপদীর সখা। হায়, তাকে কে রক্ষা করবে? সে তো কৃষ্ণর সখা নয়, এক সামান্যা ভক্ত মাত্র। সে শুনেছে কায়মনে ডাকলে ভগবান নাকি সাড়া দেন, আসন্ন বিপদাশঙ্কায় কাতর রাজকন্যা আকুল হয়ে ডাকতে লাগল সেই মুরলীধারী শ্যামকে, চোখ দিয়ে নেমে এল বারিধারা।

রাত্রির তৃতীয় যাম। সুতনুকা তখন স্বপ্ন দেখছিল। যেন তার ডাকে সাড়া দিয়ে স্বয়ং এসেছেন সেই বংশীধারী শ্যাম। যেন বলছেন, ‘সুতনুকা, আমি এসেছি। ব্যাকুল হয়ে যে আমায় ডাকে আমি তো তার কাছেই যাই। তোমার কি হয়েছে, মন খুলে আমায় বল সখী, তোমার সব আশঙ্কা, সব বিপদ আমি দূর করে দেব। রাজকুমারী, রাজকুমারী।’
‘রাজপুত্র এসেছ? আমি তোমায় কতক্ষণ ধরে ডাকছি।’
আনন্দে, অভিমানে সেই স্বপ্নের মধ্যও সুতনুকার দুচোখ ভরে জল এল।

‘- – – রাজকুমারী, রাজকুমারী।’ যেন কোন দূর থেকে আওয়াজ আসছে, স্বপ্ন আর বাস্তব যেখানে মিলেমিশে আছে। সুতনুকা ধীরে ধীরে চোখ মেলল। এ কি মায়া, সে কি এখনও স্বপ্ন দেখছে? তার ওপর যে ঝুঁকে আছে স্বপ্নে দেখা সেই কিশোর। সে চোখ বুজল। এটা কি সত্যিই স্বপ্ন? আবার চোখ খুলতে সে দেখতে পেল তার ওপর ঝুঁকে পড়ে সেই রাজপুত্র বলছে, ‘রাজকুমারী, রাজকুমারী, ভয় পেয়োনা। আমি এসেছি তোমায় উদ্ধার করতে। তোমায় নিয়ে যেতে।’ কি মৃদু অথচ গভীর আওয়াজ, কি মায়াময় চোখ। স্বপ্ন? হোক স্বপ্ন, এই স্বপ্ন যেন কখনও না ভাঙ্গে।

সুতনুকা আবার চোখ বুজল। কে যেন তাকে শক্ত হাতে কোলে তুলে নিয়েছে। দৃঢ়, কিন্তু পেলব কঠিন, তার ব্যথা লাগছে না মোটেই। কখন যে তারা প্রাকার পার হয়ে গেল। এবার তারা পরিখা পার হচ্ছে। আচ্ছা, তাকে কি জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? তার কি চিৎকার করে রক্ষীদের ডাকা উচিত?
সুতনুকা আর একবার চোখ খুলল, অন্ধকারে দৃষ্টি চলে না। দূর থেকে নগর প্রাকারের ক্ষীণ আলো আসছে। এ যে সেই স্বপ্নে দেখা রাজার কুমার, কি মমতায় তাকে দুহাতে ধরে রেখেছে। পরম আবেশে সে চোখ বুজল।

(ক্রমশ)

******

Sahityika Admin

Add comment