নগর কীর্তন
@অনিরুদ্ধ রায়, ১৯৮৩, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আজ মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরতেই আমার একমাত্র ছেলের বৌ, তিন্নি বলল, “কাকু, আজ বিকেলে আইওনক্সে গিয়ে নগর কীর্তন দেখে এসো, আমি টিকিট কেটে রেখেছি।“
আমার স্ত্রী অনেক আগেই গত হয়েছেন। আমার মাতৃহীন ছেলে, আমার বৌমা মাধুরী আর তাঁদের বন্ধু প্রদীপ্ত একসাথে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে। পাশ করে দেড় বছরের মধ্যেই আমার ছেলে বিয়ে করে আমার জীবনের শূন্যতা ভরিয়ে দিলো। তবে আজকালকার ছেলেমেয়েরা বিয়ে করলেও আমাদের মতো সংসারে কিছুদিন পরস্পরের প্রতি মুগ্ধ হয়ে জড়িয়ে মড়িয়ে থাকে না, এরা সকলেই ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত। ছেলে এবছর গুরগাঁওয়ে এমডিআই তে ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স পড়তে চলে গেলো, আর মাধুরী গেলো যাদবপুরে মাস্টার্স করতে। প্রদীপ্ত এখন সেখানে আমার বৌমার সহপাঠী।
যদিও আমাদের শ্বশুর বৌমা সম্পর্ক, তবু আমার বৌমা সেটাকে প্রথম থেকেই এক্কেবারেই বন্ধুর পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। আমাকে কাকু বলে সম্বোধন করে। সে বলে বাবা নাকি একজনই হয়। সুতরাং দ্বিতীয় বাবা সে চায় না, বরং কাকু অনেক আদরের, ওর চিন্তা ভাবনায়। আবার যখন সোহাগ উথলে ওঠে, তখন আমাকে গুরু, বস, ওস্তাদ, ডার্লিং এরকম অনেক নামেই ডাকে। আর আমি যে মাধুরী নামে ডাকি, সেটাও ওর পছন্দ নয়। বলে এটা তো আমার স্কুল কলেজের নাম। আমাকে একটা নতুন নাম ধরিয়ে দিয়েছে, তিন্নি। তাই এখন থেকে আমাকে ঐ নামেই ডাকতে হয়। আমারও ভালোই লাগে এরকম একটা নামে ডাকতে। আমাদের দু’জনের মধ্যে মুক্তমনে অনেক কথাই হয়।
আমাকে নগর কীর্তনের টিকিট ধরিয়ে দিলো। আমিও ছাড়নেওয়ালা পাত্র নই। ফুট করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম “কেন? আজ প্রদীপ্ত মালটা আসবে নাকি?”
– হ্যাঁ, আসবে।
– শালা, তোমাকে মজা দেখাচ্ছি। তোরা প্রেম করবি বলে আমাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হবে? দাঁড়া তোর মাকে ফোন করে জানাবো তোর কীর্তিকলাপ।
– সে জানিও। কিন্তু কাকু, কিছু মনে করো না। তোমার মাথাটাই গেছে। এই গত পরশুদিন রাতে খাওয়ার সময় কে আমাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলছিলো যে নগরকীর্তন নাকি খুব ভালো সিনেমা হয়েছে? কে বলছিলো বাড়ির কাছেই উজ্জলা সিনেমা হলে চলছে? সব্বাই বলছে ভালো হয়েছে। এসব কাঁদুনি কে গাইছিলো গো আমার ডার্লিং কাকু?
– এই শোন, সম্পর্কে আমি তোর শ্বশুর, আমাকে বলছিস আমি কাঁদুনি গাইছি?
– আহা, কি শ্বশুর রে? এক্ষুনি কে আমাকে বললো দূর শালা? কে বললো? বলো, বলো, কে আমাকে শালা বললো?
আমিও ছাড়বো না। বললাম, “বুঝেছি, তোরা প্রেম করবি। তাইতো?”
– কাকু, মা ঠিকই বলে তুমিই আমার মাথা খাচ্ছ। আবার ভেবে দেখো, আমরা যদি বাইরে গিয়ে মাঠে ময়দানের বেঞ্চে বসে প্রেম করি, সেটা কী ভালো হবে, লোকে কী বলবে?
– তাই বলে দরজা ভেজিয়ে পড়াশুনা করতে হয়?
এবার তিন্নি কপট রাগ করে কোমড়ে কাপড় জড়িয়ে ঝগড়া করতে এলো।
– গুরু, তুমি যে গুষ্টির বেড়াল পুষেছো, সেগুলো তাহলে তুমিই সামলে রাখো। আর আমাদের দরজায় পাহারা বসিয়ে দাও, তাহলেই দরজা খোলা থাকবে।
কথাটা মিথ্যা নয়। বেড়ালগুলো আমিই পুষি, কিন্তু বেইমান বেড়ালগুলো সারাদিন তিন্নির ঘরেই থাকে। আর তিন্নিও তাঁদের সাথে নিজের মনে কথা বলে, খেলা করে। আমি বুঝি, যতই আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকুক, তাঁর নিজের বয়সী একজন সাথী বা বন্ধু তো থাকা একান্তই দরকার। তাই তিন্নি নিজের একাকীত্ব ঘোচাতে অনেকটা সময় এই বেড়ালদের সাথেই কাটায়।
তিন্নি আমাকে সুযোগ পেলেই খোঁচা দেয়।
– কাকু, মনে আছে? এই কিছুদিন আগেই তুমি পাদুর কাছে নিজের অঙ্কের বিদ্যা জাহির করছিলে। তোমার স্কটিশ চার্চ স্কুলের অঙ্কের মাস্টার নাকি তোমার মতন অঙ্কের ব্রেন আর দ্বিতীয়টি দেখেননি। বলেছিলে তো?
– হ্যাঁ, বলেছিলাম তো। আমার মতন অঙ্ক স্কুলে তখন কেউই পারতো না।
– আর পাদু কি করলো? তোমাকে কয়েকটা অঙ্ক করতে দিলো। তারপর কি হলো?
– সে আমি ফর্মুলা ভুলে গিয়েছিলাম, তাই পারিনি।
– কিন্তু পরের দিনই তো পাদু কেশব নাগের বই এনে দিয়েছিলো, সেখানে তো সবকটা ফর্মুলাই ছিলো। তাহলে কেন পারলে না?
তিন্নি কিছু বললো না। শুধু মুখ টিপে হাসতে লাগলো। আমি রেগে গিয়ে বললাম “বড় হাঁসছিস যে?”
তিন্নি তবুও হাঁসতে থাকলো। “আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। ঠিক আছে। তাহলে আর অঙ্ক নয়। আমি পাদুকে বলবো তোমাকে নেসফিল্ডের গ্রামার থেকে কিছু প্রশ্ন দিতে।“
এই মেয়েটা তো অদ্ভুত? খালি পিছনে লাগে!
আমি এবার বাধ্য হয়ে বলি “এই মেয়ে। শোন, অঙ্ক নিয়ে খোঁটা দিবি না, আমি মাধ্যমিকে অঙ্কে একাশি পেয়াছিলাম জানিস?
– সে তো সুজনকাকুর দেখে টুকেছিলে, তাই।
– হে হে, আর তোর প্রদীপ্ত মালটা যে ফাইনাল সেমিস্টারে সাপ্লি পেয়েছিলো? তার বেলা?
– ঐ দেখো! আরে পাদু সাপ্লি পাক, আর লেটার মার্ক্স পাক, তাতে আমার কি? আর গুরু, যদি সাপ্লির কথাই বলো। ইঞ্জিনিয়ারিঙে কে সাপ্লি পায় না? ছাড়ো। তাছাড়াও তুমি তো আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ো নি। মেয়েদের সাথে আর্কি পড়েছো। তুমি এসব বুঝবে না।
একটু থেমেই আবার শুরু করে, “গুরু, তোমার আর্কির ক্লাসের ঐ মেয়েটা না, কি যেন নাম? চম্পা না চামেলি? এক্কেবারে তোমার জন্য ফিট ছিলো।“
দেখেছো মেয়েকে? শ্বশুরকে গুরু বলে ঠাট্টা করে? আর আমার ক্লাসমেটদের নিয়ে ঠাট্টা করে? আমিও ছাড়বো না।
– শোন রে মেয়ে। ঐ চম্পা চামেলী ইউনিভার্সিটি টপার ছিলো। আর তোর জিগরি দোস্ত পাদু সাপ্লি পেয়েছিলো।
– আর তোমার পাদু সাপ্লি পেয়েও তো একবারেই গেট ক্লিয়ার করে অ্যাডমিশন পেয়ে গেলো।
আমি হেরে গিয়ে হাত তুলে দিলাম।
– সে তুই যাই বল আমাকে। তুই একটা যাচ্ছাতাই। নিজের ক্লাসমেটকে বিয়ে করে আর এক ক্লাসমেটের সাথে কেউ প্রেম করে? আমার ছেলেটা একা অতো দূরে থেকে পড়াশোনা করছে, আর তোরা দিব্যি বাড়িতে থেকে পড়াশোনার নামে দরজা বন্ধ করে ফাজলামি করে যাচ্ছিস।
– দরজা বন্ধ করে নয় কাকু, দরজা ভেজিয়ে।
– সে ঐ একই হলো।
– একই হলো? ঠিক আছে। পাদুটা তো তোমার সামনে সিগারেট খেতে লজ্জা পায়, তাই দরজা বন্ধ করতে বলে। এবার থেকে তোমার সামনেই বিড়ি ফুঁকবে। আমি তাই করতে বলবো।
না, অনেক বাকবিতন্ডা হলো। আমি আমার ট্র্যাক প্যান্টের পকেট থেকে কালকের গিফ্ট পাওয়া বিদেশী সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটারটা বার করে বললাম, “তুই কি এককাপ চা করে খাওয়াতে পারবি? না আমাকেই করতে হবে?”
তিন্নি চোখ বড় বড় করে বলে, “আই ব্বাস, বিলিতি মাল? গুরু, দাও না আমাকে একটা। আমি কয়েকটা টান মারি।“
– না, তোমাকে আর টান মারতে হবে না। বরং আমাকে একটু চা বানিয়ে দাও।
– দেবে না? দেবে না তো? তাহলে চাও তুমিই বানাও। আর আমাকে হাফ কাপ দিও। কিন্তু বস। এই সিগারেটটা তোমায় এত ভালোবেসে কে দিলো?
– সোমনাথের বাড়ির প্ল্যানটা ফ্রীতে করে দিয়েছিলাম, তাই গিফ্ট দিলো।
– দেখি, মাল কেমন?
বলেই একটা সিগারেট বার করে লাইটার দিয়ে ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে দিলো।
– তিন্নি, তোকে কতবার বলেছি, সিগারেট খাওয়াটা ছাড়। কতবার বলেছি, মেয়েদের প্রেগনেন্সির সময় সিগারেট খেলে বাচ্চার ক্ষতি হয়।
– চিন্তা করো না কাকু, তোমার ছেলের যা প্ল্যান, আগামী পাঁচ বছরে তোমার দাদু হওয়ার কোনো চান্সই নেই।
– সে তো জানি। গর্দভটাকে বুঝিয়ে এখনই একটা নামিয়ে ফেললেই তো আমি অনেকটা দেখভাল করে দিতাম। আর তোরাও ঝাড়া হাত পায় বাবা, মা হয়ে বেশ কিছুদিন থাকতিস, ওকে এবার বোঝা।
আমি বাপ মেয়ের জন্য চা করতে রান্না ঘরে ঢুকলাম।
ওরা একসাথে দরজা ভেজিয়ে পড়ে বলে আমি একদিন তিন্নিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “হ্যাঁরে, তোরা দরজা বন্ধ করে কী করিস?”
তিন্নি হেসে বলেছিলো – পেরেম।
ব্যাস,এর পরে তো আমার আর কিছু বলার নেই। আমি জানি, আমার তিন্নি আমাকে কোনদিন ঠকাবে না। তবু ওর পিছনে লাগতে আমার ভালো লাগে। ওর সবকিছুই তো ভালোবেসে মেনে নিয়ে সদানন্দে সংসারে আছি। প্রদীপ্ত ছেলেটাও খুব ভালো, আমার গিন্নির শেষ সময় রোজ হাসপাতালে আসতো, আর ঐ প্রথম গিন্নিকে আমার ছেলের প্রেমের ব্যাপারটা বলেছিলো। তারপর তিন্নিকে ডেকে পাঠিয়ে দেখে গিন্নি খুব খুশি হয়েছিলো। আমি খালি চেয়েছিলাম আমাকে বাবা বলুক কিন্তু তিন্নি রাজি হয় নি কারন বাবা তো একটাই হয়, তাই আমি ওর আদরের কাকু। বৌমার বাবা এখনো চাকরি করে আর মা একটা স্কুলে পড়ায়, বেশ আধুনিক মনস্ক কিন্তু মেয়ের সব ব্যাপারে মায়ের নাক গলানো স্বভাবটা এখনো রয়ে গেছে।
চা নিয়ে গিয়ে তিন্নিকে দিয়ে বললাম। “পরশু তোর মাসির নাতির মুখেভাতে তোর মাকে নীল শাড়িতে বেশ সুন্দর লাগছিলো, তুই তোর মায়ের মতো সুন্দর হোস নি।“
– মাও বলছিল তোমায় খুব হ্যান্ডসাম লাগছিলো।
– বলেছিলো? তবে দেখ, তোর মা কত ঠিকঠাক কমেন্ট করে!
ও চা টা নিয়ে থ্যংক্যু বলে আমার মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে বলল। “তোমার সাড়ে পাঁচটায় শো ,চার নম্বর হলে ডি তিন নম্বর সিট, টিকিট টা পাঠিয়েছি,দেখে নিও।“
হলে পৌঁছে সিটে বসতে গিয়ে দেখি তিন্নির বাবা, মাও আমার পাশাপাশি এক আর দুই নম্বর সিটে বসে আছে। বুঝলাম তিন্নি বাবা মার সাথে আমার টিকিটটাও প্ল্যান করেই কেটেছে, যাতে আমরা একসাথে একটু সময় কাটাতে পারি।
তিন্নির বাবা রজত বাবু আমাকে দেখে খুশি হয়ে বললো, “মাধুরী যে আপনাকেও পাঠাবে জানতাম না।“
তিন্নির মা,চন্দ্রা জিজ্ঞেস করলো, “তা তিনি এখন কী করছেন?”
– কে আমার তিন্নি মা? সে তো প্রদীপ্তর সাথে পড়াশোনা করছে।
চন্দ্রা বলে উঠলো, “ফাঁকা বাড়িতে ওরা দুজন? দাদা, আপনার আস্কারেতেই ও মাথায় উঠছে, খারাপ কিছু হলে আমাকে বলবেন না কিন্তু।“
আমি একটু দম নিয়ে বললাম, “চন্দ্রা, আমার তিন্নিকে আমি চিনি। আপনার আমার মুখে কোনদিন সে চুনকালি দেবে না। “
রজতবাবুও হেসে মাথা নাড়লেন।
সিনেমা শুরু হয়ে গেল – নগর কীর্তন।
********
Add comment