সাহিত্যিকা

স্বল্পায়ু অপরিচিতা তরু দত্ত (১৮৫৬-১৮৭৭)

স্বল্পায়ু অপরিচিতা তরু দত্ত (১৮৫৬-১৮৭৭)
@সংকলক : দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮১, ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেন ইঞ্জিনিয়ারিং

তরু দত্ত, এই নাম বা তাঁর কাজের সাথে আমরা কতজন পরিচিত?
সেই আলোচনাই করা যাক।

লীলা মজুমদার একবার সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গে বলেছিলেন “ওঁর বাপ্-পিতেমোর মতো, সত্যজিৎ রায়ের সোনার কলমেও যে বে-পরোয়া জাদু থাকবে, তাতে আর আশ্চর্য কী !”* তাঁর এই কথাটা সম্পূর্ণরূপে প্রযোজ্য তরু দত্তের প্রসঙ্গেও। অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে কে এই তরু দত্ত? আজকে তার প্রসঙ্গে বা তার সোনার কলমের জাদু নিয়েই কিছু আলোচনা করতে চাই।

রায় পরিবারের সুকুমার রায়ের অকাল প্রয়াণ যেমন মেনে নেওয়া যায় না তেমনি ফরাসী, ও ইংরাজি সাহিত্যের বিশাল প্রতিভাময়ী তরুণী তরু দত্তের ২১ বছর বয়সের প্রয়াণও মেনে নেওয়া যায় না। মানতে পারেননি সংস্কৃত, ইংরাজি ও ফরাসী সাহিত্যের বিদগ্ধ পন্ডিতমহলও।

দত্ত পরিবার
তরুর পিতা গোভিন চন্দ্র দত্ত (১৮২৮-১৮৮৪) ছিলেন সেকালের ইংরাজি সাহিত্যের পন্ডিত। তিনি কবিতা লিখতেন। তাঁর লেখা অনেক কবিতা পাওয়া যায় ‘The Dutt Family Album’ -এ (১৮৭০ সালে প্রকাশিত)। ভাষা অবশ্যই ইংরাজি। ১৮৬২ সালে গোভিন চন্দ্র সপরিবারে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তরুর তখন ছ’বছর বয়স। কেন তাঁরা সপরিবারে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন সে বিষয়ে আলোচনা এখানে অবান্তর।

তরুর ঠাকুর্দা অর্থাৎ গোভিন চন্দ্রের পিতার পরিচয় দেওয়ার দরকার আছে বলেও মনে হয় না। তিনি ছিলেন তদানীন্তন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ রসময় দত্ত (১৭৭৯-১৮৫৪)। রসময় দত্ত ছিলেন ইংরাজি সাহিত্যেরও একজন অসাধারণ পন্ডিত। দেশে ইংরাজি শিক্ষার প্রসারে তাঁর বিশেষ অবদান ছিল। হিন্দু কলেজ তখন ছিলো সমস্ত ভারতবর্ষের ইংরাজি ভাষায় পাশ্চাত্ত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অর্থাৎ প্রকৃত ইংরাজি শিক্ষাবিস্তারের কেন্দ্রমূলে।

হিন্দু কলেজের প্রথম পরিকল্পনা করেন ডেভিড হেয়ার। ১৮১৭ সালের ২০-জানুয়ারী গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে কুড়িজন ছাত্র নিয়ে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়। সেই একই বছর ৪ জুলাই ইংরেজ ও বাঙালীদের নিয়ে একটা বেসরকারী সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়, নাম ‘কলকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি’। উদ্দেশ্য উচ্চমানের বাংলা ও ইংরাজি পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রচার। রসময় দত্ত ছিলেন এই কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় ও ইংরাজি শিক্ষার প্রসারে রসময় দত্তের বিশেষ অবদান ছিল। পরবর্তী কালে ১৮৫৪ সালের ১৫-মে হিন্দু কলেজ ভাগ হয়ে যায়; কলেজ-বিভাগ হল প্রেসিডেন্সি কলেজ, স্কুল-বিভাগ হল হিন্দু স্কুল।

দত্ত পরিবারের আর কয়েক জনের কথা না বললে দত্ত পরিবারের সাহিত্য প্রতিভার কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রথমেই যাঁর নাম আসে তিনি হলে তরুর কাকা শশী চন্দ্র দত্ত (১৮২৪-১৮৮৫)। ইনিও ইংরাজি সাহিত্য রচনা করেছিলেন। তাঁর রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর রসবোধ, সহজ ও স্বাধীন মুক্ত চিন্তার প্রকাশ। ‘Reminiscences of a Kerani’s life’ গদ্য রচনা বা ‘Vision Of Sumeru’ এবং ‘My Native Land’ কবিতাগুলো বিশেষ উল্লেথযোগ্য।

তরুর খুড়তুতো দাদা উমেশ চন্দ্র দত্ত (Omesh Chunder Dutt, ১৮৩৬-১৯১২) ছিলেন ফরাসী ও জার্মান ভাষার পন্ডিত। ইংরাজি সাহিত্য রচনা ছাড়াও তিনি ফরাসী ও জার্মান কবিতার ইংরাজি তর্জমা করেন। তাঁর বেশিরভাগ কবিতা পাওয়া যায় The Dutt Family Album-এ। তরুর আর এক খুড়তুতো দাদা রমেশ চন্দ্র দত্তের (১৮৪৮-১৯০৯) প্রশাসনিক দক্ষতার কথা বাদ দিয়ে শুধু সাহিত্য প্রতিভার কথা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। তাঁর অবিস্মরণীয় কাজ The History of Civilization in Ancient India, The Literature of Bengal (ইংরাজিতে) বা রামায়ণ ও মহাভারতের ইংরাজী কাব্যরূপ প্রকাশ করা ছাড়াও তাঁর সবথেকে বড় কাজ সংস্কৃত ঋগ্বেদসংহিতার বাংলা অনুবাদ। অনুবাদ করে রমেশ চন্দ্র সবসময় বিদ্যাসাগরের কাছে আসতেন, বিদ্যাসাগরের লাইব্রেরিতে বসে সংস্কৃত পুঁথি ঘাটতেন, বিদ্যাসাগরের উপদেশ নিতেন। উল্লেখযোগ্য, একদল পন্ডিত (?) সেই সময় খুব রুষ্ট হয়েছিলেন। ঋগ্বেদের বাংলা অনুবাদ হবে, সর্বনাশের আর বাকি কি! রব তুলেছিলেন – সর্বনাশ হয়ে গেল, ধর্ম লোপ হয়ে গেল।

কলকাতার দত্তপরিবার ছিল সেকালের রামবাগানের এক বিশাল বনেদি পরিবার। তাঁদের বাগমারীর বাগান বাড়িতে বিদেশী ভাষা চর্চার সঙ্গে চলতো কবিতার ছন্দ গাঁথা। এইরকম এক পরিবেশের মধ্যে তরু, তাঁর দিদি অরু ও দাদা অব্জু বড় হয়ে ওঠে। এই তিন ভাই বোনের মা অর্থাৎ গোভিন চন্দ্রের স্ত্রী ক্ষেত্রমণিও সাহিত্যের ভক্ত ছিলেন, অনেক পৌরাণিক কাহিনী তিনি জানতেন। পরবর্তী কালে তিনি একটি ইংরাজি বই The Blood of Jesus-এর বঙ্গানুবাদ করেন।

গোভিন চন্দ্র সরকারী উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়। তিনি সপরিবারে ১৮৬৩ সালে বোম্বে (মুম্বাই) ট্রান্সফার নিয়ে চলে যান। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ থেকেই যায়। অবশেষে, এক বছর বোম্বেতে থাকার পর, তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আবার সপরিবারে (১৮৬৪) কলকাতায় ফিরে আসেন। এরপরে নিজেকে তিনি সম্পূর্ণরূপে সাহিত্য চর্চা ও ধর্মীয় কাজে নিযুক্ত করেন। পরবর্তীকালে তিনি সাম্মানিক ম্যাজিস্ট্রেট হন। এরপরই গোভিন চন্দ্র ও ক্ষেত্রমণির জীবনে নেমে আসে এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগ। তাঁদের প্রিয় সন্তান অব্জু মারা যায় ১৮৬৫ সালে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে। সম্ভবত মারণ রোগ যক্ষ্মাতে (Tuberculosis) আক্রান্ত হয়ে। তখনও কিন্তু গোভিন ও ক্ষেত্রমণি জানতেন না, বা জানার কথাও নয়, যে এই যক্ষা রোগ তাঁদের জীবনে কি ভয়ঙ্কর অভিশাপ নিয়ে আসবে।
এই ছিলো পারিবারিক ভূমিকা। এবার তরুকে নিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক।

তরুর রচনা
তরু ছোটবেলায় গান শিখেছিলেন, এবং ভাল পিয়ানোও বাজাত পারতেন। ইংরাজি সাহিত্যের প্রতি ছিল তার বিশেষ অনুরাগ। তাদের বাগমারীর বাগান বাড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নিয়ে সনেটও লিখে ছিলেন। তরুর ছিলো সহজে বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করার এক অসীম ক্ষমতা। যদি প্রশ্ন করা হয় কোন বাঙালী মহিলা প্রথম ফরাসী ভাষায় উপন্যাস লিখেছেন? আপনি সচ্ছন্দে বলতে পারেন তিনি তরু দত্ত। উপন্যাসের নাম Le Journal de Mademoiselle D’Arvers (বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল তরুর মৃতুর পর ১৮৭৯ সালে, প্যারিস থেকে). ইংরাজি অনুবাদ পাওয়া যায়:The Diary of Mademoiselle D’Arvers. যদি প্রশ্ন করা হয় প্রথম কোন বাঙালী মহিলা শতাধিক ফরাসী কবিতার ইংরাজিতে অনুবাদ করেন? আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, তরু দত্ত। বইটির নাম : A Sheaf Gleaned in French Fields, (ফরাসী নাম: Une gerbe glanée dans les champs français). এই একটিমাত্র বই তরু বেঁচে থাকতে প্রকাশিত হয়, ১৮৭৬ সালে, ভবানীপুর, কলকাতা থেকে। ইন্টারনেটে বইটি হয়তো পাওয়া যায়। লোকে জানতে চাইতে পারে যে তরু দত্ত কি শুধুই ইংরাজি আর ফরাসী সাহিত্য নিয়েই কাব্য ও অনুবাদ রচনা করেছিলেন? আমাদের দেশের সংস্কৃতির ব্যাপারে তার কি কোন উৎসাহ ছিল না? তার উত্তরও খুব সহজ। তরু তার বাবার কাছে সংস্কৃত পাঠ নিয়ে আর মায়ের কাছে হিন্দু পুরাণের গল্প শুনে অনেক পৌরাণিক আখ্যানের ইংরাজি অনুবাদ করেছিলেন। তরুর লেখা পাওয়া যায় “Ancient Ballads and Legends of Hindustan” বইটি থেকে (বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল তরুর মৃতুর পর ১৮৮২ সালে, লন্ডন থেকে)। তরুর সোনার কলমে সত্যিই জাদু ছিল।
কিন্তু এ সবই পরের কথা। একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক।

ইউরোপ যাত্রা
একমাত্র পুত্র অব্জুর মৃত্যু শোক ভুলতেই কিনা জানি না, দুই কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে গোভিন চন্দ্র ইউরোপ পাড়ি দেন। সালটা নভেম্বর ১৮৬৯। পৌঁছলেন দক্ষিণ ফ্রান্সের মার্সেই বন্দর হয়ে নিস (Nice) শহরে। প্রথম বাঙালী পরিবারের ইউরোপ যাত্রা। এই নিস শহরেই তরু আর অরু ফ্রান্সের এক আবাসিক স্কুলে ভর্তি হয়। শুরু হয় তাদের ফরাসী শিক্ষাও। শুধু ভাষা নয়, ফরাসী দেশের সামাজিক রীতিনীতি, ইতিহাস, নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী ও ফরাসী সাহিত্যের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়ও ঘটে। তরুর মতো অল্প বয়সের একটি মেয়ের পক্ষে ফরাসী সংস্কৃতিকে মনে প্রাণে আত্মস্থ করা কি ভাবে সম্ভব হল তা আজও গবেষণার বিষয়। এরপর নিস থেকে চলে এলেন ফ্রান্সের প্যারিস শহরে। সাকুল্যে এক বছর ফ্রান্সে ছিলেন গোভিন পরিবার। গোভিন তাঁর মেয়েদের সর্বদা বুকে আগলে রাখতেন। ফরাসী শিক্ষা অব্যাহত ছিল। এরপরে সপরিবারে এলেন লন্ডনে। ফরাসী আর ইংরাজি শিক্ষা একসাথে চলতে থাকল। লন্ডনে কোন স্কুলে যদিও ভর্তি হন নি, কিন্তু অরু আর তরু কেমব্রিজে থেকে মাঝে মাঝে পাঠ নিতেন। বীজ রোপণ হয়েছিল ফ্রান্সে, এবার লন্ডনে তরুর সোনার কলম থেকে বেরিয়ে এল ফরাসী উপন্যাস, ফরাসী কবিতার ইংরাজি অনুবাদ। এরপর ১৮৭৩ সালে গোভিন চন্দ্র সপরিবারে দেশে ফিরে আসেন।

গোভিন চন্দ্রের স্মৃতিচারণ থেকে পাই, তরু আর অরুর অপূর্ব গানের গলা আর পিয়ানো বাজানোর দক্ষতার কথা। আবার সংসারের সব খুঁটিনাটি কাজই দুই বোন মিলে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন, কোন কাজই তাদের কাছে ছোট ছিল না। আমরা আরও জানতে পারি তরুর অসাধারণ স্মৃতিশক্তির কথা। একবার যা পড়তেন বা শুনতেন তা স্মৃতিতে চিরস্থায়ী হয়ে যেত। বিদেশী শব্দ উচ্চারণেও থাকত না কোন জড়তা – সে ইংরাজি ফরাসী বা জার্মানি যাই হোক না কেন।

তরু তার বড় বোনকে আগলে রাখতেন। কে যে বড় আর কে ছোট, বোঝাই যেত না। দুজনের মধ্যে কিন্তু কোন চাপা প্রতিযোগিতাও ছিল না। ১৮৭৩ সালে গোভিন চন্দ্র তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। দুই বোনেরই শারীরিক অসুস্থতার কারণে। দুই বোনে মিলে ঠিক করলেন ফরাসী ভাষায় এবং ফরাসী দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে মাথায় রেখে একটা উপন্যাস লিখবেন তরু। আর বইয়ের প্রচ্ছদ ও সমস্ত ছবি আঁকবেন অরু। তরু তার কথা মত ফরাসী উপন্যাসটি লিখেছিলেন (Le Journal de Mademoiselle D’Arvers), কিন্তু বইয়ের ছবি আঁকার আগেই ১৮৭৪ সালের জুলাই মাসে, মাত্র কুড়ি বছর বয়সে অরু মারা যান। অকাল মৃত্যু-মিছিল ছিলো অব্যাহত। তরু ইতিপূর্বেই দাদা অব্জুকে হারিয়েছিলেন। এবার দিদি অরুকে হারিয়ে তরু হয়ে গেলেন ভয়ংঙ্কর একা। তাঁর দিদির উদ্দেশ্যে কিনা জানা নেই, তরু একটা ইংরাজি উপন্যাস লিখেছিলেন – Bianca, or The Young Spanish Maiden. তখনও এটি বই আকারে প্রকাশিত হয় নি।** এর কিছু কিছু অংশ Bengal Magazine (January – April ১৮৭৮) এ প্রকাশিত হয়। এই স্প্যানিশ তরুণী, বিয়ানকা গার্সিয়ার, গল্প যেন তরুর নিজের জীবনের কথা, নিজের অনুভূতির কথা। আশা আর আশাভঙ্গের গল্প। গল্পের শুরুটা এই ভাবে: ফেব্রুয়ারির এক ভয়ঙ্কর দিনে বিয়ানকা আর তাঁর বাবা মিলে বিয়ানকার দিদিকে (Inez) কবরে রেখে আসছে। শূন্য বাড়িতে ফিরে বিয়ানকার তীব্র মানিসিক যন্ত্রনা। মর্মান্তিক সেই দৃশ্য। তরুর এই লেখায় কি অরুকে হারানোর অনুভূতি ফুটে উঠেছিলো? এর উত্তর জানা নেই।

তরুর জীবনের শেষ কয়েকটি বছর
গোভিন চন্দ্রের স্মৃতিচারণ থেকে পাই: তরু দেশে ফিরে (১৮৭৩) তাঁর বাবার সাথে সংস্কৃত চর্চা শুরু করেন। সংস্কৃত পাঠ নিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তরু। কিন্তু শরীর ক্রমশই ভেঙে পড়তে থাকে। কাশি আর জ্বর লেগেই থাকে। এক বছরের মধ্যেই সংস্কৃত চর্চা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। তবু এই ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েই তরু বিষ্ণুপুরাণ থেকে কয়েকটি রচনা ইংরাজিতে অনুবাদ করেন (The Royal Ascetic and the Hind এবং The Legend of Dhruva). সেগুলি ছাপা হয়েছিল ‘Calcutta Review’ আর ‘Bengal Magazine’ পত্রিকায়।

একদিন কি ভাবে যেন তরুর চোখে পড়ে একটা ফরাসী বইয়ের বিজ্ঞাপন। ফরাসী সাহিত্যিক মাদমোয়াজেল ক্লারিস বাদের ( Clarisse Bader : 1840-1902) লেখা “La Femme dans L’Inde Antique” অর্থাৎ ‘প্রাচীন ভারতের মহিলা’। এই বইখানি তরুকে এতটাই আলোড়িত করে দিয়েছিলো যে সে মনস্থির করে এই বইটি ইংরাজিতে অনুবাদ করবে। বাবা তাকে বইটির এক কপি কিনে দিলেন। এবং বলেন, মা তুমি অনুবাদ কর, কিন্তু লেখিকার অনুমতি নিতে ভুল যেন না হয়।

তরু প্রথম যে চিঠিটি ফরাসীতে লেখিকা ক্লারিসকে লিখেছিলেন সেটি আজ বোধহয় আর পাওয়া যায় না, তবে ম্যাডাম ক্লারিসের লেখা তরুর প্রথম চিঠির উত্তর থেকে আমরা জানতে পারি যে তিনি সানন্দে তরুকে তাঁর বইয়ের অনুবাদ করার অনুমতি দেন। এরপর চলতে থাকে তরুর আর ম্যাডাম ক্লারিসের চিঠির আদান-প্রদান। একদিকে তরুর শরীর আরও খারাপ হচ্ছে, তিনি ম্যাডামের কাছে আরও কিছুদিন সময় চাইছেন তার অনুবাদ শুরুর জন্য, অন্যদিকে ম্যাডাম ক্লারিস ক্রমাগত তরুকে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন, তিনি তরুর অনুবাদের জন্য অপেক্ষা করতে প্রস্তুত। অন্য কোন অনুবাদককে তিনি তাঁর বই অনুবাদের অনুমতি দেন নি। কিন্তু তরু শেষ পর্যন্ত একটি লাইনও অনুবাদ করতে পারে নি। তখন সে শয্যাগত। কাশি আর জ্বর তাঁর সর্বক্ষনের সঙ্গী। তবুও তারই মধ্যে ম্যাডাম ক্লারিসের সঙ্গে চিঠির আদান প্রদান চলতে থাকল। উৎসাহী পাঠকেরা সেই চিঠিগুলো মূল ফরাসীতে বা ইংরাজিতে পড়ে দেখতে পারেন। তরুর আকুতি আর ম্যাডামের ক্রমাগত উৎসাহ এই চিঠিগুলোর এক অন্য মাত্রা এনে দেয়। একটি পঙক্তিও অনুবাদ না করে তরু চলে গেলেন (১৮৭৭ সালের অগাস্ট মাসে) – শেষ হয়ে গেল বিস্ময় জাগানো একুশ বছরের এক বাঙালি তরুণীর সাহিত্যপ্রতিভা।

তরুর লেখা Le Journal de Mademoiselle d’Arvers সমাপ্তির অংশটুকু এইরকম: ‘গভীর দীর্ঘশ্বাসের সাথে সে [মার্গরিত] বলল “ভগবান আমাদের রক্ষা কর।” প্রতিদিন শুতে যাওয়ার আগে এই প্রার্থনাটা সে করে এসেছে তার ছোট বয়স থেকে। এবার সে চোখ বন্ধ করলো, ঠোঁট সামান্য খুলে গেল, আর তার শুদ্ধ আত্মা চলে গেল ভগবানের হৃদয়ে। মার্গারিত ঘুমিয়ে পড়ল। মৃত্যর ঘুমে।‘***

এ কি মার্গরিতার কথা না তরুর নিজের কথা? তরু কি নিজের মৃত্যুর আগমন শুনতে পেয়েছিলেন? তরু সম্মন্ধে ফরাসী সাহিত্যিকের কটা কথা তুলে দিলাম তরুকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাতে: The great French author, orientalist and critic James Darmesteter (1849–1894) says: “This daughter of Bengal, so admirably and so strangely gifted, Hindu by race and tradition, an Englishwoman by education, a Frenchwoman at heart, poet in English, prose-writer in French who at the age of eighteen made India acquainted with the poets of France in the rhyme of England, who blended in herself three souls and three traditions, and died at the age of twenty (sic), in the full bloom of her talent and on the eve of the awakening of her genius, presents in the history of literature a phenomenon without parallel.”

তথ্য সংগ্রহ :
1. Life and Letters of Taru Dutt by Harihar Das
2. A Sheaf Gleaned in French Fields by Taru Dutt
3. Le journal de Melle d’Arvers par Taru Dutt
4. The Diary of Mademoiselle D’Arvers by Taru Dutta (translated from the French by N. Kamala. Publisher: Penguin Books)
5. Ancient Ballads and Legends of Hindustan by Taru Dutt
6. Women in Ancient India by Clarisse Bader.
7. করুণাসাগর বিদ্যাসাগর – ইন্দ্রামিত্র (আনন্দ পাবলিশার্স)

Web Site:
Internet Archive: Digital Library of Free & Borrowable Books. https://archive.org
https://en.wikipedia.org/wiki/Toru_Dutt

Notes:
* ফেলুদা সমগ্র ২ – ফেলুচাঁদ (সন্দেশ ‘ফেলুদা ৩০’ বিশেষ সংখ্যা (অগ্রহায়ণ ১৮০২) – লীলা মজুমদার
** Originally serialized in 1878, ‘Bianca or the Young Spanish Maiden’ is now available book form edited by Subhendu Mund (Bhubaneswar: Prachi Prakashan, 2001).
*** From the original French text of ‘Le Journal de Mademoiselle d’Arvers’ – written by Taru Dutt:
« Dieu nous ait en sa garde, soupira-t-elle. C’était son habitude depuis l’enfance de faire cette prière juste avant de s’endormir. Elle ferma les yeux ; ses lèvres s’entrouvrirent, et son âme pure s’envola par-là vers le sein de son Dieu, et Marguerite s’endormit du sommeil de la mort. »

 

 

 

Sahityika Admin

4 comments

  • সুন্দর একটা লেখা। তরু দত্ত সম্বন্ধে শুনেছিলাম – তবে ভাসা ভাসা । এই প্রবন্ধ পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। লেখা পড়ে বোঝা যায় অনেক পরিশ্রম করে লেখককে এই প্রবন্ধ লিখতে হয়েছে। লেখককে ধন্যবাদ।

  • সুন্দর একটা লেখা। তরু দত্ত সম্বন্ধে কিছু কিছু শুনেছিলাম – তবে ভাসা ভাসা। এই প্রবন্ধ পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। অনেক পরিশ্রম করে লেখক এই লেখা লিখেছেন। লেখককে ধন্যবাদ।

  • সুন্দর একটা লেখা। তরু দত্ত সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারলাম। অনেক পরিশ্রম করে লেখক এই লেখা লিখেছেন। লেখককে ধন্যবাদ।

  • খুব সুন্দর লেখা। বিস্মৃতপ্রায় তরু দত্ত সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারলাম। মনে হয় অনেক পরিশ্রম করে লেখক এই প্রবন্ধ লিখেছেন। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।