সাহিত্যে বিজ্ঞানমনস্কতা – সরলা দেবী চৌধুরানী
@কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭৮ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
প্রাক কথন
উত্তরসূরী হিসাবে আমরা সরলা দেবী চৌধুরানীকে তাঁর সার্ধশত জন্মবর্ষতে ততটা মনে রাখতে পারিনি। এতে সেই মহিয়সীর মহিমা কোনভাবে ক্ষুন্ন হয় না বরং আমাদেরই মানসিক দৈন্য ও লজ্জা প্রকট হয়ে পড়ে। ঠাকুর পরিবারের কন্যা সরলা দেবী ছিলেন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয়ী, মাতা স্বর্ণকুমারী দেবী ও পিতা জানকীনাথ ঘোষাল। জানকীনাথ জাতীয় কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকেই তার সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন। মাতা স্বর্ণকুমারী দেবী সমাজে সাহিত্য় ও দর্শনচর্চায় সেযুগে অগ্রগণ্য ছিলেন এবং “সখি সমিতি” স্থাপনা ও সংগঠন তাঁর এক বড় কাজ।
১৮৭২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে সরলার জন্ম। এক অর্থে তাঁকে বাংলার অন্যতম অগ্নিকন্যা বললে অত্যুক্তি হয় না, বিশেষ করে সেইযুগে। স্বকীয় মানসিক গঠনে তিনি শিশুকাল থেকেই অন্তরের অভয়মন্ত্রে পরিচালিত ছিলেন। দেশের স্বার্থে নানা সময়ে তিনি এমন কিছু দুঃসাহসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন – যেগুলির বিষয়ে সেকালের পুরুষরাও, এমন কি শ্বেতাঙ্গরাও পিছিয়ে গিয়েছেন। (সূত্র- “অগ্নিপরীক্ষা”, ভারতী: জৈষ্ঠ ১৩২৫ বঙ্গাব্দ)। তাঁর নিজের ভাষায় “কিন্তু সেই অতি শৈশবে যে দিন ছাদের উপরে উঠিয়া প্রাণীশূন্য বিশ্বকে দেখিয়া আমি নির্ভীক ছিলাম, যে দিন আমার মন যেন শিশুর কলকন্ঠে গাহিয়া উঠিয়াছিল – শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থু: বেদাহমেত। সেদিন আমার মনের সেই স্বাবলম্বন কোথা হইতে আসিল তাই ভাবি। বোধ হয় তাহা সহজাত হইবে, শিক্ষালব্ধ নহে।”
(সূত্র –“আমার বাল্যজীবনী“,ভারতী: বৈশাখ ১৩১২ বঙ্গাব্দ)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে – শোনা যায় নারী জাগরণে সেকালের অনেক প্রবল পুরুষ ব্যাক্তিত্ব এনার সহযোগীতা আশা করেছিলেন, যেমন স্বামী বিবেকানন্দ ও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। উভয়েই একদা তাঁদের নিজ নিজ কর্মযজ্ঞে সরলার সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী যে গান্ধীজি সরলাকে নিজের আধ্যাত্মিক স্ত্রী (Spiritual wife) বলে উল্লেখ করেছিলেন। সবরমতী আশ্রমে আশ্রমিক পরিচয়ে সরলা দেবী স্বল্পকাল বাস করেছিলেন, তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামী স্বামী পাঞ্জাব-তনয় রামভূজ দত্তচৌধুরীর কারাবাস কালে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে গান্ধীজির সর্বক্ষেত্রেই নির্বিচারে অহিংস নীতির প্রয়োগ ও সেই বিষয়ে তাঁর অনমনীয়তা সরলা দেবীর পছন্দ ছিলো না।
(সূত্র- Geraldine Forbes, “ Lost letters And Feminist history, The Political Friendship of Mohandas K. Gandhi and Sarala Devi Chaudhurani)
তবে বর্তমান নিবন্ধের মূল আলোচ্য অন্য – তাঁর রচনায় বিজ্ঞানমনস্কতার অনুসন্ধান। “অনাথবন্ধু“ উপন্যাসের সূচনাপর্বেই তিনি লিখেছেন – “ভূমিকম্পে গৃহ যখন ধরাশায়ীপ্রায় তখন পাঁচজন বন্ধুর সহিত সে আকস্মিক দৈবঘটনা সম্বন্ধে ঘন্টাকৃতব্যাপী সরস আলোচনায় কালহরণ করা যায়, কিন্তু সেই সঙ্গে এঞ্জিনিয়ারের বাড়ি গিয়া দুটা কাজের কথা কহিয়া আসাও অত্যাবশ্যক বোধ হয়। সমাজ বিপ্লবের নৈসর্গিক উত্পাতের দিনে চিত্তবিনোদের নিমিত্ত ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘বিষবৃক্ষ‘ চাই কিন্তু জীর্ণ গৃহ সংস্কারের জন্য “অনাথবন্ধুর “ ন্যায় দুই একটি এঞ্জিনিয়ারের পরামর্শে কর্ণপাত করাও চাহি।“
লেখিকার বিশ্লেষণে – “শুধু ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য় উকিল বা চাকুরিয়ার দ্বারা যৌথ কারবার ভালো হয় না। সুবর্ণবনিক, তিলি, তামুলি, মারোয়ারীদিগের প্রভুতা থাকিলে তবে কারবার ‘হিসাবী ধরনে‘ এবং সহজে চলে। যাদের যে কাজ পুরুষানুক্রমে অভ্যস্ত!”
(সূত্র- “অনাথবন্ধু” উপন্যাস, ভারতী : জ্যৈষ্ঠ ১৩০৫ বঙ্গাব্দ)
এমন কি তাঁর কবিতার মধ্যেও যুক্তিবাদ ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা প্রস্ফুটিত – “ অজস্র প্রপাতে কভু বৃষ্টিধারা ঝুরে, / ভীম রবে তরুশাখা ভাঙ্গে দিশে দিশে; / একা আমি নারী হেথা বসে নির্নিমেষে / আমার চৌদিকে শত বিভীষিকা ঘুরে। / একা আমি ভয়শীলা, কম্পিত, চকিত / একা আমি ভয়হীনা, আত্মবলীয়ান! / একা আমি ক্ষুদ্রতম বৃহৎ-পীড়িত, / একা আমি বিশ্বকেন্দ্র অতি সুমহান!“
একই ব্যক্তির মধ্যে দুই বিপরীত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সত্তার সহাবস্থান বা দ্বন্দ্বের এমন কাব্যিক উপস্থাপনা সাহিত্যে বিরল।
(সূত্র – “একা”, ভারতী : জৈষ্ঠ ১৩০২ বঙ্গাব্দ)।
এরই সঙ্গে তুলনীয় – “মগন হইয়ে পেলেম তাহে আনন্দের অতল, / বিষের জ্বালা জুড়িয়ে হলো সুধাস্নিগ্ধ শীতল ! / প্রেমের পরশমণির ছোয়ায় উলট পালট ধরা! / কাঁটার মাঝে ফুলের বিকাশ ফুলের সুবাস ভরা!” (সূত্র – “প্রভুর দান “, ভারতী : মাঘ ১৩৩০ বঙ্গাব্দ)
অগ্রপথিকের বিজ্ঞানমনস্কতা
কুসংস্কার ও বিজ্ঞানমনস্কতার মধ্যে তাঁর পক্ষপাত কোন দিকে সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় সরলা দেবীর লেখনীতে – “যখন সতীদাহ নিবারণ ও পৌত্তলিকতা বিসর্জনে উদ্যত রামমোহন রায়ের প্রতি সমগ্র হিন্দুসমাজ খড়গহস্ত হয়েছিল, তখনও তিনি নির্ভীকচিত্ত, অটল। বিধবার বিবাহ শাস্ত্রসম্মত – এই সত্যপ্রচারে উদ্যোগী হলে চতুর্দিক থেকে যখন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উপর ক্রমাগত বিদ্রূপ ও উপেক্ষার বাণ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, তখনও তাঁর স্থির সিদ্ধান্ত এক মুহূর্তের জন্যও টলেনি। এঁনারা শুধু বঙ্গের গৌরব নয়, সমস্ত ভারতের গৌরব। এঁনাদের বীরত্বের সুফল শুধু বঙ্গদেশে আবদ্ধ নয় – সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে ; বীরপ্রসবিনী বঙ্গমাতা এই দুই সন্তানকে সমস্ত ভারতবাসীর কাজে নিযুক্ত করেছেন।
(সূত্র-“বাঙ্গালী ও মারহাট্টি “, ভারতী ও বালক : ১২৯৯ বঙ্গাব্দ)
প্রকৃতির মূলনীতি বা কার্যপ্রণালীর সাথে মানুষ সংঘাতের পরিনাম আজকের দিনে যা পরিবেশ-বিপর্যয় বা জলবায়ু-সংকটের রূপ ধারণ করেছে, সেই সংঘাতের বিনাশকারী রূপের প্রতীকী বর্ণনা তাঁর পৌরাণিক ব্যাখ্যায় – “যিনি দুর্গমত্রাণকারিনী বরাভয়দায়িনী তিনিই খড়্গপাণিনী মঙ্গল চন্ডী। তাঁর চন্ডতা যেদিন তোমার পক্ষে যায় সেদিনই তিনি দক্ষিণা, যেদিন তোমার বিপক্ষে যায় সেদিন তিনি করালা। পক্ষে বা বিপক্ষে যাওয়া না যাওয়া তোমার নিজেরই উপর নির্ভর করে। যে শক্তি বিজ্ঞানের সহিত সুকৌশলে নিয়মের পথে চালাইলে তোমার আজ্ঞাবহ ভৃত্য হইয়া তোমায় বীজন করে, বহন করে, আলো দেয়, সুখ দেয়, – সেই শক্তিই নিয়ম লঙ্ঘন করিয়া বে-কায়দায় নাড়ানাড়ি করিলে পলক না ফেলিতে প্রাণ হনন করে, পুড়াইয়া ছাই করিয়া দেয়। সংযমের পথে জ্ঞানের পথে তিনি তারা দুর্গা, অসংযমের অজ্ঞানের বিপথে তিনি চন্ডিকা। তাঁহাতে যদি বিশ্বাস রাখ, তিনি কখন বিশ্বাসঘাত করেন না।
(সূত্র –“দুর্গা ও চন্ডী”)।
অনেক সময় সরলাদেবীর রচনায় এক ধরনের দার্শনিকতা বা আধ্যাত্মিকতার প্রতি তাঁর টান এবং তেমনই বিষয়ের এক পরিমন্ডল কখনো বা তাঁর সাহিত্যে দেখা গেলেও, সেই আবরণের অন্তরালে মর্মবাণীকে সন্ধান করলে হয়তো দেখা যাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের মূল সুরটি তাঁর রচনায় ঝংকৃত হয়েছে।
শিল্পকলা বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গেও সরলা দেবী পরিনত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিয়েছেন – “আমাদের প্রাচ্যশিল্পের যা কিছু ত্রুটি চিত্রবিদ্যায় – তাহার বর্ণবিন্যাস অংশে নহে, কিন্তু তাহার রেখাপাতাংশে ঐ বিষয়ে অস্বাভাবিকতায়। কোন মানুষটাই স্বাভাবিক মানুষ নহে, তাহাদের স্থিতিগতির ভঙ্গী স্বভাবানুকুল ভঙ্গী নহে, দেখিলেই ভ্রম হয় না জীবন্তের প্রতিরূপ দেখিতেছি। যুদ্ধের দৃশ্যে সেখানে হত ও আহত যোদ্ধারা মাটিতে শায়িত রহিয়াছে অনুমান করিতে হইবে, চোখ সেখানে প্রকৃত পক্ষে দেখিতে পায় আকাশ হইতে অনেকগুলা মানুষ যেন ভূমিতে অবতীর্ণ হইবার প্রয়াস পাইতেছে। যেখানে মেঝেতে গালিচা বিস্তীর্ণ রহিয়াছে জানিতে হইবে, চোখ সেখানে দেখিতে পায় দেওয়ালের গায়ে গালিচা ঝুলিতেছে। এ সকলই “পার্সপেক্টিভ“ (Perspective) – দৃষ্টিবিজ্ঞান বা রেখাবিজ্ঞানের অজ্ঞতাজনিত। য়ুরোপিয় চিত্রকরদের নিকট এই কৌশলটুকু শিখিয়া লইলেই আর আমাদের কোন ত্রুটিই থাকে না। “ (সূত্র – ভারতী: আশ্বিন ১৩১০)
সমাজতাত্ত্বিক বিষয়ে আলোচনাকালেও সরলা দেবীর বিশিষ্ট দৃষ্টিকোণ ও বিশ্লেষণী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় – “হরিদ্বারের উত্তরে পাহাড় ভেদ করিয়া গঙ্গা আরম্ভ হইয়াছে। সেই গঙ্গার এক একটি ঢেউ ঐ সুদূর হইতে বাহিয়া কলিকাতায় উপনীত হইয়াছে এবং কলিকাতাও ছাড়াইয়া সাগরে গিয়া পড়িতেছে। তেমনি আমরা সকলেও কালপ্রবাহে সেই অতীতকাল হইতে বর্তমানে আসিয়া উপনীত হইয়াছি। সেই অতীতের ভারতরমণীরা আর আমরা বিভিন্ন নহি। সেই কৌশল্যা, সুমিত্রা, দ্রৌপদী, দময়ন্তী, আমরাই; সেই কর্ণ, দ্রোণ, কৃষ্ণ, ভীম আমাদেরই বীর অভিভাবকেরা।“
(সূত্র :“শক্তির অংশভূতা “, ভারতী : আশ্বিন ১৩১৩ বঙ্গাব্দ)।
শিল্প ও অর্থনীতিতে স্বনির্ভরতার প্রশ্ন
সরলা দেবী সেকালেই প্রাগ্রসর চিন্তার অধিকারিণী ছিলেন, বাংলার কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উন্নয়নে তাঁর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিলো –
১) বিদেশীয় জিনিস বর্জনের প্রতিজ্ঞা –
আমরা যদি য়ুরোপের নানা মোহিনী মূর্তিধারিণী নানা হাবভাব বিলাসিনী, নানা কৌশলজাল – বিস্তারিনী শিল্প মায়াবিনীর কুহকে বিচলিতমনা না হই, যদি আত্মজয়ী হই, যদি প্রতিজ্ঞায় অটল থাকি, তবে পৃথিবী জয় আমাদের করায়ত্ত। এই তপস্যা প্রভাবে নিখিল ঐশ্বর্য আমরা লাভ করিতে পারিব। তাহার সামান্য প্রত্যক্ষ প্রমান সঙ্গে সঙ্গেই উপলব্ধ হইতেছে।
২) স্বদেশীয় জিনিষ ব্যবহার –
ইহাতে দেশের শিল্প ও শিল্পীর উন্নতিপূর্বক দেশের ধনলাভ ও দেশের অর্থ দেশেই স্থিতির মহাসূচনা করিয়াছে।
৩) যৌথকারবার খুলিয়া কাপড়ের খুলিয়া কাপড়ের কলস্থাপনা।
ইহাতে ধনলাভ ও ঐক্যবললাভ।
৪) কতিপয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কারখানার জন্য কতিপয় ধনীর স্বতন্ত্রভাবে মূলধন নিয়োগ।
ইহাতেও ফল ধনলাভ ও সৎ দৃষ্টান্ত।
৫) অকুতোভয়তা।
এই ব্যাপারে রাজা মহারাজা হইতে আরম্ভ করিয়া চাষাপ্রজা সকলেরই প্রকাশ্যভাবে যোগদান দেওয়ায় ও বদ্ধপরিকরতায় সে সাহস ও অকুতোভয়তার পরদা খুলিয়া গিয়াছে, তাহা আর একটি মহা নৈতিক লাভ, এবং তাহার ফল বহুবিস্তৃত।
সূত্র- “বাঙ্গালীর পরীক্ষা”, ভারতী : আশ্বিন ১৩১২)
স্বাদেশিকতার যুগে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে মূলত লিখিত হলেও ভারতের শিল্প ও প্রযুক্তিগত স্বাবলম্বন এবং সার্বিক আর্থ–সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্নে সরলা দেবীর প্রস্তাবিত রূপরেখা হয়তো আজও সুধী পাঠকবৃন্দের চিন্তার খোরাক যোগাতে পারে। যেখানে ভারতীয়, বিশেষত বাঙালিদের চিন্তাস্রোত অনেকাংশে ভাবাবেগে চালিত হয়ে থাকে, সেখানে সেযুগে সরলা দেবীর এমন বস্তুনিষ্ঠ, নির্মোহ আলোচনা নিঃসন্দেহে খানিক অভিনব বলা যায় –
“মাদ্রাজের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক চ্যাটার্টন সাহেব গবর্নমেন্ট কর্তৃক ভারতবর্ষের কৃষি ও শিল্প সমস্যার কীরূপে মীমাংসা হইতে পারে তাহার অনুসন্ধান করিতে নিয়োগ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তিনি সম্প্রতি তত্সম্বন্ধে তাঁহার গবেষণা ও অনুসন্ধানের ফল পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন – ভারতবর্ষের নানাস্থানে যে বৃষচালিত যন্ত্রে জল উত্তোলন ও ক্ষেত্রে তাহা সঞ্চার করিবার ব্যবস্থা আবহমান কাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে, তাহা এত উৎকৃষ্ট ও উদ্দেশ্য সাধনের পক্ষে এত উপযোগী, যে মনে হয় বৈজ্ঞানিক পন্ডিতগণ এই পদ্ধতি বিশেষ চিন্তা ও বহুদর্শিতার ফলস্বরূপ উদ্ভাবন করিয়াছিলেন, কিন্তু এখন প্রধান সমস্যা এই যে, ক্ষেত্রে প্রচুর রূপে জল আমদানি করার উপযুক্ত কূপের অভাব সর্বত্র লক্ষিত হয়। বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে খাল কর্তন করা বহু ব্যয়সাধ্য এবং তাহা এদেশের রীতি অনুযায়ী নহে, সূতরাং ঐ উপায় প্রবর্তন করিতে হইলে তাহা এদেশের লোকের ঠিক উপযোগী হইবে কিনা, তাহাতে বিশেষ সন্দেহ আছে। চ্যাটার্টন সাহেব কূপ খননের সুব্যবস্থা করার বিশেষ পক্ষপাতী, তিনি বলেন, এই প্রণালী এদেশের চিরায়ত প্রথানুযায়ী এবং অপেক্ষাকৃত অল্প ব্যয়সাধ্য।
গভর্ণমেন্ট তাঁহার বিশেষ অনুরোধে এই বিষয়ে পরীক্ষা করিয়া দেখিবার জন্য কিছু টাকা অনুমোদন করিয়াছেন, তিনি আপাতত মাদ্রাজের অন্তঃপাতী চিঙ্গলীপত্তন নামক স্থানে পারিয়া প্রজাদের ক্ষেত্রের উত্কর্ষ সাধনের চেষ্টা করিতেছেন। একটি প্রাচীন কূপকে জলশূণ্য করিয়া তাহা বহু নিম্ন পর্যন্ত খনন করা হইয়াছে, খনিত অংশের নিম্নভাগ কঠিন প্রস্তরে আসিয়া ঠেকিয়াছে। একটি যন্ত্রের সাহায্যে সেই কূপের জল দ্বারা এখন ৫০ একর পরিমিত স্থান জল লাভ করিতেছে, পূর্বেকার কূপ দুই একর জমিতে মাত্র জল আমদানী করিত। প্রতি একর জমিতে জল দেওয়ার খরচ ১২ টাকা হিসাবে পড়িয়াছে।
(সূত্র – “সাময়িক কথা”,ভারতী : কার্ত্তিক ১৩১১ বঙ্গাব্দ)
বহুমুখী প্রতিভা
বলা চলে এক যুগসন্ধির সময়ে দেড় শতাব্দী আগে আমাদের সমাজে সরলা দেবী চৌধুরাণীর (ঘোষাল) মতন গুণী নারীর আবির্ভাব হয়েছিল যাঁকে অনেকেই ক্ষণজন্মা মনে করতে পারেন। সে যুগের তো বটেই, হয়তো এযুগের প্রেক্ষিতেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট শিক্ষিতা, বাগ্মী, সুদর্শনা, প্রবল তেজস্বিনী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, পত্রিকা সম্পাদক, শিক্ষাব্রতী, জাতীয় নেত্রী এবং বাংলা তথা ভারতে অস্ত্রচর্চা ও শরীরচর্চার প্রবর্তক। ঠাকুরবাড়ির “ভারতী“ পত্রিকার প্রথম যুগে একাধিকবার, আবার অন্তিম পর্বে মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ও সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় এই দুই নবীন সম্পাদকের অব্যাহতির অনুরোধ রক্ষার্থে সরলা দেবীকে সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হয় – যেক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট কুশলতার পরিচয় দেন। স্ত্রী-শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে উত্তর ভারতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত “ভারত স্ত্রী মহামন্ডল“ ক্রমে ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অংশে প্রসারিত হয়।
আত্মশক্তিতে বলীয়ান সরলা কখনোই নিজ মতামত প্রকাশে কুন্ঠিত হন নি। ফলে নিজের মামা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেশনেতা মোহনদাস গান্ধী বা স্বামী বিবেকানন্দ – সকলের সঙ্গেই তাঁর মতভেদ, কখনো বা লিখিত বিতর্ক ঘটেছে সমানে সমানে, যার নথি এখনও বর্তমান তাঁর পত্রাবলী ও নানা পত্রিকার পাতায়। সর্বোপরি দেশের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও শিল্পের প্রসারে সমকালীন অন্য অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির তুলনায় তাঁর আন্তরিক তাগিদ ও উদ্যোগের পাশাপাশি বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে তাঁর সজাগ দৃষ্টিও নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। এই অগ্নিশিখাসম ব্যক্তিত্বময়ী নারীর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়েছিল ১৮ আগস্ট, ১৯৪৫ তারিখে।
এই মহীয়সি মহিলা সম্বন্ধে লেখার জন্য ধন্যবাদ। সেই সঙ্গে উনার সম্বন্ধে কয়েকটা লাইন লেখার লোভ সম্বরন করতে পারলাম না।
সরলাদেবী জাতিয়তাবাদী ধ্যানধারনায় নিজেকে সমর্পন করেছিলেন। ক্লাবে ক্লাবে উনি যুবকদের লাঠি ও তলোয়ার খেলার শিক্ষা প্রচলন করেছিলেন। তিনি মনে করতেন যুবকেরা শক্তিশালি হয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হওয়া উচিৎ । বীর অষ্কমী পূজার প্রচলন করেছিলেন। বাংলার বীর প্রতাপাদিত্তের জন্মদিনে তাঁর ছবিকে সামনে রেখে যুবকদের লাঠিখেলা-তরোয়াল খেলার প্রচলন করেছিলেন। মহারাষ্ট্রের শিবাজীর মতো বাংলায় প্রতাপাদিত্যকে আইকন হিসাবে উনি পরিকল্পনা করেছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সভা সমিতিতে উনি স্বদেশী গান গাইতে যেতেন। উনার গাওয়া গান “বন্দেমাতরম …….” সভাসমিতিতে বিশাল উদ্দীপনা সৃষ্টি করতো। শোনা যায় রবিঠাকুর বঙ্কিমচন্দ্রের লিখিত গানের প্রথম চারলাইনের সুর করেছিলেন। বাকী লাইনগুলোর সুর সরলাদেবী করেছিলেন। সম্ভবত আমাদের দেশে প্রথম মহিলা যে অন্য প্রদেশে চাকরী করতে গিয়েছিলেন। উনিশ শতকের শেষদিকে মহিশূর রাজ্যের রাজার আমন্ত্রনে উনি ওখানে মেয়েদের স্কুলে শিক্ষকতার চাকরী নিয়ে যান। ওখানে থাকবার সময় উনি কর্ণাটকি সংগীতের সঙ্গে পরিচিত হন। ফিরে এসে কর্নাাটকি গানের সুর নিয়ে উনি রবিমামার সঙ্গে আলোচনা করেন। রবিঠাকুর তাঁর লেখা কিছু গানে কর্নাটকি গানের সুর বসিয়ে দেন , যা এই ধরনের গানকে ‘ভাঙ্গাগান’ বলে পরিচিত।