সাহিত্যিকা

মা কথা রাখে নি

মা কথা রাখে নি
@সঞ্জয় বসু, ১৯৯০ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

ছোটবেলায় নাগের বাজারে রথের মেলা বসত। রাস্তার দুদিকে রাতারাতি গজিয়ে উঠতো হরেক রকম দোকান। বেশ বড় মাপের জগন্নাথের রথ রাস্তার মাঝ বরাবর টেনে নিয়ে যেত। রাস্তায় সে কি ভিড়! লোকে লোকারণ্য! কোথা থেকে রথের টানা শুরু হতো আর কোথায় গিয়ে যে শেষ হতো, সে কথা আমার কখনো জানা হয় নি। রথ নাগেরবাজারের মোড় অব্দি এসে, তারপর মুখ ঘুরিয়ে উল্টো দিকে চলে যেত, এটা খেয়াল আছে। সব বাড়ির লোকেরা আমার মতন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে রথের মেলায় যেত। বাচ্চারা ফিরত হাতে ভেঁপু, বাঁশি, চরকি বা আস্ত একটা রথ টানতে টানতে।

কিন্তু আমার মেলায় যাওয়া হত না। অনেক কারণ। তোমরা হয়ত কিছু কিছু জানো। নাই বা বললাম সে সব মন খারাপের কথা। মা স্নান করে উঠে ঠাকুরের আসনের সামনে দুই হাত আঁচলে ঢেকে অনেকক্ষণ জপ করত। আঙুলের গুনতির সাথে সাথে আঁচলের কাপড়টাও একটু একটু নড়ত। আমি সেই দিকে তাকিয়ে বসে থাকতাম চুপ করে যতক্ষন না কাপড় নড়া শেষ হয়। এই সময় আমার মুখের তুবড়ি বন্ধ হয়ে যেত নিজে থেকেই। যতই ব্যস্ততা থাকুক, এই নিয়মটা থামতে দেখিনি কখনো।

একবার মা’কে ধরে পড়লাম আমায় নিয়ে যেতেই হবে। সেদিন আমি নাছোড়বান্দা। যেতেই হবে মেলায় আমাকে নিয়ে। অগত্যা মা নিয়ে চললো আমাকে। আমি আর মা, ব্যাস। মা পইপই করে বলে দিল, প্রচুর ছেলে মেলায় চুরি যায়, হাত যেন কিছুতেই না ছাড়ি। একবার ছেড়ে গেলে, চোরেরা দূর দেশে নিয়ে গিয়ে ছেলে বেচে দেয়, হাত পা ভেঙে দিয়ে জোর করে ভিক্ষে করায়! শুনে বুকটা কেঁপে উঠলো। মায়ের থেকে আমাকে কেড়ে নেবে? মায়ের হাত ধরেই থাকবো না হয়! মা বেরোবার আগে কি একটা চিরকুট লিখে পকেটে গুঁজে দিলে। কি ওটা, জিজ্ঞেস করতে, বললো, ‘কিছু না, হাত যেন না পড়ে এইটায়!’ বোধহয় আমাকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো মন্ত্র। ঠিক আছে, নাই বা দিলাম হাত!

মেলায় কি লোক রে বাবা। কতশত দোকান! ঠেলা ঠেলি ধাক্কা ধাক্কি, তার মধ্যে বাজারের ষাঁড়টাও ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ষাঁড়টাকে একবার দেখেছিলাম রবিবারের সকালের বাজারে, সরু গলির মধ্যে একটা গরুর পিঠে চড়ে চলার রাস্তা আটকে কি সব করছে। বড়রা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। এরপর ষাঁড় আর গরু চলে গেল। মানুষও যে যার কাজে গেল। বাজারের শোরগোল কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ ছিল, আবার জোরদার “পটল তিরিশ পয়সা কিলো!” …… চিৎকার শুরু হয়ে গেলো!

যাই হোক, মেলায় গিয়ে আমরা ষাঁড়, আইসক্রিমের ঠেলা গাড়ি, রাস্তার গর্ত বাঁচিয়ে এগিয়ে চললাম। দোকানে দোকানে নানান রকমের খাবার, কত রকম গন্ধ। রথের দিন একপশলা বৃষ্টি ছিলো অবধারিত। তাড়াতাড়ি ছাতা বার করে মা আমায় বাঁচালো, তবে মায়ের শাড়ি বেশ খানিকটু ভিজে গেল। ধুলোর গন্ধ পাল্টে গিয়ে ভিজে মাটির গন্ধ এল। ভিড়ের মধ্যে এক হাতে আমায় ধরে, এক হাতে ছাতা, কাঁধে বটুয়া, সব সামলে আর না পেরে শেষে আমায় নিয়ে মা ভারত সুইটস-এ ঢুকলো। সেখানেও ভিড়। দোকানে কাঠের পায়াওয়ালা শ্বেতপাথরের টেবিল ছিল। কেউ একজন মাকে জায়গা খালি করে দিলে আমায় কাঠের চেয়ারে বসিয়ে মা নিজে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। খালি তো আর বসে থাকা যায় না, খাবার অর্ডার করতে হয়। একটা করে সিঙ্গাড়া, আর দুটো করে জিলিপি। জিলিপি বিশেষ খাওয়া হতো না। কালেভদ্রে মিষ্টি এলে, সেটা রসগোল্লাই হত। গরম জিলিপি আর গরম সিঙ্গাড়া, উফফ কি বলবো তোমাদের, এত তারা-তকমা হোটেলে খাই আজকাল, সেই স্বাদ আর পাই না।

বৃষ্টি একটু ধরলে আবার মেলা জোরদার শুরু হয়ে গেলো। মেলার রথও তখন প্রায় সেখানে এসে পড়েছে। রথের দেবতার কাছে ভক্তরা ধাক্কা-ধাক্কি করে পুজো দিচ্ছিল। মাকে কখনও কোনো পুজো দেবার ভীড়ে ঠেলাঠেলি করতে দেখিনি। মা বলত, “ঠাকুর বলেছেন, ধর্ম্ম – মনে, বনে, কোণে”।

রথের মেলায় সেদিন যেন অনেক বেশি ভিড়। অবশ্য আমি আর কি জানি, কখনো যাই নি তো আগে! মাইকের আওয়াজে কান পাতা দায়। ঘুরে ঘুরে অনেক দোকান দেখে ফেরার আগে মা বললো, ‘চল একটা পুতুল কিনি।’ আমাদের পুতুল কেনার চল ছিল না। সংসারের চাহিদা মেটাতেই মায়ের হালত খারাপ হয়ে যেত। আমার পুতুল ভালোও লাগে না। তবুও, ঠিক আছে, খালি হাতে তো বাড়ি ফেরা যায় না? এই ভেবে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলের দোকানে গেলাম। পুতুলগুলো, কি বলবো তোমাদের, হ্যাজাকের আলোয় একদম জীবন্ত মনে হচ্ছিল! যেন “গালিভার্স ট্রাভেলস” এর লিলিপুটের দেশের নাগরিক সব।

মা দোকানের জিনিসে হাত দিত না বিশেষ। একটু ভেবে নিয়ে একজোড়া বুড়ো-বুড়ি পুতুল কিনল। বুড়িটা মোটা আর ফর্সা, দিদুনের মত। বুড়োটা দাদুর মত কালো বটে, কিন্তু খুব মোটা। দাদুর মত পেটা চেহারা নয়। আমি একটু পেছন দিকে ছিলাম, লোকের ধাক্কায় সামনে থাকা দায়! সবাই সব পুতুল নেড়ে চেড়ে দেখে কিনতে চায়। মা বলল, “দাঁড়িয়ে থাক, নড়িস না, পয়সা টা দিয়ে দি”। এই বলে আমার হাত ছেড়ে ব্যাগ খুলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ এক বিষম গোল শুরু হলো। মানুষ-জন সবাই মিলে রথ টাকে উল্টো দিকে ঘোরাচ্ছে এবার। একটা প্রচণ্ড মানুষের ঢেউয়ের ধাক্কা এসে লাগলো। মা হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে দোকানের পাটাতন ধরে তাল সামলালো। আর আমি সেই বিপুল জনস্রোতের ঠেলায় মুহূর্তের মধ্যে যে কোথায় চলে গেলাম, ঠাহর করতে পারলাম না। লোককে ধরে টাল সামলাতে সামলাতে মাকে খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলাম। দেখলাম মায়ের ছাপা নীল পাড় সাদা শাড়ির আঁচল কিরকম তাড়াতাড়ি ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। এক দারুন ভয়ে বুকের মধ্যে এমন হাতুড়ির বাড়ি পড়তে লাগলো যে, মা-মা চিৎকার করলেও, আওয়াজ হলো না বেশি। ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে আসে! মানুষের কোমরের কাছে আমার মাথা, চারিদিকে ঘুরে মানুষের পেট-পিঠ ছাড়া আর কিছু দেখতে না পেয়ে, আতঙ্কে হাউ হাউ করে কান্না বেরিয়ে আসতে লাগলো। এমন কান্না আমি কখনো কাঁদিনি আর। এইবার তো ছেলেধরা নির্ঘাৎ নিয়ে গিয়ে হাত পা ভেঙে দেবে। বেচে দেবে কোথাও। খেতেই দেবে না হয়ত! বুক ঠেলে এমন কান্না উঠে আসতে লাগলো, যে আমার ভিড়ের সাথে লড়াই করার ইচ্ছেটাও চলে গেল। ভেসে চললাম যেদিকে ভিড় নিয়ে যায়।

খানিক বাদে ভিড়ের চাপ যেন একটু কমল। কোথাও মায়ের দেখা নেই। অচেনা জায়গা একেবারে! হঠাৎ কে যেন খপ করে আমার হাতটা ধরলে! “এই খোকা!” আমি ছেলেধরা বুঝে জোর করে তার হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করলেও, পারলাম না। এই আমার শেষ! লোকটা অন্য হাতটাও চেপে ধরল এবার! বলির পাঁঠার মত চিৎকার করে উঠলাম ‘মা! মাআ! মাআআ!’
লোকটা বললে, – এই খোকা। তোমার সাথে কে আছে? কাঁদছ কেন?
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে টানাটানি হ্যাঁচড়া হেঁচড়ি করতে লাগলাম পালাবার জন্যে। তার হাতটায় কামড়েও দিলাম একবার ভীষন জোরে।
-উঃ! বলে উঠলেও, হাতগুলো ছাড়লোনা লোকটা। বরং এমন করে চেপে ধরলো, যে কামড়ানোও গেল না আর ভিড়ের মধ্যে। টেনে নিয়ে চললো সে আমায় ভিড়ের মধ্যে দিয়ে। বিকট ভয়ে আমি আপ্রাণ মা-মা বলে চিৎকার করতে লাগলাম।

একটু বাদে একটা দোকানের মত জায়গায় নিয়ে এলো লোকটা আমাকে। সেখানে দেখি দুজন পুলিশ আর একজন মেয়ে পুলিশ বসে। সেখানে আমায় নিয়ে বসালে। পুলিশকে বললে, হারিয়ে গেছে বোধহয়।
আমার নাম সবাই জিজ্ঞেস করলেও, কান্নার দাপটে আমি কিছুই বলতে পারলাম না।
লোকটা এবার হাত ছেড়ে দিয়ে, কামড়ের জায়গাটায় হাত বোলালে। একটু রক্ত বেরিয়ে গেছে। মেয়ে পুলিশটা জিজ্ঞেস করলো, – কি হলো?
লোকটা বললে, ও কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে।
-ডেটল-তুলো দেব?
– আরে না না, ছোট ছেলে কামড়ে দিয়েছে ভয় পেয়ে। কিছু হবে না।

পুলিশগুলো প্রায় নির্বিকার। এরকম বোধহয় নিত্য দেখে। লোকটা আমার কাছে কোনো উত্তর না পেয়ে আমার জামা প্যান্টের পকেট হাতড়াতে লাগলো। আর আমি আপত্তি করলাম না। কান্না কমলেও ফোঁপানি থামে নি। তবুও একটু যেন আশার আলো দেখতে পেলাম। আর যাই হোক, ছেলেধরা তো নয়! তা হলে কি আর পুলিশের কাছে নিয়ে আসত? ডান দিকের পকেটে লোকটা সেই চিরকুটটা খুঁজে পেল। মায়ের মন্ত্র যেটা। ভুলেই গিয়েছিলাম এটার কথা।
হাতে নিয়ে লোকটা বললে, -আরে, এ তো মৃদুলাদির ছেলে।
– কে মৃদুলাদি? জিজ্ঞেস করলে মেয়ে পুলিশটা।
– আরে, ক্রাইস্ট চার্চের দিদিমণি। আমার মেয়ে তো পড়ে ওই স্কুলে। চিনি তো ওনাকে!
ব্যাস, আর কি, মাইকে ঘোষণা হতে লাগলো চারিদিকে,
– ক্রাইস্ট চার্চের মৃদুলাদি, আপনি যেখানেই থাকুন, ইত্যাদি!

খানিক বাদে হন্তদন্ত করে মা এসে হাজির। চেহারায় একরাশ দুশ্চিন্তা আর ভয়। আমায় দেখে একটু নিশ্চিন্ত হলো। আমার চেয়ারের সামনে মা হাটু মুড়ে বসে পড়ে বললো, – কোথায় ছিলি এতক্ষন? লাগে নি তো কোথাও?
আমার কান্না আবার ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো! একটাই কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম বার বার। – মা আমার হাত আর ছেড়ে দেবে না তো? আমার হাত ছেড়ে দেবে না তো আর?
অনেক স্নেহে আদরে মা আমার মাথায় গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললে, – না বাবা, তোমার হাত আমি আর ছাড়বো না। শক্ত করে ধরে থাকব তোমার হাত! আর কেঁদো না।

মা কথা রাখে নি।
আমার হাত ছেড়ে, জগৎ ছেড়ে চলে গেছে বহুদিন হলো।
আমি জগতের মেলায় মানুষের ভিড়ে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে চলেছি পথ। ভেসে চলেছি।

 

Sahityika Admin

Add comment