সাহিত্যিকা

সেই Tradition সমানে চলেছে

সেই Tradition সমানে চলেছে
@ ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী, ১৯৮১ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

বড় বড় কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয়ের অভিজ্ঞতাটা একটু অন্যধরনের। একটু আলোচনা করা যাক।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। Crompton Greaves কলকাতার অফিসে কাজ করি। অফিস ক্লাবে নাটক করি। একটু আধটু এদিক ওদিক নিজের কবিতা পাঠ করি। বন্ধুবান্ধবরা গাছে তুলে দেয়, বলে বেড়ে হয়েছে! আত্মগরিমায় ব্যাঙ ফোলা হয়ে এরপর যখন গাছ থেকে নামতে যাই তখন দেখতে পাই, যে মইটার সাহায্যে গাছে উঠেছিলাম সেটা আর স্বস্থানে নেই। বন্ধুরা যাবার সময় মইটা কাঁধে করে নিয়ে চলে গেছে!!

তা এইসময়ে খবর পেলাম যে সুতারকিন স্ট্রিটের আনন্দবাজার অফিসে একটা Transformer-এর দরকার। লোড বেড়েছে। পুরোনো Transformer বদলিয়ে নতুন Transformer বসাবে – Higher Rating. গেলাম সেখানে। দেখলাম খুবই cramped site. ওই নির্দিষ্ট জায়গায় বড় size-এর Transformer ধরানো বেশ মুশকিল। Length (L) আর Width-এ (W) একফোঁটা extra জায়গা নেই। L & W বেড়ে গেলে maintenance-এর জন্য statutory clearance থাকবে না।তবে Height-এ(H) একটু flexibility আছে। Design-টা একটু critical হবে। Designer-এর সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে মালটা দাঁড়ালো।

Marketing-এর লোক কখনো order-কে মানা করে না। Order হচ্ছে লক্ষী। Crompton Greaves-এর Bombay’র Kanjur Marg Factory-তে কাজ করার সময় Plant Head ছিলেন প্রচন্ড রকম Market Oriented. উনি একটা কথা খুব বলতেন – Customer is always right because He has got money…..

অর্ডারটা ধরলাম।
আর Order Execution-এর সময় মাঝেমাঝে এমনিই চলে যেতাম আনন্দবাজার অফিসে। “দেশ” পত্রিকার সম্পাদকের ঘরটা তখন সাগরময় ঘোষের দখলে। দূর থেকে একবার ঘরটাই দেখেছিলাম। Technical Department-এর লোকজন বলতো যে Royal Bengal Tiger-এর খাঁচা। মাঝেমাঝে দু-একজন নামী-দামী লেখক-কবি চোখে পড়ে যেত – ব্যস তাতেই শান্তি। সুতারকিন স্ট্রিটের আনন্দবাজার অফিসে জায়গার খুব অভাব। ছোট ছোট কিউবিকলে নামী দামী লেখকরা বসে থাকেন। নড়াচড়ার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে।

তখন “দেশ” পত্রিকার কবিতা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন সুনীল গাঙ্গুলি।আর নীরেন চক্কত্তি মহাশয় “আনন্দমেলার” সম্পাদক ছিলেন বোধ হয় ।অপর্ণা সেন তখন সানন্দা’র founder “সম্পাদক”। অপর্ণা নিজেকে “সম্পাদিকা” হিসেবে মানতে রাজি ছিলেন না। তাই Male infected World-এ “সম্পাদক” পোস্টটি যে একটি neuter gender তানিয়ে তিনি ১৯৮০ সালে “সানন্দা”র জন্মমুহূর্ত থেকেই সোচ্চার। এইজন্যেই সানন্দা এখনও “সম্পাদক”-এর দ্বারা পরিচালিত, অন্য সব বাংলা মহিলা পত্রিকার মতো “সম্পাদিকা”র আশীর্বাদধন্যা নয়।

আনন্দবাজারের পরিচালন কমিটি চিরকালই ব্যতিক্রমী। তারা “দেশ” পত্রিকাকে “পুংলিঙ্গ” আর “আনন্দবাজার পত্রিকা”কে “স্ত্রীলিঙ্গ” হিসেবে বিবেচনা করে। এইজন্য আমরা পুজোর সময় “শারদীয়” দেশ আর “শারদীয়া” আনন্দবাজার পত্রিকার দেখা পাই।

যাইহোক, এত সব কিছু থেকে বোঝা যাচ্ছে যে আমি যে সময়ে আনন্দবাজার অফিসে ঘোরাঘুরি করতাম, সেই সময়টা আনন্দবাজার অফিসটা যাকে বলে চাঁদের হাট। ইচ্ছে করেই আমি একটু de-tour নিয়ে office-এর ভেতর দিয়ে site-এ যেতাম। উদ্যেশ্য একটাই যদি একবার সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি জগতের তারকাদের সাথে দেখা হয়ে যায়! ব্যস, ওইটুকুই।

অফিসে lunch-এর আড্ডায় আনন্দবাজার অফিসের গল্প শোনার লোকের অভাব হতো না। আমার সত্যি-মিথ্যে-কল্পনার মিশ্রণে বিবৃত গল্পে বেশ ভালই জমে উঠত আমাদের lunch টাইমের আড্ডাটা।

ইতিমধ্যে আমার কবিতার এক ভক্তপ্রহ্লাদ বন্ধু আমার মাথার পোকাটা নাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই যে এতদিন ধরে আনন্দবাজার অফিসে চক্কর কাটছিস, এতো রথী-মহারথীদের দেখছিস, একবার সাহস করে যা না সুনীল গাঙ্গুলীর কাছে। তোর লেখা দু-চারটে কবিতা হাতে ধরিয়ে দিয়ে আয় না! বলা যায় না, হয়তো দেশ-এ ছেপে বেরোতেও পারে। চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!?” আমি বললাম, “ক্ষেপেছিস! সুনীল গাঙ্গুলীকে পড়তে দেব আমার কবিতা! পাগল না বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস!” তখন CPM-এর রমরমা চলছে। কাজেই “পাগল না CPM” বলার সময় আসেনি। তবে সেই হার্মাদ CPM কিন্তু বছরকয়েক আগে আনন্দবাজারের গণেশ উল্টে দেবার চেষ্টা করেও “Bite the Bullet” phrase-টাকে সত্যপ্রমাণ করে was licking their wound! আনন্দবাজার অফিসকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেও CPM তাদের ব্যবসায় লালবাতি জ্বালাতে পারেনি। অসাধারন fight দিয়েছিল সেদিন আনন্দবাজার!

খাবার টেবিলে বন্ধুর কথাকে পাত্তা না দেবার ভান করলেও মাথার মধ্যে তার কথার ঘুণপোকাটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। স্বপ্নে দেখতে থাকলাম সুনীল গাঙ্গুলী আমার কবিতা পড়ে যাকে বলে উচ্ছ্বসিত! আমাকে ওনার ঘরে কোথায় বসাবেন, কোথায় রাখবেন এই নিয়ে প্রচণ্ড ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন! সুনীলের ব্যতিব্যস্ততা দেখে সাগরময় ঘোষ পর্য্যন্ত তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন, রীণাদি দেখলাম তাঁর ঘর থেকে উঁকি মারছেন…….ইত্যাদি কত বিভিন্ন প্রকার স্বপ্নের গরু আকাশে ওড়ার দৃশ্য!

এই অবস্থায় একদিন অতিরিক্ত সাহস সঞ্চয় করে কয়েকটি স্বনির্বাচিত নিজস্ব কবিতা নিয়ে হাজির হলাম “সেইসময়ের এক বিখ্যাত কবির চোখের সামনে”। তিনি দেখলাম দেশ দপ্তরেরই এক ভদ্রমহিলার সাথে কবিতার পাতার art work নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। আমাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি চাই?” আমি ওই ভদ্রমহিলার সামনে কোন কথা বলতে চাইছিলাম না। কেমন বাধো বাধো ঠেকছিল। তবু জিভ চেটে কিন্তু কিন্তু করে বললাম যে কয়েকটা কবিতা এনেছি। একটু যদি দেখে দেন।

এইবার তিনি কেমন অবাক হয়ে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। যেন খাঁচায় রাখা আশ্চর্য্য জীব দেখছেন! তারপর ভদ্রমহিলাকে বললেন, “দেখ, ইনি আমাকে ওনার কবিতা পড়ে দেখতে বলছেন!” ভদ্রমহিলা ঠোঁটে দেখলাম একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। আমার তো মনে হলো বলি যে হে ধরণী তুমি দ্বিধা হও! কেন যে মরতে এলাম এখানে!! মনে মনে আমি সেই বন্ধুর চোদ্দ পুরুষের শ্রাদ্ধ করতে লাগলাম।

ইতিমধ্যে তিনি শুনলাম বলতে শুরু করেছেন, “আপনার কবিতা পড়ে আমার কি লাভ? আমি আমার সময় ব্যয় করে আপনার কবিতা পড়ে আমার কি লাভ হবে?” আমি এর উত্তরে কি বলব ঠিক ভেবে পেলাম না। জীবনে প্রচুর difficult customer handle করেছি। সব জায়গাতেই সঠিক উত্তর দেবার জন্য আমাকে কোনদিন কথা খুঁজতে হয়নি। সেদিন কিন্তু আমার কথা হারিয়ে গেছিল। যাই হোক, তিনি এরপর আমাকে বললেন, “আপনি আপনার কবিতাগুলো ওই reception-এর পাশে রাখা বাক্সে ফেলে দিয়ে যান। আমাদের দপ্তরে মনোনীত হলে খবর পাবেন।”

মুখ নিচু করে বেরিয়ে এসেছিলাম। বলতে পারিনি যে একদিন আপনিও আপনার লেখা এইরকম কয়েকটি কবিতা নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর “কবিতাভবন” নামাঙ্কিত বাসভবনে হাজির হয়েছিলেন। তারপর বুদ্ধদেব বসুর কাছ থেকে ঠিক এইধরণের response পেয়ে আপনিও আমার মতই এইরকম মুখ চুন করে ফিরে গেছিলেন।

অফিসে ফিরতে ফিরতে মনে হলো এস.ওয়াজেদ আলির সেই বিখ্যাত উক্তি – সেই tradition সমানে চলেছে।

এই ঘটনার পর আমার কোন লেখা ছাপানোর অনুরোধ নিয়ে আর কোনদিনই কোন সম্পাদকের দপ্তরে যাইনি।

©️ স্বামী ধ্রুবানন্দ

Sahityika Admin

Add comment