সাহিত্যিকা

রবীন্দ্রনাথের কন্যা (ধারাবাহিক) (প্রথম পর্ব দামিনী)

রবীন্দ্রনাথের কন্যা (ধারাবাহিক) (প্রথম পর্ব দামিনী)
@অমিতাভ দত্ত, ১৯৭০ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

বিদ্বজ্জনেরা মনে করেন “গোরার” পর থেকে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে ভাবগত পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। প্রতিটি উপন্যাসের স্ত্রী চরিত্রের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সৃজন ক্ষমতা অভিনব রূপে প্রকাশিত। দামিনী, বিমলা, এলা, কুমুদিনী, এবং লাবণ্য – স্মরণীয় এই চরিত্রগুলি সেই সময়ের সমাজে ও পাঠকের মনে বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। প্রতিটি উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, রচনার মৌলিকতা এবং ক্রমপ্রসারতার পরিচয় দিয়েছেন।

এই আলেখ্যে আমি দামিনী, বিমলা ও ল্যাবরেটরি গল্পের সোহিনী কে নিয়ে কিছু কথা লেখার চেষ্টা করেছি।

প্রথম পর্ব – দামিনী
দামিনী চরিত্রের সৃষ্টি চতুরঙ্গ উপন্যাসে। ঘরেবাইরে এবং চতুরঙ্গ এই দুটি উপন্যাসই ১৯১৬ সালে প্রথমে “সবুজপত্রে” ধারাবাহিকভাবে এবং পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। সবুজপত্র প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে। ঐ বছরে আগস্ট মাসে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় ঘটনার প্রভাব ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উপর ছিল সুগভীর। বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের উপর সবুজপত্রেরও প্রভাব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

চতুরঙ্গ ও ঘরেবাইরে লেখার আগে রবীন্দ্র্রনাথ শেষ উপন্যাস লেখেন গোরা, ছ’বছর আগে। চতুরঙ্গ উপন্যাসের আগে রবীন্দ্রনাথ নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনীকে বিশ্লেষণ করতেন কিন্তু চতুরঙ্গে তিনি সেই ছক ভাঙেন। এই উপন্যাসের এক চরিত্র্রের (শ্রীবিলাস) বয়ানে কাহিনীর বয়ন ও বিশ্লেষণ করেন।

চতুরঙ্গ উপন্যাসটি শচীশ, দামিনী, ও শ্রীবিলাস, মুখ্যত এই তিনটি চরিত্রের হলেও লীলানন্দ স্বামী এবং উপন্যাসের গোড়ার দিকে জ্যাঠামশায় (জগমোহন), এই দুই চরিত্রেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। শচীশের অকৃতদার জ্যাঠামশায় জগমোহন ছিলেন নামজাদা ইংরেজিনবীশ এবং তেমনই নামজাদা নাস্তিক। তিনি না–ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। শচীশকে বড় করেছিলেন তার জ্যাঠামশায়। ফলে সেও হয় ইংরেজিতে তুখোড় আর ঘোর নাস্তিক।

শ্র্রীবিলাস পাড়াগাঁ থেকে ক’লকাতায় পড়তে এসে যে কলেজে ভর্তি হ’ল সেখানে শচীশ বিএ পড়তো। শচীশের ব্যক্তিত্ব ও মেধা এমনটাই ছিল যে শ্রীবিলাস নিজে থেকে তার সঙ্গে আলাপ করলো এবং শীঘ্রই সেই আলাপ প্রগাঢ় বন্ধুত্বে পরিণত হলো। শচীশের মতো শ্রীবিলাসও হলো তুখোড় ইংরেজিনবীশ এবং ঘোর নাস্তিক। কালক্রমে শ্রীবিলাস প্রেমচাঁদ – রায়চাঁদ বৃত্তিও অর্জন করলো।

সেই সময়ে দামিনীর বাবা অন্নদাপ্রসাদ পাটের ব্যবসায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন এবং শিবতোষের সঙ্গে দামিনীর বিবাহ দেন। অন্নদাপ্রসাদ জামাইকে ক’লকাতায় একটি বাড়ি, খাওয়া-পরার সংস্থান এবং প্রচুর গহনাপত্র দেন। শিবতোষকে তিনি নিজের আপিসে কাজ শেখানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শিবতোষের সংসারে মন ছিল না। জীবন্মুক্তির প্রত্যাশায় সে কাঞ্চন এবং অন্যান্য রমনীয় পদার্থের লোভ পরিত্যাগ করে লীলানন্দ স্বামীর কাছে মন্ত্র নিল।

অন্যদিকে কেমন ছিল দামিনী?
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “দামিনী যেন শ্রাবণের মেঘের ভিতরকার দামিনী। বাহিরে সে পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবনে পরিপূর্ণ; অন্তরে চঞ্চল আগুন ঝিকমিক করিয়া উঠিতেছে। “এবং“ সে নারী মৃত্যুর কেহ নয়। সে জীবনরসের রসিক। বসন্তের পুষ্পবনের মতো লাবণ্যে গন্ধে হিল্লোলে সে কেবলই ভরপূর হইয়া উঠিতেছে; সে কিছুই ফেলিতে চায় না…………..সে উত্তুরে হাওয়াকে সিকি পয়সার খাজনা দিবে না পণ করিয়া বসিয়া আছে।“

দামিনীর স্বাভাবিক দেহজ কামনা বাসনা ছিল। বলা যায় – Perhaps the marriage of Damini and Shibotosh was never consummated, সুতরাং বিবাহিত জীবনে দামিনী ছিল অতৃপ্ত, অসুখী। ওদিকে অন্নদার ব্যবসায় হ’ল ভরাডুবি। বাড়িঘর সব বিক্রি হয়ে গেলো। প্রায় অভুক্ত অবস্থা। অথচ তখনও দামিনীকে প্রত্যহ ষাট সত্তর জন ভক্তের সেবার অন্ন নিজের হাতে প্রস্তুত করতে হ’তো। এমনটাই ছিল ভক্তির দস্যুবৃত্তি। এইসব কারণে দামিনীর মনে জন্মালো ভক্তিবাদের বিরুদ্ধে চরম বীতরাগ। শিবতোষ মারা যাওয়ার সময় ক’লকাতার বাড়ি ও সম্পত্তি নিজের অল্পবয়সের নিঃসন্তান স্ত্রী দামিনীকে বঞ্চিত করে তাঁর গুরু লীলানন্দ স্বামীকে দিয়ে যায়।

জ্যাঠামশায়ের প্লেগ রোগে মৃত্যুর পরে শচীশের খোঁজ পেতে শ্রীবিলাসকে অপেক্ষা করতে হ’ল আরো দু’বছর; শচীশ তখন লীলানন্দ স্বামীর শিষ্য এবং চাটগাঁয়ের কাছে গুরুর সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় করতাল বাজিয়ে কীর্তন করে নেচে বেড়ায়। শ্রীবিলাস খুঁজে বার করে শচীশকে আর তারপরে সেও সামিল হয় লীলানন্দ স্বামীর দলে। তবে তার ভক্তি, কীর্তন ইত্যাদির বহর ছিল কিছু কম।

এবার রবীন্দ্রনাথ লীলানন্দ স্বামীকে আনলেন ক’লকাতায়। শচীন শ্রীবিলাসসহ গুরুজি অধিষ্ঠিত হলেন শিবতোষেরই বাড়িতে যেখানে দামিনীও থাকে। এরপরে জটিলতা বাড়ে আর উন্মোচিত হয় দামিনীর চরিত্র আর ব্যক্তিত্ব যখন সে গুরুজির অস্তিত্বকই অস্বীকার করে। যদি লীলানন্দ স্বামী দামিনীকে উপদেশ দেওয়ার জন্য ডাকতেন সে বলতো তার মাথা ধরেছে। গুরুজির সেবাযত্নের ব্যাপারে সে ছিল উদাসীন ও নিষ্ক্রিয়। এইভাবেই কিছুদিন চলার পরে যা ঘটে শ্রীবিলাসের বয়ানে সেটা এইরকম, “বিদ্রোহের কর্কশ আবরণটা কোন ভোরের আলোতে নিঃশব্দে একেবারে চৌচির হইয়া ফাটিয়া গেল। আত্মোৎসর্গের ফুলটি উপরের দিকে শিশির ভরা মুখটি তুলিয়া ধরিল। দামিনীর সেবা এখন এমন সহজে এমন সুন্দর হইয়া উঠিল যে তার মাধুর্যে ভক্তদের সাধনার উপরে ভক্তবৎসলের যেন বিশেষ একটি বর আসিয়া পৌঁছিল।” শচীশের নজরেও এই পরিবর্তনটা এসেছিল কিন্তু দামিনী আসেনি – “এমনি করিয়া দামিনী যখন স্থির সৌদামিনী হইয়া উঠিয়াছে, শচীশ কেবল শোভাই দেখিল, দামিনীকে দেখিল না”

প্রশ্ন ওঠে দামিনীর এহেন পরিবর্তনের কারণ কী ছিল? তার উত্তর পাওয়া যাবে উপন্যাসের সেই অংশে “একদিন শীতের দুপুরবেলায় গুরু যখন বিশ্রাম করিতেছেন এবং ভক্তেরা ক্লান্ত, শচীশ কী একটা কারণে অসময়ে তার শোয়ার ঘরে ঢুকিতে গিয়া চৌকাঠের কাছে চমকিয়া দাঁড়াইল। দেখিল দামিনী তার চুল এলাইয়া দিয়া মাটিতে উপুড় হইয়া পড়িয়া মেজের উপর মাথা ঠুকিতেছে এবং বলিতেছে, পাথর ওগো পাথর, ওগো পাথর, দয়া করো, দয়া করো, আমাকে মারিয়া ফেলো।” অতএব বলা যেতে পারে শচীশের প্রতি দামিনীর আকর্ষণ (মানসিক ও দৈহিক) এনেছিল সেই পরিবর্তন।

দামিনী বিধবা। শচীশের প্রতি দামিনীর জৈবিক আকর্ষণ তার পরবর্তী পর্যায় ছিল বিস্ফোরক। লীলানন্দ স্বামী শচীশ শ্রীবিলাস এবং দামিনী গিয়েছিল সমুদ্রের মধ্যে এক নির্জন অন্তরীপে যেখানে একটি ছোট পাহাড়ের গায়ে ছিল অনেক কাল আগে খোদিত এক গুহা। কথা ছিল সেই গুহা দেখে তারা ফিরবে লোকালয়ে। কিন্তু তখন দিন হ’য়ে এসেছিল শেষ আর সেদিন ছিল কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশী। গুরুজি মনঃস্থির করেন সেই গুহাতেই রাত কাটাতে হবে।
সূর্যাস্তের সময় সমুদ্রের বালুচরে বসলো দামিনী আর শ্রীবিলাস। আর বসলেন গুরুজি; গান ধরলেন তিনি,
“পথে যেতে তোমার সাথে, মিলন হল দিনের শেষে।
দেখতে গিয়ে সাঁঝের আলো, মিলিয়ে গেল এক নিমিষে।
দেখা তোমার হোক বা না হোক
তাহার লাগি করব না শোক।
ক্ষণেক তুমি দাঁড়াও – তোমার চরণ ঢাকি এলোকেশে”

এই গানটির প্রভাব দামিনীর উপর হয়েছিল গভীর। পরের ঘটনা শচীশের কথায়, “গুহার মধ্যে অনেকগুলি কামরা। আমি তার মধ্যে একটাতে কম্বল পাতিয়া শুইলাম। সেই গুহার অন্ধকারটা যেন কালো একটা জন্তুর মতো – তার ভিজা নিশ্বাস যেন আমার গায়ে লাগিতেছে। আমার মনে হইলো সে যেন আদিম কালের প্রথম সৃষ্টির প্রথম জন্তু; তার চোখ নাই কান নাই। কেবল তার মস্ত ক্ষুধা আছে………………জানি না কতক্ষণ পরে – সেটা বোধকরি ঠিক ঘুম নয় – অসাড়তার একটা পাতলা চাদর আমার চোখের উপর ঢাকা পড়িল। এক সময় সেই তন্দ্রাবেশের ঘোরে আমার পায়ের কাছে প্রথমে একটা ঘন নিশ্বাস অনুভব করিলাম। ভয়ে আমার শরীর হিম হইয়া গেল, সেই আদিম জন্তুটা………..তার পরে কিসে আমার পা জড়াইয়া ধরিল……………ভয়ে ঘৃণায় আমার কন্ঠ রোধ হইয়া গেল। আমি দুই পা দিয়া তাহাকে ঠেলিতে লাগিলাম। মনে হইল সে আমার পায়ের উপর মুখ রাখিয়াছে – ঘন ঘন নিশ্বাস পড়িতেছে – সে যে কীরকম মুখ জানি না। আমি পা ছুঁড়িয়া ছুঁড়িয়া লাথি মারিলাম…………..অন্ধকারে কে চলিয়া গেল। একটা কী যেন শব্দ শুনিলাম। সে কী চাপা কান্না?”

উপন্যাসের সেই রাত্রে শচীশের কামরায় যে গিয়েছিল সে ছিল দামিনী। সেই সময়ের এক বিধবা নারীর অবদমিত লিবিডোর বহিঃপ্রকাশ প্রদর্শন রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন নিঃসঙ্কোচে, নির্দ্বিধায়। আর গুহার সেই অন্ধকার কামরার মধ্যে শচীশের যে আতঙ্ক তার কারণ ছিল এটাই যে শচীশ ভয় পাচ্ছিল নিজেকেই। সেই “আদিম জন্তু” ছিল শচীনের অবচেতন মনে সুপ্ত আদিম রিপু, দামিনীর জন্য।

এই ঘটনার পরে দামিনীর ব্যবহারে ফিরে এলো তার আগের রূপ। “দামিনীর এলোখোঁপা বাঁধা ঘাড়ের দিকে, ঠোঁটের মধ্যে, চোখের কোণে এবং ক্ষণে ক্ষণে হাতের একটা আক্ষেপে একটা কঠোর ইশারা দেখা যাইতেছে……. দামিনীর ভুরুর মধ্যে কয়দিন হইতে একটি ভ্রুকুটি কালো হইয়া উঠিতেছে এবং তার মেজাজের হাওয়াটা কেমন যেন এলোমেলো বহিতে শুরু করিয়াছে।” দামিনীর এই পরিবর্তনের কারণ যে সেই রাতে শচীশের সঙ্গে মিলনের প্র্রচেষ্টার ব্যর্থতা, সেটা সহজেই অনুমেয়। এরপরে “চতুরঙ্গ” উপন্যাসের চলন হয় আঁকাবাঁকা। শচীশের প্রতি দামিনীর তীব্র আকর্ষণ জ্ঞাত ছিল শচীশের। কিন্তু তার তরফে যেটা ছিল সেটা ছিল চরম নিস্পৃহতা। তখন দামিনীর স্ট্র্যাটেজি হল শ্রীবিলাসকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার যাতে শচীশের মনে জন্মায় স্বাভাবিক ঈর্ষা। দামিনীর এই কৌশল শচীশের নজর এড়ালো না, কিন্তু তাঁর তেমন কোন ভাবান্তরও হল না।

চতুরঙ্গ উপন্যাসে দামিনীর যে পরিণতির কারণ শচীশের আত্মকেন্দ্রিকতা, বিভ্রান্তি এবং কখনো বা অস্বাভাবিকতা। এই তত্ত্বটি পরিষ্কার হয় যখন আমরা পড়ি, “আবার একদিন কানাকানি এবং কাগজে গালাগালি চলিল যে ফের শচীশের মতের বদল হইয়াছে। একদিন অতি উচ্চৈঃস্বরে সে না মানিত জাত, না মানিত ধর্ম; তারপরে আর – একদিন সে খাওয়া – ছোঁওয়া স্নান – তর্পণ যোগযাগ দেবদেবী কিছুই মানিতে বাকি রাখিল না। তারপরে আর – একদিন এই – সমস্তই – মানিয়া – লওয়ার ঝুড়ি ঝুড়ি বোঝা ফেলিয়া দিয়া সে নীরবে শান্ত হইয়া বসিল – কী মানিল আর কী না মানিল তাহা বোঝা গেল না। কেবল ইহাই দেখা গেল আগেকার মতো আবার সে কাজে লাগিয়া গেছে”।

এই পর্যায়ে শচীশের কার্য – কলাপের যে বিবরণ উপন্যাস থেকে পাওয়া যায় তা থেকে বলা যায় সে যেন হয়েছিল পরশপাথর খুঁজে ফেরা সেই ক্ষ্যাপা। কোন এক সময় শচীশ শ্রীবিলাস ও দামিনী তিনজনই লীলানন্দ স্বামীর সঙ্গ ছাড়লো। দামিনী ও শ্রীবিলাস ফিরে গেল ক’লকাতায় কিন্তু শচীশ গেলো না – “আমি কিছুদিন একলা ফিরিব। একটা যেন কিনারার মতো দেখিতেছি। এখন যদি তার দিশা হারাই তবে আর খুঁজিয়া পাইব না।” কিন্তু দামিনীর ঠাঁই হলো না ক’লকাতায় তাঁর মাসির বাড়িতে, যেখানে সে গিয়েছিল আশ্রয় নিতে। তার কারণ ছিল দামিনীর কার্য কলাপে আর নিন্দায় শহরে ঢীঢি পড়ে গিয়েছিল। সমাধান হিসেবে শ্রীবিলাস দামিনীকে বিবাহের প্রস্তাব দিলো। প্রথমে অসম্মত হলেও পরে সম্মত হয় দামিনী। অনেক অনুসন্ধান করে শচীশের খোঁজ পাওয়া যায় এবং সে এই বিবাহ অনুষ্ঠানে সোৎসাহে যোগদান করে।

সেই দাম্পত্য আপাত দৃ্ষ্টিতে স্বাভাবিক হ’লেও শ্রীবিলাসের কথায় – “আমি যাকে কাছে পাইলাম সে গৃহিণী হইল না, সে মায়া হইল না, সে সত্য রহিল। সে শেষ পর্যন্ত দামিনী। মায়ার সংসারে মানুষ যেমন করিয়া দিন কাটায় তেমনি করিয়া দামিনীকে লইয়া যদি আমি পুরামাত্রায় ঘরকন্না করিতে পারিতাম তবে তেল মাখিয়া, স্নান করিয়া, আহারান্তে পান চিবাইয়া নিশ্চিন্ত থাকিতাম।” সেই আপাত সাধারণ বা আপাত স্বাভাবিক বিবাহিত জীবনের মেয়াদ এক বছরই ছিল। সেবারে সেই গুহা থেকে ফেরার পর থেকেই মাঝেমাঝে দামিনীর বুকের মধ্যে একটা ব্যথা হ’তো। এখন সেই ব্যথার তীব্রতা বেড়ে গেলো অনেক। প্রচুর চিকিৎসা হ’ল, অর্থ ব্যয় হ’ল কিন্তু উপশম হ’ল না। যখন চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলেন হাওয়া বদল করার, দামিনী শ্রীবিলাসকে অনুরোধ ক’রলো তাকে নিয়ে যেতে সেই গুহার পার্শবর্তী সমুদ্র্র উপকূলে। আর সেখানে, “যেদিন মাঘের পূর্ণিমা ফাল্গুনে পড়িল, জোয়ারে ভরা অশ্রুর বেদনায় সমস্ত সমুদ্র ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল, সেদিন দামিনী আমার পায়ের ধুলা লইয়া বলিল, সাধ মিটিল না, জন্মান্তরে আবার যেন তোমাকে পাই”।

চতুরঙ্গ উপন্যাসে শ্রীবিলাসের বয়ানে নারী চরিত্রের রবীন্দ্রনাথ বর্ননা, “মেয়েরা স্বয়ম্বরা হইবার বেলায় তাদেরই বর্জন করে যারা আমাদের মতো মাঝারি মানুষ, যারা স্থূলে সূক্ষে মিশাইয়া তৈরি – নারীকে যারা নারী বলিয়াই জানে, অর্থাৎ, এটুকু জানে যে, তারা কাদায় তৈরি খেলার পুতুল নয়, আবার সুরে তৈরি বীণার ঝংকারমাত্রও নহে। মেয়েরা আমাদের ত্যাগ করে, কেননা আমাদের মধ্যে না আছে লুব্ধ লালসার দুর্দান্ত মোহ, না আছে বিভোর ভাবুকতার রঙিন মায়া; আমরা প্রবৃত্তির কঠিন পীড়নে তাদের ভাঙিয়া ফেলিতেও পারি না, আবার ভাবের তাপে গলাইয়া আপন কল্পনার ছাঁচে গড়িয়া তুলিতেও জানি না; তারা যা আমরা তাদের ঠিক তাই বলিয়াই জানি —- এইজন্য তারা যদি – বা আমাদের পছন্দ করে, ভালোবাসিতে পারে না”

চতুরঙ্গ প্রকাশিত হয়েছিল আজথেকে একশছয় বছর আগে। তখন না ছিল Gender Equalityর কথা, না ছিল Feminism. সেইসময়ে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছিলেন দামিনীকে, যে ছিল শতকরা একশ ভাগ রক্তমাংসের মানুষী। যে যুগে বিধবা হওয়া মানেই ছিল চুল কামিয়ে, সাদা থান পরে, একবেলা খেয়ে আর একাদশী ক’রে বাকি জীবনটা কাটানো; সেই যুগে বিধবা দামিনী এসব কিছুই মানেনি। বিদ্রোহ করেছে গুরুজির বিরুদ্ধে, নিজের দৈহিক কামনাকে অস্বীকার করেনি এবং মারা যাওয়ার সময়েও আবার জন্মলাভের আকাঙ্খা ব্যক্ত করে গেছে। এখানে বলা যেতে পারে দামিনী যে উচ্চ শিক্ষিত ছিল তেমনটি রবীন্দ্রনাথ লেখেন নি।

দামিনীর চরিত্র সৃষ্টি ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ সাধারণভাবে নারী চরিত্রের বিশ্লেষণ যেভাবে ক’রেছেন “চতুরঙ্গ” ঊপন্যাসে তাতে এইটুকু নিশ্চয়ই বলা যায় যে নারী চরিত্র্র বর্ণনে তিনি সেইসময়ের সামাজিক বাধা – নিয়মের পরোয়া করেননি কিন্তু নারীবাদে বা নারীত্বতে তাঁর সমর্ধন ছিল, সেটা বলা যায় না, তার প্রমাণ এটাই যে রবীন্দ্রনাথ দামিনীকে বাঁচতে দেননি; তাকে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় দিয়েছিলেন অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে।

Painting: New Clouds, 1937 by Nandalal Bose

Sahityika Admin

Add comment