সাহিত্যিকা

বয়েজ ডোন্ট ক্রাই

বয়েজ ডোন্ট ক্রাই
@শক্তিব্রত ভট্টাচার্য্য, ১৯৮৯ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

বাবা খুব কঠিন স্বরে বলেছিল,দুটো অপশন! হয় দার্জিলিং নয় মিশন। মা চুপ করে ছিল, যেমন চুপ করে থাকে সাধারণত। আজ শুধু একবার বলেছিল, কি দরকার ছিল? বাবার একদমই পছন্দ হয়নি কথাটা।
আমি যদিও কলকাতার এক নামকরা স্কুলেই পড়ি,পড়াশুনোতে মোটামুটি ভালই তবু বাবার পছন্দ হয় না!
– ভেতো বাঙালী হলে চলবে না! সেল্ফ মেড ম্যন হতে হবে!
আবার বাবা যে অন্যদের থেকে আলাদা সেটাও আমি বুঝি। বাবা নিজে গাড়ি চালায়, রোববার সকাল বেলা গল্ফ খেলতে যায়, দুপুরবেলা পার্ক স্ট্রীটে লাঞ্চ করতে নিয়ে যায়, আবার কখনো বা বাবার বন্ধুদের সাথে ক্লাবে!

এসব অনেকদিন আগের কথা, আমার ছোটবেলার কথা। আমি অনিন্দ্য, আমার বয়স এখন পয়তাল্লিশ। আমাদের ছোটবেলায় লোকজন আজকের মতন আমেরিকায় ডেলি প্যসেঞ্জারি করত না। আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার, অনেকদিন জার্মানিতে থেকে ভারতে ফিরেছে। এখনও বছর দু বছরে বিদেশে যেতে হয়!

আমার ঠাকমা দাদু দেশের বাড়িতে থাকে।দেশ মানে হাবড়া।
মা খবর পাঠালো, বাবার জেদের কথা জানিয়ে। এক শুক্কুরবার রাতে দাদু ঠাকুমা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত। বাবার বলা আছে যে আগে থেকে বললে স্টেশনে গাড়ি পাঠাবে কিন্তু ঠাকুমা দাদু মানবে না। সেই বাসে করেই আসবে।

রাতে খাবার টেবলে দাদুই কথাটা তুলল, অনিকে হোস্টেলে পাঠানোর কি দরকার?
বাবার মুখ গম্ভীর, শুধু পড়াশুনো শিখলেই হবে না, আজকালকার দিনে একজন কমপ্লিট মানুষ হতে হবে!
– তুমি তো গ্রামের স্কুলেই পড়েছ, তাতে তুমি কি মানুষ হও নি?
– আজকাল দিন অন্যরকম বাবা! আমি যদি প্রপার এডুকেশন পেতাম —
দাদুর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। প্রপার এডুকেশন মানে কি? আমাদের গ্রামের স্কুলের অনেক ছেলেপুলেরাই তো গণ্যমাণ্য মানুষজন হয়েছে!
– গণ্যমান্য মানে কি বাবা? ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিংবা স্রেফ কলেজের মাস্টার? ভেতো বাঙালী, জীবনে উন্নতি করার কোন স্পৃহা তো এঁদের মধ্যে দেখিনা!

দাদু চুপ করে যান।
– আমার ছেলেকে আমার মত মানুষ করতে দাও। তোমার মত গ্রামের স্কুলের মাস্টারদের কাছে জীবনে এচিভমেন্ট কি, তা বোঝা সম্ভব নয়।
শনিবার সকালে দাদু ঠাকুমা চলে গেল। মা অনেক করে দুটো দিন থাকতে বললেও রাজি হল না।

(২)
পুজো হয়ে গেল। ভাইফোঁটা কাটতে না কাটতেই পরীক্ষা।
ডিসেম্বর মাসে রেজাল্ট বের হল।
২রা জানুয়ারি মিশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
পয়লা জানুয়ারি সারা রাত ধরে কান্নাকাটি করেছিলাম।
বাবা এসে জোর করে বসিয়ে দিল।’ অনি,ইউ আর এ বয়! বয়েস ডোন্ট ক্রাই! কিপ ইট ইন ইওর মাইন্ড!’

ক্লাস টুয়েলভ দিয়ে যেদিন বের হলাম, তিন মাস বাড়িতে একা একা কাটাতে হল। কারণ মা বাপের বাড়ি সিউড়িতে চলে গেছে!
বাবা অফিসের জন্য বের হয়ে গেলে আমি যেতাম গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে। সেখানেই প্রিয়াংকার সাথে আমার আলাপ। ও জি আর ই দেবে, তারপর গ্র‍্যজুয়েশনের পর ইউ এস এ তে যাবে। ওর বাবা জামশেদপুরে থাকেন, মা সাউথ ইন্ডিয়ায়! ওর স্কুলিং কলকাতায় বলে ও কলকাতায় থেকে গ্যছে।

একদিন মিশন থেকে আমরা ওর ফ্ল্যটে গেলাম।
– তোমার কোন গার্ল ফ্রেন্ড নেই?
– না!
– রিয়েলি!
– ইউ মিন, ইউ হ্যভ নট কিসড এনিবডি —
প্রিয়াংকা হেসে গড়িয়ে পড়ে। কাম অন বেবি!
প্রিয়াংকার নিজের দুটো ঠোট আমার ঠোটে চেপে ধরে! বুঝতে পারি গরম নিশ্বাস পড়ছে!

আমি এক ছুটে বের হয়ে আসি! দুদিন ঘুমোতে পারি না। তিনদিনের দিন আবার আমি যাই ওর ফ্ল্যটে।
সেই আমি জানতে পারলাম নারী শরীরের অলিগলি। তারপর পাগলের মতো প্রতিদিনই হানা দিই প্রিয়াংকার ফ্ল্যটে।

একদিন সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে দেখি বাবার ঘরে একজন অচেনা মহিলা বসে গল্প করছে।
– এনা, হি ইজ মাই সন —
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, অনি, মিট এনা,সী ইজ মাই কলিগ!
এনার চোখে কৌতুক, গ্ল্যড টু মিট ইউ বয়! ডু ইউ গো টু জিম?
আমি মাথা নাড়ি!
– ইউ হ্যভ এন এথলেটিক বডি, গার্লস উইল লাভ টু —
– ও কে! এনা গেট রেডি। ইটস অলরেডি লেট, মি গাঙ্গুর উইল ওয়েট ফর আস!

(৩)
জয়েন্টের রেজাল্ট বেরোলে দেখলাম যে আমি যাদবপুরে মেকানিকাল পাবো, আর আইআইটি তে মাঝারি র‍্যংক পেয়েছি, তাই খড়্গপুরে বা কানপুরে পছন্দের স্ট্রীম আমি পাবো না। আমার ইচ্ছে যাদবপুরে ঢুকি কিন্তু বাবা বেকে বসল, নো, নেভার। ইউ শ্যুড ট্রাই ইন মাদ্রাজ অর পাওয়াই!
আমি প্রিয়াংকার ফ্ল্যটে যাই। সব খুলে বলি।
– আমার মনে হয়, ইউ শ্যুড গো ফর আইআইটি!
– কেন? তুমি চাও না আমি কলকাতায় —
– দেখো, মাই গোল ইজ টু সেটল ইন ইউএসএ! আজ বা কাল আমি জিআরই ক্লিয়ার করবো, তারপর

আমি বেরিয়ে পড়ি।
রাত্তিরে মা কে ফোন করি। মা চুপ করে থাকে।
– আমি তোদের কেউ না! মার গলায় কান্না।
– কি হয়েছে মা? বলো তো আমায়।
– তোর বাবা আমাকে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়েছে।

বারান্দায় এসে বসি। শহরটা কেমন যেন অচেনা লাগে। পাশের বাড়ির দত্তদাদুরা চলে গেছে, ওদের বাড়িটা ভেঙে এখন ফ্ল্যট হবে। ওদিকে রাতে লরি আসে, যাদবদের পুকুর ভরাট হচ্ছে! ওখানেও নাকি ফ্ল্যট বাড়ি হবে।
আমার খুব কান্না পায়। কিন্তু কেন এরকম হয় বুঝতে পারি না!
মার জন্য?
দত্ত দাদুদের বাড়িটা ভাঙা হবে বলে?
না কি যাদবদের পুকুরটা ভরাট হবে বলে, না কি এই শহর আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে বলে!
আমার কান্নাটা আটকে থাকে কারণ বাবার সেই কথাটা কানে ভাসে, বয়েস ডোন্ট ক্রাই!

(৪)
আমেরিকায় আমি ফাইন্যালি সেটল করি নি। দু’বছর থাকার পর আমি চলে আসি। মা বাবার ডিভোর্স হওয়ার কিছুদিন বাদেই মার একটা ম্যসিভ এটাক হয়েছিলো, তারপর আমেরিকার যাওয়ার ক’দিন আগেই মা আমার চলে যায়।

এনা বাবাকে তখন ইউজ করেছিল, এখন শুনছি এনা মুম্বাই এ কোন বড় কোম্পানীর সেক্রেটারি!
– তুই একবার সাতদিনের জন্য আসতে পারবি? বাবা ফোন করেছিল।
আমি, শান্তা আর জিনিয়া কলকাতায় আসি। শান্তা দিল্লীর মেয়ে, জিনিয়া আমাদের মেয়ে, ওর বয়স তখন জাস্ট তিন!
– শোন, নিউ টাউনের দিকে একটা ওল্ড এজ হোম দেখেছি। সেখানেই শিফট করব ঠিক করেছি!

বাবার কথার মাঝে হটাৎ জিনিয়া এসে বাবার হাত ধরে টানে!’দাদাই, এ বিল্লী ইজ সিটিং ইন দ্য ব্যলকনি! চলো, চলো, আই উইল প্লে উইথ হার–
বাবাকে ছোট্ট হাতে টেনে নিয়ে যায় জিনিয়া।

আমি এটা লক্ষ্য করছি জিনিয়া বাবাকে কিছুতেই ছাড়তে চায় না! বাবাও দিনকে দিন ওকে প্যম্পার করে যথেচ্ছা। দুদিন রাত্তিরে জিনিয়া বাবার সঙ্গেই ঘুমিয়েছে, এমন কি বাবাকে গল্পও বলতে হয়েছে!

সাতদিনের মাথায় যেদিন আমরা ফিরছি, সেদিন বাবাকে এয়ারপোর্টে যেতে হল জিনিয়ার বায়নায়!
আমি বহুবার প্লেনে যাতায়েত করেছি,বাবাকে কখনো এয়ারপোর্টে আসতে দেখিনি।

সাতদিন পরেই ফিরতে হল আমাকে।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে বাবা।
ডাক্তার বলেছেন, হি ইজ আউট আফ ডেনজার! হি ইজ এ ভেরি স্ট্রং ম্যন!
আমি বাবার মাথায় হাত রাখলাম।
বাবা নিশব্দে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে!
আমি তখন রোজ হাসপাতালে যাতায়াত করি। ডাক্তার বলেছে আর দু একদিনের মধ্যেই বাবাকে রিলিজ করে দেবে।

(৫)
মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে ইউএসএ ফিরে যাব আমি। সেরকমই আমার ট্রাভেল প্ল্যান। বাবার জন্য একটা প্রফেশনাল সার্ভিস গ্রুপের সঙ্গে ব্যবস্থা করেছি। এরা বয়স্কদের দেখাশোনা করে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, ব্যংকের কাজ করে দেয়।
এই ধাক্কায় বাবার চেহারাটাও ভেঙে গ্যছে, সেই সুপুরুষ মানুষটা যেন অর্ধেক হয়ে গেছে।

কাল চলে যাব। রাত্তিরে বাবার ঘরে যাই। আধশোয়া হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার আওয়াজ পেয়ে ইশারায় ডাকে আমাকে।
– বোস!
একটা চেয়ার টেনে বসি।
– শোন না–
– হ্যাঁ, বলো —
– চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে আয়!
– কি বলছ?
– ঠিকই বলছি! টাকার তো অভাব নেই, যা রোজগার করেছি, হাবড়ার বাড়ি বিক্রি করলে, তোর কিছু না করলেও কিংবা এখানে কোনো চাকরি বাকরি —
– তুমি জানো তো বাবা, আমার প্রস্পেক্ট!
– শেষ জীবনটা যদি তোদের সঙ্গে কাটাতে পারি! জিনিয়াকে নিয়ে –

বাবার চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে!
বাবার উপর খুব রাগ হয় কিন্তু কিছু বলতে পারিনা!
আমি বাবার হাতটা ধরি!
ভাবি বলি, বাবা ছেলেদের কাঁদতে নেই! তুমি তো শিখিয়েছিলে — কত কষ্ট যে জমে আছে!
আমার চোখ দিয়েও জলের ধারা নেমে আসে!
সেই সময় মনে হয় কান্নাটা খুব জরুরী!
পুরুষ মানুষদেরও –

********

Sahityika Admin

Add comment