ইতিহাস যেখানে নীরব (ধারাবাহিক)
@দেবাশীষ তেওয়ারী, ১৯৬৯ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
(পর্ব-১)
ঘটনাস্থল শ্মশান। সময় নিঝুম রাত। একেই ঘন জঙ্গল, তায় অমাবস্যা, এতই অন্ধকার যে নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যায় না। দূরে কাদের যেন হিংস্র চোখ মাঝে মাঝেই জ্বলে উঠছে। জানি না ভূত? না প্রেত, রাক্ষস? ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। এমন ঘোর অন্ধকারে এই গভীর জঙ্গলে কোন সাধারণ মানুষ আসাযাওয়ার কথা চিন্তাই করে না। কিন্তু একজন এরই মাঝে নিজের মনে হেঁটে চলেছে, কাঁধে একটি মৃতদেহ।
এতক্ষণ ধরে বয়ে নিয়ে চলা বোঝাটাকে হঠাৎ তার কেমন জানি ভারী ভারী মনে হতে লাগলো! চন্দ্র ভাবলো, এ নিশ্চয় তার মনের ভুল, একটা মৃতদেহ হঠাৎ কিভাবে আরও ভারী হয়ে যাবে? মনে যে চিন্তাই থাকুক, কাঁধে তাঁর গুরুদায়িত্ব, যেমন করেই হোক মাঝরাতের আগেই এই মৃতদেহ বয়ে নিয়ে তান্ত্রিকের পূজায় পৌঁছে দিতে হবে। সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অন্যথায় তান্ত্রিকের পুজোর বিঘ্ন হবে, এতদিনের সাধনা বিফল হয়ে যাবে। এই ভেবে বাড়তি ওজনকে উপেক্ষা করেই সে তাড়াতাড়ি পা চালালো।
সেই ঘন অন্ধকারে হঠাৎই কে যেন খিক খিক শব্দে হেসে উঠলো। চন্দ্র চমকে উঠে একটু থেমে পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করলো, কোথায় সেই হাসির শব্দের উৎস, কিন্তু অন্ধকারে যে কিছুই দেখা যায় না। খানিক থেমে এরপর এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই আবার সেই হাসির শব্দ, মনে হলো এবারের শব্দ যেন এলো ঠিক তার কাঁধের ওপর থেকে। সেই মৃতদেহটাই যেন হেসে উঠেছে। চন্দ্রর ধারণা হলো সে পিঠে যাকে বয়ে নিয়ে চলেছে সে কোন সাধারণ মৃত নয়। চলা না থামিয়েই করজোড়ে বলল, ‘প্রভু, আপনি যেই হোন না কেন, আমায় সাহায্য করুন, দয়া করে আপনার পরিচয় দিন।’
অদ্ভুত। এবার কোথাও কোন আওয়াজ নেই। মনে হলো মৃতদেহটিও যেন অবসন্ন শক্তিহীন হয়ে আছে। একটু আগেই যে হেসে উঠেছিলো তেমন কোন লক্ষণই নেই। চন্দ্র কোনো উত্তর না পেয়ে আবার চলা শুরু করতেই একটা ঝাঁকুনি খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। মৃতদেহ এবার তার ঘাড়ে উঠে হি হি করে হাসছে। তার কানে মুখ রেখে মৃতদেহ ফিসফিস করে উঠল, ‘আমার পরিচয় জানতে চাও? আমি বেতাল। পিশাচ জানো? পিশাচ? আমিই হলাম গিয়ে সেই পিশাচ।’ বলে সেই পিশাচ আবার হাসতে লাগল।
গভীর বনের গাঢ় অন্ধকারে অতি বড় সাহসীও কাঁধে পিশাচ চেপে বসেছে জানলে কাঁধ থেকে মৃতদেহ ফেলে ছুটে পালাবার চেষ্টা করবে, কিন্তু এই চন্দ্র অন্যরকম, সে দুঃসাহসী বীর। বিভিন্ন ধরণের বুদ্ধি ও সাহসের পরীক্ষায় উত্তীর্ন হওয়ার পর তান্ত্রিক তাঁকে এই কঠিন দায়িত্ব দিয়েছেন। চন্দ্রের ব্যাবহার স্বাভাবিক। ‘আমার কি ভাগ্য, আমি বেতালকে বয়ে নিয়ে চলেছি। এখন তুমি আমার সঙ্গে সন্ন্যাসী পর্যন্ত চলো। তোমাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে তবেই আমার ছুটি। এইটুকু সাহায্য তুমি আমায় করবে না?’
– কেন করব? এতে আমার কি কোন লাভ আছে?
– লাভ লোকসান জানি না, কেবল জানি, তুমি সন্ন্যাসীর কাছে যাচ্ছ।
– তুমি নির্বোধ বলে আমাকেও বোকা হতে হবে এমন কোন কথা নেই।
– আমি ক্ষত্রিয়, প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, জীবন দিয়েও সে কথা রাখবো। হে বেতাল, তুমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আমায় সাহায্য করো।
বেতাল চন্দ্রর সবকিছুই জানে, তার সাহস, বীরত্ব, বিচক্ষণতা সব। সে ভাবলো এর সাহস তো দেখলাম, এবার একটু বাজিয়ে দেখা যাক এর বুদ্ধির দৌড়। এই ভেবে সে বলল, ‘দেখ রাজা, এই ঘোর বনে আমি একাই থাকি, এখানে আমার কোন সঙ্গী সাথী নেই। একলা আমার সময়ই যেন কাটতে চায় না। তোমায় যখন পেয়েই গেছি, তখন তোমার সঙ্গে একটা খেলা করতে চাই। তুমি আমার সঙ্গে খেলতে রাজী থাকলে আমি তোমায় একটা সুযোগ দেব। অর্থাৎ খেলায় আমি হেরে গেলে তোমার সঙ্গে যাব। কিন্তু আমি জিতে গেলে তোমার প্রাণ যাবে। দেখ রাজামশায়, এই শর্তে খেলতে রাজী আছ তো?’
– খেলাটা কি? একটু বুঝিয়ে বলো?
– বিশেষ কিছু নয়। তুমি যখন আমায় বয়ে নিয়ে যাবে, আমি চুপ না থেকে একটা করে গল্প শোনাব। গল্পের শেষে তোমায় একটা প্রশ্ন করবো। তুমি ভুল উত্তর দিলে তোমার ঘাড় মটকাব। আর ঠিক উত্তরে আমি আবার গাছে ফিরে যাব। আর তুমি আবার আমায় গাছ থেকে নামিয়ে আনবে।
– এটা কি ধরণের খেলা? আমি সঠিক উত্তর দিলে বড় জোর আমি প্রাণে বাঁচবো। কিন্তু তোমাকে সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যাওয়ার কি হবে? আমি তো সন্ন্যাসীর কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।
– ভালো করে শোনো। তুমি যদি আমার চব্বিশ’টা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারো, তবেই আমি তোমার সঙ্গে সন্ন্যাসীর কাছ পর্যন্ত যাবো।
– বাঃ, রাত্রি দ্বিপ্রহরের মধ্যে তোমার দেহ পৌঁছে দেওয়ার কথা। এই খেলায় যদি আমি জিতেও যাই, তাহলেও তো সারা রাত গড়িয়ে যাবে।
– না, যাবে না। আমার অসীম ক্ষমতা। আমার অনিচ্ছায় তুমি আমায় তো বহন করে নিয়ে যেতে পারবে না, আমি গেলে যাব নিজের ইচ্ছায়। আর তখনই আমার যাওয়ার ইচ্ছা হবে যখন দেখব তুমি এর যোগ্য। তুমি বুঝতে পারবে না, কিন্তু ঘটনাগুলি ঘটবে অতি দ্রুত, তুলনায় পৃথিবীতে সময় বয়ে চলবে অতি ধীরে। ফলে সমস্ত কিছু ঘটে যাবে মুহূর্ত কালের মধ্যে।
চন্দ্র ভেবে দেখলো, মৃতদেহ সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যেতে এই অসম প্রস্তাবে রাজী হওয়া ছাড়া আর কোনই উপায় নেই। অতঃপর শুরু হল চন্দ্রের জীবনকে বাজী রেখে বেতালের সঙ্গে বুদ্ধির খেলা।
******
চন্দ্র আর বেতালকে এই অবস্থায় রেখে সময়ের সরণি বেয়ে আমরা এবার কিছুটা পিছিয়ে যাব। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত তখন মাত্র কয়েক মাস হলো গত হয়েছেন এবং তাঁর জায়গায় সিংহাসনে আরোহণ করেছেন তাঁরই জেষ্ঠ পুত্র রামগুপ্ত।
রাজসভায় সম্রাট রামগুপ্ত অস্থির ভাবে পায়চারী করছেন। তাঁর রাজকাজে আজ কোন মন নেই। মহামন্ত্রী কাত্যায়ন কোন এক জরুরী বিষয়ে পরামর্শ নিতে এসে তিরস্কৃত হয়ে ফিরে গেছেন। কাত্যায়ন একজন অতি প্রবীণ রাজকর্মচারি, রামগুপ্তর পিতার সময় থেকেই তিনি মহামন্ত্রী, তাঁরই প্রকাশ্যে অপমান হয়েছে, সেনাপতি দেবদত্তও উদ্বিগ্ন। একটি জরুরী বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন, অথচ পরিস্থিতির চাপে রাজার কাছে যেতে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত, মহারাজকে বিষয়টি না জানালেই নয়।
বিষয় গুরুতর। রাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিম সীমানায় শক রাজা রুদ্রসিংহ নতুন করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ শুরু করেছেন। এর একটিই উদ্দেশ্য হতে পারে, মথুরা আক্রমণ। মহারাজ সমুদ্রগুপ্ত তাঁদেরকে বিতারিত করে যে মথুরা রাজ্য দখল করেছিলেন, সেই গ্লানি শকরা ভুলতে পারেনি, আপাতত তাঁরা সুযোগের অপেক্ষায়।
সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন শালপ্রাংশু, মহাভুজ, বৃষস্কন্ধ বীর। যুবা বয়সেই তিনি প্রায় শতখানেক যুদ্ধে জয়ী হয়ে সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তৃত করেছিলেন, এবং বহুল পরিমাণে। অবশেষে তাঁর দৃষ্টিগোচর হয় রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে যেখানে শক জাতি বিগত কয়েক’শ বছর বংশানুক্রমিক জমি অধিকার করে বসবাস ও রাজত্ব করছে। বিষ্ণুর উপাসক মহারাজ সমুদ্রগুপ্তর একান্ত বাসনা ছিল কৃষ্ণের জন্মভূমি মথুরাকে শকদের হাত থেকে উদ্ধার করা। অবশেষে নিদারুণ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর শকরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। দুঃখের বিষয়, মথুরা জয়ের আনন্দ উপভোগ করতে মহারাজ বেশীদিন বাঁচেন নি, মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে হঠাৎই তিনি দেহ রক্ষা করেন। তাঁর পুত্র বর্তমান মহারাজ রামগুপ্ত চিন্তামগ্ন, সমুদ্রগুপ্তর অবর্তমানের সুযোগে শকরা সম্ভবত মথুরা পুনর্দখলের পরিকল্পনা করছে।
মহারাজের মৃত্যুর পর তাঁর জেষ্ঠপুত্র রাম গুপ্তবংশের তৃতীয় সম্রাট। বাইশ বছরের যুবক, রাম পিতার মতই সুদর্শন, শক্তিশালী ও বড় যোদ্ধা, কিন্তু প্রশাসক রূপে তিনি এখনও নিজের দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন নি। অধিকাংশ সময়ই বিবেচনা নয়, আবেগের তাড়নায় সিদ্ধান্ত নেন। অনুমান যে আরও কিছুদিন অভিজ্ঞতা অর্জন করলে প্রশাসন সঠিক হবে। কিন্তু মূল বিপদের কারণ তাঁর চণ্ডাল রাগ। তখন কোন কাণ্ডজ্ঞান থাকে না, এমন অস্বাভাবিক কিছু করেন যার জন্য পরে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।
সেনাপতি দেবদত্ত মনস্থ করলেন যে সম্রাটের এই মানসিক অবস্থায় তাঁর কাছে সমস্যা নিবেদন করা অর্থহীন। বলা যায় না, হয়ত শকদের আক্রমণ করারই আদেশ দিয়ে দেবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেদের সেনাবাহিনীর যা প্রস্তুতি আর মনোবল, সেই অবস্থায় আক্রমণ তো দূর, আত্মরক্ষা করাও হয়তো প্রানান্তকর হবে। সমুদ্রগুপ্তের দেহান্ত হয়েছে এক বছর আগে, কিন্তু সৈন্যরা ঠিক মত বেতন না পেয়ে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে সুরু করেছে। অনেকেই শত্রুপক্ষে গিয়ে যোগ দিয়েছে। কিন্তু সম্রাটের সেদিকে হুঁশ নেই। তিনি বয়স্যদের নিয়ে ফুর্তিতে ব্যস্ত। দেবদত্ত ভাবলেন, বরং বিষয়টা যদি চন্দ্রের গোচরে আনা যায়।
সম্রাটের সহোদর ভাই চন্দ্র, বছর চারেকের ছোট, কিন্তু ইতিমধ্যেই বীরত্বের খ্যাতি অর্জন করেছেন। মহারাজ সমুদ্রগুপ্ত যখন মথুরা থেকে শকদের বিতাড়ণ করেন, সেই যুদ্ধে চন্দ্র তাঁর পিতা সমুদ্রগুপ্তর সহযোদ্ধা ছিলেন। সমুদ্রগুপ্ত তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে পুরস্কৃত করার কথা চিন্তা করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য, মথুরাবিজয় শেয হতে হঠাৎই সম্রাটের মৃত্যু হয়।
রামগুপ্ত সম্রাট উপাধি নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করলেন, কিন্তু রাজ্য পরিচালনায় তাঁর দক্ষতা তেমন ছিল না। রাজা হয়েই তিনি মনস্থ করলেন যে চন্দ্রকে দক্ষিণ দেশ অভিযানে পাঠাবেন, যেখানে তখন নাগেদের রাজত্ব। তাঁরা সহজ প্রতিপক্ষ নয়, তাঁরা রণ দুর্মদ, যুদ্ধ পিপাসু জাতি। তাঁদের বশ মানানো প্রায় অসম্ভব, সকলেই এই জাতিকে সমীহ করে। পূর্বতন সম্রাট সমুদ্রগুপ্তও নাগেদের থেকে নিরাপদ কূটনৈতিক ও সামরিক দূরত্ব বজায় রাখতেন। এখন রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তও উপযুক্তভাবে সুরক্ষিত নয়, শকেরা পিছিয়ে গেছে মাত্র, কিন্তু প্রতি আক্রমণের সুযোগের মুহুর্তের অপেক্ষায়। এমত অবস্থায় মথুরায় পরিকল্পিতভাবে শক্তি কেন্দ্রীভূত করে শকদের আক্রমণ প্রতিহত করাই রাজ্যের জন্য সঠিক হয়। কিন্তু নতুন সম্রাট সেটি না করে নতুন করে আবার নাগদের সাথে বৈরী করবেন? চন্দ্র সঙ্গত কারণেই এই অভিযানে রাজী নয়। মহামন্ত্রী ও সেনাপতিও চন্দ্রের মতেই সায় দিলেন। অবশেষে মহারাজ রামগুপ্ত এখনকার মত দক্ষিণ দেশ অভিযান বাতিল করলেন বটে, কিন্তু মনে মনে খুবই অসন্তুষ্ট হলেন।
চন্দ্র সেনাপতির বক্তব্য শুনলো। বিষয়টি গুরুতর, শকদের বিরুদ্ধে সে নিজে লড়াই করেছে। তাঁদের শৌর্যক্ষমতা সে জানে। মথুরা বিজয়ের পর এখনও তাঁর পাটলিপুত্রে ফেরা হয়নি, মথুরাকেই সাময়িক রাজধানী করা হয়েছে, কিন্তু এর অবস্থান সুরক্ষিত নয়। তিনটি দিকে শত্রুরাজ্য, হঠাৎ ঝটিকা আক্রমণ হলে রাজধানীরই অস্ত্বিত্ব সঙ্কটাপন্ন হবে। চন্দ্র ঠিক করলো সে নিজেই খবরটা নিয়ে রাজার কাছে যাবে। জরুরী আলোচনা দরকার। কিন্তু তার আর রাজাকে খবরটা দেওয়া হল না। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল।
রাজসভা এই মুহূর্তে প্রায় ফাঁকা, রাজা আর তাঁর কয়েকজন বয়স্য ছাড়া আর কেউ নেই। সম্রাট গম্ভীর, মুখ যেন ক্রোধে রক্তবর্ন। অস্থির পদচারণায় নিজের মনেই কিছু যেন বলছেন। অবস্থা দেখে শঙ্কিত চন্দ্র রাজার প্রিয় বয়স্যকে ডেকে সম্রাটের রাগের কারণ জিজ্ঞেস করলো।
বয়স্য সৌগত জানালো, ‘এইটুকু তো রাজ্য, কিন্তু স্পর্ধা দেখুন ঐ ত্রিগর্তের রাজার। তাঁর কন্যা নাকি অতীব সুন্দরী এবং তার বিবাহের বয়স হয়েছে। সংবাদ পেয়ে সম্রাট আমায় পাঠিয়েছিলেন দূত হিসেবে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে। প্রস্তাব দিয়েছিলাম,”আমাদের সম্রাট আপনাদের ত্রিগর্ত রাজের কন্যার পাণিগ্রহণ করতে মনস্থ করেছেন, আগামী আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়ায় শুভদিনে আপনি নিজ কন্যাসহ যদি মথুরায় আসেন, সেইদিনই বিবাহ সম্পন্ন হবে।” কোথায় এই সুসংবাদে রাজা আহ্লাদে আটখানা হবেন, আমায় পাদ্য অর্ঘ দিয়ে খাতির যত্ন করবেন, তা নয়, ত্রিগর্ত রাজ আমাদের সম্রাটের প্রস্তাবে সরাসরি না করে দিলো? আমি তো হতবাক! কারণ কি? জানতে চাইলে সেই দাম্ভিক রাজা বলে, “সম্রাটের প্রস্তাবে আমি সম্মানিত বোধ করছি, কিন্তু এই বিবাহ হওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টা ব্যক্তিগত, সম্রাটকে বলবেন আমি দুঃখিত, অসহায়, বিশেষ কারণে এই সম্বন্ধ স্বীকার করতে পারছি না। সম্রাট যেন আমাকে মার্জনা করেন।” ভাবুন একবার রাজার সাহস।
“আরও খবর পেলাম শকরাজ রুদ্রসিংহের সঙ্গে নাকি রাজকন্যার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। বুঝুন কাণ্ড, এই যাকে আমরা সেদিন কুকুরের মত তাড়ালাম মথুরা থেকে, সেই রুদ্রসিংহ।’
চন্দ্র বুঝলো, এই রাজসভার বয়স্যদের কারণেই সম্রাট বিপদগ্রস্ত হবেন। যাঁর কন্যাকে সম্রাজ্ঞীর সন্মানে নিমন্ত্রন করে নিয়ে আসার কথা ভাবা হচ্ছে তাঁর সঙ্গে কি একজন বয়স্য এরকমভাবে কথা বলতে পারেন? উচিত ছিল আগে মহামন্ত্রীর পরামর্শ মিয়ে কন্যার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া, এবং সবকিছু মনোমত হলে তারপর রাজপুরোহিত বা রাজজ্যোতিষীকে পাঠিয়ে সন্মানজনক প্রস্তাব দেওয়া। যাক, যা হবার তো হয়েই গেছে, এখন বিষয়টি মগধের সম্মানের ব্যাপার হয়ে গেছে। কিছু তো একটা করতেই হবে।
সম্রাট ওদিকে গর্জন করে চলেছেন। ‘কাল সকালেই আক্রমণ করব। ত্রিগর্তের রাজাটাকে ধরে এনে তার কন্যাকে সম্প্রদান করাতে বাধ্য করাব। এত সাহস, আমাকে অবজ্ঞা!’
চন্দ্র সম্রাটকে বললেন, ‘রাজন, শান্ত হোন, বিষয়টা আমি দেখছি।’
– হাঁ চাঁদু, পঁচিশ হাজার সৈন্য নিয়ে তুই ত্রিগর্ত আক্রমণ কর। রাজাটাকে ধরে আমার সামনে নিয়ে আয়। আমি দেখছি ওটাকে।
– রাজন, ত্রিগর্তকে শিক্ষা দিতে অত সৈন্যের দরকার নেই, কিন্তু আগে কি ঘটেছে বোঝা দরকার, ত্রিগর্ত রাজ হঠাৎ এমন আচরণ করলেন কেন? আপনি বিষয়টি আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমি ত্রিগর্তকে বুঝে নিচ্ছি।
– তুই যা ইচ্ছা কর, কেবল একটা কথা জেনে রাখ চাঁদু, ত্রিগর্তের মেয়েকে সাত দিনের মধ্যে আমার সামনে হাজির করতে হবে, এব্যাপারে আমি কোন অজুহাতই শুনবো না।
নিজের প্রাসাদে এসে চন্দ্র গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো। ত্রিগর্ত এক অতি ক্ষুদ্র রাজ্য, তার পক্ষে মগধ সম্রাটের প্রস্তাব ফেরানো সম্ভব নয় যদি না – – -, যদি না কোনো শক্তিশালী কেউ তার পিছনে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে সে?
ত্রিগর্তের পূর্বে মথুরা, দক্ষিণে আর পশ্চিমে শক আর উত্তরে কুশানদের রাজত্ব। কুশানরা এক সময় খুবই শক্তিশালী ছিল, কিন্তু এখন দুর্বল, মগধের সঙ্গে লড়াই করার অবস্থায় তাঁরা নেই। তাহলে কি শকরা? শকদের মদতেই ত্রিগর্তের এই সাহস? সম্ভাবনা নয়, এটাই নিশ্চিত ঘটেছে, বিশেষ করে সৌগত যা বলল তার পরে। অতএব সাবধান হতে হবে, যুদ্ধ খালি ত্রিগর্তের সঙ্গে নয়, পিছনে যে ছায়া দেখা যায় শকদের, মথুরা হারিয়ে যারা এখন আহত সিংহের মত ভয়ংকর হয়ে আছে।
ত্রিগর্তের রাজধানী পার্বতীপুর মথুরা থেকে ঘোড়ায় তিন দিনের মাত্র পথ, জঙ্গলে ভরা। পরের দিন তখনও ভোরের আলো ফোটেনি, চন্দ্র ত্রিগর্তের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে সেই জঙ্গলে ঢুকে পড়লো। নগরীর ঘুম ভাঙ্গতে অনেক দেরী। কাকপক্ষীও টের পেল না তাদের অভিযান। তার নিজের অধীনে সৈন্য সংখ্যা বিশ হাজার, কিন্তু সে সঙ্গে নিলো মাত্রই পাঁচশ বাছাই সৈন্য যারা শুধু সেরাই নয়, তার আজ্ঞাবহরা হাসিমুখে জীবন দিয়ে দেবে। বেশী সৈন্য সঙ্গে থাকলে শত্রুর নজরে আসার সম্ভাবনা।
ছোট রাজার কামারশালার প্রধান জম্বুকের কাল সারারাত খুব খাটুনী গেছে। পাঁচশ সৈন্যের অস্ত্র তাকে ঠিক করে দিতে হয়েছে, উপরন্তু ফরমায়েশ মত নতুন অস্ত্রও বানাতে হয়েছে। পঞ্চাশজন কারিগর রাতভোর কাজ করে সেইসব অস্ত্র তৈরি করে দিয়েছে। ছোটরাজা খুব খুশি। যাবার আগে একশ রৌপ্যমুদ্রা হাতে তুলে দিয়েছে। সবাই চলে গেছে, এখন আয়েশ করার উপযুক্ত সময়। দুপুর হতে চলেছে, জম্বুক কামারশালা ছেড়ে চললো মধুশালার উদ্দেশ্যে।
মধুশালার মালিকের নাম অতিশয়। জম্বুক বেশ কিছুটা পান করে ফেলেছে, অতিশয় জম্বুকের কাছে এসে বসল।
– কি ভাই জম্বুক, আজ এত ভোর ভোর? তুমি তো এত সকাল সকাল আসার লোক না। কারুর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে নাকি? এই, জম্বুক দাদাকে আর এক পাত্র মাধ্বী এনে দে, এটা আমার নামে।
জম্বু ঢক ঢক করে সেই মাধ্বী পান করে বলল, ‘না রে ভাই অতিশয়, ঝগড়া নয়, আজ সকাল থেকেই আমার প্রাপ্তি যোগ চলছে। এই যেমন তুমি আমায় মাধ্বী খাওয়ালে। আবার ভোররাতে ছোটরাজা আমায় শত মুদ্রা দান করেছে।’
– তাম্র মুদ্রা? ছোঃ, ও আর বড় গলা করে বলার কি আছে!
– আরে, না না, তামা নয়, রূপো। ছোট রাজা খুশি হয়ে একশ রূপোর মুদ্রা দিয়েছে।
– কি বাজে বকছ। ছোটরাজা তোমায় শত রৌপ্যমুদ্রা দিতে যাবে কেন? তাও আবার ভোর রাতে? রাজাদের দুপুরের আগে উঠতে দেখেছ কোনদিন। ধ্যাৎ, তোমার নিশ্চয় নেশা হয়েছে।
নেশাড়ুকে চটানোর সবচেয়ে ভাল উপায় হল তার নেশা হয়েছে বলা। জম্বুকও অজান্তেই সেই ফাঁদে পড়ল।
– কি, আমার নেশা হয়েছে? আমি বাজে বকছি? এই শর্মা এখনও দু ভাঁড় মাধ্বী খেয়ে নেবে। মধুশালায় এখন কেউ নেই, তাই তোমায় বলতে পারি, শোন তবে।
জম্বুক তৎক্ষণাৎ খুবই বড়াই করে সব কথা অতিশয়কে উজাড় করে দিল।
পরের দিন সকাল। মথুরা থেকে চল্লিশ ক্রোশ দক্ষিণ পশ্চিমে শকদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি। সেনা প্রধান নাহাপণ লক্ষ্য করলো মথুরার দিক থেকে উড়ে আসছে একটি পায়রা, পায়ের কাপড়ে বাঁধা জরুরী বার্তা।
(ক্রমশ)
*******
Add comment