সরস্বতী পূজা, কুমারচক
@১৯৯১ ইলেকট্রনিকস ও টেলি কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
সরস্বতী পূজা, কুমারচকপর্ব ১
পৌষের মিষ্টি রোদ সকাল জুড়ে বসেছে। শীতের কাঁপুনি এড়াতে আমরাও রোদ পিঠ দিয়ে সদরদুয়ারে পড়তে বসেছি। সদর বলতে আটচালা মাটির দোতলাবাড়ি। বড় বড় কাঠের ধান্নার ওপর বাঁশের কাঠামো দেওয়া খড়ের চাল। পুবে, দখিনে আর পশ্চিমে প্রায় আট ফুট চওড়া মাটির দুয়ার সুন্দর করে নিকানো। পুবদুয়ার লম্বায় প্রায় পঁচিশ ফুট। সামনে উঠোন। সেও প্রায় পঁচিশ ফুট আড়ে ও লম্বায়। আমরা বলি বাইর।
বাইর উঠোন রাস্তা থেকে প্রায় ২০-২৫ফুট উঁচুতে। বন্যার প্রকোপ বেশি। রূপনারায়ন এখন শক্তি হারিয়ে ধুকছে। তাই জল তার খোলে নেমে গেছে। এরই রূপ ভয়ংকর হয়ে ওঠে বর্ষায়। খোল ছাড়িয়ে প্রায় ৩০-৪০ফুট ওপরে উঠে পাড় বরাবর উঁচু বাঁধে ধাক্কা মারে। সেই বিশাল উঁচু জলের হাত থেকে বাঁচবার জন্য এত উঁচু এখানকার বসত ভিটা সব।
উঠোনে ওঠার জন্য শক্ত ঝামার সিঁড়ি উঠে এসেছে রাস্তা থেকে। সিঁড়ির বাঁ দিকে মস্ত বেলগাছ। বেলের ভারে মাথা ঝুঁকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পাতা প্রায় নেই বললেই চলে। আর যে কটা আছে তারাও হলদে হয়ে ঝরার অপেক্ষায়। বাইরে সেদ্ধধান, গম, রাইসরষে, কাঁচা বড়ি, কাঁচের বয়ামে পুরানো আচার আরও নানান গৃহস্থালির জিনিস রোদে দেওয়া সকাল সকাল। একঝাঁক পায়রা একটু দুরে পায়রাকাবুর মাথায় বসে বকবকবকমবকম বলে ঘুরপাক খেয়ে আবার উড়ে গিয়ে ফিরে আসছে। দু’চারটে শালিকপাখি মেলা ধানের ওপর এক পা এক পা করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। একপাশে এক বুড়ি ঠাকুমা একটা বাঁশের কঞ্চি হাতে সরষের পাহারায়, আর বুড়ির সাথে শালিকগুলো যেন কুমিরডাঙা খেলছে। বুড়ি একটু রোদের আমেজে ঝিমুতে শুরু করলেই শালিকগুলো ফিরিক ফিরিক করে ধানের ওপর উড়ে এসে বসে তারপর পা দিয়ে ধান সরিয়ে পোকা না কী খুঁজছে। বুড়ির ঝিমুনি কেটে যায় খেজুরচাটাইয়ে ধান ছিটকে পড়ার শব্দে। তখনি হাতের কঞ্চি দিয়ে খেজুরচাটাইয়ে বাড়ি মারছে ছড়াস ছড়াস করে মারে। সেই শব্দে শালিকগুলো আবার ফিরফিরিক ফিরিক করে উড়ে গিয়ে ঘরের খোড়ো চালে গিয়ে বসে পরের সুযোগের অপেক্ষায়।
মাঝে মাঝে উত্তুরে হাওয়া বইছে। আশেপাশের খিরিশ, তেঁতুলের সবজে হলুদ পাতারা সেই হাওয়ায় দুলতে দুলতে নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে আমোঘ আকর্ষণে নীচে নেমে আসে। হাওয়ায় তালে তালে তাদের দল হালকা ভারী হয়ে উঠছে। শুকনো পাতা শক্ত মাটির ওপর পড়ায় কেমন এক ধরনের খড়খড়ে, ছড়ছড়ে হালকা আওয়াজ। কিছু পাতা আবার একটু বেয়াড়া গোছের। হাওয়ার পালে ভর দিয়ে সোজা পুষ্করিণীর জলে। শুকনো পাতারা জলে একদম পানসির মত ছিপছিপে। হাওয়ায় ভর দিয়ে পাঁইপাঁই দৌড়াচ্ছে আর পুষ্করিণীর স্বচ্ছ গভীর জলে হাজারো হালকা ঢেউ ছোটাচ্ছে। তারই মাঝে মাঝে, জিওল মাছের দামাল ছোকরার দল ফুট কাটতে ওঠার সময় খাবার ভেবে এক একটা পাতাকে মুখে ধরে জলে ডুবিয়ে নেয়। পরক্ষণেই ভুল বুঝতে পেরে ছেড়ে পালায়। এক অদ্ভুত মন খারাপের পরিবেশ। মন কিছুতেই বইয়ের পাতায় আটকে থাকতে চায় না।
পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কেবলই সেদিকে চোখ চলে যায়। সম্বিত ফেরে বাবার বকুনিতে। শালিকগুলোর অবাধ্য আচরণ যেন কোথায় আমাদের মিলিয়ে দিচ্ছিল। কিছুতেই মনঃসংযোগ করতে পারছিলাম আমরা। অবাক হয়ে ভাবছি বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই। পৌষপার্বণ এলো বলে। মিস্ত্রিদাদু এখনো আসছে না কেন!
এমনি এক ভাবনার দিনে, এক সময় রাস্তা থেকে হাঁক আসে “কোথায় রে সব”। এ গলা ভারি চেনা। আগামী মাস খানেক এই গলায় কত আদর, কত বকুনি ঝরে আসবে। এক ঝটকায় মুখ তুলে সবাই রাস্তার দিকে তাকাই। একটি বিশাল বাঁশের ঝোড়া মাথায় নিয়ে আমাদের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে উঠে আসছে কালো মতন দোহারা চেহারার সেই বয়স্ক মানুষটি- মাথায় একটা বিঁড়ে। তাতে মাথার বোঝাটা সুন্দর করে বসান। ধুতি হাঁটু অব্দি গুটানো, পায়ে নাগরা জুতো আর কাঁধে একটা ঝোলা।- আমাদের সবার অতি প্রিয় মিস্ত্রিদাদু।
সরস্বতী পূজা কুমারচকপর্ব ২
আমরা হই হই করে বই গোছাতে শুরু করলাম। ব্যাগে বই খাতাপত্তর ঢুকিয়ে শতরঞ্জি পাট করে চাপা দিয়ে দৌড়ে উঠোনে নেমে এলাম । দুচারজন বড়রাও এসে পড়ল। হাত ধরাধরি করে মিস্ত্রিদাদুর মাথার বোঝা নামিয়ে মাটিতে রাখা হল। মিস্ত্রিদাদু এই শীতেও দর দর করে ঘামছে। গায়ের চাদর আর ফতুয়া খুলে গামছা দিয়ে মুছলেন। কার্তিকদা- আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী, এর মধ্যেই জল আর লেবুর সরবৎ নিয়ে হাজির। সেটা খেয়ে মিস্ত্রিদাদু আবার খানিক জল খেলো।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখি যে আমাদের বসতবাটি মেদিনীপুর- বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুর হলেও জায়গাটা হাওড়া, হুগলি আর মেদিনীপুর জেলার মিলন স্থল। রূপনারায়ণ নদ আর মুণ্ডেশ্বরী নদী এই তিন জেলাকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করে রেখেছে। তাই এই তিনজেলার সাথেই আমাদের নিবিড় সামাজিক সম্পর্ক। তাই যোগাযোগটা আরও নিবিড়। আমাদের পাশের গ্রাম হুগলির ঢলডাঙা- বাবার মামাবাড়ি। তারই পাশে উজান বেয়ে জগৎপুর- আমার মামাবাড়ি। আবার হাওড়ার ভাটোড়া আমার বাবার পিসিমার বাড়ি। এই মিস্ত্রি দাদুর বাড়ি রাজহাটী, হুগলি- আমার মায়ের মামাবাড়ি। আশেপাশের তিন চারটে গ্রামের প্রায় দশবারোটা পারিবারিক ঠাকুরের বংশানুক্রমিক শিল্পী এই মিস্ত্রিদাদু- মানে শ্রী পুলিনবিহারী মান্না(?)। ঠাকুর দেখলেই চেনা যায়- একই ছাঁচে গড়া। ঠাকুরদালানে মা লক্ষ্মী-সরস্বতী ডাইনে বাঁয়ে পাশাপাশি একপায়ে দাঁড়িয়ে। তার দুপাশে পরী ও দাসী। ওপরে নারায়ণ। দালানের চার চারটে থাম। দালানের দুই দিকে দুটি শান্ত-সিংহ মুখ হাঁকরে আধশোয়া। সাদা ডাকের গহনা। পেছনের চাঁদোয়াও ডাকের সাজে মোড়া।
মিস্ত্রি দাদু সেই রাজহাটি থেকে বাসের মাথায় চেপে এসে গড়ের ঘাটে নামতেন। তারপর নদী পেরিয়ে প্রায় ৬-৭কিমি রাস্তা পায়ে হেঁটে সকাল ৯টা নাগাদ এসে পৌছাতেন আমাদের বাড়ি। তাই ক্লান্তি স্বাভাবিক এই ৫০এর কোঠায় পড়া মানুষটির। তবুও তাঁর পরিশ্রমী চেহারায় খুব একটা ক্লান্তির ছাপ নেই।
একটু জিরিয়ে নিয়েই বললেন “না রে তোপসে। বসলে চলবে না। আজ আমি মুখাগুলো তোদের জিম্মায় রেখে বাঁকিবাজারে ডাক্তারের বাড়ি যাব। ওদের ঠাকুর একমেঠে করে তারপর দোমেঠে সেরে তোদেরটা করতে আসব তরশুদিন। মাটি তুলে রাখিস তিন ঝোড়া”- এই বলে নিজের ঝাঁকাতে হাত লাগালেন। ওপরের কাপড় সরাতেই নিচে থরে বিথরে সাজানো বিভিন্ন মাপের মুখা- মানে ছাঁচে তৈরি মুখাবয়ব যার মাথা আর গলার অংশটা ফাঁপা। আমাদের লোভে চোখমুখ চকচক করে উঠল। ওই একটা ছোট মুখা যদি পাওয়া যেত- তাহলে নিজেরাই ছাঁচ বানিয়ে নিতাম। প্রতি বছর মিস্ত্রিদাদুর সাথে রফা হয় যে কোন একটা ছোটমুখা বেঁচে গেলে আমায় দিয়ে যাবেন। কিন্তু এ পর্যন্ত কখনো তা ঘটেনি। মুখা তিনি হিসেব কষে নিয়ে আসেন। আমাদের মতো কচিকাঁচাদের অগাধ বিশ্বাস মিস্ত্রিদাদুর ওপর। মুখা বাঁচলেই আমাদের। কিন্তু হায়! বেশি তো কোনদিনই হত না উপরন্তু ছাঁচ থেকে মাটি দিয়ে আবার তোলার দরকার হত যদি রাস্তার দু’একটা ঝাঁকুনিতে ভেঙ্গে যেত। অত্যুৎসাহে তার মাটিতোলা, মাটি-মাখা সব আমরাই করতাম। মাটিও কিছুতেই বেশি হত না। ফলে একটা মুখা কিছুতেই আমরা জোগাড় করে উঠতে পারতাম না। তার যে কি দুঃখ সে ভুক্তভোগী ছাড়া কারুর বোঝার নয়। মিস্ত্রিদাদু সান্ত্বনা দিতেন “তোপসে মন খারাপ করিস না। বাড়ি গিয়ে নইলে আমার ঘুমই হবে না- কখন তোকে মুখাটা দেব এই ভেবে ভেবে “। অপার বিশ্বাসে সেই সান্ত্বনায় সব ভুলে যেতাম। মিস্ত্রি দাদুর এই মুখা না দেওয়ার একটা কারন ও ছিল। উনি বলতেন “তোপসে লেখাপড়া শেখ। এসব তোকে মানায় না। মুখা নাহয় তোকে একটা দিয়েই দেব সামনের বার। তবে কাঁচা না রঙ করে চোখ এঁকে সাজিয়ে তার পর দেব”। স্বপ্নে আমার চোখ বুজে আসত। মানস চোক্ষে দেখতে পেতাম সেই সুন্দর মুখচ্ছবি।
তারপর পাঁচটি মুখা, মানে প্রতিমার মুখের ছাঁচে – ২টো বড়, ২টো মাঝারি আর ১টা ছোট, আলাদা রেখে বাকি ঝাঁকা গুটিয়ে বেঁধে সদর ঘরে এক কোনে ভাল করে ঠেস দিয়ে রাখতেন। আলাদা করা মুখাগুলো কাঁধে ঝোলায় নিয়ে রওনা দিতেন। ধীর পায় হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পুকুরপাড় ছাড়িয়ে, বটতলা ছাড়িয়ে ঝাঁকড়া আশুদতলা ছাড়িয়ে একসময় বাঁকিবাজারের রাস্তার মিলিয়ে যেতেন। আমরা নিরাশ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম মানুষটির দিকে। সে বড় কষ্টের।
সরস্বতী পূজা কুমারচকপর্ব ৩
আমাদের মন ভালো করার সরঞ্জাম হাতের কাছেই মজুত ছিল। রাস্তার দিক থেকে বাড়ির দিকে চোখ ফেরাতেই দেখি কার্তিকদা কোত্থেকে দুজন মজুর ধরে এনেছে। ঠাকুরের মেড় বা পুরানো কাঠামোটা সদরের দক্ষিণ দুয়ারের শেষে যে ক্ষুঁদিঘর তারথেকে বার করার তোড়জোড় করছে।
ক্ষুঁদিঘর বলতে জানালাবিহীন একটা অন্ধকার বদ্ধঘর যেখানে রাজ্যের জিনিস ডাঁই করা থাকে- জ্বাল দেওয়ার কাঠ, পুরানো ভাঙ্গা পালকি, ঘুঁটের বস্তা, তাল-আঁঠির খোলা, ছেঁড়া জাল, পাটকাঠির বস্তা মায় ছেঁড়া কাপড়ের পুটলি ও আরও অনেক কিছু। এসবের সাথে এক কোনে পড়ে থাকে এই কাঠের মেড়টাও। ফী বছর পুজোর শেষে বিসর্জনের পর নদী থেকে ওটাকে তুলে এনে এই ক্ষুঁদিঘরে রাখা হয়। ওটার কথা আমরা ভুলেই যাই। এই ক্ষুঁদিঘরের অজস্র গল্প আছে বড়দের মুখে শোনা। গল্পগুলো হয়তো গল্পই। কিন্তু আমাদের শিশুমনে সেগুলো ভয়ংকর রকমের সত্যি হয়ে ছিল। তাই ভুলেও ওপথ মাড়াতে সাহস হত না- তা সে কী দুপুর কী সন্ধ্যে বা কী রাত। ওদিক পানে তাকালেই গা ছমছম করত। পাশের পুকুরের দিকের একটু ঢালু অংশে শেওড়া আর ফণিমনসার দুটো গাছও ছিল। আর ছিল সরু সরু পাতার জন্রীগাছের জঙ্গল। সবমিলিয়ে সদরের ওই দক্ষিণ পূর্ব কোণের দিকটা মোটেই বাচ্চাদের পছন্দের জায়গা ছিল না। আজ বড়রা সেখানে জমায়েত হয়ে ক্ষুঁদিঘরে ঢোকার তোড়জোড় করছে। ব্যাপারটা আমাদের কৌতুহল ঘটানোর জন্য যথেষ্ট বড় উদ্দীপক। তাই সবাই কৌতুহলী হয়ে ওদিকটাতেই ভীড় বাড়াতে লাগলাম।
দেখি- দুজন মজুর আর কার্তিকদার হাত ধরে দাদামশাইয়ের (ঠাকুরদা) ব্যবস্থাপনায় মেড়টা সুড়সুড় করে নড়তে নড়তে ক্ষুঁদিঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। মেড়ের বাঁশে এখনো জামিরা আর রঙের চিহ্ন লেগে আছে। রাজ্যের মাকড়সার ফাঁদে পুরোটাই ঢেকে গেছে। নীচের পাটাতনের ওপর বাঁশের কাঠামোটা সামনে পিছনে দুলতে শুরু করেছে। বাঁশে পেনা সব গজে গিয়ে এক্কেবারে ধুন্ধুমার ক্যাঁচকঁচ শব্দে যেন প্রতিবাদ করছে। তড়িঘড়ি উঠোনে নামিয়ে ঝাড়পোঁছ শুরু হয়ে গেল। ঝাড়পোঁছ সেরে নতুন বাতা বা বাঁশের সন্ধানে কাতিকদা সেবাড়ি রওনা হল।
সেবাড়ি বলতে ওই ১০-১২ কাঠা পোড়োভিটে আর তার সংশ্লিষ্ট পতিত জমি- যেখানে বাঁশঝাড় ভর্তি। পাখপাখালি, শেয়াল, খটাশ আর সাপখোপে ভর্তি জঙ্গল। ভিটে ভর্তি আম, কুল, শিরীষ, খিরীষ, করঞ্জা, অর্জুন, তেঁতুল, সীতাহার ও আরও হরেক কিসিমের গাছ। এক ধরনের লতানে গাছও ছিল যা দড়ির মতো ব্যবহার করে আমগাছে দোলনা টাঙাতো একটু বড় দাদারা। আমরা সেই দোলনায় সুযোগ বুঝে ঝুলেও নিতাম। যাইহোক সেবাড়ি যাওয়া হবে আর আমরা পিছু নেব না এমন আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে পারে নাকি? নেহাত ইস্কুল খোলা থাকলে নিরুপায় হয়ে চানের তোড়জোড় করতে হত। অন্যথায় আমরা পিছু পিছু সেবাড়ি। বাঁশ বাছা, ছোলা, খাদিকরা থেকে বাতা ছেলা সব তাকিয়ে তারিয়ে দেখতাম। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক ঢুঁ মেরে পাখির বাসা, শেয়াল বা খটাশের গর্ত খুঁজে বেড়াতাম। অবশেষে বাঁশের পাতাগুলো সব গরুর জন্যে সংগ্রহ করে আবার বড়দের পিছু ধরে ফিরে আসতাম।
কাঁচাবাঁশের গন্ধ ম ম করত চারিদিক। তারপর মাপ অনুযায়ী কেটে মেড়টাকে আবার নতুন করে তুলে গজে যাওয়া গ্যাঁজগুলো কে উল্টো দিকে বাঁশের প্যানা মেরে আবার আঁটোসাঁটো করা হত। এই এক করতেই প্রায় পুরো একদিন। তারপর আমাদের ছোটদেরকে পুকুরপাড়ে গিয়ে কাদামাটি তুলতে হত বালতি বোঝাই করে। তিন চার বালতি কাদামাটি তুলে শুকনো সদরবাইরের মাটিতে গর্ত করে জমা করা হত। তারপর তাতে ধানের তুঁষ আর প্রায় তিন চার ইঞ্চি করে কাটা খড় মিশিয়ে আমাদের দুপায়ে করে থাসতে হত। শুকনো হয়ে গেলে জল ঢেলে আবার থাসতে হত যতক্ষণ না সেই মাটি প্রতিমা তৈরির উপযোগী হচ্ছে। দাদামশাই নিজে বসে দেখভাল করতেন আর ফিরিস্তি দিতেন কতটা কী কী মেশাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে চলত পুরানো স্মৃতির রোমন্থন।
এই পুজোর শুরু দাদামশাইএর দাদামশাইএর বাবার আমলে। সেই অর্থে আমাদের সাতপুরুষের পুজো। সবকিছুই রীতি মতন নিয়ম মেনে চালানো হয়। এক সময় ঠাকুরের প্রায় ৬৭বিঘা জমি ছিল। আধখানা গ্রামের তিনদিন উনুন জ্বলতো না। সবাই পাত পেড়ে খেত। সেই রান্নার বিশাল বিশাল লোহার কড়াই খুন্তি, পেতলের পেল্লাই গামলা -সব আছে। শুধু আড়ম্বর পাল্টে গেছে দিন বদলের ফলে। সরকার সব জমি নিয়ে ৮আনা মন ধানের দাম হিসেবে সেই ১৯৬৭ সাল থেকে এখনো ৭০০টাকা অনুদান দিয়ে আসছে। সেবাইত নিজেই তুলে নিয়েছে এ পুজো চালিয়ে যাবার যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে। পড়ে থাকা কয়েক বিঘে জমির জন্য চাষির কাছ থেকে পাওয়া যায় নামমাত্র কিছু টাকা। বংশানুক্রমে মিস্ত্রি, ঢাকি, মালাকার আর বামুনঠাকুররা তাঁদের সহানুভূতি দিয়ে এ পুজোকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অনেক ঝড়ঝাপ্টা সামলে এখনো এগিয়ে চলেছে এই পুজো। দাদামশাই নিজে সেবাইত ছিলেন। বিচক্ষণ হিসেবে যথেষ্ট সুপরিচিত ছিলেন বলে সবাই গ্রামে মুখ্যা বলেও মানত। তাঁর মুখ থেকে একের পর এক পুরানো ঘটনা আর কাহিনী শুনতে শুনতে আমরা একটুও ক্লান্ত হতাম না।
ধীরে ধীরে মাটি একদম তৈরি হয়ে গেলে গর্ত থেকে তুলে সদর দুয়ারে এক কোনে (ক্ষুঁদিঘরের পাশে) ঝোড়ায় করে গুছিয়ে রাখা হত। বেশ কয়েক লুটি সুদলি দড়িও কিনে আনা হত।
সরস্বতী পূজা কুমারচকপর্ব ৪
বাড়ির পুজোর পাশাপাশি ছিল স্কুলের ও ক্লাবের পুজো। তবে তারও বাইরে ছিল আমাদের ছোটদের নিজস্ব পুজো। আমাদের নিজেদের তৈরি প্রতিমা, বামুনও আমরাই। বাঁশ ও কঞ্চি দিয়ে ভিটের নীচে নিজেরাই বানাতাম আলাদা ঠাকুরঘর। তার তালপাতার ছাউনি। আর ভেতরটি মায়েদের শাড়ি দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। সামনেটা খোলা তবে ধানঝাড়া পাটা দিয়ে ঘেরা থাকতো পুজোর সময় ছাড়া- কুকুর বিড়ালের হাত থেকে বাঁচাতে। রাত্রে শোবার আয়োজনও থাকত সেখানে। প্রতিটি আয়োজনই কিন্তু আমাদের নিজেদের। বড়রা উৎসাহ তো দিতই না উল্টে বরং নিরুৎসাহিত করত বাড়ির পুজো ফেলে ওই সব করতাম বলে।
মিস্ত্রি দাদুর সাথে সখ্যতার প্রাথমিক কারন হল রঙ। আমাদের প্রতিমার উচ্চতা খুব জোর দেড় ফুট। তা পুরো মাটির এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের নিজেদের হাতে তৈরী। মিস্ত্রিদাদু রঙ দিলে ঝামেলা শেষ। কিন্তু কোন কোন বছর রঙের ছিটেফোঁটাও মিলত না মিস্ত্রিদাদুর কাছে। তখন মায়ের আলতার লাল রঙ, নীলবড়ির (কাপড়ে নীল দেবার নীলরঙের বড়ি) নীল আর হলুদবাটার হলুদ দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করতাম। তবে খড়িমাটির অভাবে সে সব রঙ সবসময় ফুটতো না। কালচে হয়ে লাল আর নীল আলাদা করাই যেত না। অগত্যা তখন মার কাছে বায়না করে ছাঁচের প্রতিমার পয়সা আদায় করতাম।
তবে আমাদের সময় ছোটরা খুব একটা বায়না করতাম না বিশেষতঃ যদি বাজার থেকে কিনতে হবে এমন জিনিসের প্রয়োজন হত। আমরা নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিতাম- মাঠ থেকে সংগ্রহ করা ধান, করঞ্জাবিচি বা কুড়ানো তেঁতুল বিক্রি করে। আর একটা জিনিস ছিল আমাদের আয়ের। আমাদের গ্রামের নিকটবর্তী শহর বলতে ঘাটাল বা কোলকাতা। তাদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র উপায় হল জলপথ। ভোর ৪:৪৫, ৫:৪৫ আর ৬:৪৫ এ লঞ্চ যেত এই দুই শহরের উদ্দেশ্যে আর ফিরতো বিকেল ৬:৩০ ৭:৩০ ৮:৩০টায়। প্রায় প্রতিটি বাড়ির কেউ না কেউ প্রতি সপ্তাহে না হলেও মাসে অন্তত একবার বাড়ি আসত। আর সোমবার ভোর ভোর লঞ্চে করে পাড়ি দিত কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। সেই লঞ্চঘাট ছিল আমাদের গ্রামের অপর প্রান্তে মানে উত্তর দিকে। প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা। ভোর ৪টেয় সেই রাস্তা শুনশান আর গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। যদিও গ্রীষ্মকালে কিছুটা পরিষ্কার হয়ে যায়। যা হয় যাবার পথে অনেক পোড়ো ভিটে ও ফাঁকা জায়গা পড়ে যার দুর্নাম বই সুনাম খুব একটা ছিল না। নানান কাহিনী, গল্প ও রটনা মুখে মুখে ফিরত। তাই কেউ একা একা অত ভোরে ও পথ মাড়াতো না। তখন ছোটদের ডাক পড়ত লঞ্চঘাট অব্দি সঙ্গী সবার। বিনিময়ে পাওয়া যেত বকশিশ। খুব একটা কম না। একটাকা দুটাকা আবার কখনো কখনো অতিথি বিশেষে দশটাকাও। কাজেই আমাদের পকেট ভারি থাকতোই। কারন খরচ করার মতো উপকরণ মজুতই থাকতো না হাতের কাছে। বড় জোর ফিরিওয়ালার ৫-১০পয়সার রঙীন বরফ, হাওয়া মিঠাই বা শোনপাপড়ি। আর কাছাকাছি মেলা বসলে সেখানে ওই চারআনা বা আটআনার মাটির রঙীন খেলনা। আর আমাদের পুজোর জন্য কেনাকাটা বলতে শসা, শাঁখালু ও কিছু ফল আর গুড়চিঁড়া। বাকি সবই জোগাড় তো বাড়ি থেকে। শুধু প্রতিমা নিয়েই চিন্তা হত বেশি। তাই শেষ মুহূর্তে মা তো আছেই।
একটু বড় হতেই ক্লাবের পুজোয় যোগদান। চাঁদার আবদার হত বড়দের কাছে। কেউ দিত কেউ দিত না আবার কেউ বাচ্চাগুলোর সাথে মজা করত। মাস খানেক আগেই ব্যানার ঝোলানো হয়ে যেত রাস্তার এ মাথা ওমাথা। পুরানো কাপড়ে আলতা দিয়ে লেখা হত-
নেতাজি তরুন সংঙ্ঘ, অমুক পাড়া, গ্রাম তমুক।
ব্যানারের দুই দিকে দুটো কঞ্চির লাঠি আটকে টানটান করে নারকেল দড়ি দিয়ে আটকানো হত রাস্তার দুই দিকের দুই গাছে প্রায় ১০-১৫ ফুট উঁচু করে। একটা দড়ি দুই প্রান্তে দুই দল ধরে সাইকেল আরোহী কে থামানোর চেষ্টা হত। কেউ দড়ি মাড়িয়ে চলে যেত, কেউ বা বলতো চাঁদার বই ছাপা তাহলে চাঁদা দেব। কেউ কেউ দু দশ পয়সা দিয়েও দিত। একবার দলে ছিল মাত্র দুজন। পাশের পাড়ার এক পরিচিত কাকু বাড়ি ফিরছে সাইকেলে। দুজনে কাকুকে আটকে থামিয়েছে।
“কী ব্যাপার?”
“কাকু আমরা সরস্বতী পুজো করছি। চাঁদা দিতে হবে তোমাকে। দিতেই হবে কিন্তু কাকু।”
“তোরা পুজো করবি? কোন ক্লাসে পড়িস?”
“পঞ্চম শ্রেণী কাকু। দাওনা কাকু চাঁদা। সত্যি বলছি পুজো করবো”।
“আচ্ছা। আমার কাছে তো পয়সা নেই এখন। আমি তো বার মাঠের জমি থেকে আসছি। তোরা আমার সাথে বাড়ি চল। বাড়ি গিয়ে দেব।”
ছেলেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর দুজনেই কাকুর পিছু ধরল।
“কাকু হেঁটে চল না! আমরা দৌড়াচ্ছি তো।”
“ঠিক আছে” বলে কাকু সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে চলতে লাগল। যেতে যেতে খুঁটিনাটি সব কথোপকথনে জানতে লাগল কাকু। কাকু খুবই খুশি। খুশি ওরাও। এক টাকার কমে চাঁদা নেবে না- ইশারায় ঠিক করে ফেলল ওরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই খেয়াল হল যে ওরা কাকুর বাড়ির পুষ্করিণীর পাড়ে পৌঁছে গেছে।
কাকু বলল “বাড়ির ভেতর চল”। ছেলেরা এবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করতেই কাকু বাজখাঁই গলায় হাঁক দিলেন
“এই কে কোথায় আছিস। ছোটজোড়াটা আন তো শিগগির। ছোঁড়া দুটোকে বাঁধি।”
সেই শুনে দুই ছেলে পড়ি কি মরি দৌড়। হাঁফাতে হাঁফাতে থামল এসে এক্কেবারে ভিটের কাছে।
ছোট: পাটের তৈরি পাকানো দড়ি বিশেষ। মুলতঃ ধানের বোঝা বাঁধার ও অন্যান্য কৃষিকাজের উপকরন। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই থাকে। এখনও পাওয়া যায় । খুব মজবুত। ভোরের লঞ্চ ছুটেছে শহরের দিকে আর ঘাটমাঝি হাত ধুয়ে উঠে আসছে নদী ছেড়ে ।
Add comment