সাহিত্যিকা

অচিন বাবুর কবিতা

অচিন বাবুর কবিতা
@অসীম দেব, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

অচিন আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু, প্রাক্তন সহকর্মী ও প্রতিবেশী। দুজনেই দিল্লিতে বেশ কিছু বছর এদিক ওদিক চাকরি করে অবশেষে শেষের ৩২ বছর আমরা একই অফিসে কাজ করেছি, একই দিনে অবসরগ্রহণ করেছি। সেও আজ প্রায় দশ বছর হয়ে গেলো।

অচিনের জীবন চিরকালই খুব সাধারণ। নিজেকে বুদ্ধিজীবি ভাবে না, নীরদ চৌধুরীর আত্মঘাতী বাঙালী, বা লাল সূর্য্য বিপ্লবের চিন্তাধারা, বা কিছু না জেনেই অনর্থক অহেতুক আলোচনা বা তর্ক বিতর্ক, মোদী আম্বানীর বা বিরাট কোহলি গৌতম গম্ভীরের স্ট্রাটেজিক ভুল নিয়ে হোয়াটসএপে মতামত দেওয়া, …… এসব জাগতিক ব্যাপারে সে থাকেই না। একেবারেই সাধারণ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। এহেন অচিনের মাথায় এখন কবি হওয়ার বাসনা জেগেছে।

ব্যাপারটা খুবই সাধারণ কিন্তু অচিনের জন্য চ্যালেঞ্জ। সে একটা কবিতা লিখেছিল, জীবনের প্রথম সাহিত্যচর্চা, সেই কবিতা পাড়ার দুর্গাপূজায় স্যুভেনিরে ছাপা হয় নি। সম্পাদক জানিয়েছে, আরেকটু ভালো কবিতা দিতে। সম্পাদক যা বলেন নি, সে হলো “এ কি কবিতা হয়েছে?”
এবং এখান থেকেই সূত্রপাত।
অচিনের সেই কবিতা আমি পড়েছি, মানে সেই আমাকে পড়তে দিয়েছিল। কবিতাটি মা দুর্গাকে উদ্দেশ্য করে, এইরকম ছিল:

তুমি আসবে তাই
আমি পাড়ার পূজায় দিয়েছি চাঁদা।
তোমায় আমি বরণ করবো হাতে সিঁদুর কৌটা নিয়ে
আর থাকবে ধান দুর্বা পান সুপারি।
রেকাবিতে থাকবে ভিআইপি সুইটসের সন্দেশ
আর দ্বারিক ঘোষের দই।
বিসর্জনের বরণের সময়
মুখে ঠুসে দেবো সিঁদুর মাখা সন্দেশ।
তুমি ঢাকের আওয়াজের সাথে চলে যাবে ট্রাকে
আর আমি বিষন্ন মনে ফিরে আসবো নিজের ঘরে।

অচিনের এই কবিতা পড়ে আমিই বা কি বলি? বেচারার জীবনে প্রথম কবিতা লেখার প্রয়াস। ওকে সান্ত্বনা দিলাম, উৎসাহ দিলাম, “অচি, তোর কবিতা আজ একজন বাতিল করেছে। তুই সামনের বছর ভালো থীম নিয়ে দারুণ একটা কবিতা লিখে এই সম্পাদকের মুখে ছুঁড়ে দে। টেক ইট এজ এ চ্যালেঞ্জ।“
কিন্তু আমার এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের উপদেশটাই কাল হলো। দিন তিনেক বাদে সস্ত্রীক আমাদের বাড়ি এসে জানালো, “আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, এক হাজার কবিতা লিখবো।“
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই অচিনের স্ত্রী বললো, “দাদা, ওকে প্লিজ একটু বোঝান। কয়েকদিন ধরেই মাথায় ভুত চেপেছে। গত সত্তর বছরে যে লোকটা একটাও এক লাইনের কবিতা লেখা তো দূরের কথা, একটা কবিতাও যে পড়ে না, সে এখন এক হাজার কবিতা লিখবে? শেষে পাড়া প্রতিবেশী বন্ধুরা যেন হাসাহাসি না করে।“
আমিও বলি, “অচি, কি পাগলামো করছিস? হাজার কবিতা কি ছেলেখেলা?”
অচিন মানবে না, “কেন? রবীন্দ্রনাথ নজরুল চার হাজার লিখেছে, এখনের শক্তি চট্টোপাধ্যায় আড়াই হাজার লিখেছে। আর আমি মাত্র এক হাজার পারবো না?”
অচিন শুনবে না, তাঁর কবিতা লেখা শুরু হয়ে গেলো। প্রতি সপ্তাহে গোটা পাঁচেক। এবার সেগুলি সে তাঁর বিভিন্ন হোয়াটসএপ গ্রুপে এবং আরও প্রায় ষাট সত্তরজনকে নিয়মিতভাবে পাঠাতে শুরু করে দিল। কবিতার তো বিষয় চাই। অচিন টিভি নিউজ থেকে তাঁর প্রথম কবিতার অনুপ্রেরণা পেলো।

ভারতীয় ক্রিকেটের ব্যাটসম্যান
ও প্রাক্তন অধিনায়ক বিরাট কোহলি
টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন।
তিনি আমাদের সকলের হৃদয়ে স্থান পেয়েছেন।
তাঁর এই ঘোষনা অসংখ্য ভক্ত
এবং ক্রিকেট অনুরাগীদের জন্য হৃদয়বিদারক।
তাঁর অবসরের আবেগঘন বার্তা
ভারতীয় ক্রিকেটে একটি যুগের অবসান ঘটায়।
তার নেতৃত্বে ভারতের ক্রিকেটে এসেছে পরিবর্তন
এসেছে আগ্রাসন, বিশ্বাস।
অনুপ্রাণিত করেছিলেন একটি প্রজন্মকে।
প্রার্থনা করি, তাঁর অবসরের সিদ্ধান্ত
একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

আমি এই কবিতা পেয়েই ফোন করলাম, “অচি, তুই কি ক্ষেপেছিস? খবরের কাগজের এক লাইনকে টুকরো টুকরো করে তিন চার লাইনে ভাগ করে লিখে দিলেই কবিতা হয়ে যায়?”
অচিন শুনলো, জবাব দিলো না।
কয়েকদিন বাদেই আরেকটা এলো, এবার সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে। কবিতার প্রথমটা এইরকম:

তারা যাচ্ছিল আগ্রা থেকে ইউরোপ প্যারিসে
টেক অফ হতেই যান্ত্রিক ত্রুটি,
বিমান ভেঙে পড়লো তাজমহলের চূড়ায় ……………

আমি ফোন করলাম, “অচি, এবার পাবলিক তোকে প্যাঁদাবে। প্লেন ভেঙ্গেছে আমেদাবাদে।“
– হোক আমেদাবাদ। আমার প্লেন সোজা তাজমহলে ঢুকে যাবে। কবিতায় সেনসেশন চাই, সেনসেশন। আমার কবিতার অর্থ তোর মত পাবলিক বুঝবে না।
আমি চুপ করে গেলাম।
এবার প্রায় রোজই একটা করে কবিতা আসে। ওর কবিতাগুলো পড়ে এখন কবিতা সম্বন্ধেই আমার মনে এক ভীতির সঞ্চার হয়েছে। আমার মনে হয় অনেকেই এখন অচিনের কবিতা দেখলেই ভয় পায়, পড়া তো দূরের কথা। কিন্তু ওঁর কবিতার প্লাবন অব্যাহত, এবং বিভিন্ন ধরণের কবিতা। যেমন:

আজি ঝরঝর মুখর পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
গগনে গরজে মেঘ, নেই ভরসা।
আর বসে আছি আমি কূলে একা।
আমার মন এখন মেঘের সঙ্গী হয়ে
নিঃসীম শূন্যে উড়ে চলে দিগ্‌দিগন্তের পানে
আর শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীত গেয়ে চলে
রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম।
তোমার ঝড়ে ওঠে বাউল বাতাস
তোমার মালা গাঁথা হয় বজ্রমানিক দিয়ে।
আর আমার মন ক্বচিৎ চকিত তড়িত-আলোকে
উড়ে যায় হংসবলাকার পাখায়।

আমি গিন্নিকে শোনালাম, “দেখো, অচি কি লিখেছে। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা গানের এক দু লাইন জুড়ে দিয়ে নিজের কবিতা বানিয়েছে।“ খানিক বাদে সে নিজেই ফোন করে জানালো যে একজন এই কবিতার মধ্যে জীবনানন্দকে খুঁজে পেয়েছে।

পরের দিন আরও সাংঘাতিক। সে নাকি মাঝরাতে দুই মোষের গুঁতোগুঁতির স্বপ্ন দেখে ঘুম ছেড়ে উঠে সেই মাঝরাতেই কলম ধরেছে:

রাস্তার দুটি ষাঁড়
এতদিন এঁকে অন্যের বন্ধু,
আজ কি হলো?
রাস্তার মাঝে গুঁতোগুঁতি?

প্রথম চার লাইন পড়ে আমি আর পড়িনি।
এরপর থেকে যখনই দেখি অচিনের কবিতা, আমি সঙ্গে সঙ্গে ডিলিট করে দি।
কিন্তু অচিন নিয়ে এলো এক খবর।
“কি রে? খুব তো আমার কবিতা নিয়ে হাসাহাসি করেছিলি। যে সম্পাদক আমার কবিতা রিজেক্ট করেছিল, সেই সম্পাদকই এখন পাড়ার ক্লাব থেকে আমাকে সেরা কবির সন্মান দেবে বলেছে।“
আমি অবাক।
– অচি? সেরা কবির সন্মান? তোকে?
– ইয়েস স্যার। সার্টিফিকেট দেবে, চারিদিকে সত্যেন দত্ত, কুমুদ মল্লিক, নবীন সেন, কালীদাস রায়, জীবনানন্দের ছবি থাকবে, আর আমার ছবি থাকবে মধ্যেখানে।
আমি কিছুই না বুঝে অচিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সে আরও জানালো, “আমার কবিতা এখন বিশ্ব কবি সন্মেলনের পত্রিকায় ছাপানো হবে।”
জানতে চাইলাম, এই বিশ্ব কবি সন্মেলনের কার্যালয়টা কোথায়?
– বৈঁচিগ্রামে।

অচিন বলে চলেছে, “আমি ওঁদের বলেছি, ক্লাবে ভালো চাঁদা দেবো, ওঁরা আমাকে ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দেবে। আর আমি সামনের দুর্গাপূজায় আমার কবিতার বইয়ের স্টল দেবো।“
আমি অবাক। “অচি? তোর কবিতার বই? কবে?”
– কি ভাবিস আমাকে? দুই তিন সপ্তাহ বাদেই পঞ্চাশটা কবিতা নিয়ে আমার প্রথম বই বাজারে আসছে, অচিনের বই। এর মাস দুই তিন বাদে আসবে আমার দ্বিতীয় বই। আর দুর্গাপূজা আসতে আসতে আরও গোটা চারেক হয়ে যাবে।
– কি বলছিস অচি? এক বছরে পাঁচ ছ’খানা কবিতার বই?
– ইয়েস, মিনিমাম পাঁচখানা তো হবেই।

একটু থেমে মনে করিয়ে দিলো, “বুঝলি, হাজার কবিতার জন্য হিসেব করে দেখলাম যে গোটা পনের বই তো হয়েই যাবে।“

*******

Sahityika Admin

Add comment