রামগড়ের গুপ্তধন এবং:
@দেবাশীষ তেওয়ারী, ১৯৬৯ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
পর্ব (১)
ভূমিকা
ডাক নাম অভি, ভালো নাম ইন্দ্রনারায়ন মুখার্জী, বয়স সতেরো, কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে সবে সে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। থাকে কলকাতার হিন্দুস্থান পার্কে, বাবা একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মাঝারি মাপের অফিসার। আর এখন গ্রীষ্মের ছুটিতে অভি এসেছে ওর মামার বাড়িতে। ঝাড়খণ্ডের এক জেলা শহরে ওর মামার বাড়ি। অভি এই ছুটিতে একা আসেনি, সঙ্গে এসেছে ওর পাড়াতুতো দাদা কাম ফ্রেন্ড, ফিলজফার আর গাইড, নাম রন। একটু অদ্ভুত নাম? আসল নাম সুবিমল বসু, বছর ঊনিশ বয়স, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ছে। অভির কাছে ওর মামার বাড়ির গল্প শুনে রনেরও খুব আগ্রহ হয়, তাই সেও এই ছুটিতে অভির সঙ্গী হয়েছে।
তিন পুরুষ আগে, অভির দাদুর বাবা সতীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী এই অঞ্চলের ডাকসাইটে জমিদার ছিলেন। কিন্তু বহুকালের তাঁরা জমিদার, এবং বেশ বড় জমিদারি, কিন্তু না মুঘল, না ইংরেজ, কারুর কাছ থেকেই তাঁরা রাজা উপাধি পাননি। তা সরকার বাহাদুর না দিক, সাধারণ লোক তাঁদের রাজা বলেই মানে। অভির দাদুকে বলে বড় রাজা, আর মামাকে ডাকে ছোট রাজা বলে। এসব ভুমিকা থেকে, আসুন, অভির মামার বাড়িটা একটু ঘুরে দেখা যাক।
সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। জমিদারি প্রায় সত্তর বছর হলো চলে গেছে, তার সঙ্গে গেছে জমিদারির আয়, আর হাজার হাজার একর খাস জমি। অতএব রোজগার আজ এসে ঠেকেছে তলানিতে। কিন্তু কথায় বলে না ‘মরা হাতি লাখ টাকা’। নাই নাই করেও এখনও যা আছে তাতে ত্রিবেদীদের ধনী না হোক, উচ্চ মধ্যবিত্ত অনায়াসেই বলা যায়। হাজার হাজার একর না হোক শ দুয়েক বিঘে চাষ জমি এখনও বিভিন্ন নামে এবং দেবোত্তর করে রাখা আছে, আর আছে বহু বহু একর মন্দির, ঠাকুর দালান, বসত বাড়ি, পুকুর, বাগান ইত্যাদি ইত্যাদি যার ওপর এখনকার হালের জমিদারদের রয়েছে শ্যেণ দৃষ্টি। এখনকার জমিদার বুঝলেন না! রাজনৈতিক নেতা এম এল এ, এরা গো। এটা বুঝতে কষ্ট হয়না যে ত্রিবেদীদের ক্ষতি করার জন্যে অনেক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ আছে, এর সঙ্গে আছে জ্ঞাতি পড়শীদের ঈর্ষা।
এবারে অভির মামার বাড়ির বর্ণনায় আসা যাক। মামার বাড়ি যাকে বলে চক মিলানো দোতলা বাড়ি। চক অর্থাৎ চৌকো ৮০ ফুট বাই ৮০ ফুট উঠোন ঘিরে দোতলা বাড়ী। দোতলা তিন দিক, কেবল দক্ষিণ দিকটা একতলা। সেদিক থেকে শীতকালে রোদ আর গরমের দিনে দক্ষিণের হাওয়া ঢুকে সারা বাড়ীকে গরম আর ঠাণ্ডা রাখে। পরিবারের লোকেরা থাকে দোতলায়, চার থেকে আট ফুট চওড়া ঢাকা বারান্দা দিয়ে পশ্চিম, উত্তর, পুবের ঘরগুলিতে যাওয়া যায়। একতলায় ঝি চাকর, বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী আর আশ্রিতরা থাকে। আর আছে বহু ভাণ্ডার ঘর, বহু বিচিত্র তাদের নাম,যেমন কাঁচের ঘর, বাসনের ঘর, ঠাকুরের বাসনের ঘর, বড় ভাঁড়ার, ছোট ভাঁড়ার ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই চক মিলানো বাড়ী পুবমুখী, সদর দরজার মুখে গোটা চারেক গোল জোড়া জোড়া থামে ধরে রাখা একটা একতলা পোর্টিকো, তার সামনে অনেকটা ফাঁকা জমি, তারপরে বাড়িতে ঢোকার গেট, বাড়ীর বাঁ অর্থাৎ উত্তর দিকে একটা ছোটখাট ফুটবল মাঠের মত মাঠ, আর বাড়ীর পিছনে একটা ছোট পুকুর আর অন্তত ষাটটা বিভিন্ন প্রজাতির আম গাছ। এ সবই ঘেরা আছে একটা ফুট পাঁচেক উঁচু পাঁচিল দিয়ে। কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকা ছেলেদের পক্ষে এসব একটু চিন্তা করা কঠিন বটে।
কিন্তু এটা হল অভির মামার বসত বাড়ীটুকু মাত্র। এ ছাড়াও তাদের অনেক বাগান, পুকুর, চাষের জমি, দেব মন্দির আর ঠাকুর দালান বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সে সবের কথা পরে কিছু কিছু আসতে পারে গল্পের প্রয়োজনে, এখন বেশী জানার দরকার নেই। এবার দেখা যাক এই বিশাল বাড়িতে কারা থাকেন।
সতীন্দ্রনাথ অনেক দিন হল মারা গেছেন। তাঁর ছেলে যতীন্দ্রনাথ, অভির দাদু, এখনও বেঁচে আছেন, বছর পঁচাশি বয়স। যদিও এখনও শক্ত সমর্থ আছেন, তিনি নিজে আর এই বিশাল সম্পত্তি দেখাশুনা করেন না। সব ভার ছেলে সোমেন্দ্রনাথের ওপর চাপিয়ে তিনি বানপ্রস্থে, না বানপ্রস্থ নয়, নিশ্চিন্ত অবসর জীবন যাপন করছেন। তাঁর এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে সোমেন বড়, অভির মা সুমিতা ছোট। যতীন্দ্রনাথের স্ত্রী বসুমতী এবং অভির মামীমা প্রমীলাও আছেন। তাঁদের এক মেয়ে, অভির চেয়ে বছর খানেকের ছোট রুচিরা এবারেই মেডিক্যালে অ্যাডমিশান নিয়েছে। কদিন ক্লাস করার পরেই ছুটি হয়ে গেলো, তাই সে এখন বাড়িতেই আছে। একতলার বাসিন্দাদের মধ্যে আটজন ঝি চাকর, দুজন গোমস্তা আর কিছু আশ্রিত যার মধ্যে বছর কুড়ি বয়সের টলুর সঙ্গে অভির খুব ভাব।
তার বাবা রতনবাবু, ডাক নাম মনি, সোমেনের দূর সম্পর্কের দাদা হন। সোমেনবাবু তাঁকে মনিদা বলে ডাকেন।
অভিরা যখন তাঁর মামার বাড়ি পৌঁছুলো তখন সন্ধ্যে হয় হয়। প্রণাম, কুশল প্রশ্ন ও হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হওয়া পর্ব সাড়া হয়ে যাবার পর অভির মামীমা প্রমীলা তাদের জল খাবার খেতে দিলেন। চীনে মাটির প্লেট ভর্তি আম, বেশ খোলা ছাড়িয়ে কিউব করে করে কাটা, গোটা ছয়েক করে লিচু, আর একটা ছোট প্লেটে চারটে বড় বড় অভির পছন্দের মিষ্টি, দুটো কালোজাম আর দুটো করে ক্ষীরকদম, বেশ ভাল করে পোস্ত দিয়ে মাখা। একটু খেয়েই রন বুঝল যে এই আম সে জীবনে খায়নি। যেমন মিষ্টি, তেমন স্বাদ, তেমনি অসাধারণ সুন্দর গন্ধ। সে চুপিচুপি অভিকে জিজ্ঞেস করল এটা কি আম রে।
প্রমীলাদেবী খাবার দিয়ে টেবিলেই বসে তাদের খাওয়া তদারকি করছিলেন, তিনি শুনতে পেয়ে হেসেই হেসে বললেন, ‘এটা জর্দালু আম। ভাগলপুরে হয়। আমাদের বাগানেও কটা গাছ আছে। অভি, কাল রনকে বাগানটা ঘুরিয়ে দেখাস না, ওর ভাল লাগবে।’
এতক্ষণ রুচিরাকে কোথাও দেখা যায়নি। খাওয়া যখন প্রায় শেষ, সে কোথা থেকে ধূমকেতুর মত কলকল করতে করতে উদয় হল, ‘মা, খিদে পেয়েছে, খেতে দাও। উঃ, শমীর মা কিছুতেই ছাড়ছিল না। এখন আবার আম দিতে যেয়ো না যেন, খেয়ে খেয়ে মুখ পচে গেছে, ওমলেট আর চা দাও। আরে অভি যে, তুই কখন এলি?’
তারপরে রনর দিকে চোখ পড়তেই নতুন লোক দেখে তার কলকলানি থেমে গেল, মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
প্রমীলাদেবী হেসে বললেন, ‘ও রন, অভির বন্ধু, আবার ওর দাদাও বটে। এই গরমের ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। রন, এ আমার মেয়ে রুচি, এবারে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হয়েছে ব্যাঙ্গালোরে।’
অভি বলল, ‘ও নুচি, এতক্ষণ কোথায় ছিলিস রে, তোর পাড়া বেড়ানোর অভ্যেস আর গেল না। দেখছিস দাদা এসেছে এতদিন পরে। প্রণাম ট্রণাম করবি না নাকি?’
‘দাদা না ছাই। মা দেখো অভি আবার নুচি বলে ডাকছে। আমার বন্ধুরা হাসাহাসি করে।’
‘আচ্ছা তোকে এবার নুচি থেকে লুচিতে প্রমোশন দিয়ে দেব। খুশি তো?’ অভি বলল।
রুচি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘মা, অভিকে বারণ কর, ভাল হবে না বলছি।’
ও বলতে ভুলে গেছি রুচিরার ডাক নাম রুচি, সেটাকেই একটু পাল্টে অভি নুচি বলে রাগায়। দুজনার বয়সের তফাৎ মাত্র এক বছর। রুচিও অভিকে দাদা বলে না।
এইসব দেখে যদি কেউ ভাবেন দুজনের মধ্যে খুব ঝগড়া, তিনি ভুল ভাববেন। একজন অপরজনকে চোখে হারায়। অভি আসবে শোনা থেকে রুচির আনন্দ দেখে কে। আসলে এই লেগ পুলিং তাদের ভাই বোনের ভালবাসাকে আরও বাড়িয়ে দেয়, চাটনি যেমন খাবারকে সুস্বাদু করে তোলে।
প্রমীলাদেবী হাসতে হাসতে বললেন, ‘ঐ শুরু হল। এখন আর তোরা ঝগড়া করিস না তো। রন এসেছে কলকাতা থেকে, তুই আর অভি তোদের রনদাকে চারদিক ঘুরিয়ে দেখাবি কাল থেকে।’
******
বাগানে লুকিয়ে কে?
‘এই দেখ রনদা, এইগুলো হল জর্দালু, আর ঐগুলো হল বোম্বাই আম।’ অভি বলল।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পরই তারা রনকে বাগান দেখাতে আর আমগাছ চেনাতে নিয়ে এসেছে। দলে অভি, রুচি, রন ছাড়াও আছে কটা। কটা হলো এই বাগানের যোগানদার সিধুর ছেলে। এই বাগানের আম ইত্যাদি অভির মামারা নিজেরাই খায়, বিক্রি করে না। কত আর নিজেরা খাবে? তাই জ্ঞাতি পড়শীদের বিলোয়। কিন্তু পড়শীদের এই আম বিলোনোটা বিরাট ভুল কাজ। এইসব সুস্বাদু আম তারা খেয়ে তো নেয় উপরন্তু ত্রিবেদীদের ওপর হিংসায় জ্বলতে থাকে, কেন ওদের এত থাকবে, আমাদের থাকবে না, আমরা তো ওদেরই জ্ঞাতি।
এত আমগাছের যত্ন, চাষ, সেচ, চুরি এবং হনুমানের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য লোক রাখতে হয়। এদেরকে বলে যোগানদার, এরা ফলের একটা ভাগ নিয়ে বাগানের যোগান দেয়। এই অঞ্চলে এঁরা বেশীরভাগই সাঁওতাল, যেমন সিধু নিজেও। এই সিধুর ছেলে কটা। অভির বয়সী, এবারে হায়ার সেকেন্ডারী দেবে। অভিদের মতই সেও জিনস আর টিশার্ট পড়েছে, কিন্তু হাতে তীর ধনুক। এই বাগানে মাঝেমাঝে বন মুরগী বা তিতির দেখা যায়। ভাগ্য যদি ভাল থাকে, সে রকম কিছু বেরোয়, তবে একটা ফিস্ট হয়ে যাবে আজ।
দশ বারো বিঘা জমিতে বাগান, একটা ছোট পুকুর আর কিছু চাষ জমি। এক এক সারিতে ছটা করে আম গাছ তিরিশ ফুট দূরে দূরে লাগান, এইরকম দশটা সারি। বোঝায় যায় বেশ পরিকল্পনা করেই লাগান হয়েছে। অভি বলে চলেছে, এক এক সারিতে এক এক রকম গাছ। প্রথমটা জর্দালু, তারপর বোম্বাই, হিমসাগর, ক্ষীরসাপাতি, ল্যাংড়া কাশীর আর ভাগলপুরের, সুরমা ফজলি, দশেরী। বাকী দুটো সারিতে একটা বা দুটো করে বিভিন্ন প্রজাতি, বিশেষ করে বহরমপুরের আম। মুর্শিদাবাদের শিয়া নবাবরা নাকি আম খুব ভালবাসত, ওনারা আম নিয়ে নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতেন, যেমন কোহিতুর, রানীপসন্দ, কালাপাহাড়, চাঁপা, ভবানী, মোলামজাম, চন্দনকোষা প্রভৃতি। আর আছে অ্যালফান্সো, গোলাপখাস, আর রুচির খুব প্রিয় কাঁচমিঠে আম।
রন জিজ্ঞেস করল ক্ষীরসাপাতি গাছ কোনটা। এই নাম সে নতুন শুনছে। অভি একটা সারি দেখিয়ে বলল এই সারির সবগুলো গাছই ক্ষীরসাপাতি।
রুচি হঠাৎ বলে উঠল, ‘আচ্ছা রনদা জান ওই আমটাকে ক্ষীরসাপাতি কেন বলে?’
রন বলল, ‘না গো, নামটাইতো প্রথম শুনছি। তুমিই বল শুনি।’
‘এটাই একমাত্র আম যার রস দুধে দিয়ে ফুটিয়ে ক্ষীর করা যায়। আর কোন আম দুধে দিয়ে ফোটালেই দুধ ফেটে যায়। সেই জন্যেই এই আমের নাম ক্ষীরসাপাতি।’
রন চমৎকৃত। আমের এসব সূক্ষ্ম ব্যাপার স্যাপার সে জানত না।
রুচি হঠাৎ বলে উঠল, ‘আচ্ছা রনদা আমাদের অনেক বড় একটা আমবাগান আছে, যাবে নাকি সেখানে?’
অভি আপত্তি করে উঠল, ‘না না, অতদূরে এখন যেতে হবেনা। দেরী হয়ে যাবে, অন্যদিন যাব।’ অভি জানে ত্রিবেদীদের শত্রুর অভাব নেই। রুচিটা এখনও বাচ্চাই রয়ে গেল। দুপুর হতে চলেছে, এখন তার এরকম ভাবে বাগানে বাগানে ঘোরা মোটেই নিরাপদ নয়।
রুচির অবশ্য হুঁশ নেই, সে অভিকে বলল, ‘কত আর দূর। বাগানের মধ্যে দিয়ে যাব। এরপরে চৌধুরীদের বাগান, তারপরে চৌবেদের, তারপরেই আমাদের হাজারী বাগান। বড়জোর কুড়ি মিনিট, হাজারী নাম কেন হয়েছে জান রনদা! হাজারটা আমগাছ আছে বলে।’
রনের বাগানে বাগানে ঘুরতে মজাই লাগছিল, শত্রুতার ব্যাপারটা তো সে জানে না, তাই অভিকে বলল, ‘চল্ না, তোর বোন যখন বলছে, তখন যাওয়াই যাক। চলো রুচিরা, কোন দিক দিয়ে যেতে হবে চলো।’
রনদা বলছে, তাই অভিও আর আপত্তি করল না, ইচ্ছার বিরুদ্ধে পিছু নিল। রুচিরা চলেছে আগে আগে, সঙ্গে কটা, পিছনে অভি আর রন। বাগানের ভিতরটা ছায়া ছায়া, এই গরমেও বেশ আরামদায়ক। এক বাগান থেকে অন্য বাগানে যাওয়া যায়, কেউ কিছু বলে না, গাছে হাত না দিলেই হল। সব বাগানেই যোগানদার আছে। এ বাগান ও বাগান করে অবশেষে ওরা এসে পৌঁছুল রুচিদের হাজারী বাগানে। এই বাগানের আম বিক্রি করা হয়। প্রতি বছর লীজ দেওয়া হয়। স্রেফ চার রকম আমগাছ লাগানো আছে, বোম্বাই, হিমসাগর, ল্যাংড়া আর ফজলী। প্রথমেই বোম্বাই ওঠে, তারপর হিমসাগর, ল্যাংড়া আর সবশেষে ফজলী, আলাদা আলাদা সময়, ওভারল্যাপিং খুব কম। এইবারেও লীজ দেওয়া হয়েছে। মালদহের সৌকতচাচা প্রতি বছর লীজ নেয়, এবারেও নিয়েছে। সৌকতচাচা তখন ছিল না। তার যোগানদাররা রুচিকে দেখে অবাক হয়ে গেল।, কিভাবে খাতির করবে ভেবে পায় না। রুচি বলল, ‘কিছু না, আমরা বাগানটা একটু রনদাকে ঘুরিয়ে দেখাব। তোমাদের ব্যস্ত হতে হবে না, নিজেদের কাজ কর।’
পঁয়ষট্টি বিঘার ওপর বিশাল বাগান। সত্তর আশি বা তার চেয়েও বেশী বয়সী সব গাছ, ঘন পাতার ক্যানোপী ভেদ করে সূর্যের আলো বিশেষ ঢুকতে পারে না, ভিতরটায় তাই আলো আঁধার খেলা করে।
সৌকতচাচা বাগানের যত্ন করে বোঝা যায়, আমের ভারে গাছগুলো নুয়ে আছে। রুচি সমানে বকবক করে যাচ্ছে, প্রথম পরিচয়ের জড়তা আর নেই, সে রনকে বোঝাচ্ছিল বোম্বাই আর হিমসাগর আমে তফাৎ কি, ফজলী আর সুরমা ফজলী কিন্তু এক নয়, আলাদা আলাদা ভ্যারাইটি, কাশীর ল্যাংড়া আর ভাগলপুরের ল্যাংড়া নামে ল্যাংড়া হলেও অনেক তফাৎ স্বাদে, সে বড় হয়ে এটাকে গ্রীন অর্চার্ড বানিয়ে এর আম এক্সপোর্ট করবে, প্রচুর দাম পাবে ইত্যাদি।
ঠিক এমনই সময় কটা মুখে আঙুল দিয়ে ঈশারা করল চুপ করতে। তাদের থেকে শ’খানেক ফুট দূরে একটা কালচে বাদামী রঙের নাদুসনুদুস তিতির, এদিক ওদিক ভয়ে ভয়ে দেখছে, আর তারপর কোন বিপদ নেই বুঝলে এগিয়ে এসে মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে কিছু খাচ্ছে। এতদূর থেকে তীর চালালে মিস হয়ে যেতে পারে, তাই কটা চাইছে ওটা আর একটু এগিয়ে আসুক।
সবাই দম বন্ধ করে গাছের ছায়ায় অপেক্ষা করতে লাগল। তিতিরটা একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে, আশি ফুট,তারপরে সত্তর ফুট, পঁয়ষট্টি ফুট – – -। কটা তীর চালাবে বলে প্রস্তুত, হঠাৎ কি হল, তিতিরটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন দিকে কিছু দেখেই আর তারপরেই পড়িমড়ি করে ছুট লাগাল। আর প্রায় একই সঙ্গে ধনুক থেকে কটার বাণ বেরিয়ে গেল। তিতিরটা একটু এগিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সবাই আনন্দে চিৎকার করে ছুটে গেল পড়ে থাকা তিতিরটার কাছে। কটা তিতিরটাকে উল্টে দিল। কটার তীর তিতিরটার ডানা ভেদ করে গেছে, কিন্তু সেটাই তিতিরটার মরার কারণ নয়। পাখিটার বুক ভেদ করে আটকে আছে আর একটা তীর। এই তীরটা কটার নয়। এই তীর তাহলে কে মারল? অনেক খুঁজেও কিন্তু ধারেকাছে কোন লোকের দেখা মিলল না।
(ক্রমশ)
Add comment